প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ভাষা আন্দোলন by সরদার সিরাজুল ইসলাম
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বে¡র ভিত্তিতে বিট্রিশ ভারত বিভক্ত হয়ে পড়লেও নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের ৫৬ শতাংশ বাংলাভাষী জনগণ স্বাধীনতার আনন্দে বিভোর হওয়ার চাইতে যা নিয়ে সংগ্রাম শুরু করতে হয় তা হচ্ছে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিটি।
১৯৪০ সালের লাহোরে প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরে ধারণা ছিল বাংলা একটি স্বতন্ত্র ও স্বশাসিত দেশ হবে, তাই তখনকার পর্যালোচনা ছিল নবরাষ্ট্রে বাংলা ভাষার চরিত্র ও চেহারা কি হবে সেই বিষয়টি। কিন্তু ১৯৪৭ সনের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ ঘোষিত হলে এবং মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস তা মেনে নিলে স্বশাসিত রাষ্ট্রের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। একটি স্বাধীন দেশের জন্য জাতীয় ঐক্য যেখানে খুবই প্রয়োজনীয় ছিল সেখানে জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে পাকিস্তানের নবরাষ্ট্রের কর্ণধাররা ভাষার মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে শুরু করলেন: ‘পাকিস্তানে একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা।’ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা বা তার ভৌগোলিক কাঠামো কি হবে তা নির্ধারণের পূর্বেই ১৯৪৭ সালের ১৭ মে হায়দারাবাদে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভাপতি চৌধুরী খালিকুজ্জামান মুসলিম- ইত্তেহাদুল মোছলেমীনের বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত উর্দু সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ঘোষণা করেন। উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা। একই বছর জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহম্মদও উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হবে বলে দাবি করেন। ড. জিয়াউদ্দিনের মন্তব্যের প্রতিবাদে জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ২৯ জুলাই’ ৪৭ দৈনিক আজাদে পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা শীর্ষক এক নিবন্ধে বলেন, “প্রাদেশিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার পক্ষে ড. জিয়াউদ্দিন যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবল বৈজ্ঞানিক নীতিবিরোধী নয় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বিবর্জিতও বটে।” তিনি আরো বলেন, “পাকিস্তান ডমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন যেমন: গুপ্ত, বেলুচী, পাঞ্জাবী, হিন্দি এবং বাংলা। কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের কোন অঞ্চলের মাতৃভাষারূপে চালু নয়। উপরোক্ত ভাষাসমূহের মধ্যে বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করিয়াছে। অধিক সংখ্যক লোকে একটি ভাষা বলে, এই অনুযায়ী বাংলা ভাষা বিশ্বভাষার মধ্যে সপ্তম স্থান অধিকার করিয়াছে। যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজী পরিত্যক্ত হয় তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই।” বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সে সময় যারা প্রবন্ধ লেখেন তাদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়াও ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, আব্দুল হক, আবুল মনসুর আহম্মদ, আবুল কাসেম, মাহবুল জামাল জাহেদী প্রমুখ। তবে কবি গোলাম মোস্তফা ও সাংবাদিক মুজিবুর রহমান খাঁ প্রমুখ উর্দুর সমর্থক ছিলেন।১৯৪৭ সাল থেকেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারে আরবী হরফে বাংলা লেখার ব্যবস্থা চালু করার প্রয়াস শুরু করেন। পূর্ব বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন উর্দুভাষী; যার ফলে তিনি বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হন।
১৯৪৭ সালের ৫ জুলাই গণআজাদী লীগ নামে একটি সংস্থা গঠিত হয়। ঢাকাস্থ মুসলিম লীগের বামপন্থী অংশের কয়েকজন নিয়ে গঠিত এই ক্ষুদ্র সংগঠনটির প্রধান নেতা ও আহ্বায়ক ছিলেন কমরুদ্দিন আহম্মদ। অন্যরা ছিলেনÑ মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহম্মদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন, আবুল কাসেম, ফজলুর রহমান, আলী আশরাফ, আব্দুল মুনীম, শওকত আলী, নজমুল করিম, নুরুল হক প্রমুখ। গণআজাদী লীগের ঘোষণায় বলা হয়, “মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে।... বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে দেশের যথোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৫০ সালে গণআজাদী লীগের নাম পরিবর্তন করে সিভিল লিবার্টি লীগ করা হয়। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান তমুদ্দিন মজলিস নামে একটি সংস্থার জন্ম হয়, এর সম্পাদক ছিলেন আবুল কাসেম। এই সংগঠনের লক্ষ্য ছিল কুসংস্কার ও প্রতিক্রিয়াশীলতাকে দূর করে ধর্মভিত্তিক সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা ও নিখুঁত চরিত্র গঠনের মাধ্যমে মানবীয় মূল্যবোধভিত্তিক সাহিত্য, শিল্প সৃষ্টি করা। মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রথম দিকে মজলিসের তৎপরতা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুসলিম লীগ সরকারের প্রবল বিরোধিতার মুখে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের জন্ম হয়। এর নেতা ছিলেন কমরুদ্দিন আহম্মদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহম্মদ, শামসুদ্দিন আহম্মদ, তসাদ্দুক হোসেন, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, নুরুদ্দিন আহম্মদ, আব্দুল ওদুদ, হাজেরা মাহমুদ প্রমুখ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে দাবি ছিল এই সংগঠনের লক্ষ্য।
১৯৪৭ সালের ১২ নবেম্বর তমুদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিভিল সাপাই মন্ত্রী নুরুল আমিন বলেন, “যদি রাষ্ট্রের জনসাধারণের মাতৃভাষার মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা না হয় তবে নাগরিকদের সহিত সে রাষ্ট্রের সম্পর্ক অতি শীঘ্রই বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। পূর্ববাংলার অধিবাসীদের ওপর বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষা চাপানো যুক্তিসংগত নহে। বাংলা ভাষাকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার কোন প্রতিবন্ধকতা নাই বলিয়া আমি মনে করি। ” নূরুল আমিন আরো বলেন, “উর্দু ভাষার সহিত ইসলাম ধর্মের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে বলিয়া আলেমগণ যে দাবি করেন তা ঠিক নয়। “সভাপতির ভাষণে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার প্রয়োজনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ও উর্দু ভাষারই প্রচলন করা যাইতে পারে।” বলে বক্তব্য রাখেন। সভায় কৃষিমন্ত্রী সৈয়দ মোঃ আফাজাল, আবুল হাসনাত, ড. এনামুল হক, কবি জসীম উদ্দীন প্রমুখ বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে প্রচলন সমর্থন করলেও একমাত্র কবি গোলাম মোস্তফা বিরোধিতা করেন। ১৭ নবেম্বর বাংলাকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবি জানাইয়া দেশের বিশিষ্ট্য সাহিত্যিক কবি, আইনজীবী, শিল্পী, সরকারী কর্মচারী, ওলামা, শিক্ষকবৃন্দ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন।
২৭ নবেম্বর ’৪৭ করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল রহমান বলেন, “সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐক্য বিসর্জন না দিয়ে আমরা প্রাদেশিক ভাষাসমূহ কেবল শিক্ষার মাধ্যমে নয়, সংস্কৃতি প্রচারের মাধ্যমে হিসাবেও সমধিক পরিমাণ সমৃদ্ধি লাভের সুযোগ দিব।” সম্মেলনে প্রাদেশিক মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার বাংলা ও সীমান্ত প্রদেশের প্রাথমিক স্কুলে উর্দুভাষা শিক্ষা দেয়ার বিরোধী মনোভাব ব্যক্ত করেন।
করাচীর শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার মনোভাবের খবর ঢাকায় একটু দেরিতে পৌঁছে। ৬ ডিসেম্বর ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের এক বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষার দাবিতে প্রথম সাধারণ সভায় সভাপতিত্ব করেন তমুদ্দুন মজলিদের সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম এবং বক্তব্য রাখেন মুনীর চৌধুরী, আবদুর রহমান, কল্যাণ চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ কে এম আহসান, এস আহম্মদ প্রমুখ। ডাকসু ভিপি ফরিদ আহম্মদ সভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাব পেশ করেন :
(ক) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা ও শিক্ষার বাহন করা হোক।
(খ) রাষ্ট্রভাষা ও লিংগুয়া ফ্রাংকা নিয়ে যে বিভান্তি করা হচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পূর্ববাংলার জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।
(গ) পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ফজলুল রহমান ও প্রাদেশিক মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের আচরণের তীব্র নিন্দা করছে।
(ঘ) সভা মর্নিং নিউজ পত্রিকার বাঙালী বিরোধী প্রচারণার তীব্র নিন্দা করছে ও পত্রিকাটিকে সাবধান করে দিচ্ছে।
সভার পরে ছাত্ররা মিছিল বের করে।
৫ ডিসেম্বর ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলাকালে ছাত্র-শিক্ষকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বাংলাকে পূর্ববাংলার রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। অবশ্য লীগ ওয়ার্কিং কমিটি প্রাদেশিক লীগ সভাপতি মওলানা আকরাম খাঁকে একথা ঘোষণা করার ক্ষমতা দিয়েছেন যে, “উর্দু পূর্বপাকিস্তানের সরকারী ভাষা হইবে না।” একই দিন আবুল কাসেম, আবু জাফর শামসুদ্দিন মওলানা আকরাম খাঁ’র সঙ্গে সাক্ষাত করলে তিনি তাদেরকে আশ্বাস দেন যে, পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষা চাপানোর চেষ্টা করা হলে পূর্ব পাকিস্তান বিদ্রোহ ঘোষণা করবে এবং তিনি তার নেতৃত্ব দেবেন। (চলবে)
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
No comments