সময়ের কাছে ইতিহাসের দাবি by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ইতিহাসকে মনে করা হয় অতীতের ব্যাপার; তা ইতিহাস অতীতকে নিয়ে কাজ করে বৈকি, তাকে অতীতের সংরক্ষণশালাও বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ইতিহাস আবার সমসাময়িকও বটে। দুই কারণে। একটি হচ্ছে অতীত ইতিহাসের বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা, যাকে বলা হয় ইতিহাসের শিক্ষা। ইতিহাসের শিক্ষা অবশ্য লোকে সাধারণত নিতে চায় না।


বিশেষ করে এ ব্যাপারে তাদের খুব অনীহা যারা ক্ষমতাধর। তারা ভাবে ইতিহাসের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে গেলে তাদের ক্ষতি হবে, তা ছাড়া তারা কোন শিক্ষা নেবে, তারা তো শিক্ষা দেবে এবং ইতিহাস সৃষ্টি করে রেখে যাবে অন্যদের জন্য। ইতিহাসকে সমসাময়িক মনে করার দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে এই যে ইতিহাস বর্তমানের মধ্য থেকেই তৈরি হচ্ছে এবং বর্তমানের ভেতর যেমন অতীত রয়েছে, রয়েছে তেমনি ভবিষ্যৎও। অতীতকে যে আমরা ব্যাখ্যা করি সেটা বর্তমানের আলোকেই এবং বর্তমান প্রভাবিত হয় অতীতের দ্বারা, অতীত থেকে বর্তমানকে যে বিচ্ছিন্ন করা যাবে_এটা মোটেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে আজ যেটা বর্তমান আগামীকালই তা ইতিহাসে পরিণত হয়ে যাবে।
ইতিহাস তাই যেমন সমসাময়িক তেমনি চলমান। তার চলার পথে পুনরাবৃত্তি নেই, তাকে এগোতে হয় আঁকাবাঁকা পথ ধরে, নানা ধরনের দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে। মানুষই ইতিহাস সৃষ্টি করে, তবে কাজটা তাকে করতে হয় ইতিহাসের ভেতরে থেকেই।
আর ইতিহাসের ভেতরেও তো দর্শন থাকে, আবার দর্শনের সৃষ্টি হয় ইতিহাসের অন্তর্গত অবস্থানে থেকেই, যে জন্য যতই সর্বজনীন হোক দর্শনের অবয়বে ও আচরণে ইতিহাসের উপস্থিতি অমোঘ এক বাস্তবতা। ইতিহাস কোনো এক ব্যক্তির সৃষ্টি নয়, যদিও ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা অবশ্যই থাকে। অনেক মানুষ একসঙ্গে হলে তবেই ইতিহাস তৈরি হয় এবং সেই নির্মাণের পেছনে একটি দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই থাকে। ইতিহাস মানেই সমকালীন ইতিহাস, এটা কোনো কথার কথা নয়, বাস্তবিক সত্য বটে। বর্তমানের ভেতরে অতীত রয়েছে, যেমন অতীতের ভেতর ছিল সেকালের বর্তমান। এই যে থাকা এটা দার্শনিকভাবেই থাকা। আর ওই দার্শনিকতাটা হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার।
খুবই পরিচিত একটি দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। ধরা যাক মিসরের পিরামিড ও মমির কথা। এরা বিস্ময়কর সৃষ্টি বটে। কিন্তু এদের সৃষ্টির পেছনে একটি সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই কাজ করছিল। সেটা হলো এই যে জীবনের চেয়ে মৃত্যুর ক্ষমতা অধিক, মৃতকে তাই জীবিত রাখা চাই। এর বিপরীতে গ্রিকদের ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকে যদি বিবেচনা করি, তাহলে দেখব সেখানে নিয়ামক দার্শনিকতাটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। গ্রিকরা মনে করত মৃত্যুর যতই ক্ষমতা থাক, জীবনই বড়; যে জন্য জীবিতকেই জীবন্ত রাখা প্রয়োজন, মৃতকে জীবিত করার পরিবর্তে। দুটি দুই ভিন্ন সভ্যতা, তাদের জীবনদর্শন আলাদা, যে জন্য তাদের ইতিহাসও ভিন্ন প্রকৃতির।
ইতিহাস সৃষ্টিতে মানুষের ভূমিকা সম্পর্কে খুবই পরিচ্ছন্ন ও গ্রহণযোগ্য একটি বক্তব্য আছে কার্ল মার্কসের The Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte বইতে, যেখানে তিনি বলেছেন, 'Man make their won history,but they do no make it just at they please;they do not make it under circumstances chosen by themselves,but under circumstances directly encountered, given and transmitted from the past. The tradition of all the dead generations weighs like a nightmare on the brain of living.
এখানে যে দুটি বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে তার একটির তাৎপর্য হলো মানুষ নিজেই তার ইতিহাস তৈরি করে, কিন্তু এই ইতিহাস তাকে তৈরি করতে হয় ইতিহাসের ভেতরে থেকেই, তার বাইরে যে যাবে এমন কোনো উপায় নেই। সে জন্য মানুষকে যা করতে হয় তা হলো বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া। ওই দ্বন্দ্বের মধ্য থেকেই ইতিহাসের অগ্রগতি ঘটে। অন্য বক্তব্যটি হচ্ছে, মৃত মানুষদের অতীত ঐতিহ্য জীবন্ত মানুষদের মস্তিষ্কে দুঃস্বপ্নের মতো চেপে বসে থাকে। ঐতিহ্য মানেই যে অগ্রগতির প্রতিবন্ধক মার্কস তা বলছেন না, বলছেন ঐতিহ্যের সেই অংশের কথাই যা বোঝার মতো চেপে বসে এবং ইতিহাসকে এগোতে দেয় না।
এই ব্যাপারটা যে কত বড় সত্য তা আমরা আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে তাকালেই বিলক্ষণ বুঝতে পারি। ধরা যাক, আমাদের রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রবর্তনের বিষয়টা। যে জাতীয়তাবাদের ধারণার ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক সংগ্রামের রূপ নিয়েছিল তার প্রধান ভিত্তিগুলোর একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। অথচ যুদ্ধজয়ের পর জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতারা তো বটেই; অগ্রসর চিন্তার কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীকেও দেখেছি ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে রাষ্ট্রের যে নিজস্ব কোনো ধর্ম থাকবে না সেটা না-বুঝিয়ে উল্টো বোঝাতে চেয়েছেন রাষ্ট্র সব ধর্মকে সমান মর্যাদা দেবে, অর্থাৎ এখানেও অতীত আক্রমণ করেছে বর্তমানকে। যার ফলে রাজনীতিকে ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার অতীত ঐতিহ্যটিকে পরিত্যাগ করা সম্ভব হয়নি। সেই ব্যর্থতা সাহায্য করেছে রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করার নানা ধরনের ব্যবসায়ী তৎপরতাকে সক্রিয় হতে। যা ছিল পাকিস্তান আমলেও অকল্পনীয় সে ধরনের তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে এবং পশ্চিমারা বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র না বলে মডারেট মুসলিম স্টেট বলে অভিহিত করে রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণীকে সশব্দে পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে।
ইতিহাস-ঐতিহ্যের ভূমিকা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে আরেকজন ইতিহাস সচেতন বিজ্ঞ ব্যক্তির কাছে। ইনি হচ্ছেন অ্যাডমন্ড বার্ক। ফরাসি বিপ্লবের ঠিক পরের বছরে লেখা �Reflections on the Revolution in France� বইতে তিনি গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন যে তাঁরা অর্থাৎ ব্রিটেনের লোকেরা instead of casting away all our old prejudices we cherish them to a very considerable degree, and to make more shame to ourselves, we cherish them because they are prejudices.
অনেকটা ব্যবসায়ীদের মতো করে তিনি বলছেন যে তাঁরা চান না যে ব্যক্তি নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে থাকুক, কেননা'We are afraid to put them to live and trade each on his own private stock of reason; because we suspect that the stock in each man is small, and that the invividuals woud do better to avail own history, but they do not make it just as they please; they do not make it under circumstances chosen by themselves, but under circumstances directly encountered, given and transmitted from the past. The tradition of all the dead generations weighs like the nightmare on the brain of the living�.
এই যে জাতিগত ভ্রান্ত ধারণার( Prejudices ) কাছের ফেরত যাওয়ার চেষ্টা এর ব্যাখ্যাও সমসাময়িক ইতিহাসের প্রতি বার্কের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পাওয়া যাবে। বার্ক উদারনীতিক ছিলেন, যে জন্য তিনি আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের এবং ভারতের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের ইমপিচমেন্টের সমর্থক ছিলেন; কিন্তু যখন ইংলিশ চ্যানেলের অপর পাড়ে, ফ্রান্সে একটি সামাজিক বিপ্লব ঘটে গেছে তখন তার উদারনীতিতে আর কুলালো না। তিনি তাঁর আইরিশত্ব ভুলে ইংরেজ হয়ে গেলেন এবং ইংল্যান্ডে যাতে কোনো বিপ্লব না ঘটে সে জন্য সবাইকে পরামর্শ দিতে থাকলেন পুরনো ঐতিহ্যকে সবলে আঁকড়ে ধরার। মার্কস যেখানে সামাজিক বিপ্লব কিভাবে ঘটানো যায় সেই চিন্তায় অস্থির ছিলেন এবং সে কারণে ঐতিহ্যের দুঃস্বাপি্নক বোঝাকে ঝেড়ে ফেলার পক্ষপাতী হয়ে উঠেছিলেন, বার্ক সেখানে বিপ্লবকে কিভাবে প্রতিহত করা যায় সেই ভাবনায় প্রায় দিশেহারা হয়ে ফিরে যেতে চাইলেন ঐতিহ্যের কাছে। বললেন, ব্যক্তিকে নিজের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর নির্ভর করতে বলাটা ভুল হবে, বরঞ্চ তাকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে জাতিগত ঐতিহ্যের সদ্ব্যবহারের কাজে। জাতীয়তাবাদীরা যে সাধারণত সমাজ বিপ্লবের প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করে তার প্রমাণ বার্কের দৃষ্টিভঙ্গিতে রয়েছে। যেমন রয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে।
ইতিহাসের চলমানতাকে স্তব্ধ করে দিতে পুঁজিবাদীরাও আগ্রহী বটে। যে জন্য আমরা দেখি যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রচার করা হয়েছিল যে ইতিহাসের পক্ষে আর এগোনোর প্রয়োজন নেই, কেননা সে তার গন্তব্যে, বলা যায় স্বর্গে, সশরীরে পেঁৗছে গেছে। ওই স্বর্গ যে নরকেরই অপর নাম সেটা অবশ্য এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে। আধুনিক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের আগে মানুষের সমাজে নিরাপত্তা বলে কিছু ছিল না। কেননা সে অবস্থায় প্রত্যেকে ছিল প্রত্যেকের বিরুদ্ধে এবং সবাই ছিল প্রত্যেকের বিরুদ্ধে; দার্শনিক হবসের মতে, সে অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্যই মানুষ একদা রাষ্ট্র গঠন করেছিল। পরে রাষ্ট্র কী করে রক্ষক না হয়ে পীড়নকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, তার খবরও ইতিহাসেই লেখা হয়েছে। এখন রাষ্ট্রের চেয়েও অধিক শক্তিশালী হচ্ছে পুঁজি এবং পুঁজির দুঃশাসনের অধিকাংশ মানুষের জীবনে আবার সেই আদিম নৈরাজ্য ফিরে এসেছে। পুঁজিবাদ মানুষকে অসামাজিক প্রাণীতে পরিণত করে ছেড়েছে। পরস্পর বিচ্ছিন্নতা ক্রমেই বাড়ছে এবং ব্যক্তির সামাজিক সত্তাটি পর্যুদস্ত হচ্ছে।
সামাজিকতার মধ্যেই মানুষের মনুষ্যত্ব নিহিত রয়েছে। সামাজিক না হলে মানুষ তো বন্য প্রাণী মাত্র। আর মানুষের যে বুদ্ধিবৃত্তি ও সৃষ্টিশীলতা সেটাও সামাজিকভাবেই বিকশিত হয়, নইলে নয়। আজ তাই মানুষকে সামাজিক করে তোলাটাই হচ্ছে সময়ের দাবি। সেই কাজের জন্য যে সামাজিক বিপ্লবের আশঙ্কায় বার্ক অমনভাবে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন সেই বিপ্লবেরই দরকার হবে। কিন্তু কেবল সামাজিক বিপ্লবের যে সামাজিকতা সৃষ্টির লক্ষ্য অর্জিত হয়ে যাবে তা নয়, সামাজিকভাবে গভীর ও বিস্তৃত করার জন্য প্রয়োজন হবে সাংস্কৃতিক জাগরণের। একটি সমর্থন ও সাহায্য করবে অপরটিকে।
তথাকথিত বঙ্গীয় রেনেসাঁসের কালে দুজন বিশেষ ব্যক্তিকে আমরা পাই, সমসাময়িক এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যাঁদের বিশেষ ধরনের অবদান রয়েছে, তাঁদের একজন হচ্ছেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), অপরজন ফকির লালন শাহ (১৭৭২-১৮৯০)। একই বছরে জন্ম, কিন্তু দুজনের মধ্যে কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে এমনটা জানা যায় না। হওয়ার কথা নয়। কেননা একজন রাজধানী কলকাতার, অপরজন মফস্বলের কুষ্টিয়ার। একজনের উপাধি রাজা, অপরজনের ফকির। কিন্তু দুজনেই মাতৃভাষার চর্চা করেছেন। রামমোহন আধুনিক বাংলা গদ্যের স্রষ্টাদের একজন। সে অর্থে লালন নতুন কোনো ভাষারীতি সৃষ্টি করেননি ঠিকই, কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাষাকে গানের মাধ্যমে দার্শনিক চিন্তায় সৃমদ্ধ করে তুলেছেন। রামমোহনের ছিল আন্তর্জাতিকতা ও নতুন জ্ঞানের আহরণ; লালনের চিন্তা গভীর ও সর্বজনীন বটে; কিন্তু আবার স্থানীয়ও। ওদিকে আবার রামমোহনের ভাষায় যে কৃত্রিমতা আছে লালনের ভাষায় তা নেই, লালন খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। সংস্কৃতির জন্য খুবই উপকারী হতো রাজা ও ফকির যদি মিলতে পারতেন। রামমোহন তাঁর আন্তর্জাতিকতা সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক শাসনের অনুরাগী ছিলেন এবং ধর্মসংস্কারে ব্রতী হয়েছিলেন, অপরদিকে লালন তাঁর স্থানীয়ত্ব নিয়ে ইংরেজ শাসনের প্রভাব বলয়ের বাইরেই রয়ে গেছেন এবং ধর্মের ব্যাপারে ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। দুয়ের মিলনের মধ্য দিয়ে ভেতর একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে সংস্কৃতি নতুন প্রাণ ও গতিমুখ পেত বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু সেটা ঘটা সম্ভব ছিল না এবং ঘটেওনি; তাদের ভেতরকার দূরত্ব সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিভাজন ও বিচ্ছিন্নতারই প্রতিভূ হয়ে রয়েছে।
মিলন ঘটেছিল অবশ্য অপর দুজন অসাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে, একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), অপরজন জগদীশ চন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭)। একজন কবি অন্যজন বিজ্ঞানী, একজন কলকাতার অপরজন পূর্ববঙ্গের। কিন্তু দুজনের ভেতর অত্যন্ত গভীর নৈকট্য ছিল, বিশেষ করে সে ক্ষেত্রটিতে যেখানে তাঁরা উভয়েই নিজের মতো করে মাতৃভাষার চর্চা করেছেন এবং দুজনই ছিলেন দেশপ্রেমিক ও অসাম্প্রদায়িক। এটা সেই ধরনের মিলন যেমনটা আরো অধিক ক্ষেত্রে ও পরিমাণে ঘটলে সংস্কৃতির জগতে যে জাগরণের আবশ্যকতার কথা আমরা বলছি সেটি এগিয়ে আসতে পারত। কিন্তু তা তো সম্ভব হয়নি।
সব দেশেই ইতিহাস-বিকৃতির অভিযোগ ওঠে এবং ওঠাটা যে অস্বাভাবিক তা মোটেই নয়। আমাদের দেশেও উঠেছে। বিকৃতির অর্থ দাঁড়ায় বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির ভূমিকায় মূল্যায়নের ব্যাপারটাকে ওঠানো কিংবা নামানো। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। সেটি ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাঙালির অভ্যুত্থান। ওই অভ্যুত্থানে মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণের পাশাপাশি নিতান্ত অক্ষরজ্ঞানবর্জিত কৃষকও কেন এগিয়ে এসেছিল সেটা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। ইতিহাসে কার্যকারণ থাকে, কিন্তু ইতিহাস প্রধানত এগোয় দ্বন্দ্বের কারণে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী তরুণরা কেবল যে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেছিল তা নয়, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের আওতায় নিয়ে আসার জন্য যারা অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন এবং সেই আগ্রহের দরুন যারা একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার বিপক্ষে ছিলেন, বিদ্রোহটা ছিল তাঁদের বিরুদ্ধেও। প্রশ্ন ওঠে, একুশে ফেব্রুয়ারি কি শোকের দিন নাকি উৎসবের? একুশে ফেব্রুয়ারিতে অবশ্যই শোক আছে, কিন্তু কেবল শোক নেই, আছে বিদ্রোহকে অক্ষুণ্ন রাখার অঙ্গীকারও। এখন যে ব্যবসায়ী তৎপরতার দরুন একুশকে নেহাতই উৎসবে পরিণত করার চেষ্টা চলছে এটি অবশ্যই একুশের চেতনাবিরোধী। একুশের চেতনা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক, যে জন্য এই চেতনা সরাসরি যুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধের সঙ্গে। একুশের অভ্যুত্থান অবশ্যই রাজনৈতিক ছিল; কিন্তু এ ছিল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং আমরা তো জানিই যে ভাষা ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী ইত্যাদির বিভাজন মানে না, ভাষার ওপর সবারই অধিকার থাকে এবং ভাষা নিজেও চায় সর্বজনীন হতে। সে জন্য রাজনৈতিক হলেও ওই অভ্যুত্থানের ভেতর সামাজিক বিপ্লব ও সাংস্কৃতিক জাগরণের সুস্পষ্ট উপাদান কার্যকর ছিল।
বর্তমান সময়ের কাছে ইতিহাসের যে দুই দাবি_ সামাজিকতা তৈরির এবং সাংস্কৃতিক জাগরণকে সম্ভব কর তোলার_সে দুটি থাকছেই, থাকবেই; ওই দুই দাবির ডাকে কিভাবে আমরা সাড়া দিই তার ওপরই নির্ভর করছে ইতিহাস কোন পথ ধরে এগোবে সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.