বীরাঙ্গনা ৭১ হাজার হাজার নারী গর্ভবতী হয়ে পড়ে by মুনতাসীর মামুন
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের কতজন নারী ধর্ষিত
হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরপর আমরা নানা হিসাব পেয়েছি। এখন হিসাবটা চার লাখে
দাঁড়িয়েছে। ডা. ডেভিসও এই সংখ্যা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের
ব্যাপক সংখ্যক ধর্ষিতার কথা বাইরের পৃথিবীতে জানাজানি হলে তখন বিভিন্ন
সাহায্যসংস্থা এদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল এ্যাকশন
রিসার্চ এ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার ডা. জিওফ্রে ডেভিসকে বাংলাদেশে পাঠায়।
তিনি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ধর্ষিতাদের নিয়ে কাজ করেছেন। তৎকালীন সরকারী
কর্মচারীরা যে হিসাব দিয়েছেন, ডা. ডেভিস জানিয়েছিলেন তা ঠিক নয়। তিনি
বলেছেন, ‘সরকারী কর্মকর্তারা বাংলাদেশের জেলাওয়ারী হিসাব করেছেন। সারা
দেশের ৪৮০টি থানার ২৭০টি পাক সেনাদের দখলে ছিল। প্রতিদিন গড়ে দুজন করে
নিখোঁজ মহিলার সংখ্যা অনুসারে লাঞ্ছিত মহিলার সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ। এই
সংখ্যাকে চূড়ান্তভাবে নির্ভুল অঙ্করূপে গ্রহণ করার সিন্ধান্ত হয়।’। ডা.
ডেভিস মনে করেন এই সংখ্যা ৪ লাখ থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজারের মতো হবে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, ধর্ষিত ও নির্যাতিতদের সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। নিউজ উইকের একটি প্রতিবেদনের কথা ধরা যাক উদাহরণ হিসেবে। ১৯৭১ সালের ১৫ নবেম্বর পত্রিকাটি লিখেছিল, মুক্তিবাহিনীকে দমন করার নামে কিছুদিন আগে পাক সেনারা ডেমরা নামে এক গ্রামে অভিযান চালায় (যেখানে মুক্তি বাহিনী আদৌ ছিল না)। তারা ১২ থেকে ৩৫ বছরের সমস্ত মহিলাকে ধর্ষণ করে এবং গুলি করে মারে ১২ বছরের বেশি বয়সের সমস্ত পরুষদের ।
ডা. ডেভিস এ পরিপ্রেক্ষিতে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন
‘প্রশ্ন : পাকিস্তানের অসংখ্য নথিপত্রে এখনও বলা হয়, ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা অত্যন্ত বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। আপনি কি তাদের এ দাবি সত্য মনে করেন?
জেফ্রি : না, না... তারা ধর্ষণ করেছে। সম্ভবত তারা প্রকৃতই যা করেছে, তার তুলনায় অনেকগুণ কম সংখ্যা দাবি করা হয়। তারা যে পদ্ধতিতে শহর দখল করত তার বিবরণ খুব কৌতূহলোদ্দীপক। তারা তাদের পদাতিক বাহিনীকে পেছনে রেখে গোলন্দাজ বাহিনীকে সামনে নিয়ে আসত। তারপর হাসপাতাল, স্কুল-কলেজে গোলা ছুড়ে গুড়িয়ে দিত। এরফলে শহরে নেমে আসত চরম বিশৃঙ্খলা আর তারপর পদাতিক বাহিনী শহরে ঢুকে পড়ে মেয়েদের বেছে বেছে আলাদা করত। শিশু ছাড়া যৌনভাবে ম্যাচিওরড সকল মেয়েকে তারা একত্রে জড়ো করত। আর শহরের বাকি লোকজনকে বন্দী করে ফেলত পদাতিক বাহিনীর অন্যরা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলা হতো। আর তারপর মেয়েদের পাহারা দিয়ে কম্পাউন্ডে নিয়ে এসে সৈন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হতো। অত্যন্ত জঘন্য একটা ব্যাপার ছিল এটা। বিশ্বের কোথাও কখনও এমন ঘটনার নজির পাওয়া যায় না। তবুও, এমনটাই ঘটেছিল।’
হ্যাঁ, যুক্তির খাতিরে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের ৬৪ হাজার গ্রামে তো পাকিস্তানী সৈন্যরা যায়নি। কথাটা ঠিক, ৬৪ হাজার গ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যরা যায়নি; কিন্তু যেসব গ্রামে গেছে সেখানেই তারা মেয়েদের সর্বনাশ করেছে। আমরা এখানে যে ঘটনাগুলো বর্ণনা করেছি তাতে একটি প্যাটার্ন ফুটে উঠেছে। তাহলো : গ্রামে গ্রামে তারা সুনির্দিষ্টভাবে মেয়েদের জন্য হানা দিচ্ছে, শহরাঞ্চল থেকে মেয়েদের উঠিয়ে নিচ্ছে, সে এক ভয়াবহ অবস্থা। অনেক জায়গায় রাজাকার বা শান্তি কমিটির সদস্যরা মেয়েদের তুলে নিয়ে গেছে। ধর্ষিতা নারীদের একটি অংশ আত্মহত্যা করেছে, মেরে ফেলা হয়েছে। একটি অংশের পরিবার-পরিজন ধর্ষণের কথা কখনও স্বীকার করেনি সামাজিক কারণে। ফলে সঠিক সংখ্যা কখনও জানা যাবে না। সরকারী কর্মকচারীরা তখন নানাবিধ কারণে ধর্ষিতার সংখ্যা কম করে দেখাতে চেয়েছে। এর পেছনে যে মানসিকতা কাজ করেছে তাহলো এক ধরনের অপরাধবোধ। কারণ, এই মেয়েদের রক্ষার দায়িত্ব আমরা যে কোন কারণেই হোক পালন করতে পারিনি। অনেকের কাছে এটি লজ্জার বিষয় মনে হয়েছে। এই মানসিকতার সমাজতাত্ত্বিক কারণ কি তা আমি জানি না। যে কারণে, এখনও নারী ধর্ষণের বিষয়টি পারতপক্ষে কেউ আলোচনায় আনতে চান না।
ডা. ডেভিস আরও উল্লেখ করেছিলেন, ‘হানাদার বাহিনী গ্রামে গ্রামে হানা দেয়ার সময় যে সব তরুণীকে ধর্ষণ করেছে তার হিসাব রক্ষণে সরকারী রেকর্ড ব্যর্থ হয়েছে। পৌনঃপুনিক লালসা চরিতার্থ করার জন্য হানাদার বাহিনী অনেক তরুণীকে তাদের শিবিরে নিয়ে যায়। এসব রক্ষিতা তরুণীর অন্তঃসত্ত্বার লক্ষণ কিংবা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে হয় তাদের পরিত্যাগ করা হয়েছে, নয়ত হত্যা করা হয়েছে।’
সুসান ব্রাউনমিলার লিখেছেন: Rape in Bangladesh had hardly been restricted to beauty... girls of eight and grandmothers of seventy-five had been sexually assaulted.” পাকিস্তানীরা স্থানিকভাবেই শুধু ধর্ষণ করেনি, শত শত নারীকে মিলিটারি ব্যারাকে নিয়ে আটকে রেখেছে রাতে ব্যবহারের জন্য।
Some women may have been raped as many as eight times in a night. How many died from this atrocious treatment, and how many more women were murdered as part of the generalized campaign of destruction and slaughter, can only be guessed at.
ডা. এম.এ. হাসান তাঁর গ্রন্থে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে ধর্ষিতের সংখ্যা দুই থেকে চার লাখের কথা বলা হয়েছে। তাঁর নিজের জরিপের উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৯১-২০০২ সাল পর্যন্ত দেশের ৪২ জেলার ২৫টি থানায় পরিচালিত আমাদের গবেষণায় গৃহীত অসংখ্য সাক্ষাতকারের মধ্য থেকে নির্বাচিত ২৬৭ ব্যক্তির সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, একাত্তরে দু’লাখ দু’হাজার জন নারী ধর্ষিত হয়েছে ওই সব স্থানে।... সারা দেশে ধর্ষিত ও নির্যাতিত নারীর সংখ্যা সাড়ে চার লাখের ওপরে।
তিনি অবশ্য ধর্ষিত ও নির্যাতিতকে আলাদা হিসেবে দেখিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যই বলে দেয়, এটি সারা দেশের জরিপ নয়, সাক্ষ্যও সম্পূর্ণ নয়। তবুও ধর্ষণের ব্যাপকতটা বোঝা যায়।
এরপরে তিনি যে বর্ণনা দিয়েছেন সে বর্ণনা আক্ষরিক অর্থে ধরলে তাঁর দেয়া সংখ্যাই ছাড়িয়ে যাবে। তিনি লিখেছেন, পূর্বতন সিলেটে ৩০ হাজার বীরাঙ্গনার সন্ধান পেয়েছেন। এ অঞ্চলের চা বাগানগুলোর মহিলা শ্রমিক, তাদের যুবতী ও কিশোরী কন্যাগণ, মনিপুরী ও খাসিয়া মহিলারা ব্যাপক হারে নির্যাতনের শিকার হন। সিলেট শহর, বালাগঞ্জের বুরুঙ্গা, আদিত্যপুর, শ্রী রামসী, শেরপুর, পীরপুর, পীরনগর, করিমগঞ্জ সীমান্ত ও হাওড় এলাকা, সুনামগঞ্জের হাওড় এলাকা, মৌলভীবাজার শহর, রাজনগর, সাধুহাটি, কমলগঞ্জ থানার শমসের নগর, মনিপুরীদের বিভিন্ন গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি এবং হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, শায়েস্তাগঞ্জসহ বিভিন্ন থানার গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে হামলা চালিয়ে পাকিরা অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করে। এ ছাড়া টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর থানার ছাব্বিশাসহ বিভিন্ন গ্রাম, বরিশালের গৌরনদী থানার প্রায় সব গ্রাম, আগৈলঝাড়ার রাজিহার, চেতনার কোলা গ্রামসহ সমগ্র বরিশালে পাকিরা ব্যাপক নির্যাতন চালায়।’ এ ছাড়া তিনি ফরিদপুর জেলারও বিভিন্ন থানার বেশ কিছু গ্রামের নাম দিয়েছেন যেখানে ব্যাপকহারে ধর্ষণ করা হয়। একটি শহরের প্রতিটি বাড়িতে হানা দিলে ধর্ষিতের সংখ্যা কত দাঁড়ায়।
আগে উল্লেখ করেছি- শুধু খান সেনারা নয়, তাদের সহযোগী রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজনও ধর্ষণ করেছে। ব্রাউনমিলার সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদন উদ্ধৃত করেছেন যেখানে বলা হয়েছে, রাতে পাকিস্তানী সৈনিক ও রাজাকাররা গ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেয়েদের তুলে নেয়। কাউকে কাউকে স্থানিকভাবে ধর্ষণ করা হয়। বাকিদের ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইন্টারন্যশনাল কমিশন অব জুরিস্টস জানিয়েছিল ‘জানা যায়, পাকিস্তানী সৈন্যরা ব্যাপক ধর্ষণ চালিয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক নারী এবং কম বয়সী মেয়েদের ওপর। অসংখ্য সূত্র থেকে ঘটনা সম্পর্কে স্বীকারোক্তি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ সরকার দাবি করেছে, ৭০,০০০-এর বেশি নারী এসব ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে। সঠিক সংখ্যা যাই হোক না কেন, মার্কিন ও ব্রিটিশ শল্য চিকিৎসকরা গর্ভপাতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন জনগণকে এসব ধর্ষিত নারীকে সমাজে গ্রহণ করার প্রচারণায়। এসব অবস্থা সাক্ষ্য দিচ্ছে ধর্ষণের বিশাল সংখ্যার। পাকিস্তানী অফিসাররা এসব বর্বরতা সম্পর্কে নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশ করে দায়মুক্ত থাকতে চায়। বহু ক্ষেত্রেই কিন্তু এসব সেনা অফিসার নিজেরা যুবতী মেয়েদের ধরে এনে আটক রাখত নিজেদের যৌন সন্তুষ্টির জন্য।’ যে সব সাংবাদিক তখন রিপোর্ট করেছিলেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাদের প্রতিবেদনেও প্রসঙ্গটি এসেছে বারবার এ রকম চারজনের রিপোর্ট উদ্ধৃত করছি
নিউজ উইকের সাংবাদিক টনি ক্লিফটন উল্লেখ করেছেন, ‘আমি দেখতে পাই যে, আক্ষরিক অর্থে মানুষ বোবা হয়ে গেছে, যখন পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের চোখের সামনে বাচ্চাদের হত্যা করেছে এবং মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে তাদের ভয়ঙ্কর যৌন পরিতৃপ্তির জন্য...। পূর্ব পাকিস্তানে শত শত মাইলাই এবং লেডিসির মতো নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছে সে ব্যাপারে আমার কোনই সন্দেহ নেই।’
নিউজউইকের সিনিয়র সম্পাদক এ্যারমাউড ডি ব্রোচ গ্রেভ : ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক বিদ্রোহীদের খুঁজতে আসার ভান করে ডেমরা গ্রাম ঘেরাও করে। তারপর ১২ থকে ৩৫ বছর বয়সী সকল নারীকে ধর্ষণ করে এবং ১২ বছরের বেশি বয়সী সকল পুরুষকে হত্যা করে।’
নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি এইচ, শ্যেনবার্গ : ‘পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই বাঙালী মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে আটক রেখেছে। (চলবে)
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, ধর্ষিত ও নির্যাতিতদের সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। নিউজ উইকের একটি প্রতিবেদনের কথা ধরা যাক উদাহরণ হিসেবে। ১৯৭১ সালের ১৫ নবেম্বর পত্রিকাটি লিখেছিল, মুক্তিবাহিনীকে দমন করার নামে কিছুদিন আগে পাক সেনারা ডেমরা নামে এক গ্রামে অভিযান চালায় (যেখানে মুক্তি বাহিনী আদৌ ছিল না)। তারা ১২ থেকে ৩৫ বছরের সমস্ত মহিলাকে ধর্ষণ করে এবং গুলি করে মারে ১২ বছরের বেশি বয়সের সমস্ত পরুষদের ।
ডা. ডেভিস এ পরিপ্রেক্ষিতে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন
‘প্রশ্ন : পাকিস্তানের অসংখ্য নথিপত্রে এখনও বলা হয়, ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা অত্যন্ত বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। আপনি কি তাদের এ দাবি সত্য মনে করেন?
জেফ্রি : না, না... তারা ধর্ষণ করেছে। সম্ভবত তারা প্রকৃতই যা করেছে, তার তুলনায় অনেকগুণ কম সংখ্যা দাবি করা হয়। তারা যে পদ্ধতিতে শহর দখল করত তার বিবরণ খুব কৌতূহলোদ্দীপক। তারা তাদের পদাতিক বাহিনীকে পেছনে রেখে গোলন্দাজ বাহিনীকে সামনে নিয়ে আসত। তারপর হাসপাতাল, স্কুল-কলেজে গোলা ছুড়ে গুড়িয়ে দিত। এরফলে শহরে নেমে আসত চরম বিশৃঙ্খলা আর তারপর পদাতিক বাহিনী শহরে ঢুকে পড়ে মেয়েদের বেছে বেছে আলাদা করত। শিশু ছাড়া যৌনভাবে ম্যাচিওরড সকল মেয়েকে তারা একত্রে জড়ো করত। আর শহরের বাকি লোকজনকে বন্দী করে ফেলত পদাতিক বাহিনীর অন্যরা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলা হতো। আর তারপর মেয়েদের পাহারা দিয়ে কম্পাউন্ডে নিয়ে এসে সৈন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হতো। অত্যন্ত জঘন্য একটা ব্যাপার ছিল এটা। বিশ্বের কোথাও কখনও এমন ঘটনার নজির পাওয়া যায় না। তবুও, এমনটাই ঘটেছিল।’
হ্যাঁ, যুক্তির খাতিরে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের ৬৪ হাজার গ্রামে তো পাকিস্তানী সৈন্যরা যায়নি। কথাটা ঠিক, ৬৪ হাজার গ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যরা যায়নি; কিন্তু যেসব গ্রামে গেছে সেখানেই তারা মেয়েদের সর্বনাশ করেছে। আমরা এখানে যে ঘটনাগুলো বর্ণনা করেছি তাতে একটি প্যাটার্ন ফুটে উঠেছে। তাহলো : গ্রামে গ্রামে তারা সুনির্দিষ্টভাবে মেয়েদের জন্য হানা দিচ্ছে, শহরাঞ্চল থেকে মেয়েদের উঠিয়ে নিচ্ছে, সে এক ভয়াবহ অবস্থা। অনেক জায়গায় রাজাকার বা শান্তি কমিটির সদস্যরা মেয়েদের তুলে নিয়ে গেছে। ধর্ষিতা নারীদের একটি অংশ আত্মহত্যা করেছে, মেরে ফেলা হয়েছে। একটি অংশের পরিবার-পরিজন ধর্ষণের কথা কখনও স্বীকার করেনি সামাজিক কারণে। ফলে সঠিক সংখ্যা কখনও জানা যাবে না। সরকারী কর্মকচারীরা তখন নানাবিধ কারণে ধর্ষিতার সংখ্যা কম করে দেখাতে চেয়েছে। এর পেছনে যে মানসিকতা কাজ করেছে তাহলো এক ধরনের অপরাধবোধ। কারণ, এই মেয়েদের রক্ষার দায়িত্ব আমরা যে কোন কারণেই হোক পালন করতে পারিনি। অনেকের কাছে এটি লজ্জার বিষয় মনে হয়েছে। এই মানসিকতার সমাজতাত্ত্বিক কারণ কি তা আমি জানি না। যে কারণে, এখনও নারী ধর্ষণের বিষয়টি পারতপক্ষে কেউ আলোচনায় আনতে চান না।
ডা. ডেভিস আরও উল্লেখ করেছিলেন, ‘হানাদার বাহিনী গ্রামে গ্রামে হানা দেয়ার সময় যে সব তরুণীকে ধর্ষণ করেছে তার হিসাব রক্ষণে সরকারী রেকর্ড ব্যর্থ হয়েছে। পৌনঃপুনিক লালসা চরিতার্থ করার জন্য হানাদার বাহিনী অনেক তরুণীকে তাদের শিবিরে নিয়ে যায়। এসব রক্ষিতা তরুণীর অন্তঃসত্ত্বার লক্ষণ কিংবা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে হয় তাদের পরিত্যাগ করা হয়েছে, নয়ত হত্যা করা হয়েছে।’
সুসান ব্রাউনমিলার লিখেছেন: Rape in Bangladesh had hardly been restricted to beauty... girls of eight and grandmothers of seventy-five had been sexually assaulted.” পাকিস্তানীরা স্থানিকভাবেই শুধু ধর্ষণ করেনি, শত শত নারীকে মিলিটারি ব্যারাকে নিয়ে আটকে রেখেছে রাতে ব্যবহারের জন্য।
Some women may have been raped as many as eight times in a night. How many died from this atrocious treatment, and how many more women were murdered as part of the generalized campaign of destruction and slaughter, can only be guessed at.
ডা. এম.এ. হাসান তাঁর গ্রন্থে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে ধর্ষিতের সংখ্যা দুই থেকে চার লাখের কথা বলা হয়েছে। তাঁর নিজের জরিপের উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৯১-২০০২ সাল পর্যন্ত দেশের ৪২ জেলার ২৫টি থানায় পরিচালিত আমাদের গবেষণায় গৃহীত অসংখ্য সাক্ষাতকারের মধ্য থেকে নির্বাচিত ২৬৭ ব্যক্তির সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, একাত্তরে দু’লাখ দু’হাজার জন নারী ধর্ষিত হয়েছে ওই সব স্থানে।... সারা দেশে ধর্ষিত ও নির্যাতিত নারীর সংখ্যা সাড়ে চার লাখের ওপরে।
তিনি অবশ্য ধর্ষিত ও নির্যাতিতকে আলাদা হিসেবে দেখিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যই বলে দেয়, এটি সারা দেশের জরিপ নয়, সাক্ষ্যও সম্পূর্ণ নয়। তবুও ধর্ষণের ব্যাপকতটা বোঝা যায়।
এরপরে তিনি যে বর্ণনা দিয়েছেন সে বর্ণনা আক্ষরিক অর্থে ধরলে তাঁর দেয়া সংখ্যাই ছাড়িয়ে যাবে। তিনি লিখেছেন, পূর্বতন সিলেটে ৩০ হাজার বীরাঙ্গনার সন্ধান পেয়েছেন। এ অঞ্চলের চা বাগানগুলোর মহিলা শ্রমিক, তাদের যুবতী ও কিশোরী কন্যাগণ, মনিপুরী ও খাসিয়া মহিলারা ব্যাপক হারে নির্যাতনের শিকার হন। সিলেট শহর, বালাগঞ্জের বুরুঙ্গা, আদিত্যপুর, শ্রী রামসী, শেরপুর, পীরপুর, পীরনগর, করিমগঞ্জ সীমান্ত ও হাওড় এলাকা, সুনামগঞ্জের হাওড় এলাকা, মৌলভীবাজার শহর, রাজনগর, সাধুহাটি, কমলগঞ্জ থানার শমসের নগর, মনিপুরীদের বিভিন্ন গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি এবং হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, শায়েস্তাগঞ্জসহ বিভিন্ন থানার গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে হামলা চালিয়ে পাকিরা অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করে। এ ছাড়া টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর থানার ছাব্বিশাসহ বিভিন্ন গ্রাম, বরিশালের গৌরনদী থানার প্রায় সব গ্রাম, আগৈলঝাড়ার রাজিহার, চেতনার কোলা গ্রামসহ সমগ্র বরিশালে পাকিরা ব্যাপক নির্যাতন চালায়।’ এ ছাড়া তিনি ফরিদপুর জেলারও বিভিন্ন থানার বেশ কিছু গ্রামের নাম দিয়েছেন যেখানে ব্যাপকহারে ধর্ষণ করা হয়। একটি শহরের প্রতিটি বাড়িতে হানা দিলে ধর্ষিতের সংখ্যা কত দাঁড়ায়।
আগে উল্লেখ করেছি- শুধু খান সেনারা নয়, তাদের সহযোগী রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজনও ধর্ষণ করেছে। ব্রাউনমিলার সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদন উদ্ধৃত করেছেন যেখানে বলা হয়েছে, রাতে পাকিস্তানী সৈনিক ও রাজাকাররা গ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেয়েদের তুলে নেয়। কাউকে কাউকে স্থানিকভাবে ধর্ষণ করা হয়। বাকিদের ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইন্টারন্যশনাল কমিশন অব জুরিস্টস জানিয়েছিল ‘জানা যায়, পাকিস্তানী সৈন্যরা ব্যাপক ধর্ষণ চালিয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক নারী এবং কম বয়সী মেয়েদের ওপর। অসংখ্য সূত্র থেকে ঘটনা সম্পর্কে স্বীকারোক্তি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ সরকার দাবি করেছে, ৭০,০০০-এর বেশি নারী এসব ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে। সঠিক সংখ্যা যাই হোক না কেন, মার্কিন ও ব্রিটিশ শল্য চিকিৎসকরা গর্ভপাতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন জনগণকে এসব ধর্ষিত নারীকে সমাজে গ্রহণ করার প্রচারণায়। এসব অবস্থা সাক্ষ্য দিচ্ছে ধর্ষণের বিশাল সংখ্যার। পাকিস্তানী অফিসাররা এসব বর্বরতা সম্পর্কে নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশ করে দায়মুক্ত থাকতে চায়। বহু ক্ষেত্রেই কিন্তু এসব সেনা অফিসার নিজেরা যুবতী মেয়েদের ধরে এনে আটক রাখত নিজেদের যৌন সন্তুষ্টির জন্য।’ যে সব সাংবাদিক তখন রিপোর্ট করেছিলেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাদের প্রতিবেদনেও প্রসঙ্গটি এসেছে বারবার এ রকম চারজনের রিপোর্ট উদ্ধৃত করছি
নিউজ উইকের সাংবাদিক টনি ক্লিফটন উল্লেখ করেছেন, ‘আমি দেখতে পাই যে, আক্ষরিক অর্থে মানুষ বোবা হয়ে গেছে, যখন পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের চোখের সামনে বাচ্চাদের হত্যা করেছে এবং মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে তাদের ভয়ঙ্কর যৌন পরিতৃপ্তির জন্য...। পূর্ব পাকিস্তানে শত শত মাইলাই এবং লেডিসির মতো নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছে সে ব্যাপারে আমার কোনই সন্দেহ নেই।’
নিউজউইকের সিনিয়র সম্পাদক এ্যারমাউড ডি ব্রোচ গ্রেভ : ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক বিদ্রোহীদের খুঁজতে আসার ভান করে ডেমরা গ্রাম ঘেরাও করে। তারপর ১২ থকে ৩৫ বছর বয়সী সকল নারীকে ধর্ষণ করে এবং ১২ বছরের বেশি বয়সী সকল পুরুষকে হত্যা করে।’
নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি এইচ, শ্যেনবার্গ : ‘পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই বাঙালী মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে আটক রেখেছে। (চলবে)
No comments