ওকাম্পোর আট প্রশ্নের জবাব দিয়েছে দুদক
আট প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বিশ্বব্যাংক প্যানেলের চিঠির জবাব পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সোমবার বেলা সাড়ে পাঁচটায় বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান লুই মোরেনো ওকাম্পোকে লেখা চিঠি বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের স্বাক্ষরে প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা অফিসে (আগারগাঁওয়ে) পাঠানো হয়।
গোলাম রহমান বাংলানিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। জানা গেছে, দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের দুই পৃষ্ঠার একটি ফরওয়ার্ডিং লেটার, ৮ প্রশ্নের জবাবসহ মোট ১২ পৃষ্ঠার চিঠি পাঠানো হয়। এতে তদন্তের ৩৫ পৃষ্ঠার কাগজও সংযুক্ত রয়েছে।পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সম্পৃক্ততা থাকলেও এজাহারে তাকে আসামি না করার যুক্তি দেখিয়ে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলকে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। একইসঙ্গে আবুলকে চার্জশীটভুক্ত আসামি করতে দুদক কানাডার রয়েল মাউন্টেড পুলিশের কাছে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের অপেক্ষায় রয়েছে এমন কথা চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে। দুদকের আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক চিঠি পাঠানোর আগে বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্যানেল অব এক্সপার্ট যেসব বিষয় জানতে চেয়ে দুদককে চিঠি দিয়েছে তার সব জবাব তৈরি করা হয়েছে। আশা করছি ওকাম্পোর দল তাদের সব প্রশ্নের ব্যাখ্যা পাবে।’
ওকাম্পোকে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে উল্লেখ করে ইতোপূর্বে বিশ্বব্যাংক দুদকের কাছে কিছু তথ্য দিয়েছিল। তথ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংক আবার দুদককে বলেছে এসব তথ্য বাংলাদেশের আদালতে ব্যবহার করা যাবে না। এসব তথ্য ব্যবহার করা গেলে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে এজাহারেই আসামি করা যেত কিন্তু বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকায় মামলা করার মতো তথ্য দুদকের কাছে থাকা সত্ত্বেও নিষেধাজ্ঞার কারণে তা ব্যবহার করতে পারেনি। ‘বিশ্বব্যাংকের রেফারেন্স বা তথ্য বাংলাদেশের আদালতে ব্যবহার করা যাবে না’ এ শর্ত এখন প্রত্যাহার করা হলেই আবুলকে আসামি করতে কোন বাধা নেই এমন কথা লেখা হয় চিঠিতে।
পাশাপাশি চিঠিতে দুদক আরও উল্লেখ করে, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বর্তমানে চার্জশীট না দেয়ার কারণ হচ্ছে তদন্ত কমিটি এখনও কানাডার রয়েল মাউন্টেড পুলিশের কাছ থেকে রমেশের ডায়েরির কোন অনুলিপি পায়নি। বিশ্বব্যাংকের শর্ত প্রত্যাহার এবং কানাডার পুলিশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যউপাত্ত পাওয়া মাত্রই আবুলকে আসামি করতে বাধা থাকবে না এমন ইঙ্গিত রয়েছে চিঠিতে।
চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ অনুযায়ী আবুল হোসেনকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে এটাও পুরোপুরি সত্য নয়।’
এর ব্যাখ্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দুদক বিধিমালা-২০০৭ অনুযায়ী কোন দুর্নীতির ঘটনায় এজাহার দাখিলের পর এজাহারনামীয় আসামি ব্যতীত অন্য যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় তাদের নাম ‘গ’ কলামে আসামি হিসেবে উল্লেখ করতে হয় এবং সাক্ষ্য স্মারকে (তদন্ত প্রতিবেদন) তাদের অপরাধ সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উল্লেখ করে আদালতে চার্জশীট দেয়া যায়। তদন্ত টিম এখন তাই করছে।’
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি-সংক্রান্ত মামলা দায়েরের পর মূলত আটটি বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি পাঠায় বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল। চিঠিতে দুদক যেসব প্রশ্নের উত্তর দেয় তার সংক্ষিপ্ত রূপ ও সারাংশ তুলে ধরা হলোÑ
১. ২০১১ সালের ২৯ মে এসএনসি-লাভালিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সরকারী উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বৈঠক, দরপত্র মূল্যায়নে এসএনসি-লাভালিন প্রথম হওয়া এবং এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তারা রমেশের ডায়েরিতে মন্ত্রীর নামের পাশের চার পার্সেন্ট লিখে রাখার যোগসূত্রের খুঁজে বের করার অগ্রগতি কী?
২. সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে এসএনসি-লাভালিন প্রতিনিধিদের বৈঠকে কারা উপস্থিত ছিলেন ও তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল, সে ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে কি না?
এ দুই প্রশ্নের উত্তরে দুদক জানাচ্ছে- মন্ত্রীর নামের পাশে ৪ পার্সেন্ট ও সচিবের নামের পাশে ১ পার্সেন্ট কমিশনের বিষয়ে যে অভিযোগ রয়েছে তার সপক্ষে আলামত সংগ্রহের কাজ চলছে। এরই অংশ হিসেবে সেতু ভবনে মন্ত্রীর সঙ্গে লাভালিন কর্মকর্তাদের দেখা, সাক্ষাত ও বৈঠকের বিষয়ে একটি এন্ট্রি রেজিস্ট্রার জব্দ করা হয়েছে। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই বছরে কতজন দর্শনার্থী সেতু ভবনে গমন করেছেন তাঁদের তালিকা পাওয়া গেছে। তাতে দেখা যায়, লাভালিন কর্মকর্তারা দুবার মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে ওই ভবনে গিয়েছিলেন এবং বৈঠক করেছেন। তদন্তের সময় এই বিষয়টির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।
৩. তদন্ত পর্যায়ে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসানের বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে? দুদক জানায়, সাবেক দুই মন্ত্রীর বিষয়ে বিশদ তদন্ত চলছে।
৪. সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডকে দিতে চেয়েছিল বলে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে যে আলোচনা উঠেছিল, সে বিষয়ে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত তদন্ত পর্যায়ে ব্যবহার করা হবে কি না?
এর উত্তর হ্যাঁ সূচক দেয় দুদক।
৫. সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ও দরপত্র মূল্যায়ন বিষয়ে এসএনসি-লাভালিনের কাছে পাঠানো ই-মেইলের মধ্যে এ্যাকাউন্ট থেকে যেসব ই-মেইল মুছে ফেলা হয়েছে, তা উদ্ধার কার্যক্রম কী অবস্থায় আছে?
দুদক জানায়, গ্রেফতারের পর দুই আসামির কম্পিউটার জব্দ করা হয়েছে। যেসব তথ্য কম্পিউটার ও ই-মেইল থেকে মুছে ফেলা হয়েছে তা উদ্ধারের চেষ্টা করছে দুদক।
৬. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও কাজী মোহাম্মদ ফেরদাউসকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তারা যে তথ্য দিয়েছেন তা প্যানেলের কাছে পাঠানো হবে কি না?
এ প্রশ্নের উত্তর চিঠির সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে বলে দুদক চিঠিতে উল্লেখ করে।
৭. কানাডা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রমাণ বা অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ কোন অবস্থায় আছে?
দুদক জানায়, তথ্য চেয়ে কানাডায় এমএলএআর (মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল এসিসট্যান্ট রিকোয়েস্ট)
পাঠানো হয়েছে কিন্তু কানাডা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য এখনও পাঠানো হয়নি।
৮. এজাহার দাখিলের পর তদন্তের সার্বিক অগ্রগতি কী?
প্যানেলের এ প্রশ্নের উত্তরে দুদক তদন্তের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে। এতে দুই আসামিকে গ্রেফতারের পর প্রাপ্ত তথ্য তুলে ধরা হয়।এ দুর্নীতিতে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ভূমিকা প্রয়োজনে আবারও তদন্ত করে দেখা হবে।
দুদক তদন্ত টিমের তৈরি করা চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের ২৯ মে এসএনসি প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে আবুল হোসেনের বৈঠকে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সেতুর বিষয়ে করা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ হয়েছে কি না তা দেখা হবে। সেই সঙ্গে সরকারী ক্রয় নীতিমালা ২০০৬ নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করা হবে। বিশ্বব্যাংক প্যানেল রেফারেন্স হিসেবে তা পরীক্ষার কথা বলেছিল দুদককে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী সেতুর পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আবুল হোসেনের বৈঠক করা ঠিক ছিল কি না বা এতে কোন পক্ষের হয়ে সুবিধা দেয়ার ইঙ্গিত ছিল কি না তাও ভালভাবে পরীক্ষা করা হবে। এ বিষয়ে আরও গভীরভাবে জানার জন্য তদন্ত পর্যায়ে আবুল হোসেনকে আবার জিজ্ঞাসাবাদেরও ইঙ্গিত দেয়া হয় চিঠিতে।
জানা গেছে, দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী দুদকের তদন্ত টিম বিশ্বব্যাংকের আট প্রশ্নের উত্তর তৈরি করেছে।
No comments