যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন by শাহরিয়ার কবির
একাত্তরের গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’-এ বিচারাধীন আসামিদের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষে আইনজীবীদের অদক্ষতা ও অনবধানতা সম্পর্কে বিচারপতিরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং গণমাধ্যমেও সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
অভিযুক্ত জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কাদের মোল্লা ও মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকালে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা তদন্ত সংস্থা ও সরকারপক্ষের আইনজীবীদের গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করেছেন।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায় বিভিন্ন প্রশ্নে রাষ্ট্রপক্ষের জবাবে ট্রাইব্যুনালের অসন্তোষ সম্পর্কে ১৬ মার্চ (২০১২) প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যুক্তি উপস্থাপনকালে বিভিন্ন প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল বুধবার বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ অসন্তোষ জানান।’
জামায়াত-সমর্থিত পত্রিকায় প্রসিকিউশনের এই ব্যর্থতার সংবাদ ফলাও করে ছাপা হয়েছে। এর আগে সাঈদীর বিরুদ্ধে এবং পরে নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকালে ট্রাইব্যুনাল অনুরূপ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং তদন্ত সংস্থা ও আইনজীবী নিয়োগের পর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে একাত্তরের গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে অতীতে আমরা যা তদন্ত করেছি, প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের জবানবন্দি যা নথিবদ্ধ করেছি এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে যা সংগ্রহ করেছি, তা আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছি। এর পাশাপাশি ১৩ খণ্ডে সংকলিত নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল, টোকিও ট্রাইব্যুনাল ও ম্যানিলা ট্রাইব্যুনালের গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র, মামলার বিবরণ, এ ধরনের বিচারের ক্ষেত্রে সমস্যা ও জটিলতা আমাদের পূর্বসূরিরা কীভাবে মোকাবিলা করেছেন, সেসব অভিজ্ঞতার বিবরণ যা আমাদের সংগ্রহে ছিল, তা-ও দিয়েছি। নির্মূল কমিটি ছাড়া আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অনুরূপ দলিলপত্র ট্রাইব্যুনালকে প্রদান করেছে। আমরা তখন বিজ্ঞ আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেছিলাম, নির্মূল কমিটি বা অন্যরা যেসব দলিলপত্র দিয়েছে, সব একাধিক সূত্র থেকে যাচাই করে এবং সেই সব সূত্র অনুযায়ী নতুনভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে তাঁরা যেন অভিযোগ প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। অভিযুক্ত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগনামার শুনানি থেকে জানা গেল, আমরা যা দিয়েছিলাম, কোনো রকম যাচাই না করেই তদন্ত সংস্থা ও সরকারি আইনজীবীরা তা আদালতে জমা দিয়েছেন।
আমরা বহুবার বলেছি, অন্যান্য দেশে এ ধরনের অপরাধের যেসব বিচার হয়েছে, তার সঙ্গে আমাদের বিচারের অনেক পার্থক্য আছে। আমরা যুদ্ধকালীন এসব অপরাধের বিচার করছি অপরাধ সংঘটনের প্রায় ৪০ বছর পর। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বহু যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করা হয়েছিল, কয়েক হাজার অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ৭৩টি ট্রাইব্যুনালে মামলার শুনানি শুরু হয়েছিল, ৭৫২ জনকে বিচারের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করাও হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে দালাল আইন বাতিল করে এই বিচার-প্রক্রিয়া বন্ধ করে, সংবিধান সংশোধন করে তাঁদের রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
১৯৯৩ সালে বরেণ্য কবি সুফিয়া কামালকে চেয়ারপারসন করে ১২ সদস্যের ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন’ গঠিত হয়েছিল মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান করে একাত্তরের ঘাতক দালালদের যুদ্ধকালীন অপরাধের তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য। বর্তমানে যে আটজন অভিযুক্ত বিচারাধীন আছেন, তাঁদের সবার সম্পর্কেই গণতদন্ত কমিশনের সচিবালয়ের তরুণ কর্মীরা তৃণমূল পর্যায়ে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৯৪-৯৫ সালে কমিশন দুই দফায় গোলাম আযম ছাড়া ১৫ জন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কেউ তখন মন্ত্রী, কেউ সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। যাঁরা কমিশনে তাঁদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তাঁদের কাউকে উৎকোচ প্রদান করে, কাউকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে মুখ বন্ধ করিয়েছিলেন। ১৯৯৭-৯৮ সালে কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে একাত্তরের গণহত্যা এবং গণহত্যাকারীদের বিচার সম্পর্কে ক্রাই ফর জাস্টিস (আর কত দিন) নামের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সময়ও আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যাঁরা ১৯৯৪ সালে কমিশনের কাছে জবানবন্দি প্রদান করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ চার বছরের ব্যবধানে সাক্ষ্য-প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন। ২০০৬ সালে যুদ্ধাপরাধ ৭১ নামক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সময় দেখেছি, কয়েকজন ১০ বছর আগে যা বলেছেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জামায়াত-বিএনপির শাসনকাল প্রত্যক্ষ করে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদানে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। একাত্তরের গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত-বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিচারের সময় এই বাস্তবতা ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের ভুলে গেলে চলবে না।
আমরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের বলেছি, সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য আইন তৈরি করতে হবে। এই মামলার ৯৫ শতাংশ সাক্ষী প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষ। তাঁদের দৈহিক, পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ষোলোআনা নিশ্চিত করা না হলে কোন ভরসায় তাঁরা সাক্ষ্য দেবেন? সাঈদীর মামলায় সাক্ষীদের অনুপস্থিতি এবং প্রতিপক্ষের জেরার সামনে ভয় পাওয়া থেকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের টনক কি নড়বে না?
সাঈদীর মামলায় কী কারণে ৬৫ জন সাক্ষী লাগবে, এটাও আমাদের বোধগম্যের বাইরে। জামায়াতের প্রধান গোলাম আযমের অপরাধের সাক্ষী খোঁজার জন্য তদন্ত সংস্থার সদস্য ও আইনজীবীরা নবীনগর উপজেলা চষে বেড়িয়েছেন, যেখানে অভিযুক্তের গ্রামের বাড়ি। গোলাম আযমের আইনজীবীরা বলছেন, একাত্তরে আসামি এক দিনের জন্যও নবীনগরে যাননি। সরকারপক্ষের আইনজীবী ও তদন্ত সংস্থা এখনো ১৪০ বছরের পুরোনো ‘সাক্ষ্য আইন’-এর বেড়াজাল থেকে বেরোতে পারেননি, যদিও ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩’-এ পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, এই আইন সনাতন সাক্ষ্য আইনের বিধিসমূহ অনুসরণ করবে না। মূলত সাক্ষ্য আইনের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার জন্য ১৯৭৩-এর আইনে সাক্ষী হিসেবে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, আলোকচিত্র ইত্যাদি গুরুত্ব পেয়েছে, এ ধরনের মামলায় যে নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে।
এ কথা আমরা ২০ বছর ধরে বলছি, একাত্তরের গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের মামলায় ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনকেও অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। একাত্তরের ঘাতক দালালদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ঘাতক বাহিনী ‘রাজাকার’ ও ‘আলবদর’ বাহিনীকে যদি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান সহযোগী হিসেবে বিচার না করা হয়, তাহলে চলমান বিচার প্রহসনে পরিণত হবে। একাত্তরের গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, গৃহে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও জনপদ ধ্বংসের উদ্দেশ্য বা ‘মোটিভ’ ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধকালীন এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজনৈতিক লক্ষ্যে। জামায়াতের রাজনীতি তথা মওদুদিবাদ একাত্তরের গণহত্যা, নারী ধর্ষণসহ যাবতীয় অপরাধকে বৈধতা দিয়েছে, অপরাধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে এবং অপরাধ সংঘটনে দলের ও বাহিনীর সদস্যদের প্রবৃত্ত করেছে। একাত্তরের গণহত্যা ও নির্যাতনের ৯৯ শতাংশ ভুক্তভোগী কোনো ব্যক্তির নাম জানেন না; তাঁরা জানেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, জামায়াত-মুসলিম লীগ-নেজামে ইসলামের নেতা-কর্মীরা এবং রাজাকার-আলবদররা তাঁদের সর্বনাশের জন্য দায়ী। এই বিবেচনা থেকেই নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে প্রথম দফায় ২৪ জন ব্যক্তির পাশাপাশি ‘নাৎসি পার্টি’, ‘রাইখস মন্ত্রিসভা’, ‘গেস্টাপো’, ‘এসএস’, ‘এসএ’, ‘এসডি’ প্রভৃতি বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানের বিচার হয়েছিল। পর্যাপ্ত রসদ ছিল বলেই নুরেমবার্গের প্রথম ট্রাইব্যুনালে ২৪ জনের বিচার ও শাস্তি ১০ মাসে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল।
আমরা ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে থেকে বলছি, প্রথম দফায় সাত-আটজনের বিচার করার জন্য কমপক্ষে ২৫ জন দক্ষ, সৎ ও সার্বক্ষণিক আইনজীবী, সমসংখ্যক তদন্ত কর্মকর্তা এবং অন্যান্য শাখায় পর্যাপ্তসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রয়োজন হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মাথায় সর্বক্ষণ ফৌজদারি আইনে বিচারের অভিজ্ঞতা ঘুরপাক খাচ্ছে বলে তাঁরা বুঝতে পারছেন না, কেন আমরা বারবার দক্ষ আইনজীবীর সংখ্যা বাড়াতে বলছি, কেন বলছি গবেষণা সেল, আর্কাইভ, মিডিয়া সেল, আইটি সেল ইত্যাদি দরকার। দুই সপ্তাহ আগে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ট্রাইব্যুনালের হাল-অবস্থা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, আইনজীবী ও তদন্ত সংস্থার কাজের নমুনা দেখে মনে হচ্ছে, সেখানে অতিরঞ্জিত কিছুই বলা হয়নি। এ বিষয়ে ১০ মার্চ (২০১২) ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত, বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর বা আইনজীবীদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা বর্তমান প্রসিকিউশনের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা এ কথা উল্লেখ করে আইনজীবী প্যানেল শক্তিশালী করতে কিছু সুপারিশসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে।’
‘প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তার উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—অভিযুক্তদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে অবিলম্বে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করে প্রচুরসংখ্যক সরকারদলীয় দক্ষ, সৎ এবং এ কাজের সঙ্গে জড়িত এমন অভিজ্ঞ আইনজীবীদের আইন কর্মকর্তা নিয়োগের পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের জনবল বাড়াতে হবে।’
দেশে-বিদেশে সব গণমাধ্যম ও বিভিন্ন ফোরামে একটি প্রশ্নই বারবার শুনতে হয়, বিচারের কার্যক্রম যেভাবে চলছে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট কি না। ২০১৩ সালের ভেতর শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হবে কি না। ট্রাইব্যুনালের সরকারি আইনজীবীদের কাজের যে নমুনা দেখছি, তাতে আমরা মোটেও সন্তুষ্ট নই। এ কথা বহুবার বলেছি, সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা যদি মনে করেন, তাঁরা যেনতেনভাবে একটা কিছু দাঁড় করিয়ে দিলেই বিচারকেরা সবাইকে ফাঁসিতে ঝোলাবেন, তাহলে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল যে কঠোর নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেছেন, তা থেকে সরকারি আইনজীবীদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। এই মামলা পরিচালনায় যেকোনো অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, সরকারের সদিচ্ছাকে জনতার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘ্নিত ও বানচাল করার জন্য জামায়াত ও তাদের সহযোগীরা মরিয়া হয়ে উঠেছে, দেশে-বিদেশে বহুমাত্রিক তৎপরতা চালাচ্ছে—এ কথা আমরা জানি। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব—জামায়াত ও তাদের অনুগত জঙ্গিরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, এমনটি ভাবার কারণ নেই। ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের আইনজীবীদের প্রধান কৌশল হচ্ছে কারণে-অকারণে কালক্ষেপণ। অন্যদিকে সরকারপক্ষের আইনজীবীরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা ও অনভিজ্ঞতা স্বীকার করছেন না। অভিজ্ঞদের পরামর্শ ও সহযোগিতার প্রয়োজন বোধ করছেন না। এই ব্যর্থতার দায় কে বহন করবে? প্রায় প্রতিদিন, প্রতিটি জনসভায় মন্ত্রীদের হুংকার শুনি—যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তাঁরা করবেনই, কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমরা তা বিশ্বাস করতে চাই বলেই আবারও বলছি, যত দ্রুত সম্ভব ট্রাইব্যুনালের ঘাটতিগুলো পূরণ করুন। দ্রুত ও সুষ্ঠু বিচারই পারে ঘরে-বাইরে বিচার বানচালের যাবতীয় চক্রান্ত বানচাল করতে।
শাহরিয়ার কবির: লেখক ও সাংবাদিক, কার্যকরী সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায় বিভিন্ন প্রশ্নে রাষ্ট্রপক্ষের জবাবে ট্রাইব্যুনালের অসন্তোষ সম্পর্কে ১৬ মার্চ (২০১২) প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যুক্তি উপস্থাপনকালে বিভিন্ন প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল বুধবার বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ অসন্তোষ জানান।’
জামায়াত-সমর্থিত পত্রিকায় প্রসিকিউশনের এই ব্যর্থতার সংবাদ ফলাও করে ছাপা হয়েছে। এর আগে সাঈদীর বিরুদ্ধে এবং পরে নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকালে ট্রাইব্যুনাল অনুরূপ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং তদন্ত সংস্থা ও আইনজীবী নিয়োগের পর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে একাত্তরের গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে অতীতে আমরা যা তদন্ত করেছি, প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের জবানবন্দি যা নথিবদ্ধ করেছি এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে যা সংগ্রহ করেছি, তা আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছি। এর পাশাপাশি ১৩ খণ্ডে সংকলিত নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল, টোকিও ট্রাইব্যুনাল ও ম্যানিলা ট্রাইব্যুনালের গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র, মামলার বিবরণ, এ ধরনের বিচারের ক্ষেত্রে সমস্যা ও জটিলতা আমাদের পূর্বসূরিরা কীভাবে মোকাবিলা করেছেন, সেসব অভিজ্ঞতার বিবরণ যা আমাদের সংগ্রহে ছিল, তা-ও দিয়েছি। নির্মূল কমিটি ছাড়া আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অনুরূপ দলিলপত্র ট্রাইব্যুনালকে প্রদান করেছে। আমরা তখন বিজ্ঞ আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেছিলাম, নির্মূল কমিটি বা অন্যরা যেসব দলিলপত্র দিয়েছে, সব একাধিক সূত্র থেকে যাচাই করে এবং সেই সব সূত্র অনুযায়ী নতুনভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে তাঁরা যেন অভিযোগ প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। অভিযুক্ত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগনামার শুনানি থেকে জানা গেল, আমরা যা দিয়েছিলাম, কোনো রকম যাচাই না করেই তদন্ত সংস্থা ও সরকারি আইনজীবীরা তা আদালতে জমা দিয়েছেন।
আমরা বহুবার বলেছি, অন্যান্য দেশে এ ধরনের অপরাধের যেসব বিচার হয়েছে, তার সঙ্গে আমাদের বিচারের অনেক পার্থক্য আছে। আমরা যুদ্ধকালীন এসব অপরাধের বিচার করছি অপরাধ সংঘটনের প্রায় ৪০ বছর পর। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বহু যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করা হয়েছিল, কয়েক হাজার অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ৭৩টি ট্রাইব্যুনালে মামলার শুনানি শুরু হয়েছিল, ৭৫২ জনকে বিচারের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করাও হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে দালাল আইন বাতিল করে এই বিচার-প্রক্রিয়া বন্ধ করে, সংবিধান সংশোধন করে তাঁদের রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
১৯৯৩ সালে বরেণ্য কবি সুফিয়া কামালকে চেয়ারপারসন করে ১২ সদস্যের ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন’ গঠিত হয়েছিল মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান করে একাত্তরের ঘাতক দালালদের যুদ্ধকালীন অপরাধের তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য। বর্তমানে যে আটজন অভিযুক্ত বিচারাধীন আছেন, তাঁদের সবার সম্পর্কেই গণতদন্ত কমিশনের সচিবালয়ের তরুণ কর্মীরা তৃণমূল পর্যায়ে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৯৪-৯৫ সালে কমিশন দুই দফায় গোলাম আযম ছাড়া ১৫ জন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কেউ তখন মন্ত্রী, কেউ সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। যাঁরা কমিশনে তাঁদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তাঁদের কাউকে উৎকোচ প্রদান করে, কাউকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে মুখ বন্ধ করিয়েছিলেন। ১৯৯৭-৯৮ সালে কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে একাত্তরের গণহত্যা এবং গণহত্যাকারীদের বিচার সম্পর্কে ক্রাই ফর জাস্টিস (আর কত দিন) নামের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সময়ও আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যাঁরা ১৯৯৪ সালে কমিশনের কাছে জবানবন্দি প্রদান করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ চার বছরের ব্যবধানে সাক্ষ্য-প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন। ২০০৬ সালে যুদ্ধাপরাধ ৭১ নামক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সময় দেখেছি, কয়েকজন ১০ বছর আগে যা বলেছেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জামায়াত-বিএনপির শাসনকাল প্রত্যক্ষ করে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদানে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। একাত্তরের গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত-বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিচারের সময় এই বাস্তবতা ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের ভুলে গেলে চলবে না।
আমরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের বলেছি, সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য আইন তৈরি করতে হবে। এই মামলার ৯৫ শতাংশ সাক্ষী প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষ। তাঁদের দৈহিক, পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ষোলোআনা নিশ্চিত করা না হলে কোন ভরসায় তাঁরা সাক্ষ্য দেবেন? সাঈদীর মামলায় সাক্ষীদের অনুপস্থিতি এবং প্রতিপক্ষের জেরার সামনে ভয় পাওয়া থেকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের টনক কি নড়বে না?
সাঈদীর মামলায় কী কারণে ৬৫ জন সাক্ষী লাগবে, এটাও আমাদের বোধগম্যের বাইরে। জামায়াতের প্রধান গোলাম আযমের অপরাধের সাক্ষী খোঁজার জন্য তদন্ত সংস্থার সদস্য ও আইনজীবীরা নবীনগর উপজেলা চষে বেড়িয়েছেন, যেখানে অভিযুক্তের গ্রামের বাড়ি। গোলাম আযমের আইনজীবীরা বলছেন, একাত্তরে আসামি এক দিনের জন্যও নবীনগরে যাননি। সরকারপক্ষের আইনজীবী ও তদন্ত সংস্থা এখনো ১৪০ বছরের পুরোনো ‘সাক্ষ্য আইন’-এর বেড়াজাল থেকে বেরোতে পারেননি, যদিও ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩’-এ পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, এই আইন সনাতন সাক্ষ্য আইনের বিধিসমূহ অনুসরণ করবে না। মূলত সাক্ষ্য আইনের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার জন্য ১৯৭৩-এর আইনে সাক্ষী হিসেবে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, আলোকচিত্র ইত্যাদি গুরুত্ব পেয়েছে, এ ধরনের মামলায় যে নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে।
এ কথা আমরা ২০ বছর ধরে বলছি, একাত্তরের গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের মামলায় ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনকেও অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। একাত্তরের ঘাতক দালালদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ঘাতক বাহিনী ‘রাজাকার’ ও ‘আলবদর’ বাহিনীকে যদি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান সহযোগী হিসেবে বিচার না করা হয়, তাহলে চলমান বিচার প্রহসনে পরিণত হবে। একাত্তরের গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, গৃহে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও জনপদ ধ্বংসের উদ্দেশ্য বা ‘মোটিভ’ ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধকালীন এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজনৈতিক লক্ষ্যে। জামায়াতের রাজনীতি তথা মওদুদিবাদ একাত্তরের গণহত্যা, নারী ধর্ষণসহ যাবতীয় অপরাধকে বৈধতা দিয়েছে, অপরাধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে এবং অপরাধ সংঘটনে দলের ও বাহিনীর সদস্যদের প্রবৃত্ত করেছে। একাত্তরের গণহত্যা ও নির্যাতনের ৯৯ শতাংশ ভুক্তভোগী কোনো ব্যক্তির নাম জানেন না; তাঁরা জানেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, জামায়াত-মুসলিম লীগ-নেজামে ইসলামের নেতা-কর্মীরা এবং রাজাকার-আলবদররা তাঁদের সর্বনাশের জন্য দায়ী। এই বিবেচনা থেকেই নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে প্রথম দফায় ২৪ জন ব্যক্তির পাশাপাশি ‘নাৎসি পার্টি’, ‘রাইখস মন্ত্রিসভা’, ‘গেস্টাপো’, ‘এসএস’, ‘এসএ’, ‘এসডি’ প্রভৃতি বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানের বিচার হয়েছিল। পর্যাপ্ত রসদ ছিল বলেই নুরেমবার্গের প্রথম ট্রাইব্যুনালে ২৪ জনের বিচার ও শাস্তি ১০ মাসে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল।
আমরা ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে থেকে বলছি, প্রথম দফায় সাত-আটজনের বিচার করার জন্য কমপক্ষে ২৫ জন দক্ষ, সৎ ও সার্বক্ষণিক আইনজীবী, সমসংখ্যক তদন্ত কর্মকর্তা এবং অন্যান্য শাখায় পর্যাপ্তসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রয়োজন হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মাথায় সর্বক্ষণ ফৌজদারি আইনে বিচারের অভিজ্ঞতা ঘুরপাক খাচ্ছে বলে তাঁরা বুঝতে পারছেন না, কেন আমরা বারবার দক্ষ আইনজীবীর সংখ্যা বাড়াতে বলছি, কেন বলছি গবেষণা সেল, আর্কাইভ, মিডিয়া সেল, আইটি সেল ইত্যাদি দরকার। দুই সপ্তাহ আগে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ট্রাইব্যুনালের হাল-অবস্থা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, আইনজীবী ও তদন্ত সংস্থার কাজের নমুনা দেখে মনে হচ্ছে, সেখানে অতিরঞ্জিত কিছুই বলা হয়নি। এ বিষয়ে ১০ মার্চ (২০১২) ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত, বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর বা আইনজীবীদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা বর্তমান প্রসিকিউশনের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা এ কথা উল্লেখ করে আইনজীবী প্যানেল শক্তিশালী করতে কিছু সুপারিশসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে।’
‘প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তার উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—অভিযুক্তদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে অবিলম্বে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করে প্রচুরসংখ্যক সরকারদলীয় দক্ষ, সৎ এবং এ কাজের সঙ্গে জড়িত এমন অভিজ্ঞ আইনজীবীদের আইন কর্মকর্তা নিয়োগের পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের জনবল বাড়াতে হবে।’
দেশে-বিদেশে সব গণমাধ্যম ও বিভিন্ন ফোরামে একটি প্রশ্নই বারবার শুনতে হয়, বিচারের কার্যক্রম যেভাবে চলছে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট কি না। ২০১৩ সালের ভেতর শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হবে কি না। ট্রাইব্যুনালের সরকারি আইনজীবীদের কাজের যে নমুনা দেখছি, তাতে আমরা মোটেও সন্তুষ্ট নই। এ কথা বহুবার বলেছি, সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা যদি মনে করেন, তাঁরা যেনতেনভাবে একটা কিছু দাঁড় করিয়ে দিলেই বিচারকেরা সবাইকে ফাঁসিতে ঝোলাবেন, তাহলে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল যে কঠোর নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেছেন, তা থেকে সরকারি আইনজীবীদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। এই মামলা পরিচালনায় যেকোনো অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, সরকারের সদিচ্ছাকে জনতার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘ্নিত ও বানচাল করার জন্য জামায়াত ও তাদের সহযোগীরা মরিয়া হয়ে উঠেছে, দেশে-বিদেশে বহুমাত্রিক তৎপরতা চালাচ্ছে—এ কথা আমরা জানি। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব—জামায়াত ও তাদের অনুগত জঙ্গিরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, এমনটি ভাবার কারণ নেই। ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের আইনজীবীদের প্রধান কৌশল হচ্ছে কারণে-অকারণে কালক্ষেপণ। অন্যদিকে সরকারপক্ষের আইনজীবীরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা ও অনভিজ্ঞতা স্বীকার করছেন না। অভিজ্ঞদের পরামর্শ ও সহযোগিতার প্রয়োজন বোধ করছেন না। এই ব্যর্থতার দায় কে বহন করবে? প্রায় প্রতিদিন, প্রতিটি জনসভায় মন্ত্রীদের হুংকার শুনি—যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তাঁরা করবেনই, কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমরা তা বিশ্বাস করতে চাই বলেই আবারও বলছি, যত দ্রুত সম্ভব ট্রাইব্যুনালের ঘাটতিগুলো পূরণ করুন। দ্রুত ও সুষ্ঠু বিচারই পারে ঘরে-বাইরে বিচার বানচালের যাবতীয় চক্রান্ত বানচাল করতে।
শাহরিয়ার কবির: লেখক ও সাংবাদিক, কার্যকরী সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
No comments