গ্রামীণ প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাঃ খণ্ডিত চিত্র, অখণ্ড ভাবনা by স্মৃতি চক্রবর্তী

গ্রামীণ প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার মান বা সামগ্রিক চিত্র বিশ্লেষণ করলে যা ভেসে ওঠে তা প্রীতিকর নয়। বিষয়টি রীতিমত উদ্বেগের এ কারণে যে, প্রাথমিক শিক্ষা হলো সামগ্রিক শিক্ষার ভিত্তিস্তর। কিছুদিন আগে মিডিয়ায় প্রকাশ, পটুয়াখালী জেলার লাউকাঠি ইউনিয়নের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক থেকে কিছু অংশ পড়তে বললে সে একটি শব্দও সঠিকভাবে উচ্চারণ করে পড়তে পারেনি।
ওই ক্লাসের অন্য ছাত্রদের অবস্থাও একই রকম। এটি একটি খণ্ডিত দৃষ্টান্ত। এই হলো গ্রামীণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের এমন একটি অধ্যায়, যা তার সারা জীবনে প্রভাব ফেলে।
গঠনমূলক প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার-সমাজ-জাতি সর্বোপরি দেশ গঠনের বুনিয়াদ। কিন্তু এর মান উন্নয়নে আমরা কতটা সজাগ কিংবা আন্তরিক সে প্রশ্নও জাগে। শিক্ষক-অভিভাবক-বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি, এমনকি সরকারও খুব একটা নজর দিচ্ছে না এদিকে—বিদ্যমান চিত্র তাই বলে। ঢাকার এক শিক্ষার্থী আধুনিক যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বড় ব্যবধান সেখানেই। এ পার্থক্য দূর করা না গেলে গ্রামীণ শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সরকারি প্রথমিক শিক্ষার মান নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চললেও মানসম্মত বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে কোনো পরিবর্তন আসছে না। একদিকে প্রাথমিক শিক্ষার মানের অধঃপতন ঘটছে, অন্যদিকে সেই সুযোগে দেশব্যাপী গড়ে উঠছে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাব্যবস্থা। বেসরকারি সংবাদ সংস্থা ম্যাস-লাইন মিডিয়া সেন্টারের (এমএমসি) ২০০৭ সালের মার্চের এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে মোট ৩৭ হাজার ৬৭২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা সঠিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন থেকে অনেক দূরে। দেশের ৮০ ভাগ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ শিক্ষকসংখ্যা চার, অর্থাত্ ৬৭ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক। প্রত্যেক শিক্ষার্থী দৈনিক তিন-চার ঘণ্টা বিদ্যালয়ে অবস্থান করলেও শিক্ষকের কাছ থেকে সময় পায় মাত্র চার-পাঁচ মিনিট।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভৌত সুবিধাদি হলো মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতকরণের একটি অন্যতম শর্ত। গত কয়েক বছরে গ্রামীণ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকার ব্যাপক বিনিয়োগ করলেও এখনও শ্রেণীকক্ষ ও বিদ্যালয়ের সংখ্যা এবং এগুলোর গুণগত মান সবদিক থেকেই অপর্যাপ্ত। কিছু কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক অবস্থায় এখনও রয়েছে। নলছিটি উপজেলার সরাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়ই সব কার্যক্রম চলছে এবং সাইক্লোন শেল্টার হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি সদ্য নির্মিত ও মেরামতকৃত বিদ্যালয় ভবনের শ্রেণীকক্ষের দেয়াল খসে পড়ছে। এও খণ্ডিত দৃষ্টান্ত। অভিযোগ আছে, যেসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন সরকারি সহায়তায় নির্মাণ বা মেরামত করা হচ্ছে সেগুলোর কাজ মানসম্মত না হওয়ায় অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের সাম্প্রতিক ‘এডুকেশন ওয়াচ বিদ্যালয় জরিপ’ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জরিপকৃত ২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৩টি আংশিক পাকা অর্থাত্ ভবনের দেয়াল ও মেঝে পাকা আর ছাদ টিন দিয়ে তৈরি। ১০টি বিদ্যালয়ে শৌচাগার অপর্যাপ্ত। এছাড়া রয়েছে ক্লাসরুম ও বিশুদ্ধ পানির অভাব।
অন্যদিকে শব্দদূষণ, বিদ্যালয়ের চারদিকে সীমানা দেয়াল না থাকা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপত্তাহীন পরিবেশ স্পষ্টতই কার্যকর ও আনন্দদায়ক শিক্ষণ-শিখনের পরিপন্থী। এরকম সমস্যা রয়েছে আরও।
সচেতন মহল থেকে এ অভিযোগও এরই মধ্যে বহুবার উঠেছে, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় আরেক সমস্যা হলো উপবৃত্তির অপর্যাপ্ত টাকা ও এর অসম বণ্টন। ২০০২ সালে শুরু হওয়া এ উপবৃত্তি শিক্ষার্থী নির্বাচনে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি ও শিক্ষকদের ওপর প্রভাবশালীদের প্রভাব, শিক্ষার্থীদের নিজেকে দরিদ্র প্রমাণের চেষ্টা, এমনকি রাজনৈতিক পরিচয়ও প্রাধান্য পায়, যা এখনও বিদ্যমান। এ ক্ষোভও অসঙ্গত নয়, একজন প্রাথমিক শিক্ষক সামাজিকভাবে শিক্ষক হিসেবে মর্যাদা পেলেও অর্থনৈতিকভাবে তারা খুবই অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত। যেমন ধরা যাক, একজনের মূল বেতন হলো ৩ হাজার ১০০ টাকা। সব মিলিয়ে তিনি পান পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার মতো। বর্তমানে এ টাকা দিয়ে পরিবার ও সামাজিকতা রক্ষা করা দুঃসাধ্য। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যদি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবনযাপন করেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানে কীভাবে তাদের মধ্যে আন্তরিকতা কাজ করবে?
অন্যদিকে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদেরও অভিযোগের শেষ নেই। বিদ্যালয়গুলোতে সামান্য কারণেই শিশুদের গায়ে হাত তোলা হয়। অভিযোগ আছে, শ্রেণীকক্ষে শিশুদের শারীরিক শাস্তির কারণে তারা ভীত হয়ে পড়ে এবং আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। ফলে শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করে। এছাড়া অনেক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী না থাকায় শিক্ষার্থীদের দিয়ে কাজ করানো হয়।
উপজেলা শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যর্থতা সম্পর্কে গণসাক্ষরতা অভিযান জরিপে যে বিষয়গুলো চিহ্নিত হয়েছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো—সরকারি প্রাথমিক ও নিবন্ধনকৃত বেসরকারি বিদ্যালয় মিলে একজন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানের জন্য ১১৮ থেকে ২৫০টি বিদ্যালয় রয়েছে। তাদের যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট না থাকা, তত্ত্বাবধানসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব প্রভৃতি। প্রাথমিক শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য অবশ্যই কাঠামোগত শিক্ষানীতি থাকা প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষার সামগ্রিক চিত্র বা ব্যবস্থা মানসম্মত করতে সরকার যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করা উচিত। তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষার নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সহকারী থানা শিক্ষা কর্মকর্তারা মূল ব্যক্তি হলেও অনেক উপজেলায় প্রয়োজনীয়সংখ্যক সহকারী থানা শিক্ষা কর্মকর্তা নেই এবং তাদের কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় কাগজে-কলমে বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ফলপ্রসূ হচ্ছে না; সব বিদ্যালয় পরিদর্শনের জন্য তারা খুব কম সময়ই দিতে পারেন।
পরিশেষে সার্বিক চিত্র বিশ্লেষণে বলা যায়, দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-২) নেয়া পদক্ষেপগুলো পর্যাপ্ত না হলেও শুরু হিসেবে ভালো। প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত করতে হলে অবশ্যই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের মানস গঠন কেমন এবং তারা সহনশীল ও ইতিবাচক চরিত্রের অধিকারী কিনা সে বিষয়গুলো যাচাই করা প্রয়োজন। শিক্ষক, প্রশিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তা প্রত্যেকের ক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকলে তারা কাজের প্রতি আরও আন্তরিক হবেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বাধ্যতামূলক বিষয়গুলোর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলার প্রতি জোর দিতে হবে। এতে শিশুরা মানবিক গুণের অধিকারী হবে।
অনেক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও অভিভাবকের মতে, শিক্ষক, অভিভাবক, সরকার—সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দিয়েই দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান আরও কাঠামোবদ্ধ, সুশৃঙ্খল ও মানসম্মত করতে হবে।
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড—বহুল উচ্চারিত এ প্রবাদবাক্যকে আজ নতুন করে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উপলব্ধিতে সচল করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। শিক্ষাকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না—উচ্চারণ করার ক্ষেত্রে দৃশ্যত এর কোনো অবকাশ নেই বটে, কিন্তু এ গুরুত্বটুকু দেয়া হচ্ছে এক ধরনের খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সংখ্যাগত অর্জনের দিকে আমরা বেশি সচেষ্ট হয়েছি, কিন্তু মান প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আমরা চোখে পড়ার মতো অমনোযোগী থেকেছি। এ গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব পালনে এখনই নিষ্ঠ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি প্রয়োজন আছে সামাজিক এবং নাগারিক উদ্যোগেরও।
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.