মার্বেল মেলা ॥ ভেদাভেদ নেই নারী-পুরুষে, মত্ত সবাই মজার খেলায়- দু’শ’ বছরের ঐতিহ্য by খোকন আহম্মেদ হীরা
নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে শিশু-কিশোর ও বয়োবৃদ্ধরা সবাই মেতে উঠেছে মার্বেল খেলা প্রতিযোগিতায়। আর তাই তো মাঠঘাট, রাস্তার ওপর, বাড়ির আঙ্গিনায়, অনাবাদি জমি, বাগানসহ প্রায় ছয় কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসেছে মার্বেল মেলা।
সর্বত্রই মার্বেল খেলার আমেজ বইছে। আবহমান গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে দু’শ’ বছরের পুরনো দু’দিনব্যাপী এ মার্বেল মেলার আজ মঙ্গলবার শেষদিন। এ উপলক্ষে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের প্রত্যন্ত রামানন্দেরআঁক গ্রামে বসেছে এক মিলনমেলা। প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তিতে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সোমবার ছিল মেলার প্রথমদিন মেলায় বরিশাল জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ, পার্শ্ববর্তী গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া, কালকিনি, ফরিদপুর, রাজবাড়ীসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে সব বয়সের হাজার-হাজার নারী-পুরুষের ঢল নামে। খেলায় নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রামানন্দেরআঁক গ্রামে আড়াই শ’ বছর আগে জনৈক সোনাই চাঁদ নামের এক নারীর বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই তাঁর স্বামী মারা যান। নিঃসন্তান বিধবা সোনাই চাঁদ ওই বাড়ির একটি নিমগাছের নিচে স্বামীর নামে পূজা-অর্চনা ও ধ্যান করতেন। তাঁর (সোনাই চাঁদের) মৃত্যুর পর ওই বাড়িটি সোনাই আউলিয়ার বাড়ি হিসেবে এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছর এই দিনে ওই বাড়িতে বৈষ্ণব সেবা, সংকীর্তন, কবিগানের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানকে ব্যাপক প্রসার ঘটাতে প্রতিবছরের পৌষ সংক্রান্তিতে সোনাই চাঁদ আউলিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী ও বাস্তপূজা উপলক্ষে প্রায় দু’শ’ বছরের অধিক সময় ধরে ওই গ্রামে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মার্বেল খেলা মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি হরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস (৮৫), হরবিলাস মিস্ত্রি (৮০) ও বুদ্ধি হালদার (৭৫) বলেন, দু’শ’ বছরের অধিক সময় ধরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বাপ-দাদারা এ মার্বেল খেলার মেলার আয়োজন করে আসছিল, তাঁদের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য প্রতিবছর সোনাই চাঁদ আউলিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী ও বাস্তপূজা উপলক্ষ্যে এ মার্বেল মেলার আয়োজন করা হয়। এদিনটিকে ঘিরে রামানন্দেরআঁক গ্রামে মহোৎসবের আমেজ বিরাজ করে। স্থানীয়রা তাদের মেয়ে-জামাতাকে পর্যন্ত এ মেলায় মার্বেল খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। মেলা উপলক্ষে চিড়া, মুড়ি, খেজুর রসের গুড়ের পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে ওই এলাকায়। এ বছরও মেলার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে মেয়েদের মার্বেল খেলার প্রতিযোগিতা।
বরিশালের বাকেরগঞ্জ থেকে মেলায় এসেছেন প্রদীপ দাস (৩৫)। তিনি জানান, মার্বেল খেলার কথা শুনে মেলায় এসেছি। সব বয়সের নারী-পুরুষ একসঙ্গে মার্বেল খেলছে দেখে আনন্দ উপভোগ করছি। রাজবাড়ী জেলার বালিয়কান্দীর বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথ রায় (৮২)। তাঁর মেয়ের জামাই মিহির বিশ্বাসের বাড়ি আগৈলঝাড়া উপজেলার রামানন্দেরআঁক গ্রামে। মেলার একদিন আগেই (গত ১৩ জানুয়ারি) মেলা উপভোগ করার জন্য তিনি মেয়ে-জামাতার বাড়িতে এসেছেন। তিনি বলেন, গ্রামবাংলার ব্যতিক্রমধর্মী এ মেলাটি উপভোগ করতে ভাল লাগছে। মার্বেল খেলায় অংশগ্রহণ করা তরুণী কল্পনা বিশ্বাস, মিতু রায়, সাথী মজুমদারসহ অনেকেই বলেন, ছেলেরা শুধু মার্বেল খেলে, সামাজিক কারণে মেয়েদের ইচ্ছা থাকলেও তারা খেলতে পারে না। এই দিনটি উপলক্ষে মেয়েদের মনের ইচ্ছাটি পূরণ করা সম্ভব। তাই এ গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামের মেয়েরা এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থেকে মেলায় আগত সমীর বিশ্বাস (৩০), পলাশ রায় (২৫), জুয়েল সমাদ্দার (২৩), মিলন বিশ্বাস (২৪), টিটু সমাদ্দার (১৯) ও মনতোষ সমাদ্দার (২০) বলেন, আমরা মার্বেল খেলার মেলার কথা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। তাই এ বছর এ মেলায় আসার জন্য গত ছয় মাস পূর্বেই আমরা বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি মেলায় আসার। এবছরই প্রথম এ মেলায় এসেছি। ব্যতিক্রমধর্মী এই মেলা দেখতে আমাদের অনেক ভাল লেগেছে। এছাড়াও বাস্তপূজার প্রসাদ খেতে পেরেও আমরা খুবই আনন্দিত।
No comments