শান্তিপূর্ণ হরতাল যেমন হয় by এ এম এম শওকত আলী
বাম মোর্চার ১৮ ডিসেম্বরের শান্তিপূর্ণ হরতাল একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। হরতাল-পরবর্তী প্রায় দুই দিন এ ধরনের ব্যতিক্রমী হরতালের বিষয়ে প্রায় সবাই প্রশংসা করেছেন।
মিডিয়ায় প্রকাশিত এ ধরনের কিছু খবরে অনেকে বলেছেন যে স্বাধীনতার পর এ ধরনের শান্তিপূর্ণ হরতাল যে সম্ভব, তা বামপন্থী দলগুলোই প্রমাণ করেছে। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও শান্তিপূর্ণ হরতালের প্রশংসা করেছেন। অনেকের মতে, শান্তিপূর্ণ হরতালের নজির থেকে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষা নেওয়া উচিত।
এ ধরনের ব্যতিক্রমী হরতালের সাফল্যের কারণ একাধিক। যে অল্প কয়েকটি বামপন্থী দল এ দেশে রয়েছে, তারা কোনো দিন ক্ষমতা লাভ করেনি। তবে ২০০৯ সালের নির্বাচনে অন্তত দুটি দল ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক গঠিত ১৪ দলীয় জোটে যোগ দিয়েছিল। এখনো তারা একই জোটভুক্ত। বিনিময়ে সংসদে তিনটি আসনও তারা পেয়েছে। তাদের একজন মন্ত্রীও হয়েছেন। ১৪ দলে যোগ দিয়েও তাঁরা মাঝেমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের কিছু কার্যক্রমের সমালোচনাও করেছেন। ১৮ ডিসেম্বরের হরতাল বাসদ-সিপিবিসহ সমমনা অন্য দলগুলোর ডাকেই হয়েছে। বাসদ-সিপিবিই এর নেতৃত্ব দিয়েছে। হরতাল আহ্বান করার সময় তারা বলেছিল যে হরতাল হবে শান্তিপূর্ণ। এ কারণে বলা যায়, তারা সারা বিশ্বে প্রশংসিত মহাত্মা গান্ধীর অহিংসতার নীতিই অনুসরণ করেছে।
শান্তিপূর্ণ হরতাল ১৮ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশের অন্য শহরেও দৃশ্যমান ছিল। একাধিক দৈনিক পত্রিকায় এ বিষয়টিই ছিল বহুল আলোচিত। এসব পত্রিকা বিশেষ করে দেশের সব মহানগরীর শান্তিপূর্ণ হরতালের দৃশ্য প্রচার করেছে। অতীতের সব হরতালের মতো জোর করে যানবাহন ভাঙচুর, দোকানপাট বন্ধ, পুলিশের ওপর আক্রমণের ঘটনা দেখা যায়নি। এ দৃষ্টিকোণে শান্তিপূর্ণ হরতাল ছিল একটি ভিন্নতর ঘটনা। এর প্রধান কারণ ছিল সংশ্লিষ্ট বামপন্থী দলের শৃঙ্খলাভিত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা। এ সময় সহিংসতার কোনো সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। এর সঙ্গে যোগ করা যায় সংশ্লিষ্ট দলের কর্মীদের রাজনৈতিক মূল্যবোধ। কর্মীরা স্বেচ্ছায় তাঁদের নেতাদের অভিপ্রায় মেনে নিয়ে শান্তিপূর্ণ হরতাল সফল করেছেন। অতীতে এবং এখনো বামপন্থী দলের কর্মীদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা ইতিবাচক। তারা মনে করে যে এ দলের কর্মীরা অন্য দলের কর্মীদের তুলনায় অধিকতর আলোকিত মনের। এ বিষয়টিও শান্তিপূর্ণ হরতালের সাফল্যের অন্যতম কারণ।
১৮ ডিসেম্বর হরতালের সময় টিভি মিডিয়ায় এসব দলের কর্মীদের কিছু কর্মকাণ্ডেই উপরোক্ত বিষয়টির প্রতিফলনও দেখা গেছে। ওই সময় কিছু হরতাল সমর্থক একটি মিনিবাস থামানোর জন্য বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ওই যানের জানালার কাচ ভাঙার চেষ্টা করলে অন্য সমর্থকরা ছুটে এসে তাদের নিরস্ত করে। সরু বাঁশের কঞ্চিতে দলীয় পতাকা ছিল। এ ছাড়া মিডিয়ায় ছাপানো কিছু ছবিতেও ছিল কর্মীদের গান-বাজনা করার দৃশ্য। অন্যান্য হরতালের সময় সমর্থকদের মোটা বাঁশের লাঠি বহন করতে দেখা গেছে। ক্ষেত্রবিশেষে ধারালো চাপাতি, এমনকি পিস্তল বা রিভলবারের দৃশ্যও দেখা যায়। বিশ্বজিতের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময়ও এ বিষয়টি দৃশ্যমান ছিল।
পক্ষান্তরে অন্যান্য দল যখন হরতাল করে, তখন একটা ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশের দৃশ্য দেখা যায়। তবে ১৮ তারিখের হরতালের সময় কিছু সহিংস ঘটনা যে হয়নি তা বলা যাবে না। গাজীপুরে টঙ্গী এলাকার বিক্ষুব্ধ শ্রমিক দল কয়েকটি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর করে। এর ফলে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, প্রায় ৫০টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই সংখ্যার কারখানার কর্মী আহতও হয়। কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের মতে, এসব ঘটনার জন্য হরতালকর্মীরাই দায়ী। এই ক্ষেত্রে এ কথাও বলা যায় যে বহুদিন ধরেই পোশাক কারখানার মালিক ও কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল। ভাঙচুরের ঘটনা এরই বহিঃপ্রকাশ। এটা ছিল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
এই বিছিন্ন ঘটনা বাদে ঢাকাসহ সারা দেশে হরতাল ছিল শান্তিপূর্ণ। অন্য যেসব মহানগরীতে পোশাক কারখানা রয়েছে, সেখানে এ ধরনের ঘটনার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ হরতালের বিষয়ে প্রধান বিরোধী দলের কিছু শীর্ষ নেতার প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্নতর। তাঁদের মতে, হরতালটি ছিল ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনপুষ্ট। তবে মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, বিশেষ করে পথচারীদের মতে হরতাল ছিল শান্তিপূর্ণ, যা একটি অভূতপূর্ব দৃষ্টান্তের পরিচায়ক। এ বিষয়ে একজন মানবাধিকারকর্মীর প্রতিক্রিয়াও ছিল ইতিবাচক। তাঁর মতে, সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ হরতালের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিল।
কর্তব্যরত কিছু পুলিশ সদস্যের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি মনে কিছু সন্দেহও সৃষ্টি করেছে। তাঁরা শান্তিপূর্ণ মিছিলকারীদের জন্য কোনো বাধার সৃষ্টি করেননি। অন্যান্য হরতালের সময় কিছু পুলিশ কর্মকর্তা প্রকাশ্যে বলেছেন যে কোনো অনুমতিবিহীন মিছিলে তাঁরা বাধা দেবেন না। কারণ যে মিছিল দৃশত শান্তিপূর্ণ, সে মিছিল যেকোনো সময় অশান্তির কারণ হতে পারে। এ ছাড়া যেকোনো মিছিল যানবাহন চলাকালে বাধার সৃষ্টি করে, যা বেআইনি। কয়েকজন পথচারীর মতে, কিছু স্থানে কর্তব্যরত পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য ওই রাস্তা বন্ধ করে। তবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণে বিচার করলে বলা যায়, এ ধরনের কাজ পুলিশের দায়িত্বের পরিধিভুক্ত। মিছিল-মিটিংয়ের সময় যেকোনো দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য এ কাজ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণেরই অংশবিশেষ। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশংসা অনেকটা বুমেরাং হয়েছে। হরতাল আহ্বানকারী বাম মোর্চার নেতৃত্ব এ ধরনের প্রশংসার সমালোচনা করেছে। তাদের মতে, হরতালের সাফল্য এর ফলে ম্লান হয়েছে অথবা সরকার সাফল্যের অংশীদার হতে চেষ্টা করছে।
শান্তিপূর্ণ হরতাল বা অশান্ত হরতালের মধ্যে পার্থক্য অতি ক্ষীণ। মূল পার্থক্য হলো শান্তিপূর্ণ হরতাল সহিংসতাবিহীন। মারমুখো হরতাল সহিংসতায় ভরপুর। তবে দুই ধরনের হরতালেই স্বাভাবিক জনজীবন স্তব্ধ হয়েছে। স্বাভাবিক জনজীবন ছাড়াও দুই ধরনের হরতালেই অর্থনীতির ক্ষতি হয়। বিদেশি সাহায্যদাতা সংস্থা ছাড়াও দেশের বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে বহু তথ্য অতীতে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব এখনো দৃশ্যমান নয়। ভবিষ্যতেও যে হবে না এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। হরতালবিহীন রাষ্ট্রের নমুনা সাধারণত উন্নত দেশেই দৃশ্যমান। কারণ সেসব রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশে এর বড় অভাব। ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে সব ক্ষমতাসীন দল গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখনো এ ধরনের প্রতিশ্রুতি মাঝেমধ্যে শোনা যায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব অনেক বছর ধরেই দৃশ্যমান; বিশেষ করে দুই বড় দলের মধ্যে। এক দল যখন বলে, হ্যাঁ, অন্য দল বলে, না। এর ফলে সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। ঘন ঘন হরতাল সংঘাতপূর্ণ রাজনীতিরই ফল। সুধীসমাজসহ দেশের অনেক গুণীজন দ্বিপক্ষীয় বা বহুদলীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশের অবসানের কথা বললেও তা ফলপ্রসূ হয়নি।
দলগতভাবে পারস্পরিক দোষারোপের দৃশ্য অপেক্ষাকৃত অনুন্নত গণতান্ত্রিক দেশেও দৃশ্যমান। কিন্তু সেসব দেশে পারস্পরিক আলোচনার পথও একেবারে রুদ্ধ নয়। এ শিক্ষা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখনো গ্রহণ করেনি। এ কারণে বলা যায়, ভবিষ্যতেও সহিংস হরতাল হবে। অবশ্য তা ১৮ ডিসেম্বরের মতো হলে খুব একটা আশঙ্কাজনক হবে না। তবে জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যারা দিন আনে দিন খায় ভিত্তিতে জীবন যাপন করে, তাদের জন্য কষ্টকর। যেদিন আয় সম্ভব নয়, সেদিন খাওয়াও বন্ধ।
ক্ষমতাসীন ও প্রধান বিরোধী দলের বর্তমান সংঘাতের কারণ প্রধানত দুটি- এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার পুনঃপ্রবর্তন। দুই. একাত্তরের ঘাতকদের আইন অনুযায়ী বিচার। মূলত প্রথমোক্ত বিষয়টিই ছিল বর্তমান সংঘাতের প্রধান উৎস। দ্বিতীয় বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন ও কাজ শুরু করার পর বিরোধ ঘনীভূত হয়। তৎকালীন বিএনপি সরকারের অংশীদার জামায়াতের শীর্ষ কিছু নেতার এখন বিচার হচ্ছে। জামায়াত প্রথমেই এর বিরুদ্ধাচরণ করে।
ডিসেম্বর ২০১২
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
এ ধরনের ব্যতিক্রমী হরতালের সাফল্যের কারণ একাধিক। যে অল্প কয়েকটি বামপন্থী দল এ দেশে রয়েছে, তারা কোনো দিন ক্ষমতা লাভ করেনি। তবে ২০০৯ সালের নির্বাচনে অন্তত দুটি দল ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক গঠিত ১৪ দলীয় জোটে যোগ দিয়েছিল। এখনো তারা একই জোটভুক্ত। বিনিময়ে সংসদে তিনটি আসনও তারা পেয়েছে। তাদের একজন মন্ত্রীও হয়েছেন। ১৪ দলে যোগ দিয়েও তাঁরা মাঝেমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের কিছু কার্যক্রমের সমালোচনাও করেছেন। ১৮ ডিসেম্বরের হরতাল বাসদ-সিপিবিসহ সমমনা অন্য দলগুলোর ডাকেই হয়েছে। বাসদ-সিপিবিই এর নেতৃত্ব দিয়েছে। হরতাল আহ্বান করার সময় তারা বলেছিল যে হরতাল হবে শান্তিপূর্ণ। এ কারণে বলা যায়, তারা সারা বিশ্বে প্রশংসিত মহাত্মা গান্ধীর অহিংসতার নীতিই অনুসরণ করেছে।
শান্তিপূর্ণ হরতাল ১৮ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশের অন্য শহরেও দৃশ্যমান ছিল। একাধিক দৈনিক পত্রিকায় এ বিষয়টিই ছিল বহুল আলোচিত। এসব পত্রিকা বিশেষ করে দেশের সব মহানগরীর শান্তিপূর্ণ হরতালের দৃশ্য প্রচার করেছে। অতীতের সব হরতালের মতো জোর করে যানবাহন ভাঙচুর, দোকানপাট বন্ধ, পুলিশের ওপর আক্রমণের ঘটনা দেখা যায়নি। এ দৃষ্টিকোণে শান্তিপূর্ণ হরতাল ছিল একটি ভিন্নতর ঘটনা। এর প্রধান কারণ ছিল সংশ্লিষ্ট বামপন্থী দলের শৃঙ্খলাভিত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা। এ সময় সহিংসতার কোনো সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। এর সঙ্গে যোগ করা যায় সংশ্লিষ্ট দলের কর্মীদের রাজনৈতিক মূল্যবোধ। কর্মীরা স্বেচ্ছায় তাঁদের নেতাদের অভিপ্রায় মেনে নিয়ে শান্তিপূর্ণ হরতাল সফল করেছেন। অতীতে এবং এখনো বামপন্থী দলের কর্মীদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা ইতিবাচক। তারা মনে করে যে এ দলের কর্মীরা অন্য দলের কর্মীদের তুলনায় অধিকতর আলোকিত মনের। এ বিষয়টিও শান্তিপূর্ণ হরতালের সাফল্যের অন্যতম কারণ।
১৮ ডিসেম্বর হরতালের সময় টিভি মিডিয়ায় এসব দলের কর্মীদের কিছু কর্মকাণ্ডেই উপরোক্ত বিষয়টির প্রতিফলনও দেখা গেছে। ওই সময় কিছু হরতাল সমর্থক একটি মিনিবাস থামানোর জন্য বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ওই যানের জানালার কাচ ভাঙার চেষ্টা করলে অন্য সমর্থকরা ছুটে এসে তাদের নিরস্ত করে। সরু বাঁশের কঞ্চিতে দলীয় পতাকা ছিল। এ ছাড়া মিডিয়ায় ছাপানো কিছু ছবিতেও ছিল কর্মীদের গান-বাজনা করার দৃশ্য। অন্যান্য হরতালের সময় সমর্থকদের মোটা বাঁশের লাঠি বহন করতে দেখা গেছে। ক্ষেত্রবিশেষে ধারালো চাপাতি, এমনকি পিস্তল বা রিভলবারের দৃশ্যও দেখা যায়। বিশ্বজিতের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময়ও এ বিষয়টি দৃশ্যমান ছিল।
পক্ষান্তরে অন্যান্য দল যখন হরতাল করে, তখন একটা ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশের দৃশ্য দেখা যায়। তবে ১৮ তারিখের হরতালের সময় কিছু সহিংস ঘটনা যে হয়নি তা বলা যাবে না। গাজীপুরে টঙ্গী এলাকার বিক্ষুব্ধ শ্রমিক দল কয়েকটি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর করে। এর ফলে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, প্রায় ৫০টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই সংখ্যার কারখানার কর্মী আহতও হয়। কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের মতে, এসব ঘটনার জন্য হরতালকর্মীরাই দায়ী। এই ক্ষেত্রে এ কথাও বলা যায় যে বহুদিন ধরেই পোশাক কারখানার মালিক ও কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল। ভাঙচুরের ঘটনা এরই বহিঃপ্রকাশ। এটা ছিল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
এই বিছিন্ন ঘটনা বাদে ঢাকাসহ সারা দেশে হরতাল ছিল শান্তিপূর্ণ। অন্য যেসব মহানগরীতে পোশাক কারখানা রয়েছে, সেখানে এ ধরনের ঘটনার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ হরতালের বিষয়ে প্রধান বিরোধী দলের কিছু শীর্ষ নেতার প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্নতর। তাঁদের মতে, হরতালটি ছিল ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনপুষ্ট। তবে মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, বিশেষ করে পথচারীদের মতে হরতাল ছিল শান্তিপূর্ণ, যা একটি অভূতপূর্ব দৃষ্টান্তের পরিচায়ক। এ বিষয়ে একজন মানবাধিকারকর্মীর প্রতিক্রিয়াও ছিল ইতিবাচক। তাঁর মতে, সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ হরতালের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিল।
কর্তব্যরত কিছু পুলিশ সদস্যের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি মনে কিছু সন্দেহও সৃষ্টি করেছে। তাঁরা শান্তিপূর্ণ মিছিলকারীদের জন্য কোনো বাধার সৃষ্টি করেননি। অন্যান্য হরতালের সময় কিছু পুলিশ কর্মকর্তা প্রকাশ্যে বলেছেন যে কোনো অনুমতিবিহীন মিছিলে তাঁরা বাধা দেবেন না। কারণ যে মিছিল দৃশত শান্তিপূর্ণ, সে মিছিল যেকোনো সময় অশান্তির কারণ হতে পারে। এ ছাড়া যেকোনো মিছিল যানবাহন চলাকালে বাধার সৃষ্টি করে, যা বেআইনি। কয়েকজন পথচারীর মতে, কিছু স্থানে কর্তব্যরত পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য ওই রাস্তা বন্ধ করে। তবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণে বিচার করলে বলা যায়, এ ধরনের কাজ পুলিশের দায়িত্বের পরিধিভুক্ত। মিছিল-মিটিংয়ের সময় যেকোনো দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য এ কাজ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণেরই অংশবিশেষ। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশংসা অনেকটা বুমেরাং হয়েছে। হরতাল আহ্বানকারী বাম মোর্চার নেতৃত্ব এ ধরনের প্রশংসার সমালোচনা করেছে। তাদের মতে, হরতালের সাফল্য এর ফলে ম্লান হয়েছে অথবা সরকার সাফল্যের অংশীদার হতে চেষ্টা করছে।
শান্তিপূর্ণ হরতাল বা অশান্ত হরতালের মধ্যে পার্থক্য অতি ক্ষীণ। মূল পার্থক্য হলো শান্তিপূর্ণ হরতাল সহিংসতাবিহীন। মারমুখো হরতাল সহিংসতায় ভরপুর। তবে দুই ধরনের হরতালেই স্বাভাবিক জনজীবন স্তব্ধ হয়েছে। স্বাভাবিক জনজীবন ছাড়াও দুই ধরনের হরতালেই অর্থনীতির ক্ষতি হয়। বিদেশি সাহায্যদাতা সংস্থা ছাড়াও দেশের বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে বহু তথ্য অতীতে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব এখনো দৃশ্যমান নয়। ভবিষ্যতেও যে হবে না এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। হরতালবিহীন রাষ্ট্রের নমুনা সাধারণত উন্নত দেশেই দৃশ্যমান। কারণ সেসব রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশে এর বড় অভাব। ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে সব ক্ষমতাসীন দল গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখনো এ ধরনের প্রতিশ্রুতি মাঝেমধ্যে শোনা যায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব অনেক বছর ধরেই দৃশ্যমান; বিশেষ করে দুই বড় দলের মধ্যে। এক দল যখন বলে, হ্যাঁ, অন্য দল বলে, না। এর ফলে সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। ঘন ঘন হরতাল সংঘাতপূর্ণ রাজনীতিরই ফল। সুধীসমাজসহ দেশের অনেক গুণীজন দ্বিপক্ষীয় বা বহুদলীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশের অবসানের কথা বললেও তা ফলপ্রসূ হয়নি।
দলগতভাবে পারস্পরিক দোষারোপের দৃশ্য অপেক্ষাকৃত অনুন্নত গণতান্ত্রিক দেশেও দৃশ্যমান। কিন্তু সেসব দেশে পারস্পরিক আলোচনার পথও একেবারে রুদ্ধ নয়। এ শিক্ষা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখনো গ্রহণ করেনি। এ কারণে বলা যায়, ভবিষ্যতেও সহিংস হরতাল হবে। অবশ্য তা ১৮ ডিসেম্বরের মতো হলে খুব একটা আশঙ্কাজনক হবে না। তবে জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যারা দিন আনে দিন খায় ভিত্তিতে জীবন যাপন করে, তাদের জন্য কষ্টকর। যেদিন আয় সম্ভব নয়, সেদিন খাওয়াও বন্ধ।
ক্ষমতাসীন ও প্রধান বিরোধী দলের বর্তমান সংঘাতের কারণ প্রধানত দুটি- এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার পুনঃপ্রবর্তন। দুই. একাত্তরের ঘাতকদের আইন অনুযায়ী বিচার। মূলত প্রথমোক্ত বিষয়টিই ছিল বর্তমান সংঘাতের প্রধান উৎস। দ্বিতীয় বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন ও কাজ শুরু করার পর বিরোধ ঘনীভূত হয়। তৎকালীন বিএনপি সরকারের অংশীদার জামায়াতের শীর্ষ কিছু নেতার এখন বিচার হচ্ছে। জামায়াত প্রথমেই এর বিরুদ্ধাচরণ করে।
ডিসেম্বর ২০১২
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments