রঙ্গব্যঙ্গ-ঘুষখোরকে না by মোস্তফা কামাল

আলী আকবর অস্থির। তিনি এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে যাচ্ছেন। আর বিড় বিড় করে কী যেন বলছেন। তাঁর মাথার মধ্যে নানা ভাবনা ঘুরপাক খায়। তিনি কী করবেন কিছুই বুঝতে পারেন না। বিবাহযোগ্য মেয়েকে নিয়ে তিনি মহাবিপাকে পড়েছেন। তিনি মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজছেন।
কিন্তু পছন্দমতো পাচ্ছেন না।
একবার পাত্রপক্ষ আলী আকবরের মেয়ে আলিয়াকে দেখতে এল। ছেলের বাবা, মা-খালারা মেয়েকে ভালো করে দেখেন। তার হাত দেখেন, পা দেখেন। হাত-পায়ের আঙুল ঠিক আছে কি না দেখেন। তার হাঁটাচলা দেখেন। গরু-ছাগলের মতো মেয়েটাকে দেখেন।
আলিয়া রীতিমতো বিরক্ত। এসব সে মোটেই মানতে পারছে না। কিন্তু কী করবে! এ দেশের সামাজিক নিয়মনীতি না মানলে হয়তো তার বিয়েই হবে না। যা-ই হোক, আলিয়াকে দেখাদেখি যখন শেষ তখন আলী আকবর নড়েচড়ে বসলেন। তিনি পাত্রের বাবাকে বললেন, ভাই, আমার মেয়েকে তো গরু-ছাগলের মতো দেখলেন। এবার আর কী বাকি আছে বলেন?
কথা বলা বাকি আছে।
আপনাকে তো আগেই বলেছি, আমার মেয়ে কম কথা বলে।
কম কথা বলুক সমস্যা নেই। কথা তো বলতে পারে!
জি, তা পারে।
ছেলের বাবা এবার বললেন, আলিয়া মা, একটা সুরা বলো তো!
আলিয়া বিরক্ত। ভীষণ বিরক্ত। সে বিরক্তির সঙ্গে বলল, কোন সুরাটা শুনতে চান, বলেন?
ছেলের বাবা পড়ে গেলেন বিপাকে। তিনি কিছুতেই সুরার নাম বলতে পারেন না। তাঁদের দৌড় কত দূর আলিয়া তা বুঝে গেল। সে এতক্ষণ তাঁদের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। এবার তার পালা। সে বলে বসল, এবার আপনার ছেলেকে আমি কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
ছেলের বাবা বললেন, আমরা কি তাহলে বাইরে যাব?
না না! বাইরে যেতে হবে না। আপনাদের সামনে প্রশ্ন করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
ঠিক আছে, তুমি প্রশ্ন করো।
আলিয়া ছেলেকে বলল, আপনার কি আমাকে পছন্দ হয়েছে? সত্যি করে বলবেন।
হ্যাঁ, পছন্দ হয়েছে।
আপনি কি আমার সম্পর্কে জানেন? আমি কত দূর পড়াশোনা করেছি, আমি কী করি, এসব জানেন?
না।
এসব না জেনে আমাকে দেখতে চলে এসেছেন? কারণ বলবেন কি?
পছন্দই যদি না হয় তাহলে সব কিছু জেনে কী লাভ? তাই আগে দেখতে এলাম। পছন্দ হলে এক এক করে সব জেনে নেব।
আপনার পড়াশোনা কত দূর?
এমএ পাস।
কী করেন?
সরকারি চাকরি।
আপনার র‌্যাংক কী?
অফিসার হিসেবে আছি।
কোন লেভেলের অফিসার? ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস নাকি থার্ড ক্লাস?
আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে আমি একটা কথা বলতে চাই। আপনার বাবা বললেন, আপনি নাকি কম কথা বলেন। এখন তো দেখছি বেশি কথা বলেন!
তাই নাকি। আপনারা আমার এত দেখাদেখি করলেন আর আমি কিছু প্রশ্ন করতে পারব না? বিয়ের আগে জেনেশুনে নেওয়া ভালো না?
তা ঠিক, তা ঠিক।
তাহলে আমার প্রশ্নের জবাব দিন।
কী প্রশ্ন যেন করলেন?
আপনি কোন লেভেলের অফিসার।
সেকেন্ড ক্লাস।
বেতন কত পান?
বেতনের কথা বলতে নেই। পুরুষের বেতন আর নারীর বয়স নাকি বলতে মানা। তাই আমি বেতনের কথা বলতে চাচ্ছি না।
মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে আলী আকবর তখন বললেন, আচ্ছা বাবা, তোমার বেতনের কথা বলার দরকার নেই। তুমি বলো, উপরি কত?
জি, উপরি!
হ্যাঁ বাবা, উপরি কত?
ছেলেটা কিছু বলার আগেই আলিয়া বলল, শোনেন, এই আধুনিক যুগের মেয়েরা কিন্তু বয়স গোপন রাখে না। আমার বয়স ২৫ বছর। এবার আপনার বেতন কত বলেন।
আলী আকবর মেয়েকে কিছুটা ধমকের সুরে বললেন, আহা! তুমি বারবার বেতনের কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন? তুমি জিজ্ঞাসা করো, উপরি কত?
আচ্ছা বলেন তো, প্রতি মাসে আপনার উপরি কত?
ঠিক নেই। ৪০-৫০ হাজার টাকা থাকে।
বলেন কী! তাহলে তো ইনকাম ভালো! তার মানে আপনি ঘুষ খান।
ঘুষ না, ঘুষ না। মানুষ খুশি হয়ে দেয়।
প্রতি মাসে ৪০-৫০ হাজার টাকা খুশি হয়ে দেয়! এটা কী চাকরি, বলেন তো?
আরে, সরকারি চাকরি মানেই তো ঘুষের পয়সা। ঘুষ না নিলে সংসার চলবে! যে টাকা বেতন, তা দিয়ে তো ঘর ভাড়াও হয় না।
বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি তো সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোনো ঘুষখোরকে বিয়ে করব না।
এ জন্যই তো গোপন কথা বলতে চাইনি।
বলে ভালো করেছেন।
কেন?
আমার বড় একটা উপকার করেছেন।
তাহলে বিয়েতে রাজি হয়ে উপকারের প্রতিদান দিন।
উপস্থিত সবাই হেসে উঠলেন।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.