গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশের জন্য জাতীয় পুঁজি অপরিহার্য by মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন
শেখ হাসিনার সরকারকে মোজাফ–র আহমদের পরামর্শ, দেশপ্রেমিক জাতীয় ধনিক শ্রেণী বিকাশে নজর দিন—এই শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ‘আমাদের সময়’ পত্রিকায়। দেশপ্রেমিক জাতীয় ধনিক শ্রেণী বিকাশের দিকে নজর দিতে পরামর্শ দিয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ–র আহমদ।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ত্রিকালদর্শী বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে ক্রমবর্ধমান হারে লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণী ভেঙে একটি গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিজ ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি তাদের দৃষ্টি আছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ব্যক্তি পুঁজির বিকাশের মাধ্যমে জাতীয় পুঁজি গঠন সম্ভব। এ জন্য রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।অধ্যাপক মোজাফ–র আহমদ বলেন, আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যদি বাস্তবিকই চান এ দেশের উন্নতি হোক, এ দেশে সত্যিকারের রাজনীতি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক, তাহলে তাদের প্রধান ও মৌলিক কর্তব্য হওয়া উচিত বাংলাদেশের শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কোনোক্রমেই বাধাগ্রস্ত হতে না দেয়া এবং অর্থনৈতিক বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। তিনি মনে করেন, শিল্পায়নে পশ্চাত্পদ সব দেশই সর্বক্ষেত্রে পেছনে পড়ে। তার মতে, যতদূর সম্ভব ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে সামগ্রিক শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া রাজনীতি ও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে দুনিয়ার ইতিহাসে এরকম দৃষ্টান্ত নেই।
অধ্যাপক মোজাফ–র আহমদ আরও বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় এ দেশে সত্যিকারের বুনিয়াদি ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো ও ধনিক শ্রেণী না থাকায় যে গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা এলো তারা হলো লুটেরা (লুম্পেন), ধনিক-বণিক, উকিল, মোক্তার, শিক্ষক, বেকার যুবক, এক ধরনের সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত, অনভিজ্ঞ, দুর্নীতিপরায়ণ, অদক্ষ আমলা কর্মচারী ও অদূরদর্শী রাজনীতিক। এতে যে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠে, তা হচ্ছে লুম্পেন ধনতন্ত্র। এই লুম্পেন ধনিকরা বুনিয়াদি ধনিক শ্রেণীর ভূমিকা পালন করতে পারে না। কারণ এদের শ্রেণী চরিত্র গড়ে ওঠেনি। শ্রেণী চরিত্র গড়ে না ওঠার প্রধান কারণ, এদের উত্পাদনবিমুখতা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের ওপর নির্ভরশীলতা, বিদেশি পুঁজির ভোগ সর্বস্বতা, ভোগবাদে গা-ভাসিয়ে দেয়া, রাজধানী শহুরে সল্ট্যাটাস অর্জন করার কাজে মগ্নতা ও সুযোগে বিদেশে অর্থ পাচার (সূত্র : আমাদের সময়, ২ নভেম্বর ২০০৯)।
ধন্যবাদ অধ্যাপক মোজাফ–র আহমদের বোধোদয়ের জন্য। আমার জানা মতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে লুটেরা গোষ্ঠী ক্ষমতাসীন হয়েছিল তাদের সঙ্গেই অধ্যাপক মোজাফ–র আহমদ জোট বেঁধেছিলেন এবং সেই সময় তার দল অধনতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের তত্ত্বে বিশ্বাস করত। সেই জায়গা থেকে উঠে এসে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপের প্রশ্নে অর্থনীতির জাতীয় ধনবাদী বিকাশের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তিনি এখন উপলব্ধি করছেন এবং সম্ভবত এ কারণেই শেখ হাসিনাকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন দেশপ্রেমিক জাতীয় ধনিক শ্রেণী বিকাশে নজর দেয়ার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা যে এখনও লুটেরা চরিত্রের ধারাবাহিকতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি—এ বিষয়ে উপলব্ধির ক্ষেত্রে মনে হয় অধ্যাপক মোজাফ–র আহমদের স্বচ্ছতা সৃষ্টি হয়নি। রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে বিদেশি প্রভুদের সেবায় যেসব পদক্ষেপ দ্রুত কার্যকর করার চেষ্টা চলছে এসব দেখার পরও সেই নেতৃত্বকে জাতীয়তাবাদী ধারার ধনিক শ্রেণী বিকাশে নজর দেয়ার পরামর্শ দেয়াটা মোটেই যথাযথ নয়। জাতীয়তাবাদী ধারার ধনিক শ্রেণী বিকাশে নজর দেয়ার জন্য এ দেশে সচেতন রাজনৈতিক নেতৃত্ব দরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে সে ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়। এ উপলব্ধি অধ্যাপক মোজাফ–র আহমদের মধ্যে গড়ে উঠলে সেটা সত্যিকার অর্থেই খুশির খবর হতো।
পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে বাংলাদেশ নামক এ রাষ্ট্রটিকে যারা ভালোবাসেন তাদের করণীয় হবে বাংলাদেশী অর্থনীতির জাতীয় ধনবাদী বিকাশকে এগিয়ে নেয়া। এ ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান সেসব অপসারণ করার কর্মসূচিই হবে সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের মূল কর্মসূচি। এই কর্মসূচির পক্ষে জনমত গঠন করাই হবে প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোর পক্ষে ইচ্ছুক রাজনৈতিক নেতৃত্বের করণীয়। এ কর্মসূচির পক্ষে জনমত গঠনে তত্পর না হয়ে যারা বিদেশি প্রভুদের স্বার্থে বিভিন্ন পদক্ষেপ কার্যকর করার তত্পরতা চালাচ্ছে তাদের স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বলে চিহ্নিত করা, প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে এমন সব পদক্ষেপ কার্যকর করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বর্তমানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এরপরও তারা নিজেদের বলে স্বাধীনতার পক্ষশক্তি। এ হচ্ছে চরম ভাঁওতাবাজি, যাকে বলা যায় ‘চোরের মার বড় গলা’।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জাতীয় ধনবাদী বিকাশকে এগিয়ে নিতে হলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে কয়েকটি বিষয় কার্যকর করা একান্ত প্রয়োজন। ১. তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুত্ বন্দরের ওপর জাতীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ২. বাংলাদেশের তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ দেশে সংরক্ষণ করে শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা দ্রুত নিশ্চিত করা। ৩. দেশীয় শিল্পের বিকাশের স্বার্থে দেশীয় শিল্পে উত্পাদিত পণ্যের বাজার অভ্যন্তরীণভাবে নিশ্চিত করার জন্য দেশি বাজারের ক্ষেত্রে সংরক্ষণমূলক নীতি অবলম্বন করা। ৪. দেশীয় ধনবাদের জাতীয় বিকাশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। পরিকল্পিত পদক্ষেপের অর্থ হচ্ছে উত্পাদনের উপায় উত্পাদনকারী খাত ও ভোগ্যপণ্য উত্পাদন খাতের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ নিশ্চিত করা, কেননা এ দুই খাতের ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশের ওপরই নির্ভর করে দেশীয় শিল্পে উত্পাদিত পণ্যের বাজার রক্ষা নিশ্চিত করা এবং অভ্যন্তরীণ বাজারের ক্রমাগত প্রসারকে এগিয়ে নেয়া। ৫. রাষ্ট্রীয় সংবিধানের ক্ষেত্রে ওপরে উল্লিখিত বিষয়গুলোর কার্যকারিতা যাতে নিশ্চিত হয় সেই মোতাবেক এমনসব নীতি কাঠামো গ্রহণ করা, যাতে করে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা কার্যকর করতে বাধ্য থাকে।
যারা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য অর্থনীতির জাতীয় ধনবাদী বিকাশকে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিতে চান, তাদেরকে ওপরে উল্লিখিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচির পক্ষে জনমত গঠনের পদক্ষেপ নিতে হবে। উল্লিখিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচি যেমন জাতীয় পুঁজির গঠনকে শক্তিশালী করবে, ঠিক তেমনভাবেই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সহায়তা করবে। অর্থনীতির জাতীয় ধনবাদী বিকাশ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সহায়তা করবে এ কারণে যে, এই বিকাশ জনগণকে সুসংগঠিত করার ক্ষেত্রে অবদান রাখে। জনগণের এই সুসংগঠিত অবস্থানের কারণে জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতাকে নিজে থেকেই দমন করতে হয়। অন্যথায় শক্তিশালী সংগঠিত প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হবে; এ কারণেই স্বৈরাচারী মনোভাব দমন করে ক্ষমতায় টিকে থাকা ছাড়া কোনো পথ থাকে না শাসকশ্রেণীর জন্য। এরই ফলস্বরূপ গণতন্ত্রের চর্চা সমাজে বিকশিত হতে থাকে। এদিক থেকে বিচার করলে অধ্যাপক মোজাফ–র যখন বলেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া রাজনীতি ও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে দুনিয়ার ইতিহাসে এ রকম দৃষ্টান্ত নেই—তখন এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। অর্থাত্ গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপের বিকাশে জাতীয় পুঁজির শক্তিশালী গঠন অপরিহার্য, এর কোনো বিকল্প নেই। এই কথা মেনেই গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অর্থনীতির জাতীয় ধনবাদী বিকাশ ত্বরান্বিত করার পদক্ষেপ নিতেই হবে। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করা পরস্পরবিরোধী। কেননা এ পদক্ষেপ দেশীয় অর্থনীতির জাতীয় ধনবাদী বিকাশকে কোণঠাসা করে। লুটেরা অর্থনীতির বিস্তৃতি ঘটায়। আর যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে লুটেরা অর্থনীতি বিস্তৃত হয় সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কোনো সময় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্ব বলা যায় না। এদিক থেকে অধ্যাপক মোজাফ–রের কথা, ‘ধনিক শ্রেণী হয় জাতীয়তাবাদী। জাতীয়তাবাদ ধনিক শ্রেণীরই উদ্ভাবন, তারা নিজের স্বার্থ এগিয়ে নেয় এবং নিজের স্বার্থেই জাতির স্বার্থ দেখে।’ অর্থাত্ জাতীয়তাবাদী কনসেপ্ট দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণীর কার্যক্রমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর এই ধনিক শ্রেণী হচ্ছে উত্পাদনশীল পুঁজির মালিক, লুটেরা পুঁজির নয়। উত্পাদনশীল পুঁজির স্বার্থকে জাতীয়ভাবে ক্রমাগত বিকশিত করে তোলাই হচ্ছে দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণীর কাজ। ঐতিহাসিক কারণেই এ দেশের উত্পাদনশীল পুঁজির জাতীয় গঠন দুর্বল, আর এ দুর্বল অবস্থানের মূল কারণ স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের লুটেরা চরিত্রের মধ্যে নিহিত। এ বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা যদি অধ্যাপক মোজাফ–রসহ সমাদর্শী অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের আগেই গড়ে উঠত, বিদেশি প্রভাবে অধনবাদী পথে ংসমাজতন্ত্রে উত্তরণের তত্ত্ব যদি তারা ধারণ না করতেন বরং বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ধনবাদ বিকাশের প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নে সোচ্চার হতেন তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, এই উপমহাদেশের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে আজকে ভিন্ন অবস্থা দেখা যেত। সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বকে আমরা ঝেড়ে ফেলতে পারতাম। কিন্তু সেটা হয়নি এটাই বাস্তবতা। এর মধ্যে সময় অনেক গড়িয়ে গেছে, তবুও অধ্যাপক মোজাফ–রের উপলব্ধিকে স্বাগত জানাতে হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জাতীয় ধনবাদী বিকাশের প্রয়োজনীয়তার কথা বাংলাদেশে অন্য কতিপয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে বলেননি এমনটা নয়; কিন্তু জাতীয় ধনবাদ বিকাশের শর্তগুলোর প্রশ্নে তাদের রয়েছে অস্বচ্ছ ধারণা। তত্কালীন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী প্রয়াত অধ্যাপক আবু মাহমুদসহ এসব রাজনৈতিক নেতৃত্ব মনে করতেন অর্থনীতির জাতীয় ধনবাদী বিকাশ বা জাতীয় উত্পাদনশীল পুঁজির বিকাশ জনগণের ক্রয়ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। যেমন—প্রয়াত অধ্যাপক আবু মাহমুদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষুদে কৃষকরা প্রতি বছর জোতদার ও ধনী চাষীদের কাছে জমি হারিয়ে ভূমিহীনের সংখ্যা যে পরিমাণে বাড়িয়ে তুলছে তাতে আশির দশকের মধ্যেই তাদের পরিমাণ সমগ্র কৃষক জনতার ৬০% থেকে ৮০% হবে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। বিপরীতে মুষ্টিমেয় ওই জোতদার ও ধনী কৃষকদের হাতে আয় বাড়ার ফলে এ দেশে শিল্পজাতদ্রব্য কেনার লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একদিনের অন্ন সংস্থান যার নেই সে শিল্পজাতদ্রব্য কিনবে কোন শৌখিনতায়? সুতরাং উপরোক্ত আর্থ-সামাজিক কাঠামো যতদিন বহাল থাকবে ততদিন বাংলাদেশে শিল্পের বিকাশ ঘটাতো দূরের কথা, হাল্কা শিল্প গড়ে ওঠাও অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার (সূত্র : পুঁজিবাদের পুঁজি ও তৃতীয় বিশ্বে অধ্যাপক আবু মাহমুদ, পৃষ্ঠা-১২০)।
প্রয়াত অধ্যাপক আবু মাহমুদের ধ্যান-ধারণা এ দেশে অনেকের মধ্যে বিদ্যমান। পুঁজি সৃষ্টির ঐতিহাসিক সামাজিক শর্ত সম্পর্কে তাদের রয়েছে ভুল ধারণা। পুঁজি সৃষ্টির ঐতিহাসিক পূর্বশর্ত হলো, প্রথমত সাধারণভাবে পণ্য উত্পাদনের অপেক্ষাকৃত উচ্চস্তরে ব্যক্তিবিশেষের হাতে কিছু পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় এবং দ্বিতীয়ত এমন শ্রমিকের অস্তিত্ব যে উভয় অর্থে মুক্ত, শ্রমশক্তি বিক্রয়ের পথে সব রকমের বাঁধা-নিষেধ থেকে মুক্ত এবং জমি ও সাধারণভাবে উত্পাদনের সবকিছু উপায় থেকেও মুক্ত।
এ দেশে ভূমিহীনের সংখ্যা বৃদ্ধি পুঁজি সৃষ্টির ঐতিহাসিক পথে বাধা নয়, কেননা এই ভূমিহীনরা শ্রমশক্তি বিক্রয়ের পথে সব রকমের বাধা-নিষেধ থেকে মুক্ত। অথচ এই ভূমিহীনতাকেই শিল্প বিকাশের পথে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন প্রয়াত অধ্যাপক আবু মাহমুদ ও অন্যরা। শুধু তাই নয়, জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টিকেও তারা যুক্ত করেছেন শিল্প বিকাশের শর্ত হিসেবে, যা আদতে সঠিক নয়; কেননা শুধু ভোগ্যপণ্যকে কেন্দ্র করে পুঁজিবাদী উত্পাদন এগিয়ে যায় না, উত্পাদনের উপায় হিসেবে উত্পাদিত পণ্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুঁজিবাদী উত্পাদনের গতিশীলতার সঙ্গে লোহা, বিদ্যুত্, যন্ত্রপাতির সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। পুঁজিপতিদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা, উত্পাদন খরচ কমিয়ে আনার প্রবণতাকে কেন্দ্র করে যন্ত্রপাতির আধুনিকীকরণ অনেক বেশি প্রয়োজনীয় এবং হয়ও তাই। অর্থনীতিবিদরা এ কারণে বলেন, পূর্ববর্তী অন্যান্য অর্থনৈতিক উত্পাদন ব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্যসূচক পার্থক্যই হচ্ছে যন্ত্রপাতি এবং তা উত্পাদনে প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদির (কয়লা, লোহা ইত্যাদির) বিকাশ। প্রযুক্তিগত মাত্রায় পুঁজিবাদ অন্যান্য পূর্ববর্তী সমাজ ব্যবস্থা থেকে অনেক উন্নত। এদিক থেকে বিচার করলে উত্পাদনের উপায় উত্পাদনকে কেন্দ্র করেই প্রধানত পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ ঘটে, তা মোটেই জনগণের ক্রয়ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভোগ্যপণ্যকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয় না, অর্থাত্ এটা শিল্পায়নের প্রধান শর্ত নয়।
জাতীয় অর্থনীতির ধনবাদী বিকাশের কথা বললেই শুধু কর্তব্য শেষ নয়, তার ঐতিহাসিক শর্তগুলোর বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা এবং তা অর্জন করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপই এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তনের জন্য প্রয়োজন। আর এ প্রয়োজন অর্জিত হতে পারে সমাজ-সচেতন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে, লুটেরা পুঁজির প্রতিনিধিত্ব যারা করে তাদের দিয়ে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
No comments