প্রেসিডেন্ট বাশারের টিকে থাকার রহস্য
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সম্প্রতি এক ভাষণে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন-তিনি পদত্যাগ করবেন না, বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন না, রাশিয়া ও আমেরিকার সমর্থিত জাতিসংঘ দূতের দেয়া আপোস প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখবেন না।
তার বদলে তিনি আল্লাহর দুশমন ও পাশ্চাত্যের পদলেহীদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ওদিকে দেশের বেশিরভাগ এলাকা এবং প্রধান প্রধান নগরীর অংশবিশেষ নিয়ন্ত্রণকারী বিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যকার একটি গ্রুপ অন্তর্বর্তী বিচার ব্যবস্থার একটি খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করেছে, যেখানে বাশারের ক্ষমতার অন্দরমহলের গোঁড়া-অনুগত সদস্যদের কঠোর সাজা দেয়ার এবং তার আলাওয়াইত সদস্যদের অধিকাংশকে ক্ষমা করে দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।বাশারের ঘণ্টাখানেক দীর্ঘ ভাষণটি ছিল ছয় মাসের মধ্যে প্রথম ভাষণ। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এই ভাষণকে বাস্তবতাবিবর্জিত আখ্যা দিলেও ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক নিবন্ধে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাইমন টিসডাল বলেন, প্রকৃতপক্ষে বাস্তববিবর্জিত হলো বাশারের শত্রু যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা দেশগুলো ও আরব রাষ্ট্রবর্গ। কারণ, অপ্রিয় সত্যটা হলো দু’বছর ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলার পরও বাশার এখনও ক্ষমতায় বসা। মার খেয়ে বিপর্যস্ত হওয়া তো দূরের কথা, ক্ষমতা ছাড়ার দাবির প্রতি কর্ণপাতের সামান্যতম লক্ষণও তিনি দেখাচ্ছেন না।
কিন্তু কেন বাশার ক্ষমতায় টিকে থাকছেন? এর পেছনে তার কোন ব্যক্তিগত কৃতিত্ব নেই। থাকলেও তা অতি সামান্য। তার অভ্যন্তরীণ সমর্থকরা সংখ্যালঘু হলেও তাদের টেকসই সমর্থনের জন্য তিনি ক্ষমতায় আছেন, তাও নয়। সামরিক অভিযানে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন বলে টিকে আছেন, তাও নয়। পাশ্চাত্যের যেসব দেশ সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পারত তাদেরকে বাশার শুদ্ধভাবে হলেও নিশ্চিতভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, তাদের চোখে তিনি যত মন্দই হোন না কেন, তিনি না থাকলে সিরিয়ায় যা হবে সেটা তাদের জন্য নিশ্চিতরূপে আরও খারাপ হবে। সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইসলামী মৌলবাদীদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করে বাশার যে বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছেন তা হলো জিহাদভীতি। গত ফেব্রুয়ারিতে এক ভিডিও বার্তায় আল কায়েদা নেতা আইমান-আল-জাওয়াহিরি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এবং প্রধানত লেবানন, তুরস্ক, জর্দান ও ইরাকে বসবাসরত সুন্নিদেরকে বাশার সরকারের পতন ঘটাতে সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারপর থেকে বার্তাটি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং সিরিয়ায় শিয়া একনায়কের বিরুদ্ধে জিহাদে যোগ দেয়ার জন্য সারাবিশ্বের মুসলমান তরুণদের আকৃষ্ট করে। সুদূর ইন্দোনেশিয়া ও চীনের সিনকিয়াং থেকেও শত শত ভলান্টিয়ার জিহাদে অংশ নিতে আসে। সবশুদ্ধ এই বিদেশীদের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এরা ফ্রি সিরিয়ান আর্মি, লিওয়া আল ইসলাম, কাতিবাত-আল-আনসার, আহরার আল শাম এবং জাবহাত আল-নুসরাসহ অসংখ্য গ্রুপের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে যাদের সঙ্গে ইরাকের আল কায়েদার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। পাশ্চাত্যের ক্রমবর্ধমান উপলব্ধি হলো সিরিয়া আরেক মিসর বা সিরিয়া নয়। সেখানকার গণঅভ্যুত্থান থেকে অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার ফলাফল বেরিয়ে এসেছে। সিরিয়া এমন এক দেশ যেখানে বাশারের পতন ঘটলে এই অঞ্চলে আরেকটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটবে এবং এর অভিশাপ চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আল কায়েদার সঙ্গে বৈশ্বিক সংঘাতের আশঙ্কা তাই পশ্চিমাদের ভাবনায় বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।
সুতরাং পাশ্চাত্য মুখে মুখে বাশারের যতই মু-ুপাত করুক না কেন, তাকে উৎখাতের জন্য সামরিক ও লজিস্টিক দিক দিয়ে তেমন কিছুই করছে না। সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়ালিশনের ছত্রছায়ায় বিরোধী শক্তিগুলো একজোট হওয়া সত্ত্বেও অস্ত্র-অর্থ সরবরাহ ফুরিয়ে আসছে। বাশার পরবর্তী সিরিয়া এক ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে অতলস্পর্শী নৈরাজ্যে চলে যেতে পারে আশঙ্কা করে সুন্নি উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোও বিষয়টি দ্বিতীয়বারের মতো ভেবে দেখছে। ইসরাইলও সে গোলানে সীমান্ত নিরাপত্তা গড়ে তুলছে এবং তুরস্ক তার সীমান্তে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করছে সেগুলোর লক্ষ্য সিরিয়াকে মুক্ত করা নয় বরং একে একঘরে করে রাখা ও সঙ্গনিরোধ করা; যাতে এর সংক্রমণ আটকে রাখা যায়। এর পাশাপাশি তুরস্ক, লেবানন ও জর্দানে আশ্রয় নেয়া সিরীয় উদ্বাস্তুদের সাহায্যার্থে সমন্বিত কোন ত্রাণতৎপরতা পরিচালিত না হওয়া থেকে একটা উপসংহারেই পৌঁছা যায় এবং সেটা হলো পাশ্চাত্য জোরজবরদস্তি করে বাশারের পতন ঘটানোর ব্যাপারে সিরিয়াস নয় এবং নিঃসন্দেহে এই বার্তাটি বাশারের কানে পৌঁছে গেছে। সেজন্য মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর যতই যা বলুক বাশার তার অবস্থান থেকে একবিন্দু সরছেন না। বাইরের হস্তক্ষেপ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি না পেলে ২০১৪ সালেও তার ক্ষমতায় থেকে যাওয়া বিচিত্র নয়। বিদ্রোহীদের বর্তমান লড়াইয়ের মধ্যে এমন কিছু নেই যার দ্বারা তাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা যেতে পারে।
চলমান ডেস্ক
No comments