মমতা : নাম বদলের খেলায় নতুন মোড় আনুন by সুনন্দন রায়চৌধুরী
নাম বদলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বেশ কিছুদিন হলো ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে জেঁকে বসেছে। প্রথম যে শহরের নাম পাল্টানো হয়েছিল, সেটা হলো বোম্বে। আজ তা নতুন নব্য ধনতান্ত্রিক ভারতের নতুন প্রজন্মের কাছে মুম্বাই বলে পরিচিত। সেখানকার উগ্র মারাঠি এক নেতা মাঝেমধ্যে হুংকার ছাড়েন,
বিহারি বা হিন্দিভাষী কোনো যুবক সেই শহরে ইন্ডিয়ান রেলের চাকরির পরীক্ষায় বসতে পারবে না! মুম্বাই হয়েছিল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, মাদ্রাজ পাল্টে চেন্নাই তার কিছু পরে। এই গত কয়েক বছরে ব্যাঙ্গালোর নিজেকে পাল্টে বলেছে বেঙ্গালুরু, সিপিএম তথা বামফ্রন্ট আমলে ক্যালকাটা হয়েছে কলকাতা, সেটাও ২০০০ সালের পর বা ওই সময়ে। যদি সারা ভারতের দিকে তাকাই, দেখব এই নাম পরিবর্তনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে বড় শহরগুলোতে। ১৯৯১ সালের পর থেকে নতুনভাবে নব্য পুঁজির আস্ফালনে ভারতের প্রায় সব বড় শহর ব্যতিব্যস্ত শপিং মল ও রিয়েল এস্টেট থেকে শুরু করে এস ই জেদ_সর্বত্রই এই নিও-লিবারেল পুঁজির প্রকোপ। পুঁজি এর ধর্মমতো বড় শহরগুলোর দিকে ধেয়ে গেছে। এর সঙ্গে নিয়ে এসেছে নতুন পেশাদার ও শ্রমজীবী মানুষের ঢেউ। তারা এসেছে দেশের নানা প্রান্ত থেকে এবং দেশের বাইরে থেকেও। নতুনদের ধাক্কায় শহরের এবং রাজ্যের মানুষ যখন বিপন্ন বোধ করছে, তখন রাজ্যের রাজধানীর নাম পাল্টে স্থানীয় বহুল পরিচিত ভাষার নাম দিয়ে নামকরণ হয়েছে রাজধানীর। সেই রাজ্যের মানুষের সাংস্কৃতিক গৌরবে কিঞ্চিৎ মলম পড়েছে, রাজনীতির লোকরা তাতে স্বস্তি বোধ করেছেন। এমন একটা সময়ে, যখন পানীয় জলের সুরাহা হয় না, বিদ্যুতের দাম ক্রমে বাড়তে থাকে, একচিলতে বাসস্থান মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ইলেকট্রিক শক দেয়, তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মানুষকে এসব ললিপপ দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে চায়, তাদের নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে যেন আঘাত না লাগে। এই চেহারা সারা ভারতের বড় শহরগুলোতে আমরা দেখেছি, দেখতে পাচ্ছি। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম আমলে কী হয়েছে তা সবার জানা। হার্ডিঞ্জ স্ট্রিট হয়েছে হো চি মিন সরণি, ধর্মতলা স্ট্রিট হয়েছে লেনিন সরণি। এই যে নামকরণের ঘটা, প্রশ্ন ওঠে_এতে কি জনমানসে হো চি মিন বা লেনিন বিষয়ে জানা-বোঝা বেড়েছে? আমার প্রকাশনা সংস্থায় বিভিন্ন সময় বাম ছাত্র আন্দোলনে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছে এ রকম যুবক-যুবতীদের যখন জিজ্ঞেস করেছি, রুশ বিপ্লব কবে হয়েছিল, তারা এমনভাবে তাকিয়েছে, যেন আমি জিজ্ঞাসা করেছি_তোমরা কি চাঁদে গিয়েছিলে? নাম বদল যে শুধু বামরা করেছে তা নয়, দিলি্লতে হঠাৎ করে একদিন কনট প্লেস হয়ে গেল রাজীব চক। এতে কি রাজীব গান্ধী বিষয়ে আমাদের যুবমানসে ভক্তি-শ্রদ্ধা বেড়ে গেল? রাজনীতির লোকরা কি এর চেয়ে আরেকটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজে মন দিতে পারেন না? যা আমরা সিপিএম বা কংগ্রেসকে দেখে অভ্যস্ত, তার চেয়ে একটা অন্য রাজনীতি, একটা অন্য শাসননীতি দেখবে_এই আশায় বাংলার মানুষ, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর তৃণমূল দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে এবং রাজনীতির যে গতিমুখ আজ তৃণমূলকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, সেটা আগে বর্ণিত নব্য পুঁজিবাদী আস্ফালনের বিরোধী গণ-আন্দোলন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মানুষ ও সারা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মমতাকে আশীর্বাদ করেছে। কারণ তিনি আগ্রাসী পুঁজি ও তার ধামাধরা অমানবিক সরকারি শাসকদলের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করেছেন। ক্ষমতায় আসার পর মমতা তাঁর সাধ্যমতো মানুষের কল্যাণ সাধন করার চেষ্টা করেছেন। একটা বিশেষ দিকে পাঠকের দৃষ্টি নিয়ে যেতে চাই। সেটা হলো, মমতার মন্ত্রিসভা। গত ৩৪ বছরে এই প্রথম একজন শিখ মন্ত্রী পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকারেও মমতাকে বলতে শুনেছি যে তাঁর কাছে সব পশ্চিমবঙ্গবাসী সমান। তাহলে আমি বা আমার মতো পশ্চিমবঙ্গের বহু বাঙালি নাগরিক কেন এই নামকরণের বিরুদ্ধে? এ জন্য যে পশ্চিমবঙ্গ একটা বাংলা নাম, আর আমাদের এই রাজ্যে শুধু বাংলাভাষীরা থাকে না, থাকে সোন্তালি, গোর্খা ও কামতাপুরীরা। তা ছাড়া আমাদের রাজ্যের মানুষের অনেকেই বিহার বা উত্তর প্রদেশ বা উড়িষ্যার। মহারাষ্ট্রের উগ্র নেতা যা করেন, আমরা তা করতে চাই না। আমরা চাই প্রতিটি মানুষ মাথা উঁচু করে এখানে থাকুক। বাংলা বাঙালির ভাষা, কিন্তু তা পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র ভাষা নয়। সে জন্য একটা নিরপেক্ষ ভাষা ইংরেজিতে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি নাম থাকা শ্রেয়। এরপর আসি একটি বাস্তব সমস্যার আলোচনায়। অনেকে বলছেন, সর্বভারতীয় সভাগুলোতে ওয়েস্ট বেঙ্গলের ডাক আসে প্রায় শেষে। ফলে আমাদের রাজ্যের বক্তব্য কেউ শোনে না মন দিয়ে। ভেবে দেখুন, আমরা আগে রাজ্যগুলোর নাম ডাকার নীতিটা মেনে নিলাম, তারপর আমরা আমাদের নিজেদের নাম বদল করলাম।
লেখক : কলকাতার সাংবাদিক
লেখক : কলকাতার সাংবাদিক
No comments