প্যারেন্টিং by ড. জাকিয়া বেগম
সব মা-বাবাই চান তার সনত্মানের ভবিষ্যত সুন্দরভাবে গড়ে উঠুক_সফলতায় ভরে থাকুক তার জীবন। বিশেষ করে যেসব পরিবারে মাত্র একটি কি দুটি সনত্মান যাদের তাদের জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া যেন সনত্মানকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকে।
সনত্মানদের আনন্দে ভরিয়ে রাখতে যেয়ে তারা অনেক সময়ই নিজ জীবনের সামান্যতম সুখ বা আরামও উপেৰা করে এবং সনত্মানের মঙ্গল চিনত্মায় ও চেষ্টায় উদগ্রীব হয়ে থাকে। অনেক মা-বাবাই বাচ্চাদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার ৰেত্রে সফলকাম হলেও কোন কোন সনত্মান মা-বাবার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছুটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আর তারই পরিণতিতে এ ধরনের সনত্মানের জীবন কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে, দেখা দিতে পারে উশৃঙ্খল জীবনযাপনের প্রবণতাও। যেহেতু মাদকের সর্বগ্রাসী ছোবলের হাতছানি সমাজের প্রায় সর্বসত্মরেই বিরাজমান, তাই মাদকাসক্তির মতো ভয়াবহ পরিণতিও ঘটতে পারে। উন্নত বিশ্বে আজ তাই সনত্মান লালন-পালনের ৰেত্রে মা-বাবার কতটুকু ভূমিকা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যই বা কতটুকু তা নিয়ে চলছে গবেষণা ও বিভিন্ন জরিপ এবং মা-বাবাকে পরামর্শ দেয়ার জন্য গড়ে উঠছে বিভিন্ন সংস্থা। সনত্মানের প্রতি স্নেহ বা আদরের মাত্রা কতটুকু প্রকাশ করা উচিত এবং কতটুকুই বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে সে ব্যাপারে মনসত্মাত্তি্বক ও মনোবিজ্ঞানীরাও দিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন পরামর্শ।মা-বাবাদের সনত্মান লালন-পালন পদ্ধতিকে 'প্যারেন্টিং' বলা হয়। প্যারেন্টিং বলতে কোন পরিবারে বাবা-মা সমষ্টিগত আচরণে সৃষ্ট পরিবেশকে বুঝায়, যার ফলে কোন বিশেষ অবস্থায় একটি সনত্মান নিজস্ব অনুভূতি বা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে সৰম হয়। উষ্ণতা বা আনত্মরিকতা এবং নিয়ন্ত্রণের মাত্রার ওপর নির্ভর করে এই প্যারেন্টিং ধরনকে পৃথক অথচ সুস্পষ্ট চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। এক, কতর্ৃত্বপরায়ন (অথরিটারিয়ান), দুই, অধিকার প্রদায়ক (অথরিটেটিভ), তিন, অনুমতিদায়ক (পারমিসিভ) এবং চার, অবহেলাপূর্ণ বা অমনোযোগী। জরিপে দেখা গেছে, শুধু শিশুদের বেলাতেই নয় সঠিক প্যারেন্টিং পদ্ধতি পরিণত বয়সী সনত্মানদের জীবন পরিচালনার ৰেত্রেও প্রযোজ্য এবং কার্যকর হয়ে থাকে। উষ্ণতা বা আনত্মরিকতা হচ্ছে সম্পৃক্ততা, অনুকূলে সাড়া দেয়া এবং সমর্থন প্রকাশের মাত্রা আর নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে নিয়মকানুন মেনে চলতে বাধ্য করা এবং স্বাধীনভাবে কোন কিছু করতে বাধা প্রদান।
অধিকার প্রদায়ক : মা-বাবারা সনত্মানদের যেমন খুব যত্ন করেন ঠিক ততটাই আবার নিয়ন্ত্রণ করেন যা একটা সমতা আনয়নে সহায়ক হয়। এ ধরনের মা-বাবা কোন কোন ব্যাপারে সনত্মানদের কিছুটা স্বাধীনতাও দিয়ে থাকেন অনেকটা যেন আধা-স্বায়িত্ত অবস্থা। এরা সনত্মানদের স্বাধীনতার মাত্রা নির্ধারণ করে দেন, তাদের কাছ থেকে কতটুকু প্রতিদান প্রত্যাশা করেন তা বুঝিয়ে বলেন, নিয়ম-নীতি মানার ব্যাপারে সঙ্গতিপূর্ণভাবে কঠোর, যৌক্তিক ও দৃঢ় থাকেন এবং পরনির্ভরশীল না করে সনত্মানদের তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেষ্ট করে তোলেন।
কর্তৃত্বপরায়ন : মা-বাবারা সনত্মানদের প্রতি কম উষ্ণতা বা আনত্মরিকতা প্রকাশ করেন, স্বাধীনতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন, সনত্মানদের নিজস্ব সিদ্ধানত্ম গ্রহণে স্বাধীনতা বা সমর্থন প্রদান করেন না, সনত্মানদের যৌক্তিক মতামত প্রকাশের ৰেত্রেও কম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। এমনকি অবাধ্য হলে এরা প্রায়শই সনত্মানদের শারীরিক বা মানসিকভাবে শাসত্মি প্রদান করেন।
অনুমতিদায়ক : মা-বাবারা সনত্মানদের ব্যাপারে খুবই দুর্বল থাকেন, কোন ধরনের দায়িত্বভার অর্পণ না করে অতিমাত্রায় স্বাধীনতা এবং সেই সঙ্গে সমর্থন দিয়ে যান। সনত্মানকে নিয়ন্ত্রণ করেন খুব কম উপরন্তু সব ধরনের চাহিদা পূরণ করতে সচেষ্ট থাকেন। অমনোযোগী : পিতা-মাতারা সনত্মানদের প্রতি দায়িত্বও পালন করেন না এবং তাদের কাছ থেকে তেমন কিছু প্রত্যাশাও করেন না। এরা সনত্মানদের ব্যাপারে উদাসীন থাকেন বলে কোন ধরনের সমর্থন দেখান না বা কোন নিয়ন্ত্রণও প্রয়োগ করেন না।
দেখা যায় কর্তৃত্বপরায়ন পিতা-মাতার সনত্মানেরা বাধ্যগত হলেও সাধারণত খামখেয়ালি হয়। এরা নিজেদের গুটিয়ে রাখে, কম আত্মবিশ্বাসী হয়, নতুন পরিস্থিতিতে ভীতসন্ত্রসত্ম হয়ে পড়ে এবং সামাজিকভাবে মেলামেশা করতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। অনুমতিদায়ক পদ্ধতিতে বেড়ে ওঠা সনত্মানেরা যদিও বেশি সৃজনশীল গুণসম্পন্ন হয়ে থাকে কিন্তু এরা কথা-বার্তায় এবং স্বভাবগতভাবে আবেগপ্রবণ হয়। এরা অনেকটা আক্রমণাত্মক স্বভাবের হয় এবং শিৰালয়ের বেঁধে দেয়া নিয়ম-কানুন মেনে চলতেও এদের অসুবিধা হয়। তাছাড়া এরা মনে করে যে পিতা-মাতা তাদের ব্যাপারে যত্নবান নয় এবং তাদের স্বভাবের জন্যও পিতা-মাতার তেমন কিছু যায় আসে না। অধিকারপ্রদায়ক পিতা-মাতার সনত্মানদের ৰেত্রেই ইতিবাচক উন্নতি বেশি হতে দেখা যায়। এরা সুশৃঙ্খল, অধিক আত্মপ্রত্যয়ী, সামাজিকভাবে বেশি আত্মবিশ্বাসী, কৌতূহলি, নিজস্ব শক্তির ওপর নির্ভরশীল ইত্যাদি গুণসম্পন্ন হয়ে থাকে। অবহেলাপূর্ণ বা অমনোযোগী সনত্মানেরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। এদের মধ্যে অনেককেই অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়তে অথবা মাদকাসক্ত হয়ে পড়তে দেখা যায়।
আমাদের দেশে আজকাল অনেক মা-বাবাকেই হতাশা প্রকাশ করতে শোনা যায় যে বাচ্চারা নিয়ম-কানুন মেনে চলার প্রতি আগ্রহী নয়। সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে এর প্রধান কারণ আগের দিনের শিশুরা খেলার মাঠ, স্কুল থেকে আরম্ভ করে তার পরিবেশ ও সমাজের প্রায় সর্বত্র একই বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের সম্মুখীন হতো। মা-বাবারাও সনত্মানদের কাছে প্রত্যাশা ছিল প্রায় একই ধরনের। কিন্তু এখন সে চিত্র বদলে গেছে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ছোট ছোট পরিবারগুলোর জীবনযাপনের মান এবং রীতিনীতি বিভিন্ন এবং তাই শিশুরাও বিভিন্ন সময়ে মূল্যবোধ ও ন্যায়-অন্যায়ের বিভিন্ন মিশ্রণের সম্মুখীন হচ্ছে যা প্রতি নিয়ত তাদের এক ধরনের বিভ্রানত্মির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
তাই এ অবস্থা মোকাবেলা করতে শিশু অবস্থা থেকেই বাবা-মাকে অনেক বেশি যত্নবান হতে হবে। সনত্মানের প্রতি মা-বাবার স্নেহ চিরনত্মন আর স্নেহ-ভালবাসা ও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের লৰ্যে একটি মৌলিক চাহিদাও বটে। তবে সেই সঙ্গে তাদের ছোট বেলা থেকেই শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনে অভ্যসত্ম করে তুলতে হবে। শৃঙ্খলা মানে হচ্ছে এমন সব নিয়মকানুন যা সমাজে এবং ধর্মীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য সেগুলো মেনে চলা এবং যেগুলো গ্রহণযোগ্য নয় সেগুলো বর্জন করে চলা। সফল মাতা-পিতা এবং তাদের সনত্মানেরা নিয়মানুবর্তিতার বেলায় একদল অপর দলের অংশীদার। এ ধরনের মাতা-পিতা জানেন নিয়মানুবর্তিতা কোন শাসত্মি নয় বরং এক ধরনের শিৰনীয় পদ্ধতি। তারা এও জানেন তাদের আচরণ, অভ্যাস এবং আবেগ সনত্মানদের স্বভাব এবং আবেগের ওপর দারম্নণভাবে প্রভাব বিসত্মার করে। আর বেশির ভাগ ৰেত্রেই মাতা-পিতার অসফলতার কারণ নিয়মানুবর্তিতা ও রীতিনীতি প্রয়োগের ৰেত্রে সঙ্গতিহীনতা বা তাদের পরস্পরবিরোধিতা।
অনেক মা-বাবা এমন একটি ভ্রানত্ম ধারণা পোষণ করেন যে সনত্মানদের অনুশাসন নয়, যতদূর সম্ভব শুধু ভালবাসাই দিয়ে যেতে হবে। এই ভ্রানত্ম ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা সনত্মানদের অগ্রহণযোগ্য আচরণ শোধরানোর চেষ্টা করেন না এবং মনে করেন বড় হলে এক সময় সব ঠিক হয়ে যাবে। অনেকে আবার সনত্মানদের শোধরানো বা শাসত্মি দেয়ার ব্যাপারে ভীত, কারণ তারা মনে করেন এতে করে সনত্মানরা হয়তো কষ্ট পাবে এবং সনত্মানদের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব তৈরি হবে। তাই তারা সনত্মানদের শাসন বা শোধরানোর চেষ্টা থেকে বিরত থাকেন।
যদিও অধিকারপ্রদায়ক পদ্ধতিই বেশি ফলপ্রসূ হয়ে থাকে তবে কখনও কখনও মিশ্র পদ্ধতি গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। নমনীয়তা এমনকি অত্যধিক কঠোরতাও খারাপ অভ্যাসকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই শৈশব থেকেই প্রশ্রয় না দিয়ে খারাপ অভ্যাস শোধরানোর জন্য অথবা রীতিনীতি বা নিয়মকানুন মেনে চলার ব্যাপারে সনত্মানদের মনোযোগী করে তুলতে হবে। এৰেত্রে কঠোর নয় এমন শাসত্মিও প্রদান করা যেতে পারে। শাসত্মি হিসেবে অল্প সময়ের জন্য সখের জিনিস পাওয়া, পছন্দনীয় খেলা, কাজ বা বেড়ানোর সুযোগ থেকে কিছু সময় বা দিন বিরত রাখা অথবা প্রিয়জনের সাহচর্য পাওয়ার সুযোগ থেকে সাময়িকভাবে বঞ্চিত রাখা যেতে পারে। কোন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে তা অনেকটা সনত্মানের স্বভাবের ওপর নির্ভর করে। যেমন_ যদি কোন সনত্মান বেশি অবাধ্য হয়ে ওঠে তবে সেৰেত্রে কঠোর কিছু নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। আজকের শিশু আগামীদিনের নাগরিক। তাই সনত্মানকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রাথমিক দায়িত্ব মা-বাবার হলেও স্কুল, সমাজ এবং জাতিকেও এ ব্যাপারে ইতিবাচক পদৰেপ গ্রহণ করতে হবে।
No comments