দীর্ঘ জীবন কেন চাই কেন চাই না by মাহমুদ শামসুল হক

কটি বিষয়ে মানুষ এখনও ছেলেমানুষই রয়ে গেল। মানুষ হয়ে ওঠার সময় থেকে এখন পর্যন্ত এক নির্বোধ বাসনা তাকে কেবলই ফুসলায়। মানুষ অমর হতে চায়। চায় জরা-ব্যাধিহীন অনন্ত যৌবন। এ লক্ষ্যে প্রকাশ্যে-গোপনে লাগাতার চেষ্টা-তদবিরের কোনো অন্ত নেই। বিজ্ঞানীরা তাবত্ জরা-ব্যাধিকে হটিয়ে দীর্ঘ জীবনের লাগসই দাওয়াই খুঁজে খুঁজে পেরেশান। আত্মাকে দেহ খাঁচায় আটকে রাখতে বিচিত্র সাধনায় নিবেদিত সাধু-সন্তরা।
যদিও এখন পর্যন্ত তাদের সব প্রয়াসই পর্যবসিত পণ্ডশ্রমে। কিন্তু মানুষ একবিন্দু দমেনি। ফলাফল শূন্য জেনেও লিপ্ত রয়েছে অনন্ত জীবনের সমান যৌবন লাভের কাজে। অর্থাত্ দীর্ঘদিন বাঁচা এবং নিরঙ্কুশ যৌবন নিয়ে বাঁচা।
পৌরাণিককালে নাকি কেউ কেউ অমরত্ব বর নিয়ে জন্মেছিলেন। কিন্তু সেসব মৃত্যুহীন প্রাণকে এই গ্রহে থাকতে দেয়া হয়নি। এক পর্যায়ে বিধাতা তাদের সশরীরে তুলে নিয়েছেন স্বর্গলোকে। অনেকে আবার সাধনায় সিদ্ধি পেয়ে জীবনকে দীর্ঘায়িত করতে পেরেছিলেন শত শত বছর। কিন্তু জরা-ব্যাধি তাদেরও ছাড়েনি। বার্ধক্য যথারীতি এসে ঘটিয়েছে দেহের বিনাশ। গুরুর আশীর্বাদে অনেকে শতায়ু হতেন—এ ধরনের বিস্তর গল্প আছে বৈদিক পুরাণাদিতে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। অমরত্ব দূরের কথা, বার্ধক্যমুক্ত শতবর্ষী হওয়ার সাধ স্বপেম্নই থেকে গেছে। হাজার তিনেক বছর আগে গ্রিক সভ্যতার সূচনাপর্বে মানুষের গড় আয়ু নাকি ছিল কুড়ি বছরের মতো। অসুখ-বিসুখে, বিভিন্ন প্রাণীর আক্রমণে মারা যেত অসংখ্য মানুষ শৈশবেই। ফলে কমে যেত গড় আয়ু। এখন মানুষের আয়ুর গড় সত্তর বছর কিংবা তারও বেশি। জাপান, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে এ অংক আশির ঘর ছুঁয়েছে। অনাহারক্লিষ্ট তৃতীয় বিশ্বেও হাল আমলে শতায়ু মানুষ বিরল নয়। এটা হয়েছে দুনিয়াজোড়া স্বাস্থ্যবিধির উন্নতির কারণে, রোগ-ব্যাধির প্রতিষেধক আবিষ্কারের কল্যাণে। এখন ‘ক্লোন’ পদ্ধতিতে জীবনের পুনরুত্পাদন সম্ভব হয়েছে, শরীরের স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গ পাল্টে ফেলার কৌশল করায়ত্ত হয়েছে, মুছে ফেলা সম্ভব হয়েছে ত্বক থেকে বার্ধক্যের চিন্। কাজেই আশা করা হচ্ছে, শিগগির মানুষ শতায়ু তো বটেই, একাধিক শতাব্দী বেঁচে থাকতে সক্ষম হবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মন নিয়ে। দেহ যদি সর্বাংশে কর্মক্ষম না থাকে, জৈবিক আকর্ষণ তিরোহিত হয়ে যায় এবং দেহের সঙ্গে মনটিও সজীব না থাকে তাহলে অমন দীর্ঘায়ু হবে বিড়ম্বনারই নামান্তর। এ প্রসঙ্গে গ্রিক উপাখ্যানের ঘুঘুরে পোকার গল্পটি প্রাসঙ্গিক। দেবী ইয়স দেবরাজ জিউসকে তুষ্ট করে বর চেয়েছিলেন তার প্রেমিক টিথোনাস যেন অমর হয়। জিউস বর দিলেন। কিন্তু ইয়স অমরত্ব চেয়েছিলেন, চিরযৌবন চাননি। ফলে টিথোনাস অথর্ব হয়ে অন্তহীন নালিশে ইয়সের জীবন দুর্বিষহ করে তোলেন। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ইয়স তাকে মন্ত্রবলে বানিয়ে দেন ঘুঘুরে পোকা।
মানুষের গড় আয়ু বাড়াতে বিজ্ঞানের আয়োজন বিস্ময়কর, সন্দেহ নেই। কিন্তু দীর্ঘায়ু কি সব সময় সব মানুষের কাম্য? অনাহার, নিরানন্দ, ভয়-বিদ্বেষ, অসাম্য-বৈষম্য, দৈহিক ও মানসিক অসুখ-অশান্তি নিয়ে যে মানুষ বেঁচে থাকে সে মানুষ অনেক সময় জীবন থেকে পরিত্রাণও চায়। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্যপীড়িত মানুষ প্রতিবাদ করে, লড়াই করে জীবন দেয়, আত্মহনন করে ক্ষুধাসহ বিচিত্র মানসিক অভিঘাতে। এসব বিষয়ের সুরাহা না পেলে জীবনকে দীর্ঘ করেই বা কী লাভ? মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠজন রাজনীতিক কুমার মাঙ্গলিক ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর কাছে আত্মহননের অনুমতি চেয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন, জীবন আমার—তা যদি কোনো কারণে ভারবোধ হয় তাহলে তা বিনাশ করার অধিকার অর্থাত্ আত্মহত্যার অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত থাকা উচিত। যুক্তিটি জীবনের বিরুদ্ধে হলেও এর ভেতরে একটা দার্শনিকতা লুকিয়ে আছে। এই দার্শনিকতার অর্থ বুঝেছিল আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ—যারা জন্মেছিল ক্রীতদাস হওয়ার জন্য। এ কথার অর্থ বোঝে আমৃত্যু যে লোক খোলা আকাশের নিচে বাস করে, ডাসল্টবিন থেকে কুড়িয়ে খায় খাবার, ধূলিলগ্ন হয়ে থাকে শরীরে দগদগে ঘা নিয়ে, পোড়া রুটি দিয়ে দিনের পর দিন যে তরুণী ঢেকে রাখে নিজের সম্ভ্রম, কামানের গোলার ভয়ে শিশুকে কোলে করে দিনের পর দিন শঙ্কিত থাকে যে জননী। কাজেই দীর্ঘ নয়, জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা, আনন্দ-বিষাদ লুকিয়ে আছে যাপিত জীবনে, তা যতই ছোট হোক না কেন। এ অর্থেই দীর্ঘ জীবনের চেয়ে বোধকরি ভয়শূন্য, সম্প্রীতিভরা প্রফুল্ল জীবনই বেশি প্রার্থিত। অস্বাভাবিক মৃত্যুর ছায়া ক্রমাগত তাড়া করলে দীর্ঘ জীবনের প্রাপ্তি কোন্ অর্থে বাঞ্ছিত? বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানীরা যখন দীর্ঘায়ু লাভের উপায় খুঁজে পাচ্ছেন, তখন তাদেরই একশ্রেণী তৈরি করছেন মানুষ মারার বিস্তর উপকরণ। ধর্ষণ যেমন আক্রমণকারী যুদ্ধবাজদের একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি, তেমন আধিপত্য বিস্তারের জন্য মানুষ হত্যা করাও একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। অর্থাত্ আয়ু বাড়ানোর উপায় উদ্ভাবন এবং মানুষ নিধনের আয়োজন—দুটোই এখন সমান গবেষণার বিষয়। এই প্রেক্ষাপটে দুশ’-আড়াইশ’ বছরের দীর্ঘ জীবন লাভের স্বপেম্ন শুধু অমিত সম্ভাবনাই নয়, বিপদও রয়েছে। কাজেই গড় আয়ু বাড়ানোর পাশাপাশি, বাড়াতে হবে বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরির গড় সম্ভাবনাও। এজন্য মানব সমাজকে একটি নৈতিক চুক্তিতে আসতে হবে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির বিষয়টি কেবল একটি বৈজ্ঞানিক কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ না রেখে নিয়ে যেতে হবে সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মসূচির আওতায়। নইলে দীর্ঘ জীবনের ভার বহন করবে কীভাবে মানুষ?

No comments

Powered by Blogger.