নিরাপদ সড়কের দায়িত্ব কার by এ এম এম শওকত আলী
নিরাপত্তাহীন সড়ক জনস্বাস্থ্যের জন্য বিশাল হুমকি। বিশ্বব্যাপী এ তত্ত্বটি বর্তমানে স্বীকৃত। বিগত দুই সপ্তাহে সংবাদমাধ্যমে নিরাপদ সড়কের অভাবসহ আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মূলত এ-সংক্রান্ত সংবাদ বিশ্লেষণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো_এক. রাজনৈতিক, দুই. অর্থনৈতিক, তিন. সামাজিক, চার. ক্ষমতাসীন কিছু ব্যক্তির অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং পাঁচ. নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তাবিধানে সংশ্লিষ্ট কাঠামোর ব্যর্থতা।
জনস্বাস্থ্য : নিরাপত্তাহীন সড়কের জন্য জনপথ সম্পর্কিত দুর্ঘটনায় সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বিগত এক দশকে (১৯৯৯-২০১০) ৩৮ হাজার ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে। একটি দৈনিকের তথ্য অনুযায়ী এর ফলে আড়াই লাখ ব্যক্তির অঙ্গহানি হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ হাজার ৩৪ জন মারা যায়। এক বছরেই যদি ২০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়, তাহলে এক দশকের মধ্যে ৩৮ হাজার মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনাজনিত নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। এ তথ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব কার? স্বভাবতই বলা যায়, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের। অনুসন্ধানে জানা যায়, মূলত সড়ক ও জনপথ বিভাগের একটি শাখা এসব তথ্য সংরক্ষণ করে থাকে। এ নিয়ে এ বিভাগ এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য দেয়নি। অথবা অনুসন্ধিৎসু কোনো সাংবাদিক এ বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে চেষ্টা করেননি অথবা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।
রাজনৈতিক : প্রকাশিত সব সংবাদেই রাজনৈতিক বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং একটি টিভি নিউজ চ্যানেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান মিশুক মুনীরের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর একজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা মন্তব্য করেছেন, এ কোনো মৃত্যু নয়, হত্যাকাণ্ড। বিশিষ্টজনরা বলেছেন, এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের দায় নিতে হবে। একই সঙ্গে তাঁরা দ্রুত সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরীক্ষা না করে লাইসেন্স প্রদানের প্রবণতা বা চেষ্টা বন্ধ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।
বস্তুত মানিকগঞ্জের দুর্ঘটনা এবং পর পর ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে বাস মালিকরা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাস চলাচল বন্ধ ঘোষণার পরই প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে তলব করেন। এ বিষয়ে তাঁর পূর্ববর্তী সাফাই ছিল, অর্থ বিভাগ অর্থ বরাদ্দ না দিলে কিভাবে তিনি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করবেন? অকাট্য যুক্তি। তবে প্রধানমন্ত্রীর আহূত সভায় অর্থমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর উত্তর ছিল, বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী অর্থ দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী কী বলেছেন তা জানা যায়নি। যা জানা গেছে তা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এ রকম ঘটলে একটি তদন্ত হতো। সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি অথবা পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি এ বিষয়টি খতিয়ে দেখে সংসদের কাছে প্রয়োজনীয় সুপারিশ পেশ করত। প্রধানমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত যুক্তিসংগত হলেও অন্তত একটা নিরপেক্ষ তদন্ত করার প্রয়োজন ছিল। কারণ এতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হতো।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সূত্র অনুযায়ী, সাফ বলে দিয়েছেন, তাঁর পদত্যাগ করার কোনো কারণ নেই। কারণ অবশ্যই রয়েছে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পরিচালনায় মন্ত্রীর দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করার রীতি রয়েছে। ইংরেজিতে এ রীতিকে প্রিন্সিপল অব মিনিস্টেরিয়াল রেসপনসিবিলিটি (Principle of Ministerial Responsibility) বলা হয়। বাংলাদেশে এ সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। তবে নগণ্যসংখ্যক ব্যতিক্রমও রয়েছে।
অর্থনৈতিক : যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ডিএফআইডি) হিসাব অনুযায়ী (২০০৪ সালের জরিপ), সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৬ শতাংশ ক্ষতি হয়। একজন বিশেষজ্ঞের মতে, বর্তমানে এ ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ২ শতাংশেরও বেশি। বিপুল অঙ্কের এই ক্ষতি রোধে সরকারের কি কোনো দায়িত্বই নেই?
অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বেসরকারি পরিবহন সাময়িকভাবে বন্ধ করার বিষয়টিও মিডিয়ায় আলোচিত হয়েছে। এই সড়কপথে প্রায় ১৫ হাজার ছোট, মাঝারি ও বড় শিল্প রয়েছে। এদের পরিচালনায় নিযুক্ত ব্যক্তিরা বলেছেন, পরিবহনব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার সময় দীর্ঘ হলে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। এ ছাড়া এ সড়কসংলগ্ন মৎস্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী চাষিরাও বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ব্যবসায়ীদের মতে, এ দেশে অবকাঠামোর ঘাটতি অবশ্যই রয়েছে। তবে বিদ্যমান অবকাঠামোগত সুবিধাও এখন ব্যবহারের অযোগ্য হওয়ায় ব্যবসায়িক ক্ষতি বৃদ্ধি পাবে। মাছ, মুরগি, ডিমসহ শাকসবজি এ পথে ঢাকার বাজারে আসতে না পারলে রাজধানীর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যও বৃদ্ধি পাবে। সার্বিকভাবে বলা হয়েছে, এ দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মোট ১০৫ বিলিয়ন ডলারের এক-তৃতীয়াংশ হলো এ সড়কসংলগ্ন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবদান। এ অবদানও এখন হুমকির মুখে।
সামাজিক : সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টি একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে জিডিপির ক্ষতি রোধে যদি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট বেসরকারি খাত সচেষ্ট হতো, তাহলে প্রাপ্ত অর্থসম্পদ দিয়ে সামাজিক উন্নয়ন খাতভুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা খাতগুলোর অধিকতর উন্নয়ন করা সম্ভব বা সম্ভাবনা ছিল। কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী অর্থনীতিতে যে কালো ছায়া দেখতে পেয়েছেন, সে ছায়ার ব্যাপ্তি বিরামহীন। সড়ক দুর্ঘটনা সুনামিতে পরিণত হয়ে অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারে। অন্যদিকে অবিরাম সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গহীন হয়, তাও অনেক সামাজিক সমস্যার কারণ হতে পারে। শারীরিকভাবে সমর্থ না হলে কাজ করা যায় না। এদের ব্যয়ভার কে বহন করবে? এদের মধ্যে যারা গরিব, তাদের ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। এদের অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের দায়িত্ব কে নেবে?
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড : উপেক্ষিত সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে মিডিয়া একটি চমকপ্রদ সংবাদ প্রকাশ করেছে। একজন মন্ত্রীর চাপে ২০০৯ সালে পরীক্ষা ছাড়া ১০ হাজার চালককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। এবার শোনা যায়, তিনি একই পদ্ধতি অনুসরণে ২৪ হাজার লাইসেন্স প্রদানের জন্য চাপ দিচ্ছেন। এই মন্ত্রীর জনপথ-সংক্রান্ত কোনো দায়িত্ব নেই। কেন তিনি এ চাপ প্রয়োগ করছেন? সড়ক ও জনপথ-সংক্রান্ত বিষয়ে মন্ত্রী পর্যায়ে একটি নীতিনির্ধারণী কাঠামো রয়েছে। এর নাম সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। এই কাউন্সিল নিষ্ক্রিয়। বাংলাদেশে এ ধরনের সব কাউন্সিলই নিষ্ক্রিয়। ২০০৮ সালে দেখা গিয়েছিল, জাতীয় জনসংখ্যা কাউন্সিল প্রায় ১০ বছর কোনো সভা না করে ২০০৮ সালে একটি সভা করেছিল। সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল নিষ্ক্রিয় থাকলে কোনো ক্ষতি নেই। তবে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য মাঝেমধ্যে সক্রিয় হয়ে আইন ও বিধান ভঙ্গ করে পরীক্ষা ছাড়াই হাজার হাজার চালককে লাইসেন্স দিয়ে সড়ক চলাচল ব্যবস্থাকে মরণফাঁদে পরিণত করলেই সমূহ বিপদ, যে বিপদ এখন দৃশ্যমান। এ-সংক্রান্ত সংবাদে এ তথ্যই পরিবেশিত হয়েছে। এক সভায় নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো আলোচনা না করে পরীক্ষাবিহীন লাইসেন্স প্রদানের আগ্রহই বেশি দেখিয়েছেন কর্তাব্যক্তিরা।
এটাই শেষ নয়। পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়া এবং একই সঙ্গে পরিবহন খাতে চাঁদা নির্ধারণ করার সিদ্ধান নেওয়া হয়। এবার ওই কর্তাব্যক্তির শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা ২৪ হাজার লাইসেন্স সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে বলা যায়, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে একটি অনুসরণীয় নীতি রয়েছে। ইংরেজিতে বলা হয়, কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট (Conflict of Interest)। অর্থাৎ কোনো সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী কোনো ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকবেন। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে ব্যক্তিগত পেশাসংক্রান্ত বিষয় লিপিবদ্ধ করার নিয়ম রয়েছে। ওই কর্তাব্যক্তি চাঁদার বিনিময়ে নিজস্ব সংগঠন অথবা যার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন, সে সংগঠনকে পরীক্ষা ছাড়াই পেশাদার লাইসেন্স প্রদানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে এ নীতির ব্যত্যয় করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর আহূত সভায় চলাচলের অযোগ্য সড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কী সিদ্ধাণ্ড হয়েছে, তা জানা যায়নি। এ বিষয়ে ভারতে সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সরকারের দুর্নীতির বিষয়টি স্মরণ করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলছে, তাঁকেও সার্বিকভাবে দুর্নীতির দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সজ্ঞানে দুর্নীতির দায়ে বর্তমানে বিচারাধীন এ রাজাকে নিবৃত্ত করেননি। দুর্নীতিবিষয়ক সামাজিক সংস্থাসহ বিরোধী দলের প্রচণ্ড চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত রাজাকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দেওয়ার পর টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ রাজা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এ উদাহরণ নিরাপদ সড়ক সংক্রান্ত বিষয়ে বর্তমানে যে বিতর্ক চলছে, তার জন্য অনুসরণ করা যেতে পারে। কিন্তু সব কিছু নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। তিনি এ পথ অনুসরণ না করলে সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সব ধরনের দুর্নীতি ও অনাচার সম্পর্কিত বিষয়ে জড়িত হওয়ার জন্য সমালোচিত হবেন। এ আশঙ্কা অমূলক নয়। কারণ ক্লিন নামে অভিহিত মনমোহনের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।
পরিবহন খাতের এককালের শ্রমিকনেতার বর্ণিত চাপের বিষয়ে একজন বিশিষ্ট নাগরিকের প্রতিক্রিয়া প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, লাইসেন্স দেবে বিআরটিএ, কাউন্সিল কেন? রাজনৈতিক প্রভাবদুষ্ট শাসনকাঠামোতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কারণ আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কাঠামো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়। কিছু নগণ্যসংখ্যক কর্তাব্যক্তি প্রশাসনসহ আইন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী। যদি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ জনস্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়, সুশাসনের জন্য সেটাই হওয়ার কথা, তাহলে কোনো ক্ষতি ছিল না। এ ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই হয়নি। ফলে বিপন্ন হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে প্রতিদিন দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী, যারা যানবাহন ব্যবহার করে।
সড়ক নিরাপত্তা বিধানে প্রচলিত কাঠামোর ব্যর্থতা : এ দেশে যখনই বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা বা অপরাধ হয়, তখনই বিভিন্ন মহলের একটি অভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়_আইনকে যুগোপযোগী ও কঠোর করা হোক। আইন প্রয়োগে ব্যর্থতার কথা বলা হয় এবং বলা হয় বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা বা দীর্ঘসূত্রতার কথা। তবে আইনে কঠোর বা কঠোরতম শাস্তির বিধানের কথাই উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারিত হয়। কয়েক দিন আগে মহাজোটভুক্ত এক দলীয় প্রধানও মৃত্যুদণ্ডের কথা বলেছেন। ১৬ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারও সেই পথে এগোবে। আইন প্রয়োগের ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে অধিকতর জনবল নিয়োগের কথা বলা হয়। কিন্তু কেউ আইন ও আইনবহির্ভূত কাঠামোকে শক্তিশালী করার জন্য কোনো প্রস্তাব উচ্চৈঃস্বরে দেন না। আইনবহির্ভূত কাঠামোর মধ্যে রয়েছে পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্ট সমিতিগুলো_মালিক সমিতি, শ্রমিক সমিতি ও চালক সমিতি। এ কাঠামোগুলোকে কেন কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয় না অথবা এরাই বা কেন নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে এ দায়িত্ব গ্রহণ করে না? অনেক কারণ থাকতে পারে, যা অনুসন্ধানযোগ্য। একটি কারণ সর্বজনবিদিত। তা হলো এ ধরনের সমিতিগুলোর রাজনীতিকায়ন। প্রধান দুই দলই এ দোষে দুষ্ট। খেসারত দিচ্ছে সাধারণ ও নিরীহ যাত্রীরা। বর্তমান সড়ক পরিবহন খাতের অবর্ণনীয় দুরবস্থা থেকে একটি বিষয় শিক্ষণীয়। তা হলো বিগত তিন দশক ধরে অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে সড়ক পরিবহন অন্যান্য পরিবহন, যেমন_রেলপথ ও নৌপথের চেয়ে অধিকতর গুরুত্ব লাভ করে। অন্য দুই পরিবহন মাধ্যম ক্রমাগত উপেক্ষিত হয়েছে। বর্তমানে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে রেলপথ উন্নয়ন উপেক্ষিত হওয়া ছাড়াও এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নয়নসংক্রান্ত বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট সম্পদ বরাদ্দ হয় না। বর্তমানে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হওয়ায় রেলের ওপর চাপ পড়েছে। এ বিষয়ে সরকার কী কৌশল গ্রহণ করবে? আন্তপরিবহনব্যবস্থার উন্নতির সমতা বিধান করাই উচিত ও যুক্তিযুক্ত কৌশল।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
রাজনৈতিক : প্রকাশিত সব সংবাদেই রাজনৈতিক বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং একটি টিভি নিউজ চ্যানেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান মিশুক মুনীরের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর একজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা মন্তব্য করেছেন, এ কোনো মৃত্যু নয়, হত্যাকাণ্ড। বিশিষ্টজনরা বলেছেন, এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের দায় নিতে হবে। একই সঙ্গে তাঁরা দ্রুত সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরীক্ষা না করে লাইসেন্স প্রদানের প্রবণতা বা চেষ্টা বন্ধ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।
বস্তুত মানিকগঞ্জের দুর্ঘটনা এবং পর পর ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে বাস মালিকরা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাস চলাচল বন্ধ ঘোষণার পরই প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে তলব করেন। এ বিষয়ে তাঁর পূর্ববর্তী সাফাই ছিল, অর্থ বিভাগ অর্থ বরাদ্দ না দিলে কিভাবে তিনি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করবেন? অকাট্য যুক্তি। তবে প্রধানমন্ত্রীর আহূত সভায় অর্থমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর উত্তর ছিল, বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী অর্থ দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী কী বলেছেন তা জানা যায়নি। যা জানা গেছে তা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এ রকম ঘটলে একটি তদন্ত হতো। সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি অথবা পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি এ বিষয়টি খতিয়ে দেখে সংসদের কাছে প্রয়োজনীয় সুপারিশ পেশ করত। প্রধানমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত যুক্তিসংগত হলেও অন্তত একটা নিরপেক্ষ তদন্ত করার প্রয়োজন ছিল। কারণ এতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হতো।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সূত্র অনুযায়ী, সাফ বলে দিয়েছেন, তাঁর পদত্যাগ করার কোনো কারণ নেই। কারণ অবশ্যই রয়েছে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পরিচালনায় মন্ত্রীর দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করার রীতি রয়েছে। ইংরেজিতে এ রীতিকে প্রিন্সিপল অব মিনিস্টেরিয়াল রেসপনসিবিলিটি (Principle of Ministerial Responsibility) বলা হয়। বাংলাদেশে এ সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। তবে নগণ্যসংখ্যক ব্যতিক্রমও রয়েছে।
অর্থনৈতিক : যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ডিএফআইডি) হিসাব অনুযায়ী (২০০৪ সালের জরিপ), সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৬ শতাংশ ক্ষতি হয়। একজন বিশেষজ্ঞের মতে, বর্তমানে এ ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ২ শতাংশেরও বেশি। বিপুল অঙ্কের এই ক্ষতি রোধে সরকারের কি কোনো দায়িত্বই নেই?
অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বেসরকারি পরিবহন সাময়িকভাবে বন্ধ করার বিষয়টিও মিডিয়ায় আলোচিত হয়েছে। এই সড়কপথে প্রায় ১৫ হাজার ছোট, মাঝারি ও বড় শিল্প রয়েছে। এদের পরিচালনায় নিযুক্ত ব্যক্তিরা বলেছেন, পরিবহনব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার সময় দীর্ঘ হলে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। এ ছাড়া এ সড়কসংলগ্ন মৎস্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী চাষিরাও বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ব্যবসায়ীদের মতে, এ দেশে অবকাঠামোর ঘাটতি অবশ্যই রয়েছে। তবে বিদ্যমান অবকাঠামোগত সুবিধাও এখন ব্যবহারের অযোগ্য হওয়ায় ব্যবসায়িক ক্ষতি বৃদ্ধি পাবে। মাছ, মুরগি, ডিমসহ শাকসবজি এ পথে ঢাকার বাজারে আসতে না পারলে রাজধানীর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যও বৃদ্ধি পাবে। সার্বিকভাবে বলা হয়েছে, এ দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মোট ১০৫ বিলিয়ন ডলারের এক-তৃতীয়াংশ হলো এ সড়কসংলগ্ন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবদান। এ অবদানও এখন হুমকির মুখে।
সামাজিক : সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টি একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে জিডিপির ক্ষতি রোধে যদি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট বেসরকারি খাত সচেষ্ট হতো, তাহলে প্রাপ্ত অর্থসম্পদ দিয়ে সামাজিক উন্নয়ন খাতভুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা খাতগুলোর অধিকতর উন্নয়ন করা সম্ভব বা সম্ভাবনা ছিল। কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী অর্থনীতিতে যে কালো ছায়া দেখতে পেয়েছেন, সে ছায়ার ব্যাপ্তি বিরামহীন। সড়ক দুর্ঘটনা সুনামিতে পরিণত হয়ে অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারে। অন্যদিকে অবিরাম সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গহীন হয়, তাও অনেক সামাজিক সমস্যার কারণ হতে পারে। শারীরিকভাবে সমর্থ না হলে কাজ করা যায় না। এদের ব্যয়ভার কে বহন করবে? এদের মধ্যে যারা গরিব, তাদের ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। এদের অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের দায়িত্ব কে নেবে?
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড : উপেক্ষিত সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে মিডিয়া একটি চমকপ্রদ সংবাদ প্রকাশ করেছে। একজন মন্ত্রীর চাপে ২০০৯ সালে পরীক্ষা ছাড়া ১০ হাজার চালককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। এবার শোনা যায়, তিনি একই পদ্ধতি অনুসরণে ২৪ হাজার লাইসেন্স প্রদানের জন্য চাপ দিচ্ছেন। এই মন্ত্রীর জনপথ-সংক্রান্ত কোনো দায়িত্ব নেই। কেন তিনি এ চাপ প্রয়োগ করছেন? সড়ক ও জনপথ-সংক্রান্ত বিষয়ে মন্ত্রী পর্যায়ে একটি নীতিনির্ধারণী কাঠামো রয়েছে। এর নাম সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। এই কাউন্সিল নিষ্ক্রিয়। বাংলাদেশে এ ধরনের সব কাউন্সিলই নিষ্ক্রিয়। ২০০৮ সালে দেখা গিয়েছিল, জাতীয় জনসংখ্যা কাউন্সিল প্রায় ১০ বছর কোনো সভা না করে ২০০৮ সালে একটি সভা করেছিল। সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল নিষ্ক্রিয় থাকলে কোনো ক্ষতি নেই। তবে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য মাঝেমধ্যে সক্রিয় হয়ে আইন ও বিধান ভঙ্গ করে পরীক্ষা ছাড়াই হাজার হাজার চালককে লাইসেন্স দিয়ে সড়ক চলাচল ব্যবস্থাকে মরণফাঁদে পরিণত করলেই সমূহ বিপদ, যে বিপদ এখন দৃশ্যমান। এ-সংক্রান্ত সংবাদে এ তথ্যই পরিবেশিত হয়েছে। এক সভায় নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো আলোচনা না করে পরীক্ষাবিহীন লাইসেন্স প্রদানের আগ্রহই বেশি দেখিয়েছেন কর্তাব্যক্তিরা।
এটাই শেষ নয়। পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়া এবং একই সঙ্গে পরিবহন খাতে চাঁদা নির্ধারণ করার সিদ্ধান নেওয়া হয়। এবার ওই কর্তাব্যক্তির শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা ২৪ হাজার লাইসেন্স সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে বলা যায়, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে একটি অনুসরণীয় নীতি রয়েছে। ইংরেজিতে বলা হয়, কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট (Conflict of Interest)। অর্থাৎ কোনো সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী কোনো ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকবেন। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে ব্যক্তিগত পেশাসংক্রান্ত বিষয় লিপিবদ্ধ করার নিয়ম রয়েছে। ওই কর্তাব্যক্তি চাঁদার বিনিময়ে নিজস্ব সংগঠন অথবা যার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন, সে সংগঠনকে পরীক্ষা ছাড়াই পেশাদার লাইসেন্স প্রদানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে এ নীতির ব্যত্যয় করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর আহূত সভায় চলাচলের অযোগ্য সড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কী সিদ্ধাণ্ড হয়েছে, তা জানা যায়নি। এ বিষয়ে ভারতে সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সরকারের দুর্নীতির বিষয়টি স্মরণ করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলছে, তাঁকেও সার্বিকভাবে দুর্নীতির দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সজ্ঞানে দুর্নীতির দায়ে বর্তমানে বিচারাধীন এ রাজাকে নিবৃত্ত করেননি। দুর্নীতিবিষয়ক সামাজিক সংস্থাসহ বিরোধী দলের প্রচণ্ড চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত রাজাকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দেওয়ার পর টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ রাজা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এ উদাহরণ নিরাপদ সড়ক সংক্রান্ত বিষয়ে বর্তমানে যে বিতর্ক চলছে, তার জন্য অনুসরণ করা যেতে পারে। কিন্তু সব কিছু নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। তিনি এ পথ অনুসরণ না করলে সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সব ধরনের দুর্নীতি ও অনাচার সম্পর্কিত বিষয়ে জড়িত হওয়ার জন্য সমালোচিত হবেন। এ আশঙ্কা অমূলক নয়। কারণ ক্লিন নামে অভিহিত মনমোহনের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।
পরিবহন খাতের এককালের শ্রমিকনেতার বর্ণিত চাপের বিষয়ে একজন বিশিষ্ট নাগরিকের প্রতিক্রিয়া প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, লাইসেন্স দেবে বিআরটিএ, কাউন্সিল কেন? রাজনৈতিক প্রভাবদুষ্ট শাসনকাঠামোতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কারণ আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কাঠামো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়। কিছু নগণ্যসংখ্যক কর্তাব্যক্তি প্রশাসনসহ আইন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী। যদি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ জনস্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়, সুশাসনের জন্য সেটাই হওয়ার কথা, তাহলে কোনো ক্ষতি ছিল না। এ ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই হয়নি। ফলে বিপন্ন হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে প্রতিদিন দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী, যারা যানবাহন ব্যবহার করে।
সড়ক নিরাপত্তা বিধানে প্রচলিত কাঠামোর ব্যর্থতা : এ দেশে যখনই বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা বা অপরাধ হয়, তখনই বিভিন্ন মহলের একটি অভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়_আইনকে যুগোপযোগী ও কঠোর করা হোক। আইন প্রয়োগে ব্যর্থতার কথা বলা হয় এবং বলা হয় বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা বা দীর্ঘসূত্রতার কথা। তবে আইনে কঠোর বা কঠোরতম শাস্তির বিধানের কথাই উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারিত হয়। কয়েক দিন আগে মহাজোটভুক্ত এক দলীয় প্রধানও মৃত্যুদণ্ডের কথা বলেছেন। ১৬ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারও সেই পথে এগোবে। আইন প্রয়োগের ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে অধিকতর জনবল নিয়োগের কথা বলা হয়। কিন্তু কেউ আইন ও আইনবহির্ভূত কাঠামোকে শক্তিশালী করার জন্য কোনো প্রস্তাব উচ্চৈঃস্বরে দেন না। আইনবহির্ভূত কাঠামোর মধ্যে রয়েছে পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্ট সমিতিগুলো_মালিক সমিতি, শ্রমিক সমিতি ও চালক সমিতি। এ কাঠামোগুলোকে কেন কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয় না অথবা এরাই বা কেন নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে এ দায়িত্ব গ্রহণ করে না? অনেক কারণ থাকতে পারে, যা অনুসন্ধানযোগ্য। একটি কারণ সর্বজনবিদিত। তা হলো এ ধরনের সমিতিগুলোর রাজনীতিকায়ন। প্রধান দুই দলই এ দোষে দুষ্ট। খেসারত দিচ্ছে সাধারণ ও নিরীহ যাত্রীরা। বর্তমান সড়ক পরিবহন খাতের অবর্ণনীয় দুরবস্থা থেকে একটি বিষয় শিক্ষণীয়। তা হলো বিগত তিন দশক ধরে অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে সড়ক পরিবহন অন্যান্য পরিবহন, যেমন_রেলপথ ও নৌপথের চেয়ে অধিকতর গুরুত্ব লাভ করে। অন্য দুই পরিবহন মাধ্যম ক্রমাগত উপেক্ষিত হয়েছে। বর্তমানে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে রেলপথ উন্নয়ন উপেক্ষিত হওয়া ছাড়াও এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নয়নসংক্রান্ত বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট সম্পদ বরাদ্দ হয় না। বর্তমানে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হওয়ায় রেলের ওপর চাপ পড়েছে। এ বিষয়ে সরকার কী কৌশল গ্রহণ করবে? আন্তপরিবহনব্যবস্থার উন্নতির সমতা বিধান করাই উচিত ও যুক্তিযুক্ত কৌশল।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments