জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলন by ড. শামছুল আলম
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য
অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি তাঁর
পদত্যাগের এক দফার দাবিতে তুমুল আন্দোলন করছে।
শিক্ষক
সমিতি উপাচার্যকে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে উপাচার্যের সব
ধরনের কর্মকাণ্ডে বাধা দিচ্ছে। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষক সমিতির বাধার মুখে গত ২১ জুনের কর্তৃপক্ষ আহূত বার্ষিক সিনেট
অধিবেশনও পণ্ড হয়। উপাচার্যের আহ্বানে কিছুসংখ্যক সিনেট সদস্য ক্যাম্পাসে
এসেছিলেন; কিন্তু উপাচার্য তাঁদের নিয়ে সিনেট হলে প্রবেশ করতে পারেননি,
বাধা পেয়ে তাঁরা ফিরে যান।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন সম্পর্কে দেশের অনেক মানুষের ভালো ধারণা রয়েছে বলে মনে হয়। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে তাঁর আলোচনা ও বক্তব্য শুনে তাঁর সম্পর্কে হয়তো এ ধারণা জন্ম হতে পারে। কিন্তু যাঁরা তাঁর সঙ্গে মিশেছেন, তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁরাই মাত্র বলতে পারবেন, ব্যক্তি আনোয়ার হোসেনের ভেতরে-বাইরে কত পার্থক্য। তিনি কতটা অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী ও মিথ্যুক। শিক্ষক হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে মিথ্যুক হওয়ার কারণে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর বক্তব্য আমাদের রেকর্ড করতে হয় এবং এটা তাঁকে জানিয়েই করা হয়। শিক্ষক সমিতি থেকে প্রচারিত অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছাচারী, স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক আচরণের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। কিন্তু ক্যাম্পাসবাসী মাত্রই জানেন, তাঁর এ দাবি সত্যের অপলাপ মাত্র।
২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি একজন ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সংঘটিত নজিরবিহীন ভাঙচুর, শিক্ষকদের গালাগাল দেওয়া এবং আবাসিক এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করার ঘটনায় তিনি কোনো বিচার করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক, সামাজিক, একাডেমিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তিনি ভেঙে ফেলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বর্ধনের নামে তিনি ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত রীতি ভেঙে তিনি আজ্ঞাবহ শিক্ষককে (তাঁর প্রাক্তন ছাত্র) অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ভর্তি পরীক্ষায় তিনি অকৃতকার্য শিক্ষার্থীকে এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অর্থের বিনিময়ে ভর্তি করিয়েছেন। এটা বিশ্বাস করতেও খারাপ লাগে যে বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষক, অফিসার, কর্মচারীদের সঙ্গে তিনি অসৌজন্যমূলক ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ করেছেন। উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা মিথ্যা বললে, প্রমাণ সাপেক্ষে স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেন। কিন্তু আমাদের দেশে সে সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। অধ্যাপক আনোয়ার একের পর এক মিথ্যা বলেই চলছেন।
একজন উপাচার্যের কাজ কী? একজন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণাকে এগিয়ে নেওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা গ্রহণ করবেন। তিনি নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষীয় সভা যেমন সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ও অন্যান্য শিক্ষা-গবেষণা সংশ্লিষ্ট পর্ষদের সভা করবেন। অনুষদ ও বিভাগগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে প্রতিনিয়ত খোঁজখবর রাখবেন। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনের এসবের দিকে কোনো খেয়াল নেই। তিনি শিক্ষা ও গবেষণাকে উপেক্ষা করে অনুষ্ঠান ও মিডিয়া নিয়ে মেতে থাকেন।
এবার পাখি মেলার সব আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পরও তিনি দর্শক ও মিডিয়াপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে পাখি মেলা অনুষ্ঠান ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালান। কিন্তু আয়োজক ও সংশ্লিষ্টদের প্রবল বিরোধিতার কারণে তিনি পাখি মেলা অনুষ্ঠানটি নিজের আয়ত্তে নিতে না পেরে পূর্বনির্ধারিত দিনেই সকালে শীতের পিঠা খাওয়ানোর একটা পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে ৩০ হাজারের বেশি টাকা ব্যয় করেন। ১৯৮৬ সাল থেকে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পাখি নিয়ে কাজ করে এবং পরবর্তী সময়ে পাখি মেলার আয়োজন করে এলেও এবার তিনি আলাদাভাবে দাওয়াতপত্র পাঠিয়েছেন। এদিন তিনি ভোরে শত শত দেশি-বিদেশিকে ক্যাম্পাসে এনে পিঠা খাওয়ানোর দাওয়াত দিয়ে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করেন। কিন্তু তাঁর কর্মসূচিটি সফল হয়নি। একজন মন্ত্রী ছাড়া তাঁর দাওয়াতে আর কেউ আসেননি। ক্যাম্পসের সাংবাদিকদের নিজের আজ্ঞাবহ রাখতে লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে তাঁদের জন্য গলফ ক্লাবে মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করেছেন।
আওয়ামী লীগের একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করতে তিনি লাখ টাকারও বেশি ব্যয় করে বিজয় র্যালি নামে একটি শোভাযাত্রা নিয়ে স্মৃতিসৌধে গিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করেন। এরপর ডিসেম্বর মাসে তিন লাখ টাকার অধিক ব্যয়ে বিজয় কনসার্ট করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম ফেলে রেখে তিনি দিনের পর দিন অনুষ্ঠানের নামে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান।
বিভাগগুলোর শিক্ষা কার্যক্রমে অগ্রগতি ও তদারকির কাজ এখন স্থবির হয়ে পড়েছে। নিয়মিত একাডেমিক কাউন্সিল সভা এখন আর অনুষ্ঠিত হয় না। শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ মোট বাজেটের এক শতাংশেরও কম। তিনি এখন পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে নতুন কোনো থোক বরাদ্দ আনতে পারেননি।
উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছরের মধ্যেই তিনি শিক্ষা সংকুচিত করেছেন। বিগত উপাচার্য হলগুলো আবাসিক সিটের বাইরেও অল্প সংখ্যায় হলেও ছাত্রছাত্রী ভর্তি করিয়েছেন। সেখানে বর্তমান উপাচার্য মানসম্পন্ন শিক্ষার কথা বলে চার শর অধিক সিট কমিয়েছেন। সচেতন লোকজন মনে করেন, তিনি কাজের চেয়ে অকাজে বেশি সময় দিচ্ছেন।
এ কথা অনেকেই জানেন, বর্তমানে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র তিনিই নির্বাচিত উপাচার্য। কিন্তু অনেকেরই জানা নেই যে তিনি মেয়াদোত্তীর্ণ সিনেট সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর প্রাপ্ত ৩৩ ভোটের মধ্যে ১৩টি ছিল সিঙ্গেল ভোট। সিনেট সদস্যরা তিনজনের উপাচার্য প্যানেলে সর্বোচ্চ 'তিনটি' ভোট দিতে পারেন। ধারণা করা হয়, সরকার মনোনীত সিনেট সদস্যরা শুধু অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে 'সিঙ্গেল' ভোট দিয়েছেন। সুতরাং এটা তো প্রতিষ্ঠিত যে তিনি মেয়াদোত্তীর্ণ সিনেটে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে উপাচার্যের তিনজনের প্যানেলে নির্বাচিত হয়েছেন। তার পরও প্যানেলে তিনি প্রথম হননি। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির ৫৫ ভোট পেয়ে প্রথম এবং অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক নুরুল আলম ৩৩ ভোট পেয়ে যৌথভাবে দ্বিতীয় হয়েছিলেন।
অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র বা শিক্ষক ছিলেন না, এটা তাঁর সমস্যা বা অপরাধ নয়। আমরা মনে করি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে এটা তাঁর বাধাও নয়। সমস্যা হলো তাঁর আচরণ, মানসিকতা ও বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে উদাসীনতা। আচরণের মাধ্যমে তিনি বুঝিয়েছেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাঁর কোনো দায়বদ্ধতা নেই। দীর্ঘ সময় ধরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরস্পরের প্রতি সামাজিক সম্পর্ক, ভ্রাতৃত্ববোধ, পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ তিনি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি ও ক্যাম্পাসে তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় গৃহীত হয়েছে। অথচ এটাকে তিনি কিছুসংখ্যক শিক্ষকের আন্দোলন, অবরোধ বলে প্রচার চালাচ্ছেন। আমরা দেখেছি, সত্যকে যে আড়াল করে, অসম্মান তার জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। আমরা উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের শেষ পরিণতি কী হয়!
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন সম্পর্কে দেশের অনেক মানুষের ভালো ধারণা রয়েছে বলে মনে হয়। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে তাঁর আলোচনা ও বক্তব্য শুনে তাঁর সম্পর্কে হয়তো এ ধারণা জন্ম হতে পারে। কিন্তু যাঁরা তাঁর সঙ্গে মিশেছেন, তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁরাই মাত্র বলতে পারবেন, ব্যক্তি আনোয়ার হোসেনের ভেতরে-বাইরে কত পার্থক্য। তিনি কতটা অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী ও মিথ্যুক। শিক্ষক হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে মিথ্যুক হওয়ার কারণে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর বক্তব্য আমাদের রেকর্ড করতে হয় এবং এটা তাঁকে জানিয়েই করা হয়। শিক্ষক সমিতি থেকে প্রচারিত অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছাচারী, স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক আচরণের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। কিন্তু ক্যাম্পাসবাসী মাত্রই জানেন, তাঁর এ দাবি সত্যের অপলাপ মাত্র।
২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি একজন ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সংঘটিত নজিরবিহীন ভাঙচুর, শিক্ষকদের গালাগাল দেওয়া এবং আবাসিক এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করার ঘটনায় তিনি কোনো বিচার করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক, সামাজিক, একাডেমিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তিনি ভেঙে ফেলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বর্ধনের নামে তিনি ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত রীতি ভেঙে তিনি আজ্ঞাবহ শিক্ষককে (তাঁর প্রাক্তন ছাত্র) অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ভর্তি পরীক্ষায় তিনি অকৃতকার্য শিক্ষার্থীকে এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অর্থের বিনিময়ে ভর্তি করিয়েছেন। এটা বিশ্বাস করতেও খারাপ লাগে যে বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষক, অফিসার, কর্মচারীদের সঙ্গে তিনি অসৌজন্যমূলক ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ করেছেন। উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা মিথ্যা বললে, প্রমাণ সাপেক্ষে স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেন। কিন্তু আমাদের দেশে সে সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। অধ্যাপক আনোয়ার একের পর এক মিথ্যা বলেই চলছেন।
একজন উপাচার্যের কাজ কী? একজন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণাকে এগিয়ে নেওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা গ্রহণ করবেন। তিনি নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষীয় সভা যেমন সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ও অন্যান্য শিক্ষা-গবেষণা সংশ্লিষ্ট পর্ষদের সভা করবেন। অনুষদ ও বিভাগগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে প্রতিনিয়ত খোঁজখবর রাখবেন। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনের এসবের দিকে কোনো খেয়াল নেই। তিনি শিক্ষা ও গবেষণাকে উপেক্ষা করে অনুষ্ঠান ও মিডিয়া নিয়ে মেতে থাকেন।
এবার পাখি মেলার সব আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পরও তিনি দর্শক ও মিডিয়াপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে পাখি মেলা অনুষ্ঠান ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালান। কিন্তু আয়োজক ও সংশ্লিষ্টদের প্রবল বিরোধিতার কারণে তিনি পাখি মেলা অনুষ্ঠানটি নিজের আয়ত্তে নিতে না পেরে পূর্বনির্ধারিত দিনেই সকালে শীতের পিঠা খাওয়ানোর একটা পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে ৩০ হাজারের বেশি টাকা ব্যয় করেন। ১৯৮৬ সাল থেকে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পাখি নিয়ে কাজ করে এবং পরবর্তী সময়ে পাখি মেলার আয়োজন করে এলেও এবার তিনি আলাদাভাবে দাওয়াতপত্র পাঠিয়েছেন। এদিন তিনি ভোরে শত শত দেশি-বিদেশিকে ক্যাম্পাসে এনে পিঠা খাওয়ানোর দাওয়াত দিয়ে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করেন। কিন্তু তাঁর কর্মসূচিটি সফল হয়নি। একজন মন্ত্রী ছাড়া তাঁর দাওয়াতে আর কেউ আসেননি। ক্যাম্পসের সাংবাদিকদের নিজের আজ্ঞাবহ রাখতে লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে তাঁদের জন্য গলফ ক্লাবে মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করেছেন।
আওয়ামী লীগের একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করতে তিনি লাখ টাকারও বেশি ব্যয় করে বিজয় র্যালি নামে একটি শোভাযাত্রা নিয়ে স্মৃতিসৌধে গিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করেন। এরপর ডিসেম্বর মাসে তিন লাখ টাকার অধিক ব্যয়ে বিজয় কনসার্ট করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম ফেলে রেখে তিনি দিনের পর দিন অনুষ্ঠানের নামে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান।
বিভাগগুলোর শিক্ষা কার্যক্রমে অগ্রগতি ও তদারকির কাজ এখন স্থবির হয়ে পড়েছে। নিয়মিত একাডেমিক কাউন্সিল সভা এখন আর অনুষ্ঠিত হয় না। শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ মোট বাজেটের এক শতাংশেরও কম। তিনি এখন পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে নতুন কোনো থোক বরাদ্দ আনতে পারেননি।
উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছরের মধ্যেই তিনি শিক্ষা সংকুচিত করেছেন। বিগত উপাচার্য হলগুলো আবাসিক সিটের বাইরেও অল্প সংখ্যায় হলেও ছাত্রছাত্রী ভর্তি করিয়েছেন। সেখানে বর্তমান উপাচার্য মানসম্পন্ন শিক্ষার কথা বলে চার শর অধিক সিট কমিয়েছেন। সচেতন লোকজন মনে করেন, তিনি কাজের চেয়ে অকাজে বেশি সময় দিচ্ছেন।
এ কথা অনেকেই জানেন, বর্তমানে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র তিনিই নির্বাচিত উপাচার্য। কিন্তু অনেকেরই জানা নেই যে তিনি মেয়াদোত্তীর্ণ সিনেট সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর প্রাপ্ত ৩৩ ভোটের মধ্যে ১৩টি ছিল সিঙ্গেল ভোট। সিনেট সদস্যরা তিনজনের উপাচার্য প্যানেলে সর্বোচ্চ 'তিনটি' ভোট দিতে পারেন। ধারণা করা হয়, সরকার মনোনীত সিনেট সদস্যরা শুধু অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে 'সিঙ্গেল' ভোট দিয়েছেন। সুতরাং এটা তো প্রতিষ্ঠিত যে তিনি মেয়াদোত্তীর্ণ সিনেটে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে উপাচার্যের তিনজনের প্যানেলে নির্বাচিত হয়েছেন। তার পরও প্যানেলে তিনি প্রথম হননি। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির ৫৫ ভোট পেয়ে প্রথম এবং অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক নুরুল আলম ৩৩ ভোট পেয়ে যৌথভাবে দ্বিতীয় হয়েছিলেন।
অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র বা শিক্ষক ছিলেন না, এটা তাঁর সমস্যা বা অপরাধ নয়। আমরা মনে করি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে এটা তাঁর বাধাও নয়। সমস্যা হলো তাঁর আচরণ, মানসিকতা ও বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে উদাসীনতা। আচরণের মাধ্যমে তিনি বুঝিয়েছেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাঁর কোনো দায়বদ্ধতা নেই। দীর্ঘ সময় ধরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরস্পরের প্রতি সামাজিক সম্পর্ক, ভ্রাতৃত্ববোধ, পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ তিনি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি ও ক্যাম্পাসে তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় গৃহীত হয়েছে। অথচ এটাকে তিনি কিছুসংখ্যক শিক্ষকের আন্দোলন, অবরোধ বলে প্রচার চালাচ্ছেন। আমরা দেখেছি, সত্যকে যে আড়াল করে, অসম্মান তার জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। আমরা উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের শেষ পরিণতি কী হয়!
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments