ভালবাসব, বাসবরে বন্ধু... পনেরো দেশের ৭০ শিল্পী- 'বাংলায় গাইবে বিশ্ব' তিন দিনব্যাপী উৎসব শুরু
বাঙালীর জাগৃতির ইতিহাসে অতু্জ্জ্বল এক বাতিঘর একুশে ফেব্রুয়ারি। এদিন উজ্জীবনের ও উদ্দীপনের। বাধার বিন্ধ্যাচল অতিক্রম করার শিক্ষা দিয়েছে এই একুশে।
পঞ্জিকার অসাধারণ এই তারিখটি আমাদের পথ দেখায় এবং পথ দেখিয়েছে জীবনজয়ের। '৫২-এর এই দিনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বাররা মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে বুকের রক্ত দিয়ে এঁকে দিয়েছেন যে পথরেখা; সেটাই জাতিকে পৌঁছে দিয়েছে মুক্তির দিগন্তে । বাঙালীর স্বাধীনতার মূলমন্ত্রটি বস্তুত রচিত হয়েছিল ৫৮ বছর আগে, এমনই এক একুশে ফেব্রুয়ারিতে। এই দিনটিই আজ সারাবিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। তারও এগারো বছর হয়ে গেল। যে ভাষার জন্য বাঙালীর (বাংলাদেশের) এত আত্মত্যাগ, সেই বাংলা এখন ২৫ থেকে ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা। ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে যার স্থান ষষ্ঠ। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবেও এখন বাংলা জানে অবাঙালী অনেকে_ সে হিসেবে কেউ কেউ পঞ্চম বা চতুর্থ স্থানে রাখে বাংলাকে। তাই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা-তদ্বির করে চলেছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আগ্রহেই বাংলা ভাষাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করার লৰ্যে আয়েজন করা হয়েছে প্রথম আনত্মর্জাতিক বাংলা সঙ্গীত উৎসবের। সেই উৎসবই শুরম্ন হলো সোমবার আনত্মর্জাতিক বাণিজ্যমেলা মাঠে। তিন দিনব্যাপী এই উৎসবের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ফর ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিইডিএসএস)।'বাংলায় গাইবে বিশ্ব'_ সেস্নাগান নিয়ে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী উৎসবের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুভেচ্ছা বক্তৃতা দেন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। অতিথির সারিতে আরও উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী, দেশী_বিদেশী কূটনীতিক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
সঙ্গীতের এই উৎসব উপলৰে এখন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করছেন বিশ্বের ১৫টি দেশের ৭০ শিল্পী; যার মধ্যে ৩০ জন অবাঙালী। তবে মজার বিষয়, বাঙালী_অবাঙালী_ সবাই গান গাইলেন বাংলায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ধ্যা ছ'টা পর্যনত্ম উপভোগ করলেন বিশ্বের তারকা শিল্পীদের কণ্ঠে বাংলা গান। তবে গান শুরম্নর আগে একুশে গানের সিডি ও একুশের ঘটনাপ্রবাহের প্রামাণ্যচিত্রের সিডির মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী অতিথির সারিতে গিয়ে বসার পরই মঞ্চ আলোকিত করে আসে ১৫ দেশের খ্যাতিমান শিল্পীরা। এঁেদর মধ্যে ছিলেন ভারতের বিখ্যাত শিল্পী বাপ্পী লাহিড়ী, পাকিসত্মানের হাসান জাহাঙ্গীর, আমেরিকার আলেকজান্দ্রা, কানাডার প্রিয়া, সিঙ্গাপুরের নাদিয়া আলী, ইউক্রেনের ইরিনা পভঝন, বাংলাদেশের রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফকির আলমগীর, পপ সম্রাট আজম খান, জানে আলম, ফকির সিরাজ, ফাহমিদা নবী । তাঁরা মঞ্চে এসেই দলীয়কণ্ঠে আমন্ত্রিত অতিথিদের গেয়ে শোনান বাঙালীর রক্ত গরম করা কালজয়ী গান _ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি... এবং জয় বাংলা বাংলার জয় হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়...গান দু'টি। একক গান পরিবেশনে প্রথমেই মঞ্চে আসেন ফাহমিদা নবী, গেয়ে শোনান দেশের গান_ ও আমার বাংলা মা'তোর আকুল করা রূপের সুধায় হৃদয় যায় জুড়িয়ে...গানটি। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা এসে পরিবেশন করেন_ ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী একা একা করি খেলা...গানটি। এরপরই মঞ্চে আসেন উপমহাদেশের তথা বিশ্বের বিখ্যাত শিল্পী বাপ্পী লাহিড়ী। তিনি মঞ্চে উঠেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সালাম জানিয়ে বলেন, আমি আজ এত খুশি হয়েছি যে, জীবনের অনেক প্রাপ্তিকে ছাপিয়ে দিয়েছে আজকের এই আনন্দ। বাংলাদেশের এমন সুন্দর একটি অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে নিজেকে বেশ গর্বিত মনে হচ্ছে। আমার বাবার জন্ম বাংলাদেশের পাবনায়, মা'র জন্ম সিরাজগঞ্জে, আমার জন্ম কলকাতায়। তবে সারা বিশ্বে আমি নিজেকে বাঙালী বলে পরিচয় দিয়ে থাকি এবং এতে আমি গর্ববোধ করি। এর পরই তাঁর কণ্ঠে গীত হয়ে বেজে ওঠে_ চিরদিনই তুমি যে আমার যুগে যুগে আমি তোমারই আমি আছি সেই তোমার তুমি আছ সেই আমারই সঙ্গী আমরা অমর সঙ্গী... এবং আমি ভালবাসি বাংলার নীল আকাশ ধানের গন্ধ ভালবাসি বাঙালীর উচ্ছ্বাস... গান দু'টি। বাপ্পীর পরেই প্রবাসী বাঙালী শিল্পী আলমগীর উঠে আসেন মঞ্চে। তিনি বলেন, আমার বাবা-মা'র জন্ম বরিশালে এবং আমার জন্ম ঢাকায়। কিন্তু দেশের বাইরে থাকলেও মনে করি আমি যে নিঃশ্বাস নেই তা বাংলাদেশের। পরে তিনি গেয়ে শোনান- আমায় ভাসাইলিরে, আমায় ডুবাইলিরে, অকুল দরিয়ার বুঝি কূল নাইরে... গানটি। আলমগীরের পরই মঞ্চে উঠে আসে অবাঙালী শিল্পী নাদিয়া আলী। গেয়ে শোনান- আমি বাংলায় গান গাই, বাংলার গান গাই, আমি আমার আমিকে চিরদিন বাংলায় খুঁজে পাই...গানটি। আমেরিকার আলেকজান্দ্রা গেয়ে যান_ ভালবাসবো বাসবোরে বন্ধু তোমায় যতনে... গানটি। এ পর্যনত্ম গান শুনে চলে যান প্রধানমন্ত্রী।
তারপরই নেমে আসে সন্ধ্যা। মঞ্চে উঠে আসেন পপ সম্রাট আজম খান। গেয়ে শোনান_ আমি যারে চাইরে... এবং রেল লাইনের বসত্মিতে বাংলাদেশ... গান দু'টি। আব্দুল জব্বার পরিবেশন করেন_ সালাম সালাম হাজার সালাম... এবং হাজার বছর পরে আবার আসিব ফিরে... গান দু'টি। এভাবেই একে একে মঞ্চে এসে আরও গান শোনান শিল্পী জানে আলম, পাকিসত্মানের হাসান জাহাঙ্গীর, ইউক্রেনের ইরিনা পভঝন, ফকির আলমগীর, কানাডার প্রিয়া শিল্পীগণ। তাঁরা পরিবেশন করেন- একটি গন্ধমের লাগিয়া..., মায়ের একধার দুধের দাম..., ও সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে..., হাওয়া হাওয়া ও হাওয়া..., তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়... প্রভৃতি গান। রাত ১০টা পর্যনত্ম দেশী-বিদেশী শিল্পীরা এভাবেই গেয়ে যান একে একে বাংলা গান। আজ মঙ্গলবার এই উৎসবের দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান শুরম্ন হবে বিকেল চারটায়। চলবে রাত দশটা পর্যনত্ম। বুধবার উৎসবের সমাপনী দিন।
No comments