চালের মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কাঃ জেগে ঘুমানো বিপজ্জনক হতে পারে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে চাল উত্পাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। বিশ্বের প্রধান ধান উত্পাদনকারী দেশগুলোতেও উত্পাদন ভালো হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে চালের মূল্য বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু কৃষিমন্ত্রী দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, দেশে এবার কাঙ্ক্ষিত উত্পাদন হয়েছে এবং সঙ্কটের কোনো আশঙ্কা নেই।
বুধবার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় উপস্থিত গবেষক-অর্থনীতিবিদদের বক্তব্যের বিরোধিতা করে কৃষিমন্ত্রী আমন উত্পাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হওয়ার দাবি করেছেন। এক লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উত্পাদন বেশি হয়েছে ৪ হাজার মেট্রিক টন। তিনি জোর গলায় দেশে কোনো খাদ্যসঙ্কটের আশঙ্কা নেই বলে উল্লেখ করেছেন। তবে উপস্থিত আলোচকদের অনেকেই মন্ত্রীর সঙ্গে একমত পোষণ করেননি।
সভার মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ২০০৯-১০ সালে বিশ্বে ধানের উত্পাদন ৩ ভাগ কমবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভারত, ফিলিপাইন, উরুগয়ে, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা প্রভৃতি দেশে ধান উত্পাদন মার খেয়েছে। এর মধ্যেই অন্যতম চাল রফতানিকারক দেশ ফিলিপাইন চাল আমদানি করার ঘোষণা দিয়েছে। তারা আগামী বছর দুই মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল আমদানি করবে। খরার কারণে ১৫ লাখ টন চালের ঘাটতি মোকাবিলায় ভারতও চাল আমদানি উত্সাহিত করার জন্য ৭০ ভাগ কর প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। আর ব্রাজিল ও সুইজারল্যান্ড স্বাভাবিকের চেয়ে চাল আমদানি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব কারণে এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। এ অবস্থায় দেশে ছয় মাস ধরে চাল আমদানি বন্ধ এবং আমন উত্পাদনে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় চালের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা খুবই বাস্তবসম্মত।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী অস্বীকার করলেও বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষকে চিন্তিত না করে পারে না। এ সরকারের আমলে মন্ত্রীদের আশ্বাস মিথ্যা প্রমাণ হওয়া নতুন নয়। এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা ডিঙিয়ে বার বারই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির মাশুল গুনতে হয়েছে মানুষকে। এ অবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বোরো উত্পাদন ঝুঁকিমুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা দরকার। অনুষ্ঠানের বক্তারাও এসব বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। বীজ, সার, সেচ সঙ্কট দূর করা না গেলে বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বীজের সঙ্কট নেই বলা হলেও কৃষক বীজ পাচ্ছে না এমন অভিযোগ তুলে সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান বলেন, দু’শ’ টাকার বীজ কৃষককে কিনতে হচ্ছে ৬৫০ টাকায়। তিনি বিদ্যুত্ সঙ্কটের কথাও বলেছেন। রাতে বিদ্যুত্ দেয়ার কথা প্রচার করা হলেও কৃষক তা পাচ্ছে না। এর সমর্থন মিলেছে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে। গতকালের আমার দেশ-এর খবরে জানা যায়, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের নতুন সেচ নীতিমালার ফলে টাঙ্গাইলের মধুপুর, গোপালপুর, ধনবাড়ী, ভূঞাপুর, ঘাটাইল উপজেলার চারশ’রও বেশি সেচপাম্প অচল হয়ে আছে। ফলে ৩৫ হাজার একরেরও বেশি জমি অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। এমন অব্যবস্থার খবর অন্যান্য জেলা থেকেও পাওয়া যাচ্ছে। সরকার অবশ্য এ বাস্তবতার কথা অস্বীকার করতেই সচেষ্ট।
অন্যদিকে খাদ্য অধিদফতর সূত্রে বলা হচ্ছে, ১৫ কোটি মানুষের জন্য বছরে দুই কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন চালের প্রয়োজন। এর বিপরীতে চাল ও গম মিলিয়ে এ বছর উত্পাদন হয়েছে তিন কোটি ২৬ লাখ মেট্রিক টন। কাগজপত্রের হিসাবে খাদ্যে আমরা উদ্বৃত্ত বলতেই হয়! তবে বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি পরিষ্কার বলেছেন, সরকার যতই বলুক না কেন, আমনের ফলন কম হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্টদেরও একই অভিমত পোষণ করতে দেখা যায়।
এ অবস্থায় বোরো উত্পাদনে কৃষি উপকরণাদির প্রাপ্যতা সহজলভ্য করার পাশাপাশি এখনই বোরো সংগ্রহের মূল্য ঘোষণার দাবি তোলা হয়েছে। হিসাব করে বলা হয়েছে, এবার বোরোর উত্পাদন খরচ পড়বে কেজি প্রতি ধান ১১.৪৩ টাকা ও চাল ১৮.২২ টাকা। সরকারের সংগ্রহ মূল্য হতে হবে ধানের ক্ষেত্রে কেজি প্রতি ১৫ টাকা এবং চাল ২৫ টাকা। এ দামে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করা হলে কৃষক লাভবান হবে। এর পাশাপাশি ইউনিয়ন পর্যায়ে শস্য গুদাম গড়ে তোলা ও কৃষকের ঋণ পাওয়ার সুবিধা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। আর বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল সংগ্রহ করলে দেশীয় বাজারে চালের দাম বাড়বে বৈ কমবে না। অর্থাত্ চালের মূল্য নিয়ে দেয়ার মতো সুখবর কারও কাছে নেই। তারপরও কৃষিমন্ত্রীর কথা শুনে কেউ যদি বলে ফেলেন, তিনি জেগে ঘুমাতেই ভালোবাসেন—তবে বলার কিছু নেই। এটা যে সবার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে তা বলাই বাহুল্য।
No comments