দক্ষিণের আশা ব্রি ধান ৪৭ by ড. মোঃ মোশাররফ হোসেন ও এম এ কাসেম
চারদিকে এখন দিন বদলের স্লোগান। তবে স্লোগানের চেয়ে চ্যালেঞ্জিং হলো এর বাস্তবায়ন। এ প্রেক্ষাপটে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের কৃষকদের জন্য একটি আশার বার্তা নিয়ে এসেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)।
যেখানে লবণাক্ততার দরুন কৃষকরা উচ্চফলনশীল ধান চাষ করতে পারতেন না, সেখানে নতুন দিনের সূচনা করতে পারে ব্রি ধান৪৭।
এ ধানের জাতটির যথাযথ সম্প্রসারণ ঘটলে এর মাধ্যমে ওই অঞ্চলের ধানচাষীদের জীবনযাত্রায় গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে। এ ধানের চাষ করলে তাদের আয় বাড়বে। আর আয় বাড়লে তাদের দৈনন্দিন জীবনে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নিশ্চিত হতেই পারে।যেখানে লবণাক্ততার দরুন কৃষকরা উচ্চফলনশীল ধান চাষ করতে পারতেন না, সেখানে নতুন দিনের সূচনা করতে পারে ব্রি ধান৪৭।
অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য হচ্ছে, দেশের দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের চাষীভাইদের জন্য লবণাক্ততা আসলে একটি বড় সমস্যা। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, কেবল পিরোজপুর জেলাতেই ৩৩ শতাংশ আবাদি জমি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে এবং এর দরুণ বছরে সেখানে একশ’ কোটি টাকার খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ধরনের প্রতিবেদন পাওয়া যাচ্ছে খুলনা, বরিশালসহ অন্যান্য উপকূলীয় এলাকা থেকেও। লবণাক্ততাজনিত ফসলহানির পুরো চিত্র স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগজনক।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নে সর্বাধিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে দেখা দিচ্ছে খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি- অনাবৃষ্টি, ঠাণ্ডা, পানি ও মাটির লবণাক্ততা। হুমকির মুখে পড়ছে দেশের কৃষি।
এক্ষেত্রে যেসব পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে সর্বাধিক উদ্বেগজনক হলো, অদূর ভবিষ্যতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি। সেটি হলে লবণাক্ত পানি আরও ব্যাপক হারে আমাদের কৃষি জমিকে গ্রাস করবে। মাটির লবণাক্ততা বাড়বে, ব্যাহত হবে ধানসহ অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ। খরার প্রভাবেও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাবে। এভাবে প্রচুর কৃষি জমি ধান চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় ধান উত্পাদন বৃদ্ধি এবং টেকসই করতে হলে লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কোনো বিকল্প নেই। এসব প্রযুক্তির মধ্যে থাকতে হবে :
* লবণ সহিষ্ণু ধানের জাত এবং
* লাগসই চাষাবাদ ও ফসল ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি।
বাংলাদেশ একটি ছোট্ট দেশ। আমাদের মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৮.৩ মিলিয়ন হেক্টর। এর মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলেই রয়েছে ২.৫ মিলিয়ন হেক্টর। অর্থাত্ মোট জমির প্রায় ৩০ ভাগ উপকূলীয় এলাকায়। এ অঞ্চলের পরিবেশ ধান উত্পাদনের প্রতিকূল। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক কারণে কৃষি জমির পরিমাণও আশঙ্কাজনক হারে কমছে। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুসারে, প্রতিদিন কৃষি জমি কমছে প্রায় ২২৫ হেক্টর, যা বছরে প্রায় শতকরা এক ভাগ। অপরদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় ১.৪৮ ভাগ হারে। এ অবস্থায় ধান তথা খাদ্য উত্পাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা কীভাবে সম্ভব হবে, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও নীতি নির্ধারকদের কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
মাটি ও পানির লবণাক্ততা বাংলাদেশের ধান চাষে একটি বড় অন্তরায়। উপকূলীয় অঞ্চল কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলাগুলোর বিস্তীর্ণ অঞ্চল লবণাক্ততাকবলিত। প্রায় দশ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত। কিন্তু মাটি ও পানির লবণাক্ততার মাত্রা মৌসুম ও এলাকা ভেদে ভিন্ন।
সাধারণত খরা মৌসুমেই লবণাক্ততা বেশি হয় এবং বর্ষা মৌসুমে তা কমে আসে। যেমন জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত লবণাক্ততা বেশি হয়, যা মার্চ থেকে এপ্রিল মাসে তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে আউশ ও বোরো ধানের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্ষাকালে বৃদ্ধির প্রভাবে লবণাক্ততা কমে যায়। জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত লবণাক্ততা সাধারণত কম থাকে। খরা দেখা দিলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে আমন ধানের ক্ষতি করে এবং ফলন কমে যায়।
বিভিন্ন ফসলের মধ্যে ধানই লবণাক্ততায় সর্বাধিক সংবেদনশীল। বাংলাদেশে লবণাক্ততার মাত্রা মাটিতে ১ থেকে ২০ ডিএস/মিটার পর্যন্ত হতে পারে। ধানের জন্য সাধারণত ৪ ডিএস/মিটার লবণাক্ততা ক্ষতিকর। অর্থাত্ এটি ৪ ডিএস/মিটারের বেশি হলে ধানের বাড়বাড়তি ও ফলন ব্যাহত হয়। ধান সাধারণত চারা এবং প্রজনন অবস্থায় (ফুল আসা) অতিরিক্ত লবণ সংবেদনশীল। এ প্রেক্ষাপট সামনে রেখে ব্রি তার গবেষণা জোরদার করেছে এবং লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সাফল্য অর্জন করছে।
ব্রি এখন পর্যন্ত কয়েকটি লবণ সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত এবং ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করেছে। এর আগে ব্রি আমন মৌসুমের জন্য ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১ এবং বিআর২৩ উদ্ভাবন করেছে। এ ধারায় সাম্প্রতিক সংযোজন ব্রি ধান৪৭, যা বোরো মৌসুমে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন পেয়েছে।
মাটি ও পানির অবস্থা বুঝে জাত নির্বাচনের পাশাপাশি চাষাবাদের কিছু ব্যবস্থাপনা কৌশলও চাষীভাইদের মনে রাখা প্রয়োজন। এগুলো হচ্ছে:
* ধানের সুস্থ-সবল চারা রোপণ করলে লবণাক্ততার মধ্যেও টিকে থাকতে পারে।
* প্রতিকূল অবস্থায় তুলনামূলকভাবে ঘন করে রোপণ ধান গাছের বাড়বাড়তি ও ফলনের জন্য ভালো।
* উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় বর্ষা মৌসুমে মিঠা পানি স্লুইস গেটের মাধ্যমে ধরে রেখে সহজেই বোরো ধানের চাষ সম্প্রসারণ করা সম্ভব।
এদিকে ব্রি ধান৪৭-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি চারা অবস্থায় ১২-১৪ ডিএস/মিটার এবং বাকি জীবনকালে ছয় ডিএস/মিটার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।
খুলনার কিছু এলাকায় বোরো মৌসুমে লবণাক্ততার পরিমাণ চার থেকে আট ইসি থাকে। আর ব্রি ধান৪৭ জাতের ধান ১০ ইসি লবণাক্ততার মধ্যেও চাষ করা যায়। এ ধান লবণাক্ত এলাকায় বিঘাপ্রতি ১৮ থেকে ২০ মণ উত্পাদিত হবে। ব্রি ধান৪৭ আবাদ করে কৃষকরা ব্রি ধান২৮ বা অন্যান্য বোরো ধানের চেয়ে বেশি ফলন পাবেন। তবে এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, সেচের পানির লবণাক্ততার মাত্রা যেখানে ৪ ডিএস/মিটার সেখানে সহজেই এ ধানের চাষ করা যাবে।
ব্রি ধান৪৭-এর চাষ একটি বড় সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। আর সেটি হলো, এ ধানের চাষাবাদের মাধ্যমে এ দেশের উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় সীমিত পরিসরে হলেও এক ধরনের সবুজ বিপ্লবের সূচনা হতে পারে। ওই এলাকায় এতকাল মাইলের পর মাইলজুড়ে দেখা যেত অতি কম ফলন দেয় এমন শস্য অথবা কেবলই নিষম্ফলা জমি। ওই জমিই এখন ভরে উঠতে পারে উফশী সোনালি ধানের অপরূপ সমারোহে।
দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকার কৃষকরা এরকম একটি উফশী ধানের প্রতীক্ষায় ছিলেন। ব্রি’র কল্যাণে এই প্রত্যাশিত ধানের জাত এখন কৃষকের দোরগোড়ায়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) একটি সূত্র জানিয়েছে, এ প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে ব্রি ধান৪৭-এর ৫০ টন বীজ ওই লবণাক্ত এলাকার কৃষকদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) এবং ব্রি একযোগে ব্রি ধান৪৭-এর চাষ জনপ্রিয় করতে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে।
উদ্ভাবনের পর থেকে এ পর্যন্ত ব্রি’র ফলিত গবেষণা বিভাগ এবং এর আঞ্চলিক কার্যালয় সাতক্ষীরা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঝালকাঠি প্রভৃতি জেলার বিভিন্ন উপজেলার লবণাক্ত এলাকায় ব্রি ধান৪৭-এর দুই শতাধিক প্রদর্শনী করেছে। এর মধ্যে মাঠ দিবস, কৃষক র্যালি, বীজ বিতরণ, কৃষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি রয়েছে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে এ ধানের জাত অন্তত পাঁচ হাজার কৃষকের কাছে পৌঁছানো হয়েছে।
ব্রি এ পর্যন্ত কৃষক পর্যায়ে বীজ উত্পাদন ও সম্প্রসারণ কর্মসূচির আওতায় এ ধানের প্রায় ১৬ টন বীজ উত্পাদন করেছে, যার শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ ‘কৃষক থেকে কৃষকের মধ্যে বিনিময়’ হয়েছে।
এর বাইরে ব্রি’র সাতক্ষীরা আঞ্চলিক কার্যালয়ের তত্ত্ব্বাবধানে গত দু’বছরে এ ধানের প্রায় সাড়ে পাঁচ টন মানঘোষিত বীজ উত্পাদন করা হয়, যার অংশ বিশেষ ডিএইকে প্রদর্শনী কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য দেয়া হয় এবং অবশিষ্টাংশ কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয়।
আরও জানা যায়, ব্রি ধান৪৭ এ পর্যন্ত দেশের পূর্বোক্ত অঞ্চলগুলোয় প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে।
বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, তারা যথারীতি এ জাতের বীজ উত্পাদন ও বর্ধন এবং মাঠ পর্যায়ে হস্তান্তরের কর্মসূচি নিয়েছে।
এসব উদ্যোগের ফলে একটি ভালো জাতের বীজ দেশের প্রতিকূল জলবায়ু অঞ্চলের কৃষকদের আয়ত্তের মধ্যে যাচ্ছে। আর অতীতে দেখা গেছে, ভালো বীজ কৃষকদের কাছে গেলে তারা এটিকে কাজে লাগিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মানের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটান। এর আগে বিআর১১, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯ এবং সর্বশেষ ব্রি ধান৩৩ নিয়ে যেমন সাড়া পড়েছিল তেমনি আশা করা যায়, অনুকূল পরিবেশ ও সহযোগিতা পেলে এই নতুন জাতটিও অনুরূপ সাড়া জাগাতে সক্ষম হবে। প্রসঙ্গত ব্রি’র অনলাইন নলেজ ব্যাংক সম্পর্কে কিছু জানা প্রয়োজন। এই ওয়েবসাইটে রয়েছে ব্রি ধান৪৭সহ ব্রি উদ্ভাবিত আরও প্রায় অর্ধশতাধিক ধানের জাত এবং এদের চাষাবাদ প্রযুক্তি বিষয়ক যাবতীয় তথ্যের সার-সংক্ষেপ। সচিত্র ফ্যাক্টশিট আকারে উপস্থাপিত এসব তথ্য সারা দেশের কৃষি কর্মকর্তা, সম্প্রসারণবিদ ও গণমাধ্যমকর্মীরা কাজে লাগাতে পারেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে যখন চারদিকে হৈ চৈ তখন দেশের কৃষকদের প্রয়োজনীয় তথ্য এভাবে ছড়িয়ে দেয়ার এই বিনীত প্রয়াস বাস্তবে কতটা ফলপ্রসূ হয় সেটা দেখা যেতে পারে।
ব্রি নলেজ ব্যাংকের ফ্যাক্টশিট থেকে জানা গেছে, ব্রি ধান৪৭, এর বীজ বপনের সময় ১-১৫ অগ্রহায়ণ বা ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বর। রোপণের জন্য চারার বয়স ৩৫ থেকে ৪০ দিন হলে ভালো। এ ধানের রোপণ দূরত্ব ২০/১৫ সেন্টিমিটার হওয়া প্রয়োজন। এ ধানের ক্ষেতে সার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রতি বিঘায় ইউরিয়া ২৫ কেজি, টিএসপি ৯ কেজি, এমপি ৮ কেজি, জিপসাম ৮ কেজি এবং জিংক ১৫ কেজি করে প্রয়োগ করতে হয়।
ব্রি ধান৪৭ উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় ধান চাষে নতুন দিনের সূচনা করতে পারে, যদি আমাদের চাষী ভাইরা এক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও কিছু সহায়তা পান। আর এই সহায়তা দেয়া যেতে পারে পর্যাপ্ত বীজ ও সংশিষ্ট উপকরণ কৃষকদের কাছে সহজলভ্য করে। একইসঙ্গে সঠিক চাষাবাদ ও ব্যবস্থাপনা কৌশল যাতে তারা অনুসরণ করেন, সেদিকেও নজর দেয়া প্রয়োজন। সরকারের কৃষি বিভাগ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং উন্নয়নসহযোগীরা এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারেন।
ড. মো. মোশাররফ হোসেন : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফলিত গবেষণা বিভাগ, ব্রি; এম এ কাসেম : সম্পাদক, প্রকাশনা ও জনসংযোগ বিভাগ, ব্রি, গাজীপুর
No comments