বানানরীতি উপেক্ষিত সর্বত্র, পরিভাষা সঙ্কট কাটেনি
মহান ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে আবেগ উচ্ছ্বাসের ব্যাপক বহির্প্রকাশ ঘটলেও মানা হচ্ছে না বাংলা বানান নীতিমালা। অনুসরণ করা হচ্ছে না বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বিধিবিধান।
স্কুলের পাঠ্যবই থেকে শুরম্ন করে নাটক, উপন্যাস, কবিতা, শ্রেণীকৰ, সরকারী প্রজ্ঞাপন, বিজ্ঞপ্তি, সংসদসহ কোথাও কোন নিয়মনীতির বালাই নেই। সর্বত্রই ব্যবহার হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ, নিম্নমানের অশুদ্ধ ভাষা। আবার ইংরেজীসহ বিদেশী শব্দের ৰেত্রে নির্ধারিত বানানরীতিও উপেতি হচ্ছে সর্বত্র। অন্যদিকে বাংলা একাডেমীর বাংলা পরিভাষা সেলের কার্যক্রম আশার সঞ্চার করতে পারছে না। বানানরীতির উপেৰাসহ সর্বত্র ভুলেভরা নিম্নমানের বাংলা ব্যবহারের এই পরিস্থিতিকে বাংলার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ বলে অভিহিত করেছেন দেশের প্রবীণ ভাষাসৈনিক ও ভাষা বিজ্ঞানীরা। তাঁদের অভিমত, বাংলা বানান নিয়ে চলছে বিশৃঙ্খলা। একেক মাধ্যমে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলা ভাষার বিভিন্ন রূপ। ফলে দেশের অধিকাংশ শিার্থী রীতিমতো 'খিচুড়ি' ভাষা শিখে বড় হচ্ছে।ভাষা আন্দোলনের ৫৫ বছর পরও বাংলা বানান নীতিমালা মানা হচ্ছে না। অনুসরণ করা হচ্ছে না বাংলা একাডেমীর বেঁধে দেয়া প্রমিত বাংলা বিধিবিধান। সর্বত্রই ব্যবহার হচ্ছে অশুদ্ধ ও নিম্নমানের ভাষা। জানা গেল, বানানের েেত্র নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর জন্য বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যনত্ম বাংলা বানান প্রমিতকরণের কাজ শেষে তা চূড়ানত্ম করা হয়। বানানের নিয়ম প্রণয়নের জন্য ১৯৯১ সালে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে সভাপতি করে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। পাঁচ সদস্যের কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন বশীর আল্হেলাল। সদস্যরা ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরম্নজ্জামান, জামিল চৌধুরী ও নরেন বিশ্বাস। এ কমিটি প্রমিত বানানের নিয়ম চূড়ানত্ম করে এবং কমিটির অন্যতম সদস্য জামিল চৌধুরী বাংলা একাডেমী প্রকশিত 'বাংলা বানান অভিধান' সঙ্কলন ও সম্পাদনা করেন। এছাড়া জাতীয় শিৰাক্রম ও পাঠ্যপুসত্মক বোর্ডও (এনসিটিবি) প্রাথমিক সত্মরের বইয়ের বাংলা বানান প্রমিতকরণের কাজ করে। ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমী প্রমিত বানানরীতি চূড়ানত্ম করার পর ওই বছরের একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে সামনে রেখে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শুদ্ধ বানান লেখার আবেদন জানিয়ে একটি পোস্টার ছাপানো হয়েছিল। তবে সংশিস্নষ্টদের আৰেপ, শুদ্ধ বানান ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করার জন্য ওই পোস্টারটি প্রথম এবং এখন পর্যনত্ম একমাত্র প্রয়াস। আজ পাঠ্যবই থেকে শুরম্ন করে ব্যবহারিক বাংলায় বিরাজ করেছে চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য। শিশুদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে ভুল বানান. ভুল শব্দ আর বিকৃত তথ্য। কেবল তাই নয়, জনগণের কাছে বাংলা একাডেমী প্রণীত প্রমিত বানানরীতি অনুসরণের আবেদন জানানো হলেও বাংলা একাডেমী তার নিজের নামের বানানের েেত্র এখনও তা অনুসরণ করেনি। প্রমিত বানানরীতিতে বিদেশী শব্দের প্রতিবর্ণীকরণের যে নিয়ম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তা মেনে চললে 'একাডেমী' বানানে ঈ- (দীর্ঘ-ই)-কার পরিবর্তন করে ই (হ্র-স্ব-ই)-কার ব্যবহার করতে হবে, অর্থাৎ 'একাডেমী' না লিখে 'একাডেমি' লিখতে হবে। বাংলা একাডেমীই আজ পর্যনত্ম এটি বাসত্মবায়ন করতে পারেনি। বাংলা একাডেমীর মতো সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শিল্পকলা একাডেমী এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শিশু একাডেমীর নামের বানানেও প্রমিত বানানরীতি উপো করা হচ্ছে। তবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় জাদুঘর অবশ্য প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করে 'যাদুঘর' বানান পরিবর্তন করে 'জাদুঘর' করা হয়েছে মোঃ শামসুজ্জামান খান (বর্তমানে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক) মহাপরিচালক থাকাকালীন। ইংরেজীসহ বিদেশী ভাষা ব্যবহারে সুনিদির্ষ্ট বিধি থাকলেও তা মানা হচ্ছে অধিকাংশ ৰেত্রেই। প্রায় সকল ডিগ্রীপর্যায়ের কলেজের নামে 'লেখা হচ্ছে 'ডিগ্রী'। এজেন্সি বানানে ঈ-কার ব্যবহারের কথা বলা হলেও রাজধানীর সব দোকানের নাম ফলকে ী-কার ব্যবহার করা হয়েছে। আর ষ্টিল লেখা হয়েছে 'ষ্টীল' মডার্ন শব্দটি রাজধানীর প্রায় সব সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছে 'ণ'। রেষ্টুরেন্ট এখনও লেখা হচ্ছে 'ষ্ট' দিয়ে। ইনসুরেন্স বানানটি এভাবে শুদ্ধ হলেও ফকিরাপুলের কন্টিনেন্টাল কোম্পানির সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছে 'ইনসু্যরেন্স'। আর কোম্পানি বানানেতো ী-কারের ছড়াছড়ি।
এতো গেল বানান, আছে সর্বত্র অশুদ্ধ আর নিম্নমানের বাংলা ভাষা প্রয়োগের আরও অনেক সঙ্কট। নাটক, উপন্যাস, কবিতায় ব্যবহার করা হচ্ছে ভুলেভরা অত্যনত্ম নিম্নমানের বাংলা। স্কুল কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকৰেও শিৰকরা অত্যনত্ম ভুলেভরা বাংলায় পাঠদান করছেন বলে অভিযোগ ভাষা বিজ্ঞানীদের। এছাড়া সরকারী প্রজ্ঞাপন, বিজ্ঞপ্তি, সংসদসহ সকল ৰেত্রেই ভুল বানান, সাধু-চলিত ভাষার মিশ্রণে নিম্নমানের ভাষা প্রয়োগ হচ্ছে বলে অভিযোগ সংশিস্নষ্ট সকলেরই। অন্যদিকে একেক মাধ্যমে একেক বাংলা ভাষা শুনে বিভ্রানত্ম শিৰার্থীরা। দেশের গ্রামাঞ্চলে শিকরা অনেক ৰেত্রেই আঞ্চলিক ভাষায় পাঠদান করেন। পাঠ্যবইয়ের শিার্থী পড়ে মানসম্পন্ন একটি ভাষা। আবার ঘরে ব্যবহার করে আঞ্চলিক ভাষা। গণমাধ্যমে শোনে বাংলা, ইংরেজী, আঞ্চলিকসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুষ্ঠান। এদিকে, বাংলা একাডেমীর বাংলা পরিভাষা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, একাডেমীর বাংলা পরিভাষা সেলের কার্যক্রম তেমন আশার সঞ্চার করতে পারছে না। যদিও আগে অর্থনীতি, প্রশাসনিক, দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক পরিভাষার বই বের করার বদলে এখন অভিন্ন একটি পরিভাষার বই বের করা হবে বলে জানা গেছে। একাডেমীর অনুসন্ধান কেন্দ্রে দায়িত্বরতদের সঙ্গে বুধবার কথা বলে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন আগেই পরিভাষার একটি বড় বই বের করার কাজ শুরম্ন হয়েছে। শীঘ্রই এটি বের হবে বলে আশাবাদী একাডেমীর কর্মকর্তারা। বাংলা বানানরীতি না মানা এবং সর্বত্র ভুলেভরা নিম্নমানের বাংলা ব্যবহারে ুব্ধ এবং হতাশ দেশের প্রবীণ ভাষাসৈনিক ও ভাষা বিজ্ঞানীরা। বিষয়ে প্রশ্ন তুলতেই অত্যনত্ম আৰেপের সুরে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, বানান নিয়ে আমাদের দেশে একটা বিশৃঙ্খলা চলছে। কিন্তু আইন করে তো আর সঠিক শব্দ মানুষের ওপর চাপানো যাবে না। মানুষ নিজেরা না চাইলে এ ব্যাপারে সফলও হওয়া যায় না। কেউ যদি ভুলভাবে চিঠি লিখতেই ভালবাসে আমি বা অন্য কেউ তো তাতে বাধা দিতে পারি না। এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, প্রমিত বানানরীতি নিয়ে দেশে এ পর্যনত্ম দুটি কমিটি কাজ করেছে। যার একটি করে বাংলা একডেমী।
বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন পরিস্থিতিকে বাংলার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলছিলেন, সর্বত্র অশুদ্ধ আর নিম্নমানের বাংলা ভাষা প্রয়োগ হচ্ছে। স্কুল কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকৰেও শিৰকরা অশুদ্ধ বাংলায় পাঠদান করছেন। সরকারী প্রজ্ঞাপন, বিজ্ঞপ্তি, সংসদসহ সকল ৰেত্রেই ভুল বানান, সাধু-চলিত ভাষার মিশ্রণে নিম্নমানের ভাষা প্রয়োগ হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের কবিতা, নাটক, উপন্যাসে অত্যনত্ম নিম্নমানের প্রশ্নবিদ্ধ বাংলা ব্যবহার হচ্ছে অহরহ।
No comments