গীতাঞ্জলির ভূমিকা by ডব্লিউ বি ইয়েটস
অনুবাদ : তানিম হুমায়ুন আইরিস কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের সং অফরিংসের ভূমিকা লিখেছিলেন অতি যত্ন নিয়ে, আগ্রহ সহকারে। গীতাঞ্জলির ইংরেজিতে ভাষান্তরিত পুস্তক ১৯১২ সালে রচিত হয়ে লন্ডনে প্রকাশ পায় ১৯১৩ সালে। ওই বছরই ইউরোপে এর আরও তিনটি সংস্করণ প্রকাশ পায়।
রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান সে বছরেই, ১৯১৩ সালে। ইয়েটস নোবেল পুরস্কার পান ১৮২৩ সালে
কিছুদিন আগে একজন খ্যাতিমান বাঙালি ডাক্তারকে আমি বলছিলাম, ‘আমি একবর্ণ জার্মান জানি না, তার পরও কোনো জার্মান কবিতার অনুবাদ যদি আমাকে নাড়া দেয়, আমি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গিয়ে সেই কবিকে নিয়ে লেখা দু-একটা ইংরেজি বই খুঁজে দেখি, যেন তাঁর জীবন আর চিন্তার ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার এই গদ্য অনুবাদ পড়ে বহু বছর পর আমার রক্ত চঞ্চল হয়েছে। তার পরও আমি তাঁর জীবন ও চিন্তার গতিবিধি—যা এই কবিতাগুলোকে সম্ভব করে তুলেছে—সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, যদি না এক ভারতীয় পর্যটক আমাকে জানাতেন।’ ডাক্তার ভদ্রলোকের কাছে এটাই স্বাভাবিক লাগল যে, কবিতাগুলো পড়ে আমি তাড়িত হব। কারণ, তিনি বললেন, ‘আমি প্রতিদিনই রবীন্দ্রনাথ পড়ি। তাঁর লেখা একটা লাইন পড়া মানে জগতের সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে যাওয়া।’ আমি বললাম, ‘দ্বিতীয় রিচার্ডের রাজত্বকালে লন্ডনে বাস করা কোনো ইংরেজকে যদি পেত্রার্ক কিংবা দান্তের অনুবাদ দেখানো হতো, তার মনে তৈরি হওয়া প্রশ্নের জবাব কোনো বইয়ে খুঁজে না পেয়ে সে হয়তো কোনো ফ্লোরেন্সীয় ব্যাংকার কিংবা লম্বার্ড বণিকের শরণ নিত, যেমন আমি নিয়েছি আপনার। আমি শুধু এটুকুই জানি, রবিঠাকুরের কাব্য এত সাবলীল আর ঐশ্বর্যময় যে আপনার দেশে নির্ঘাত নয়া রেনেসাঁর জন্ম হয়েছে, লোকমুখে না শুনলে যা আমার অজানাই থেকে যেত।’ তিনি বললেন, ‘আমাদের দেশে আরও কবি রয়েছেন, কিন্তু কেউই রবিঠাকুরের তুল্য নন। এই সময়কে আমরা বলছি রবীন্দ্রযুগ। ইউরোপে কোনো কবিই এতটা বিখ্যাত নন, রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাঝে যতটা। তিনি গানেও ততটাই বড়, যতটা তিনি কবিতায়। ভারতের পশ্চিম থেকে বার্মা অবধি যেখানেই বাংলায় কেউ কথা বলে, সেখানেই তাঁর গান গাওয়া হয়। উনিশ বছর বয়সে প্রথম উপন্যাস লিখেই তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন। বয়স আরেকটু বাড়ার পর লিখেছেন নাটক, যেগুলো এখনো কলকাতায় মঞ্চস্থ হচ্ছে। তাঁর জীবনের পূর্ণতা আমাকে মুগ্ধ করে। যখন কিশোর ছিলেন, তখন প্রকৃতি নিয়েই বেশি লিখতেন, সারা দিন বাগানে বসে থাকতেন। পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত যখন একটা গভীর বেদনায় তিনি আচ্ছন্ন ছিলেন, সে সময়টায় আমাদের ভাষায় লেখা সুন্দরতম প্রেমের কবিতাগুলো রচনা করেন;’ এরপর আবেগপূর্ণ হয়ে তিনি বললেন, ‘সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতা থেকে আমি যা পেয়েছি, ভাষায় তার প্রকাশ সম্ভব নয়। পঁয়ত্রিশের পর তাঁর শিল্প গভীরতর হয়েছে, হয়ে উঠেছে ধর্মের আর দর্শনের; মানবজাতির সমস্ত রকমের প্রেরণার ছোঁয়া আছে তাঁর গীতিকবিতায়। আমাদের সন্ন্যাসীদের মধ্যে তিনিই প্রথম যিনি জাগতিক জীবনকে অস্বীকার করেননি, কিন্তু কথা বলেছেন এই জীবনের ওপরে উঠে, এ জন্যই তাঁকে আমরা এত ভালোবাসি।’ আমার স্মৃতি হয়তো তাঁর সুচয়িত শব্দগুলো অদলবদল করে ফেলতে পারে, কিন্তু তাঁর কথার মূলসুর এটাই ছিল। ‘আমাদের একটি চার্চে তাঁর প্রার্থনাবাণী পাঠ করার কথা ছিল—আমরা ব্রাহ্মসমাজের লোকেরা ইংরেজিতে আপনাদের “চার্চ” শব্দটাই ব্যবহার করি—এই চার্চটা কলকাতার মধ্যে সর্ববৃহৎ, কেবল চার্চটাই যে লোকে ভরে গিয়েছিল তা না, মানুষের ভিড়ে আশপাশের রাস্তাগুলোতেও চলার জো ছিল না।’
আরও কয়েকজন ভারতীয় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁদের শ্রদ্ধাবোধ আমাদের জগতে এক আশ্চর্যের বিষয় বলে ঠেকবে, যেখানে আমরা মহৎ ও তুচ্ছকে ঠাট্টা আর অবজ্ঞার একই আবরণে ঢাকতে অভ্যস্ত। আমরা যখন ক্যাথেড্রালগুলো নির্মাণ করেছিলাম, আমাদের মহান মানুষদের নিয়ে আমাদের মনের ভেতর কি কোনো শ্রদ্ধার ভাব ছিল? রবীন্দ্রনাথকে কাছ থেকে দেখা একজন ভারতীয় আমাকে জানালেন, ‘প্রতি রাত তিনটায় তিনি অনড় হয়ে বসে ধ্যান করেন, এবং দুই ঘণ্টা বিশ্ববিধাতাকে ভাবেন। তাঁর পিতা, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও কখনো কখনো দিনমান ধ্যানমগ্ন থাকতেন। একবার এক নদীর তীরে প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে তিনি ধ্যানে বসে যান। বোটের মাঝিদের আট ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করতে হয় আবার যাত্রা শুরু করার জন্য।’ এরপর তিনি আমাকে রবীন্দ্রনাথের পরিবার নিয়ে বলা শুরু করলেন। কীভাবে এই পরিবারটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম মহান সব মানুষ তৈরি করেছে। তিনি বললেন, ‘ঠাকুরপরিবারে এখন রয়েছেন গগেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাঁরা চিত্রশিল্পী। রবীন্দ্রনাথের ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ একজন মহান দার্শনিক। গাছের শাখা থেকে কাঠবিড়ালি নেমে এসে তাঁর হাঁটুতে উঠে বসে, পাখিরা এসে বসে তাঁর হাতে।’ এই লোকগুলোর ভাবনায় দৃশ্যমান সৌন্দর্য এবং অর্থের একটা জায়গা রয়েছে বলে আমার মনে হলো। যেন তাঁরা নিৎসের সেই মতবাদটায় বিশ্বাস করেন—সেসব নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সৌন্দর্যে আমাদের বিশ্বাস করা উচিত নয় যেগুলো কখনো না কখনো বস্তুর মধ্যে নিজের ছাপ না ফেলে। আমি বললাম, ‘পুবে আপনারা জানেন কীভাবে একটি পরিবারকে কীর্তিমান করে তুলতে হয়। সেদিন জাদুঘরে দেখলাম, কালো চামড়ার একজন ছোটখাটো লোক চীনা নকশাগুলো সাজিয়ে রাখছিল। জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক আমাকে বললেন, ‘উনিই মিকাডোর বংশপরম্পরাগত শিল্পসমঝদার। তিনি তাঁর বংশের মধ্যে চতুর্দশ যিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন।’ ভারতীয়টি বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যখন ছোট ছিলেন, তাঁর বাড়িতে তাঁকে ঘিরে থাকত সাহিত্য ও সংগীত।’ তাঁর কাব্যের ঐশ্বর্য্য ও সহজতার কথাটা আমার আরেকবার মনে পড়ল। বললাম, ‘আপনাদের দেশে প্রোপাগান্ডামূলক, সমালোচনাধর্মী লেখালেখি কেমন হয়? আমাদের এসব প্রচুর করতে হয়, বিশেষ করে আমার দেশে। আর এ জন্যই বোধহয় আমাদের মন আস্তে আস্তে আর সৃষ্টিশীল হতে চাইছে না। তার পরও আমরা থামতে পারছি না। আমাদের জীবন যদি ধারাবাহিক যুদ্ধক্ষেত্র না হতো, আমাদের রুচি তৈরি হতো না, আমরা জানতাম না কোনটা শ্রেয়তর, আমরা পাঠক কিংবা শ্রোতা পেতাম না। আমাদের উদ্যমের পাঁচ ভাগের চার ভাগ নষ্ট হয় কুরুচির সঙ্গে বিবাদ করতে গিয়ে, হয় আমাদের নিজেদের অথবা অন্যদের মনের ভেতর।’ ‘আমি বুঝতে পারছি,’ তিনি উত্তর করলেন, ‘আমাদের দেশেও যে প্রোপাগান্ডামূলক লেখালেখি নেই, তা না। গ্রামের পণ্ডিতেরা প্রায়শই মধ্যযুগের সংস্কৃত থেকে নেওয়া মিথনির্ভর কবিতা পাঠ করে, আর এসবের মধ্যে স্তবক ঢুকিয়ে দিয়ে পাঠককে জ্ঞান দেয় কোনটা তাদের কর্তব্য, কোনটা নয়।’
রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের পাণ্ডুলিপি নিয়ে আমি অনেক দিন ঘুরেছি, ট্রেনে বসে পড়েছি, বাসে কিংবা রেস্তোরাঁয় বসে পড়েছি। প্রায়শই আমাকে এটা বন্ধ করে রাখতে হয়েছে পাছে কেউ দেখ ফেলে যে এটা পড়তে গিয়ে আমি কতটা আপ্লুত হয়ে গেছি। এই গীতিকবিতাগুলোর ভাবনার মধ্যে, আমার ভারতীয় বন্ধুর মতে, যেগুলোর বাংলা সংস্করণ লয়ের সূক্ষ্মতা, রঙের অনুবাদ-অসম্ভব মাধুর্য আর ছন্দের নতুন উদ্ভাবনে পূর্ণ, আমি এমন একটা পৃথিবী খুঁজে পেয়েছি যার স্বপ্ন আমি আমার সারা জীবন ধরে দেখেছি। কবিতাগুলো একটি মহত্তম সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে, যদিও সেগুলো যেন সাধারণ মৃত্তিকায় ঘাস কিংবা নলখাগড়ার বেড়ে ওঠার মতো সাবলীল। এই কবিতাগুলো শতাব্দী পেরোনো এমন একটি ঐতিহ্য থেকে উঠে আসা, যেখানে কাব্য ও ধর্ম আদতে একই জিনিস, যে ঐতিহ্য শিক্ষিত ও মূর্খের কাছ থেকে উপমা আর আবেগ জমা করে করে শতাব্দী পাড়ি দিয়েছে, এবং তারপর আবার জনমানসের জন্য বয়ে নিয়ে এসেছে পণ্ডিত ও মহাজনদের মনীষা। বাংলার সভ্যতা যদি অটুট থাকে, যদি একটা সর্বজনীন মন সবার মধ্যে বিরাজ করে, আমাদের মতো হাজারটা মন হয়ে ভেঙে না যায়, যে মনগুলো একটা আরেকটা সম্পর্কে কিছুই জানে না, এই কাব্যগুলোর সূক্ষ্মতম উপাদানগুলো হয়তো কয়েক প্রজন্ম পরে পথের ভিক্ষুকের কাছেও খুঁজে পাওয়া যাবে। ইংল্যান্ডেও যখন কেবল একটাই মন বিরাজ করত, তখন শসার লিখেছিলেন ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিডা, এবং ভেবেছিলেন তিনি লিখেছেন পঠিত হওয়ার জন্য, অথবা উচ্চ স্বরে গীত হওয়ার জন্য; কারণ, নতুন সময় ধেয়ে আসছিল। চারণকবিরা তাঁর গানগুলো গাইত। রবীন্দ্রনাথও—শসারের উত্তরাধিকারীর মতোই—তাঁর কথায় সুর দেন, এবং প্রতিটি মুহূর্তেই বুঝিয়ে দেন যে তিনি কতটা অবারিত, কতটা স্বতঃস্ফূর্ত, নিজের আবেগ নিয়ে কতটা সাহসী, কতটা বিস্ময়ে ভরা। কারণ, তিনি এমন একটা কিছু করছেন, যাকে কখনো আনকোরা, কৃত্রিম কিংবা রক্ষণনির্ভর লাগে না। এই কাব্যগুলো কখনোই মহিলাদের টেবিলে সুমুদ্রিত বই হয়ে পড়ে থাকবে না, যারা তাদের অলস হাত দিয়ে বইয়ের পাতাগুলো এমনভাবে ওল্টায় যেন সেগুলো জীবনভর কোনো অর্থ ছাড়াই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মরবে; জীবন সম্পর্কে বইয়ের পাতাগুলোর অভিজ্ঞতা হয় কেবল সেই স্পর্শটুকুই। অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বইয়ের ভারে এমনভাবে জায়গা করে নেবে না যে জীবনের প্রকৃত মহড়া যখন শুরু হবে, ছাত্রটি আলগোছে বইটি সরিয়ে রাখবে এক পাশে। বরং এক যুগ শেষে যখন নতুন আরেক যুগ আসবে, তখনো মহাসড়ক পাড়ি দেওয়া পর্যটক কিংবা নৌকা বাইতে থাকা মাঝি এই কাব্যগুলো গুনগুন করে গাইবে। বিরহী প্রেমিক ও প্রেমিকা এই কাব্যগুলো উচ্চারণ করে এর ঈশ্বরপ্রেমে এমন এক জাদুময়তার সমুদ্র খুঁজে পাবে, যে সমুদ্রে তাদের প্রণয়ের তিতে অনুভূতি স্নান করে তরুণ হয়ে উঠবে। প্রতিটি মুহূর্তেই এই কবির মন এই আবেগগুলোকে তুচ্ছ কিংবা অমর্যাদা না করেই এসবের বাইরে বয়ে চলে, কারণ তিনি জানেন যে পাঠক তাঁকে বুঝবে। কবির এই মন পাঠকের জীবন-অভিজ্ঞতা দিয়ে নিজেকে ভরিয়ে রেখেছে। ধুলোর চিহ্ন যেন গায়ে না থাকে, এ জন্য গৈরিক কাপড় গায়ে দেওয়া পথিক, শয়নে রাজোচিত প্রেমিকের মালা থেকে খসে পড়া ফুল খুঁজতে থাকা শয্যারতা নারী, প্রভুর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় প্রহর গোনা দাসী কিংবা ভার্যা—এ সবই ঈশ্বর-অন্বেষী মনের প্রতীক। ফুল, নদী, শাঁখের আওয়াজ, ভারতীয় জুলাইয়ের প্রবল বরষা, মিলন কিংবা বিরহে মনের গতি-প্রকৃতি, নৌকায় বসে বাঁশি বাজানো মানুষ—এগুলো যেন কোনো চীনা ছবিতে অগণিত রহস্যময় নকশার মতো, ঈশ্বর নিজেই। একটা জনসমষ্টি, একটা সভ্যতা, আমাদের কাছে যা অভাবিত রকমের অজানা, যেন এই কল্পনার মধ্য দিয়ে উঠে আসে; কিন্তু আমরা এর অচেনা রূপের কারণে তাড়িত হই না, বরং আমরা তাড়িত হই আমাদের নিজেদের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়ে, যেন এই সাহিত্যে আমরা রসেটির উইলোবনের মধ্য দিয়ে হেঁটে বেড়াই, অথবা এই প্রথমবার কোনো সাহিত্যে আমরা নিজেদের কণ্ঠস্বর শুনি, যেন স্বপ্নে শোনা কোনো এক কণ্ঠস্বরের মতো করে।
ইউরোপীয় সন্তদের লেখায় যতই সুপরিচিত উপমা কিংবা সাধারণ গঠনশৈলী থাকুক না কেন, রেনেসাঁর পর থেকে সেগুলো আমাদের খুব বেশি টানেনি। আমরা জানি যে, আমাদের একটা পর্যায়ে দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসতেই হয়, এবং আমরা এক মুহূর্তের ক্লান্তি কিংবা উচ্ছ্বাসের জন্য দুনিয়াকে স্বেচ্ছায় ভুলে থাকতে অভ্যস্ত; কিন্তু আমরা যারা এত কবিতা পড়েছি, এত চিত্রকর্ম দেখেছি, এত সংগীত শ্রবণ করেছি, যেখানে মাংস ও আত্মার কান্না একই বলে অনুভূত হয়, তাদের পক্ষে জগৎকে এত রুক্ষ ও ককর্শভাবে ভুলে থাকা কি সম্ভব? সুইজারল্যান্ডের হ্রদের সৌন্দর্য ধারণ করা আর সম্ভব হচ্ছে না, এই কারণে দুই হাতে চোখ ঢেকে ফেলা সেইন্ট বার্নার্ড, কিংবা ‘বুক অব রেভেলেশন’-এর প্রচণ্ড অলংকারশাস্ত্রের সঙ্গে আমাদের মিল কোথায়? পড়ে দেখলে দেখবেন যে রবীন্দ্রনাথের বইটি সৌজন্যময় কথায় ভরে আছে। ‘পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহ ভাই/ সবারে আমি প্রণাম করে যাই।/ ফিরায়ে দিনু দ্বারের চাবি/ রাখি না আর ঘরের দাবি,/ সবার আজি প্রসাদবাণী চাই,/ সবারে আমি প্রণাম করে যাই।/ অনেক দিন ছিলাম প্রতিবেশী,/ দিয়েছি যত নিয়েছি তার বেশি।/ প্রভাত হয়ে এসেছে রাতি,/ নিবিয়া গেল কোণের বাতি,/ পড়েছে ডাক চলেছি আমি তাই,/ সবারে আমি প্রণাম করে যাই।’ (‘আই হ্যাভ গট মাই লিভ। বিড মি ফেয়ারওয়েল, মাই ব্রাদার্স! আই বো টু ইউ অল অ্যান্ড টেক মাই ডিপার্চার। হেয়ার আই গিভ ব্যাক দ্য কিইস অব মাই ডোর অ্যান্ড আই গিভ আপ অল ক্লেইমস টু মাই হাউস। আই ওনলি আস্ক লাস্ট কাইন্ড ওয়ার্ডস ফ্রম ইউ। উই ওয়্যার নেইবার্স ফর লং, বাট আই রিসিভড মোর দেন আই কুড গিভ। নাউ দ্য ডে হ্যাজ ডৌনড অ্যান্ড দ্য ল্যাম্প দ্যাট লিট মাই ডার্ক কর্নার ইজ আউট। আ সামনস হ্যাজ কাম অ্যান্ড আই অ্যাম রেডি ফর মাই জার্নি।’) আ কেম্পিস কিংবা জন অব দ্য ক্রসের ঘোষণা, ‘অ্যান্ড বিকজ আই লাভ দিস লাইফ, আই নো আই শ্যাল লাভ ডেথ অ্যাজ ওয়েল’—এ থেকে দূরবর্তী বলেই রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলো আমাদের একান্ত অনুভূতি। রবীন্দ্রনাথের এই রচনা আমাদের বিচ্ছেদচিন্তার গভীরতাই কেবল পরিমাপ করে না। এর আগে আমরা জানতাম না যে ঈশ্বরকে আমরা ভালোবাসি, বড়জোর হয়তো তাঁকে আমরা বিশ্বাস করি; এখন আমাদের ফেলে আসা জীবনের দিকে তাকালে, বনের মাঝবরাবর সরু পথ ধরে আমাদের ভ্রমণের ভেতর, পর্বতের নিঃসঙ্গতম অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া পুলকের মধ্যে, না-পাওয়া নারীর ওপর আমাদের রহস্যময় দাবির ভেতর ঈশ্বরপ্রেমের মায়াবী মধুরতার আবেগ যেন আমরা আবিষ্কার করি। ‘তখন করি নি, নাথ, কোনো আয়োজন;/ বিশ্বের সবার সাথে, হে বিশ্বরাজন্,/ অজ্ঞাতে আসিতে হাসি আমার অন্তরে/ কত শুভদিনে; কত মুহূর্তের ’পরে/ অসীমের চিহ্ন লিখে গেছ!...’ (‘এন্টারিং মাই হার্ট আনবিডেন ইভেন অ্যাজ ওয়ান অব দ্য কমন ক্রাউড, আননোন টু মি, মাই কিং, দাউ ডিড প্রেস দ্য সিগনেট অব এটার্নিটি আপন মেনি আ ফ্লিটিং মোমেন্ট।’) এটা কোনো অন্ধকার প্রকোষ্ঠ কিংবা চাবুকের মাধ্যমে নিশ্চিত করা ধর্মের শুচিতা নয়; বরং এ যেন ধুলো কিংবা রোদের ছবি আঁকতে আঁকতে শিল্পীমনের বড় এক তীব্রতার পানে উড্ডীন হওয়া। আর এর মধ্য দিয়েই আমরা যেন সেইন্ট ফ্রান্সিস কিংবা উইলিয়াম ব্লেকের কণ্ঠস্বর নতুন করে খুঁজে পাই, যা আমাদের প্রচণ্ডতার ইতিহাসে বিরলপ্রায় হয়ে উঠেছে।
কিছু ধরাবাঁধা কাঠামোর প্রতি আস্থাশীল থেকে আমরা দীর্ঘ বইগুলো লিখে থাকি। এগুলোতে এমন একটা পৃষ্ঠাও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না যেটায় লেখাকে আনন্দের বাহন বলে মনে হয়। বইগুলো আমরা সেভাবেই লিখি, ঠিক যেভাবে আমরা যুদ্ধ করি, টাকা কামাই আর আমাদের মস্তিষ্ককে ভর্তি করে ফেলি রাজনীতিতে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সভ্যতার মতোই আত্মার আবিষ্কারেই তুষ্ট থেকেছেন এবং এর স্বতঃস্ফূর্তিতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। মাঝে মাঝেই তিনি সেসব লোকের সঙ্গে জীবনের পার্থক্য দেখান, যারা ফ্যাশনের দিকে বেশি ঝুঁকেছে, এবং জগতে যারা আপাতদৃষ্টিতে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এবং সব সময়ই রবীন্দ্রনাথ বিনয়ের সঙ্গেই বলেছেন যে তাঁর বেছে নেওয়া রাস্তাই তাঁর জন্য সবচেয়ে ভালো: ‘সবাই ঘরের পানে যাবার বেলা আমায় দেখে হাসে,/ মনে লজ্জা লাগে মোর।/ আমি বসে আছি বসনখানি টেনে মুখের ’পরে/ যেন ভিখারিনীর মতো;/ কেহ শুধায় যদি ‘কী চাও তুমি’ থাকি নিরুত্তরে/ করি দুটি নয়ন নত।’ (‘মেন গোয়িং হোম গ্লেন্স অ্যাট মি অ্যান্ড স্মাইল অ্যান্ড ফিল মি উইথ শেম। আই সিট লাইক আ বেগার মেইড, ড্রয়িং মাই স্কার্ট ওভার মাই ফেস, অ্যান্ড হোয়েন দে আস্ক মি, হোয়াট ইট ইজ আই ওয়ান্ট, আই ড্রপ মাই আইজ অ্যান্ড আনসার দেম নট।’) আরেক জায়গায় তাঁর ফেলে আসা জীবন কেমন ছিল সেটা ভেবে তিনি বলছেন, ‘মন্দ-ভালোর দ্বন্দ্বে খেটে/ গেছে তো দিন অনেক কেটে,/ অলস-বেলার খেলার সাথি/ এবার আমার হূদয় টানে। /বিনা-কাজের ডাক পড়েছে/ কেন যে তা কেই বা জানে।’ (‘মেনি অ্যান আওয়ার আই হ্যাভ স্পেন্ট ইন দ্য স্ট্রাইফ অব দ্য গুড অ্যান্ড দ্য ইভিল, বাট নাউ ইট ইজ দ্য প্লেজার অব মাই প্লেমেট অব দ্য এম্পটি ডে’জ টু ড্র মাই হার্ট অন টু হিম; অ্যান্ড আই নো নট হোয়াই দিস সাডেন কল টু হোয়াট ইউজলেস কনসিক্যুয়েন্স।’) সাহিত্যের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না এমন এক দুর্লভ সারল্য আর নির্মলভাব পাখি কিংবা গাছের পাতাকে তাঁর ততটাই কাছে নিয়ে আসে যতটা কাছে তারা শিশুদের। কখনো কখনো আমি ভাবি, তিনি এগুলো বাংলা সাহিত্য কিংবা ধর্ম থেকে পেয়েছেন কি না। আবার তাঁর ভাইয়ের হাতে এসে পাখিদের বসে থাকার কথা মনে করে ভাবি যে এটা হয়তো এক উত্তরাধিকার, যেন শতকের পর শতকজুড়ে বেড়ে উঠতে থাকা এক রহস্য, কোনো ট্রিস্টান অথবা পেলানোরের (ইংলিশ লোককথার নায়ক) সৌজন্যে। আসলেই, যখন তিনি শিশুদের কথা বলছেন, তাঁর মধ্যে এই গুণটা এত প্রবলভাবে দেখা যায়, কারও পক্ষে এ কথা বলা মুশকিল হয়ে পড়ে যে তিনি সন্তদের কথাও বলছেন না, ‘বালুকা দিয়ে বাঁধিছে ঘর,/ ঝিনুক নিয়ে খেলা।/ বিপুল নীল সলিল—’পরি/ ভাসায় তারা খেলার তরী/ আপন হাতে হেলায় গড়ি/ পাতায়-গাঁথা ভেলা।/ জগৎ-পারাবারের তীরে/ ছেলেরা করে খেলা।/ জানে না তারা সাঁতার দেওয়া,/ জানে না জাল ফেলা।/ ডুবারি ডুবে মুকুতা চেয়ে,/ বণিক ধায় তরণী বেয়ে,/ ছেলেরা নুড়ি কুড়ায়ে পেয়ে/ সাজায় বসি ঢেলা।/ রতন ধন খোঁজে না তারা,/ জানে না জাল ফেলা।’ (‘দে বিল্ড দেয়ার হাউজেস উইথ স্যান্ড অ্যান্ড দে প্লে উইথ এম্পটি শেলস। উইথ উইথার্ড লিভস দে উইভ দেয়ার বোটস অ্যান্ড স্মাইলিংলি ফ্লোট দেম অন দ্য ভাস্ট ডিপ। চিলড্রেন হ্যাভ দেয়ার প্লে অন দ্য সি শোর অব ওয়ার্ল্ডস। দে নো নট হাউ টু সুইম, দে নো নট হাউ টু কাস্ট নেটস। পার্ল ফিশার্স ডাইভ ফর পার্লস, মার্চেন্ট সেইল ইন দেয়ার শিপস, হোয়াইল চিলড্রেন গ্যাদার পিবলস্ অ্যান্ড স্কাটার দেম এগেইন। দে সিক নট ফর হিডেন ট্রেজার, দে নো নট হাউ টু কাস্ট নেটস।’ )
কিছুদিন আগে একজন খ্যাতিমান বাঙালি ডাক্তারকে আমি বলছিলাম, ‘আমি একবর্ণ জার্মান জানি না, তার পরও কোনো জার্মান কবিতার অনুবাদ যদি আমাকে নাড়া দেয়, আমি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গিয়ে সেই কবিকে নিয়ে লেখা দু-একটা ইংরেজি বই খুঁজে দেখি, যেন তাঁর জীবন আর চিন্তার ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার এই গদ্য অনুবাদ পড়ে বহু বছর পর আমার রক্ত চঞ্চল হয়েছে। তার পরও আমি তাঁর জীবন ও চিন্তার গতিবিধি—যা এই কবিতাগুলোকে সম্ভব করে তুলেছে—সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, যদি না এক ভারতীয় পর্যটক আমাকে জানাতেন।’ ডাক্তার ভদ্রলোকের কাছে এটাই স্বাভাবিক লাগল যে, কবিতাগুলো পড়ে আমি তাড়িত হব। কারণ, তিনি বললেন, ‘আমি প্রতিদিনই রবীন্দ্রনাথ পড়ি। তাঁর লেখা একটা লাইন পড়া মানে জগতের সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে যাওয়া।’ আমি বললাম, ‘দ্বিতীয় রিচার্ডের রাজত্বকালে লন্ডনে বাস করা কোনো ইংরেজকে যদি পেত্রার্ক কিংবা দান্তের অনুবাদ দেখানো হতো, তার মনে তৈরি হওয়া প্রশ্নের জবাব কোনো বইয়ে খুঁজে না পেয়ে সে হয়তো কোনো ফ্লোরেন্সীয় ব্যাংকার কিংবা লম্বার্ড বণিকের শরণ নিত, যেমন আমি নিয়েছি আপনার। আমি শুধু এটুকুই জানি, রবিঠাকুরের কাব্য এত সাবলীল আর ঐশ্বর্যময় যে আপনার দেশে নির্ঘাত নয়া রেনেসাঁর জন্ম হয়েছে, লোকমুখে না শুনলে যা আমার অজানাই থেকে যেত।’ তিনি বললেন, ‘আমাদের দেশে আরও কবি রয়েছেন, কিন্তু কেউই রবিঠাকুরের তুল্য নন। এই সময়কে আমরা বলছি রবীন্দ্রযুগ। ইউরোপে কোনো কবিই এতটা বিখ্যাত নন, রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাঝে যতটা। তিনি গানেও ততটাই বড়, যতটা তিনি কবিতায়। ভারতের পশ্চিম থেকে বার্মা অবধি যেখানেই বাংলায় কেউ কথা বলে, সেখানেই তাঁর গান গাওয়া হয়। উনিশ বছর বয়সে প্রথম উপন্যাস লিখেই তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন। বয়স আরেকটু বাড়ার পর লিখেছেন নাটক, যেগুলো এখনো কলকাতায় মঞ্চস্থ হচ্ছে। তাঁর জীবনের পূর্ণতা আমাকে মুগ্ধ করে। যখন কিশোর ছিলেন, তখন প্রকৃতি নিয়েই বেশি লিখতেন, সারা দিন বাগানে বসে থাকতেন। পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত যখন একটা গভীর বেদনায় তিনি আচ্ছন্ন ছিলেন, সে সময়টায় আমাদের ভাষায় লেখা সুন্দরতম প্রেমের কবিতাগুলো রচনা করেন;’ এরপর আবেগপূর্ণ হয়ে তিনি বললেন, ‘সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতা থেকে আমি যা পেয়েছি, ভাষায় তার প্রকাশ সম্ভব নয়। পঁয়ত্রিশের পর তাঁর শিল্প গভীরতর হয়েছে, হয়ে উঠেছে ধর্মের আর দর্শনের; মানবজাতির সমস্ত রকমের প্রেরণার ছোঁয়া আছে তাঁর গীতিকবিতায়। আমাদের সন্ন্যাসীদের মধ্যে তিনিই প্রথম যিনি জাগতিক জীবনকে অস্বীকার করেননি, কিন্তু কথা বলেছেন এই জীবনের ওপরে উঠে, এ জন্যই তাঁকে আমরা এত ভালোবাসি।’ আমার স্মৃতি হয়তো তাঁর সুচয়িত শব্দগুলো অদলবদল করে ফেলতে পারে, কিন্তু তাঁর কথার মূলসুর এটাই ছিল। ‘আমাদের একটি চার্চে তাঁর প্রার্থনাবাণী পাঠ করার কথা ছিল—আমরা ব্রাহ্মসমাজের লোকেরা ইংরেজিতে আপনাদের “চার্চ” শব্দটাই ব্যবহার করি—এই চার্চটা কলকাতার মধ্যে সর্ববৃহৎ, কেবল চার্চটাই যে লোকে ভরে গিয়েছিল তা না, মানুষের ভিড়ে আশপাশের রাস্তাগুলোতেও চলার জো ছিল না।’
আরও কয়েকজন ভারতীয় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁদের শ্রদ্ধাবোধ আমাদের জগতে এক আশ্চর্যের বিষয় বলে ঠেকবে, যেখানে আমরা মহৎ ও তুচ্ছকে ঠাট্টা আর অবজ্ঞার একই আবরণে ঢাকতে অভ্যস্ত। আমরা যখন ক্যাথেড্রালগুলো নির্মাণ করেছিলাম, আমাদের মহান মানুষদের নিয়ে আমাদের মনের ভেতর কি কোনো শ্রদ্ধার ভাব ছিল? রবীন্দ্রনাথকে কাছ থেকে দেখা একজন ভারতীয় আমাকে জানালেন, ‘প্রতি রাত তিনটায় তিনি অনড় হয়ে বসে ধ্যান করেন, এবং দুই ঘণ্টা বিশ্ববিধাতাকে ভাবেন। তাঁর পিতা, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও কখনো কখনো দিনমান ধ্যানমগ্ন থাকতেন। একবার এক নদীর তীরে প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে তিনি ধ্যানে বসে যান। বোটের মাঝিদের আট ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করতে হয় আবার যাত্রা শুরু করার জন্য।’ এরপর তিনি আমাকে রবীন্দ্রনাথের পরিবার নিয়ে বলা শুরু করলেন। কীভাবে এই পরিবারটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম মহান সব মানুষ তৈরি করেছে। তিনি বললেন, ‘ঠাকুরপরিবারে এখন রয়েছেন গগেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাঁরা চিত্রশিল্পী। রবীন্দ্রনাথের ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ একজন মহান দার্শনিক। গাছের শাখা থেকে কাঠবিড়ালি নেমে এসে তাঁর হাঁটুতে উঠে বসে, পাখিরা এসে বসে তাঁর হাতে।’ এই লোকগুলোর ভাবনায় দৃশ্যমান সৌন্দর্য এবং অর্থের একটা জায়গা রয়েছে বলে আমার মনে হলো। যেন তাঁরা নিৎসের সেই মতবাদটায় বিশ্বাস করেন—সেসব নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সৌন্দর্যে আমাদের বিশ্বাস করা উচিত নয় যেগুলো কখনো না কখনো বস্তুর মধ্যে নিজের ছাপ না ফেলে। আমি বললাম, ‘পুবে আপনারা জানেন কীভাবে একটি পরিবারকে কীর্তিমান করে তুলতে হয়। সেদিন জাদুঘরে দেখলাম, কালো চামড়ার একজন ছোটখাটো লোক চীনা নকশাগুলো সাজিয়ে রাখছিল। জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক আমাকে বললেন, ‘উনিই মিকাডোর বংশপরম্পরাগত শিল্পসমঝদার। তিনি তাঁর বংশের মধ্যে চতুর্দশ যিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন।’ ভারতীয়টি বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যখন ছোট ছিলেন, তাঁর বাড়িতে তাঁকে ঘিরে থাকত সাহিত্য ও সংগীত।’ তাঁর কাব্যের ঐশ্বর্য্য ও সহজতার কথাটা আমার আরেকবার মনে পড়ল। বললাম, ‘আপনাদের দেশে প্রোপাগান্ডামূলক, সমালোচনাধর্মী লেখালেখি কেমন হয়? আমাদের এসব প্রচুর করতে হয়, বিশেষ করে আমার দেশে। আর এ জন্যই বোধহয় আমাদের মন আস্তে আস্তে আর সৃষ্টিশীল হতে চাইছে না। তার পরও আমরা থামতে পারছি না। আমাদের জীবন যদি ধারাবাহিক যুদ্ধক্ষেত্র না হতো, আমাদের রুচি তৈরি হতো না, আমরা জানতাম না কোনটা শ্রেয়তর, আমরা পাঠক কিংবা শ্রোতা পেতাম না। আমাদের উদ্যমের পাঁচ ভাগের চার ভাগ নষ্ট হয় কুরুচির সঙ্গে বিবাদ করতে গিয়ে, হয় আমাদের নিজেদের অথবা অন্যদের মনের ভেতর।’ ‘আমি বুঝতে পারছি,’ তিনি উত্তর করলেন, ‘আমাদের দেশেও যে প্রোপাগান্ডামূলক লেখালেখি নেই, তা না। গ্রামের পণ্ডিতেরা প্রায়শই মধ্যযুগের সংস্কৃত থেকে নেওয়া মিথনির্ভর কবিতা পাঠ করে, আর এসবের মধ্যে স্তবক ঢুকিয়ে দিয়ে পাঠককে জ্ঞান দেয় কোনটা তাদের কর্তব্য, কোনটা নয়।’
রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের পাণ্ডুলিপি নিয়ে আমি অনেক দিন ঘুরেছি, ট্রেনে বসে পড়েছি, বাসে কিংবা রেস্তোরাঁয় বসে পড়েছি। প্রায়শই আমাকে এটা বন্ধ করে রাখতে হয়েছে পাছে কেউ দেখ ফেলে যে এটা পড়তে গিয়ে আমি কতটা আপ্লুত হয়ে গেছি। এই গীতিকবিতাগুলোর ভাবনার মধ্যে, আমার ভারতীয় বন্ধুর মতে, যেগুলোর বাংলা সংস্করণ লয়ের সূক্ষ্মতা, রঙের অনুবাদ-অসম্ভব মাধুর্য আর ছন্দের নতুন উদ্ভাবনে পূর্ণ, আমি এমন একটা পৃথিবী খুঁজে পেয়েছি যার স্বপ্ন আমি আমার সারা জীবন ধরে দেখেছি। কবিতাগুলো একটি মহত্তম সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে, যদিও সেগুলো যেন সাধারণ মৃত্তিকায় ঘাস কিংবা নলখাগড়ার বেড়ে ওঠার মতো সাবলীল। এই কবিতাগুলো শতাব্দী পেরোনো এমন একটি ঐতিহ্য থেকে উঠে আসা, যেখানে কাব্য ও ধর্ম আদতে একই জিনিস, যে ঐতিহ্য শিক্ষিত ও মূর্খের কাছ থেকে উপমা আর আবেগ জমা করে করে শতাব্দী পাড়ি দিয়েছে, এবং তারপর আবার জনমানসের জন্য বয়ে নিয়ে এসেছে পণ্ডিত ও মহাজনদের মনীষা। বাংলার সভ্যতা যদি অটুট থাকে, যদি একটা সর্বজনীন মন সবার মধ্যে বিরাজ করে, আমাদের মতো হাজারটা মন হয়ে ভেঙে না যায়, যে মনগুলো একটা আরেকটা সম্পর্কে কিছুই জানে না, এই কাব্যগুলোর সূক্ষ্মতম উপাদানগুলো হয়তো কয়েক প্রজন্ম পরে পথের ভিক্ষুকের কাছেও খুঁজে পাওয়া যাবে। ইংল্যান্ডেও যখন কেবল একটাই মন বিরাজ করত, তখন শসার লিখেছিলেন ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিডা, এবং ভেবেছিলেন তিনি লিখেছেন পঠিত হওয়ার জন্য, অথবা উচ্চ স্বরে গীত হওয়ার জন্য; কারণ, নতুন সময় ধেয়ে আসছিল। চারণকবিরা তাঁর গানগুলো গাইত। রবীন্দ্রনাথও—শসারের উত্তরাধিকারীর মতোই—তাঁর কথায় সুর দেন, এবং প্রতিটি মুহূর্তেই বুঝিয়ে দেন যে তিনি কতটা অবারিত, কতটা স্বতঃস্ফূর্ত, নিজের আবেগ নিয়ে কতটা সাহসী, কতটা বিস্ময়ে ভরা। কারণ, তিনি এমন একটা কিছু করছেন, যাকে কখনো আনকোরা, কৃত্রিম কিংবা রক্ষণনির্ভর লাগে না। এই কাব্যগুলো কখনোই মহিলাদের টেবিলে সুমুদ্রিত বই হয়ে পড়ে থাকবে না, যারা তাদের অলস হাত দিয়ে বইয়ের পাতাগুলো এমনভাবে ওল্টায় যেন সেগুলো জীবনভর কোনো অর্থ ছাড়াই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মরবে; জীবন সম্পর্কে বইয়ের পাতাগুলোর অভিজ্ঞতা হয় কেবল সেই স্পর্শটুকুই। অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বইয়ের ভারে এমনভাবে জায়গা করে নেবে না যে জীবনের প্রকৃত মহড়া যখন শুরু হবে, ছাত্রটি আলগোছে বইটি সরিয়ে রাখবে এক পাশে। বরং এক যুগ শেষে যখন নতুন আরেক যুগ আসবে, তখনো মহাসড়ক পাড়ি দেওয়া পর্যটক কিংবা নৌকা বাইতে থাকা মাঝি এই কাব্যগুলো গুনগুন করে গাইবে। বিরহী প্রেমিক ও প্রেমিকা এই কাব্যগুলো উচ্চারণ করে এর ঈশ্বরপ্রেমে এমন এক জাদুময়তার সমুদ্র খুঁজে পাবে, যে সমুদ্রে তাদের প্রণয়ের তিতে অনুভূতি স্নান করে তরুণ হয়ে উঠবে। প্রতিটি মুহূর্তেই এই কবির মন এই আবেগগুলোকে তুচ্ছ কিংবা অমর্যাদা না করেই এসবের বাইরে বয়ে চলে, কারণ তিনি জানেন যে পাঠক তাঁকে বুঝবে। কবির এই মন পাঠকের জীবন-অভিজ্ঞতা দিয়ে নিজেকে ভরিয়ে রেখেছে। ধুলোর চিহ্ন যেন গায়ে না থাকে, এ জন্য গৈরিক কাপড় গায়ে দেওয়া পথিক, শয়নে রাজোচিত প্রেমিকের মালা থেকে খসে পড়া ফুল খুঁজতে থাকা শয্যারতা নারী, প্রভুর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় প্রহর গোনা দাসী কিংবা ভার্যা—এ সবই ঈশ্বর-অন্বেষী মনের প্রতীক। ফুল, নদী, শাঁখের আওয়াজ, ভারতীয় জুলাইয়ের প্রবল বরষা, মিলন কিংবা বিরহে মনের গতি-প্রকৃতি, নৌকায় বসে বাঁশি বাজানো মানুষ—এগুলো যেন কোনো চীনা ছবিতে অগণিত রহস্যময় নকশার মতো, ঈশ্বর নিজেই। একটা জনসমষ্টি, একটা সভ্যতা, আমাদের কাছে যা অভাবিত রকমের অজানা, যেন এই কল্পনার মধ্য দিয়ে উঠে আসে; কিন্তু আমরা এর অচেনা রূপের কারণে তাড়িত হই না, বরং আমরা তাড়িত হই আমাদের নিজেদের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়ে, যেন এই সাহিত্যে আমরা রসেটির উইলোবনের মধ্য দিয়ে হেঁটে বেড়াই, অথবা এই প্রথমবার কোনো সাহিত্যে আমরা নিজেদের কণ্ঠস্বর শুনি, যেন স্বপ্নে শোনা কোনো এক কণ্ঠস্বরের মতো করে।
ইউরোপীয় সন্তদের লেখায় যতই সুপরিচিত উপমা কিংবা সাধারণ গঠনশৈলী থাকুক না কেন, রেনেসাঁর পর থেকে সেগুলো আমাদের খুব বেশি টানেনি। আমরা জানি যে, আমাদের একটা পর্যায়ে দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসতেই হয়, এবং আমরা এক মুহূর্তের ক্লান্তি কিংবা উচ্ছ্বাসের জন্য দুনিয়াকে স্বেচ্ছায় ভুলে থাকতে অভ্যস্ত; কিন্তু আমরা যারা এত কবিতা পড়েছি, এত চিত্রকর্ম দেখেছি, এত সংগীত শ্রবণ করেছি, যেখানে মাংস ও আত্মার কান্না একই বলে অনুভূত হয়, তাদের পক্ষে জগৎকে এত রুক্ষ ও ককর্শভাবে ভুলে থাকা কি সম্ভব? সুইজারল্যান্ডের হ্রদের সৌন্দর্য ধারণ করা আর সম্ভব হচ্ছে না, এই কারণে দুই হাতে চোখ ঢেকে ফেলা সেইন্ট বার্নার্ড, কিংবা ‘বুক অব রেভেলেশন’-এর প্রচণ্ড অলংকারশাস্ত্রের সঙ্গে আমাদের মিল কোথায়? পড়ে দেখলে দেখবেন যে রবীন্দ্রনাথের বইটি সৌজন্যময় কথায় ভরে আছে। ‘পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহ ভাই/ সবারে আমি প্রণাম করে যাই।/ ফিরায়ে দিনু দ্বারের চাবি/ রাখি না আর ঘরের দাবি,/ সবার আজি প্রসাদবাণী চাই,/ সবারে আমি প্রণাম করে যাই।/ অনেক দিন ছিলাম প্রতিবেশী,/ দিয়েছি যত নিয়েছি তার বেশি।/ প্রভাত হয়ে এসেছে রাতি,/ নিবিয়া গেল কোণের বাতি,/ পড়েছে ডাক চলেছি আমি তাই,/ সবারে আমি প্রণাম করে যাই।’ (‘আই হ্যাভ গট মাই লিভ। বিড মি ফেয়ারওয়েল, মাই ব্রাদার্স! আই বো টু ইউ অল অ্যান্ড টেক মাই ডিপার্চার। হেয়ার আই গিভ ব্যাক দ্য কিইস অব মাই ডোর অ্যান্ড আই গিভ আপ অল ক্লেইমস টু মাই হাউস। আই ওনলি আস্ক লাস্ট কাইন্ড ওয়ার্ডস ফ্রম ইউ। উই ওয়্যার নেইবার্স ফর লং, বাট আই রিসিভড মোর দেন আই কুড গিভ। নাউ দ্য ডে হ্যাজ ডৌনড অ্যান্ড দ্য ল্যাম্প দ্যাট লিট মাই ডার্ক কর্নার ইজ আউট। আ সামনস হ্যাজ কাম অ্যান্ড আই অ্যাম রেডি ফর মাই জার্নি।’) আ কেম্পিস কিংবা জন অব দ্য ক্রসের ঘোষণা, ‘অ্যান্ড বিকজ আই লাভ দিস লাইফ, আই নো আই শ্যাল লাভ ডেথ অ্যাজ ওয়েল’—এ থেকে দূরবর্তী বলেই রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলো আমাদের একান্ত অনুভূতি। রবীন্দ্রনাথের এই রচনা আমাদের বিচ্ছেদচিন্তার গভীরতাই কেবল পরিমাপ করে না। এর আগে আমরা জানতাম না যে ঈশ্বরকে আমরা ভালোবাসি, বড়জোর হয়তো তাঁকে আমরা বিশ্বাস করি; এখন আমাদের ফেলে আসা জীবনের দিকে তাকালে, বনের মাঝবরাবর সরু পথ ধরে আমাদের ভ্রমণের ভেতর, পর্বতের নিঃসঙ্গতম অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া পুলকের মধ্যে, না-পাওয়া নারীর ওপর আমাদের রহস্যময় দাবির ভেতর ঈশ্বরপ্রেমের মায়াবী মধুরতার আবেগ যেন আমরা আবিষ্কার করি। ‘তখন করি নি, নাথ, কোনো আয়োজন;/ বিশ্বের সবার সাথে, হে বিশ্বরাজন্,/ অজ্ঞাতে আসিতে হাসি আমার অন্তরে/ কত শুভদিনে; কত মুহূর্তের ’পরে/ অসীমের চিহ্ন লিখে গেছ!...’ (‘এন্টারিং মাই হার্ট আনবিডেন ইভেন অ্যাজ ওয়ান অব দ্য কমন ক্রাউড, আননোন টু মি, মাই কিং, দাউ ডিড প্রেস দ্য সিগনেট অব এটার্নিটি আপন মেনি আ ফ্লিটিং মোমেন্ট।’) এটা কোনো অন্ধকার প্রকোষ্ঠ কিংবা চাবুকের মাধ্যমে নিশ্চিত করা ধর্মের শুচিতা নয়; বরং এ যেন ধুলো কিংবা রোদের ছবি আঁকতে আঁকতে শিল্পীমনের বড় এক তীব্রতার পানে উড্ডীন হওয়া। আর এর মধ্য দিয়েই আমরা যেন সেইন্ট ফ্রান্সিস কিংবা উইলিয়াম ব্লেকের কণ্ঠস্বর নতুন করে খুঁজে পাই, যা আমাদের প্রচণ্ডতার ইতিহাসে বিরলপ্রায় হয়ে উঠেছে।
কিছু ধরাবাঁধা কাঠামোর প্রতি আস্থাশীল থেকে আমরা দীর্ঘ বইগুলো লিখে থাকি। এগুলোতে এমন একটা পৃষ্ঠাও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না যেটায় লেখাকে আনন্দের বাহন বলে মনে হয়। বইগুলো আমরা সেভাবেই লিখি, ঠিক যেভাবে আমরা যুদ্ধ করি, টাকা কামাই আর আমাদের মস্তিষ্ককে ভর্তি করে ফেলি রাজনীতিতে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সভ্যতার মতোই আত্মার আবিষ্কারেই তুষ্ট থেকেছেন এবং এর স্বতঃস্ফূর্তিতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। মাঝে মাঝেই তিনি সেসব লোকের সঙ্গে জীবনের পার্থক্য দেখান, যারা ফ্যাশনের দিকে বেশি ঝুঁকেছে, এবং জগতে যারা আপাতদৃষ্টিতে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এবং সব সময়ই রবীন্দ্রনাথ বিনয়ের সঙ্গেই বলেছেন যে তাঁর বেছে নেওয়া রাস্তাই তাঁর জন্য সবচেয়ে ভালো: ‘সবাই ঘরের পানে যাবার বেলা আমায় দেখে হাসে,/ মনে লজ্জা লাগে মোর।/ আমি বসে আছি বসনখানি টেনে মুখের ’পরে/ যেন ভিখারিনীর মতো;/ কেহ শুধায় যদি ‘কী চাও তুমি’ থাকি নিরুত্তরে/ করি দুটি নয়ন নত।’ (‘মেন গোয়িং হোম গ্লেন্স অ্যাট মি অ্যান্ড স্মাইল অ্যান্ড ফিল মি উইথ শেম। আই সিট লাইক আ বেগার মেইড, ড্রয়িং মাই স্কার্ট ওভার মাই ফেস, অ্যান্ড হোয়েন দে আস্ক মি, হোয়াট ইট ইজ আই ওয়ান্ট, আই ড্রপ মাই আইজ অ্যান্ড আনসার দেম নট।’) আরেক জায়গায় তাঁর ফেলে আসা জীবন কেমন ছিল সেটা ভেবে তিনি বলছেন, ‘মন্দ-ভালোর দ্বন্দ্বে খেটে/ গেছে তো দিন অনেক কেটে,/ অলস-বেলার খেলার সাথি/ এবার আমার হূদয় টানে। /বিনা-কাজের ডাক পড়েছে/ কেন যে তা কেই বা জানে।’ (‘মেনি অ্যান আওয়ার আই হ্যাভ স্পেন্ট ইন দ্য স্ট্রাইফ অব দ্য গুড অ্যান্ড দ্য ইভিল, বাট নাউ ইট ইজ দ্য প্লেজার অব মাই প্লেমেট অব দ্য এম্পটি ডে’জ টু ড্র মাই হার্ট অন টু হিম; অ্যান্ড আই নো নট হোয়াই দিস সাডেন কল টু হোয়াট ইউজলেস কনসিক্যুয়েন্স।’) সাহিত্যের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না এমন এক দুর্লভ সারল্য আর নির্মলভাব পাখি কিংবা গাছের পাতাকে তাঁর ততটাই কাছে নিয়ে আসে যতটা কাছে তারা শিশুদের। কখনো কখনো আমি ভাবি, তিনি এগুলো বাংলা সাহিত্য কিংবা ধর্ম থেকে পেয়েছেন কি না। আবার তাঁর ভাইয়ের হাতে এসে পাখিদের বসে থাকার কথা মনে করে ভাবি যে এটা হয়তো এক উত্তরাধিকার, যেন শতকের পর শতকজুড়ে বেড়ে উঠতে থাকা এক রহস্য, কোনো ট্রিস্টান অথবা পেলানোরের (ইংলিশ লোককথার নায়ক) সৌজন্যে। আসলেই, যখন তিনি শিশুদের কথা বলছেন, তাঁর মধ্যে এই গুণটা এত প্রবলভাবে দেখা যায়, কারও পক্ষে এ কথা বলা মুশকিল হয়ে পড়ে যে তিনি সন্তদের কথাও বলছেন না, ‘বালুকা দিয়ে বাঁধিছে ঘর,/ ঝিনুক নিয়ে খেলা।/ বিপুল নীল সলিল—’পরি/ ভাসায় তারা খেলার তরী/ আপন হাতে হেলায় গড়ি/ পাতায়-গাঁথা ভেলা।/ জগৎ-পারাবারের তীরে/ ছেলেরা করে খেলা।/ জানে না তারা সাঁতার দেওয়া,/ জানে না জাল ফেলা।/ ডুবারি ডুবে মুকুতা চেয়ে,/ বণিক ধায় তরণী বেয়ে,/ ছেলেরা নুড়ি কুড়ায়ে পেয়ে/ সাজায় বসি ঢেলা।/ রতন ধন খোঁজে না তারা,/ জানে না জাল ফেলা।’ (‘দে বিল্ড দেয়ার হাউজেস উইথ স্যান্ড অ্যান্ড দে প্লে উইথ এম্পটি শেলস। উইথ উইথার্ড লিভস দে উইভ দেয়ার বোটস অ্যান্ড স্মাইলিংলি ফ্লোট দেম অন দ্য ভাস্ট ডিপ। চিলড্রেন হ্যাভ দেয়ার প্লে অন দ্য সি শোর অব ওয়ার্ল্ডস। দে নো নট হাউ টু সুইম, দে নো নট হাউ টু কাস্ট নেটস। পার্ল ফিশার্স ডাইভ ফর পার্লস, মার্চেন্ট সেইল ইন দেয়ার শিপস, হোয়াইল চিলড্রেন গ্যাদার পিবলস্ অ্যান্ড স্কাটার দেম এগেইন। দে সিক নট ফর হিডেন ট্রেজার, দে নো নট হাউ টু কাস্ট নেটস।’ )
No comments