আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৩৬)-শম্ভু মিত্রের 'রক্তকরবী' দেখেছি নিউ এম্পায়ার সিনেমা হলে by আলী যাকের
লাবনী মোটেল ছিল তখন একতলা আর সমুদ্রতট ছিল ঠিক লাবনীর পেছনেই। প্রতিদিন সকালে আমরা সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। ক্ষুধা এবং পিপাসায় নিতান্ত ক্লান্ত হয়ে না পড়লে সমুদ্র ছেড়ে উঠতাম না। সেবার প্রায় প্রতিদিনই সামুদ্রিক মাছের ভোজ হতো আমাদের। কত রকম মাছ : রূপচাঁদা, ছুরি, লাক্কা এবং চিংড়ি। মায়ের নির্দেশে শামসু ভাই একেক দিন একেক ধরনের বিচিত্রসব পদের মাছ রান্না করত। তখন কঙ্বাজার ছিল আদিগন্ত ঝাউগাছ আবৃত একটি ছোট্ট শহর।
পাহাড়ের গালিচা পাতা। পশ্চিমে সমুদ্র আর পুবে পাহাড়। সেই পাহাড়ের নিচেও আমাদের বনভোজন হতো। তখন অনেক কষ্ট করে হিমছড়িতে পেঁৗছাতে হতো। তবে সেই হিমছড়ির ঝরনা ছেড়ে শহরে ফিরতে ইচ্ছে করত না সহজে। মনে পড়ে একদিন মুড়ির টিন বাসে করে আমরা রামুতে বৌদ্ধ মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছিলাম। এ ছাড়া কঙ্বাজারের আদিবাসী মগ সম্প্রদায়ের পল্লীতেও বেড়াতে গিয়েছিলাম এবং তাদের জীবনযাত্রা আমাদের চমৎকৃত করেছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর স্বজনহারা এক সংসার হঠাৎ যেন সব শোক ভুলে গিয়েছিল কয়েক দিনের জন্য। আনন্দে মেতে উঠেছিলাম আমরা সবাই। ফেরার পথে আমরা চট্টগ্রাম শহরে যাত্রাবিরতি দিয়ে আমানত শাহের মাজার-সংলগ্ন আমার বাবার সমাধি দেখতে গিয়েছিলাম। বাবা নিশ্চয়ই কোনো একদিন মায়ের কাছে উল্লেখ করেছিলেন তাঁর ইচ্ছার কথা। সে অনুযায়ী ওই খানে তাঁর কবর দেওয়া হয়। পরিবারের আমরা সবাই মিলে ঢাকা থেকে তাঁর মৃতদেহ চট্টগ্রামে নিয়ে যাই।
কঙ্বাজারের সেই আনন্দভ্রমণ আমাদের যদিও সঞ্জীবিত করেছিল, তবুও ফিরে এসে মায়ের ক্যান্সার ধরা এবং পরে তাঁর চিকিৎসা আমাদের সব আনন্দ আবারও মুছে দেয়। এ বিষয়ে আমি আগেও নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছি। '৬২ থেকে '৬৪ সম্পর্কেও আমি লিখেছি। তবে আমার এ লেখাটি যেহেতু চলমান সময়ের ওপরে, তাই পথ চলতে, চলতে অনেক সময় অতীতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা, যা বলা হয়নি, স্বভাবতই স্থান পেতে পারে। তেমনি একটি ঘটনা ছিল আমাদের কঙ্বাজার ভ্রমণ। তবুও একেবারে স্মৃতিনির্ভর লেখায় সব বিষয় মনে রেখে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবুও তাৎপর্যপূর্ণ কোনো ঘটনা হলে আমাকে পেছন ফিরে তাকাতে হবে বৈকি।
কলকাতায় চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে মায়ের চিকিৎসা চলার সময় আমরা পালা করে একের পর এক কলকাতায় যেতাম। তখন পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে চলাচলের জন্য ভিসাবিষয়ক জটিলতা ছিল না বললেই চলে। এটি শুরু হয় ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর এবং '৭০-এর শুরুতে কয়েক বছর বাদ দিয়ে আবার আরোপিত হয়। এখন তো ভারতের ভিসা পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার। যাহোক, সে সময় 'বি' ভিসা বলে একধরনের ভিসার প্রচলন ছিল, যার মাধ্যমে বছরে আটবার ভারত ভ্রমণ করা যেত। আমার মা এবং ভাইবোন সবারই এ ভিসাটি ছিল। ফলে আমাদের পক্ষে সময়ে-সময়ে কলকাতায় গিয়ে মায়ের অসুখের তদারকি করা সহজ হয়েছিল। এ ছাড়া কলকাতার প্রতি একটা আকর্ষণ আমাকে সব সময় ওই দিকে টানত। কলকাতার গান, নৃত্য, বইপত্র, নাটক এবং সিনেমার সবই আমাদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। মনে পড়ে, মা যখন হাসপাতালে ছিলেন তখন কোনো সন্ধ্যায় হাসপাতালে আমার কিছু করার না থাকলে আমি নাটক দেখতে উত্তর কলকাতায় পৌঁছে যেতাম। সেখানে তখন নিয়মিতভাবে নান্দিকার এবং পিপল্স লিটল থিয়েটার গোষ্ঠী নাটক মঞ্চায়ন করত। শম্ভু মিত্রের 'রক্তকরবী' অবশ্য আমি দেখেছি নিউ এম্পায়ার সিনেমা হলে। এ হলটি নাটকাভিনয়ের জন্যও ব্যবহার করা হতো। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত তখনো আমাদের ততটা আকৃষ্ট করত না। তবে মানবেন্দ্র, হেমন্ত, মান্না দে, সতীনাথ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আমাদের বড় প্রিয় শিল্পী ছিলেন। তখন আকাশবাণীতে অনুরোধের আসর বলে একটি অনুষ্ঠান হতো রবিবার দুপুরে। সেই অনুষ্ঠানে অনুরোধকারীদের নাম পড়ে শোনানোর রেওয়াজ ছিল। অস্বীকার করব না যে রেডিওতে নিজের নাম শোনার জন্য অনেক সময় কোনো বিশেষ গান শোনার অনুরোধ করে পাঠিয়েছি। বাষট্টির শেষ, কি তেষট্টির শুরুর দিকে মা সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন। আমরা সবাই হৈ হৈ করে মাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম। মাও খুশি। ওঁর ওজন অনেকটা বেড়েছে, গালে রং লেগেছে এবং মা আবারও আমাদের সংসারের কাজে ফিরে এলেন। মায়ের একটা অভ্যাস ছিল বিপদ-আপদ, কী আনন্দের কিছু ঘটলে তিনি বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন মাজারে যেতেন। ফলে দিলি্ল, আজমির, সিলেট এবং চট্টগ্রাম_সব জায়গাতেই তিনি গেলেন। '৬৪ সালে আমার সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা হবে। সে জন্য আমি তাঁর সঙ্গে কোথাও যেতে পারিনি। তবে দিদি অথবা ঝুনু ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। ঢাকায় আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব নিয়মিত মাকে দেখতে আসতেন। এঁরা এলে মা খুব আনন্দিত হতেন। মা আপাতদৃষ্টিতে সব বিপদ কাটিয়ে উঠলেও আমরা পরিষ্কার বুঝতাম যে বাবার জন্য তাঁর মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে থাকত। আমাদের লুকিয়ে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। তবুও আমরা ধরে নিয়েছিলাম সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। এরই মধ্যে ঝুনু হলিক্রস কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
(চলবে.....)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
কঙ্বাজারের সেই আনন্দভ্রমণ আমাদের যদিও সঞ্জীবিত করেছিল, তবুও ফিরে এসে মায়ের ক্যান্সার ধরা এবং পরে তাঁর চিকিৎসা আমাদের সব আনন্দ আবারও মুছে দেয়। এ বিষয়ে আমি আগেও নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছি। '৬২ থেকে '৬৪ সম্পর্কেও আমি লিখেছি। তবে আমার এ লেখাটি যেহেতু চলমান সময়ের ওপরে, তাই পথ চলতে, চলতে অনেক সময় অতীতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা, যা বলা হয়নি, স্বভাবতই স্থান পেতে পারে। তেমনি একটি ঘটনা ছিল আমাদের কঙ্বাজার ভ্রমণ। তবুও একেবারে স্মৃতিনির্ভর লেখায় সব বিষয় মনে রেখে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবুও তাৎপর্যপূর্ণ কোনো ঘটনা হলে আমাকে পেছন ফিরে তাকাতে হবে বৈকি।
কলকাতায় চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে মায়ের চিকিৎসা চলার সময় আমরা পালা করে একের পর এক কলকাতায় যেতাম। তখন পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে চলাচলের জন্য ভিসাবিষয়ক জটিলতা ছিল না বললেই চলে। এটি শুরু হয় ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর এবং '৭০-এর শুরুতে কয়েক বছর বাদ দিয়ে আবার আরোপিত হয়। এখন তো ভারতের ভিসা পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার। যাহোক, সে সময় 'বি' ভিসা বলে একধরনের ভিসার প্রচলন ছিল, যার মাধ্যমে বছরে আটবার ভারত ভ্রমণ করা যেত। আমার মা এবং ভাইবোন সবারই এ ভিসাটি ছিল। ফলে আমাদের পক্ষে সময়ে-সময়ে কলকাতায় গিয়ে মায়ের অসুখের তদারকি করা সহজ হয়েছিল। এ ছাড়া কলকাতার প্রতি একটা আকর্ষণ আমাকে সব সময় ওই দিকে টানত। কলকাতার গান, নৃত্য, বইপত্র, নাটক এবং সিনেমার সবই আমাদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। মনে পড়ে, মা যখন হাসপাতালে ছিলেন তখন কোনো সন্ধ্যায় হাসপাতালে আমার কিছু করার না থাকলে আমি নাটক দেখতে উত্তর কলকাতায় পৌঁছে যেতাম। সেখানে তখন নিয়মিতভাবে নান্দিকার এবং পিপল্স লিটল থিয়েটার গোষ্ঠী নাটক মঞ্চায়ন করত। শম্ভু মিত্রের 'রক্তকরবী' অবশ্য আমি দেখেছি নিউ এম্পায়ার সিনেমা হলে। এ হলটি নাটকাভিনয়ের জন্যও ব্যবহার করা হতো। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত তখনো আমাদের ততটা আকৃষ্ট করত না। তবে মানবেন্দ্র, হেমন্ত, মান্না দে, সতীনাথ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আমাদের বড় প্রিয় শিল্পী ছিলেন। তখন আকাশবাণীতে অনুরোধের আসর বলে একটি অনুষ্ঠান হতো রবিবার দুপুরে। সেই অনুষ্ঠানে অনুরোধকারীদের নাম পড়ে শোনানোর রেওয়াজ ছিল। অস্বীকার করব না যে রেডিওতে নিজের নাম শোনার জন্য অনেক সময় কোনো বিশেষ গান শোনার অনুরোধ করে পাঠিয়েছি। বাষট্টির শেষ, কি তেষট্টির শুরুর দিকে মা সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন। আমরা সবাই হৈ হৈ করে মাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম। মাও খুশি। ওঁর ওজন অনেকটা বেড়েছে, গালে রং লেগেছে এবং মা আবারও আমাদের সংসারের কাজে ফিরে এলেন। মায়ের একটা অভ্যাস ছিল বিপদ-আপদ, কী আনন্দের কিছু ঘটলে তিনি বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন মাজারে যেতেন। ফলে দিলি্ল, আজমির, সিলেট এবং চট্টগ্রাম_সব জায়গাতেই তিনি গেলেন। '৬৪ সালে আমার সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা হবে। সে জন্য আমি তাঁর সঙ্গে কোথাও যেতে পারিনি। তবে দিদি অথবা ঝুনু ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। ঢাকায় আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব নিয়মিত মাকে দেখতে আসতেন। এঁরা এলে মা খুব আনন্দিত হতেন। মা আপাতদৃষ্টিতে সব বিপদ কাটিয়ে উঠলেও আমরা পরিষ্কার বুঝতাম যে বাবার জন্য তাঁর মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে থাকত। আমাদের লুকিয়ে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। তবুও আমরা ধরে নিয়েছিলাম সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। এরই মধ্যে ঝুনু হলিক্রস কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
(চলবে.....)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments