গোধূলির ছায়াপথে-মেহদি যান, রয়ে যায় কণ্ঠের রেশ by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
মেহদি হাসানের গুলবার্গ এলাকার বাসাটা চেনা, বিদায়ের দিনে অনেকে উপস্থিত, লোক উপচে পড়ছে। কেউ পাঠ করছেন অস্ফুট স্বরে কোরআন থেকে, কেউ কাঁদছেন ফুঁপিয়ে, কেউ দেখে চলেছেন টিভিতে তাঁর সম্পর্কে নানা স্টেশনের প্রোগ্রাম। নেই শুধু আমি।
মনে পড়ছে তাঁর মধুর কণ্ঠের গানের রেশ: ‘মুহাব্বত করনেওয়ালে কম না হোঁঙ্গে, তেরি মেহিফলমে কভি হমনা হোঁঙ্গে’। এই মাহফিলে যিনি গান গেয়ে যান, তিনি আর ফিরে আসেন না। দিন যায় কথা থাকে। কথা যায় সুর থাকে। মেহদি যান, রয়ে যায় কণ্ঠের রেশ। উপমহাদেশ আজ তাঁর সুরের রেশে বিহ্বল।
সাল ১৯৬০। করাচি রেডিও স্টেশন। স্টুডিওতে গাইছি একটার পর একটা। এক ভদ্রলোক এসে আমার পাশেই বসলেন। আমার পর তাঁর প্রোগ্রাম। বললেন, এত সুন্দর কণ্ঠ শুনিনি। গলা খুললেন, খুবই পাতলা গলা, মধুর আওয়াজ, সুর নিজের। প্রোগ্রামের পর তাঁকে এক পেয়ালা চা ও একটি বিস্কিট অফার করলাম, যেন বর্তে গেলেন। বললাম, ‘তোমার মতো মানবকণ্ঠ আর শুনিনি। ভালো ওস্তাদের কাছে শেখো, তোমার নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে। রেকর্ড বেরোয়নি।’ কেউ নাম জানে না, তা নয়। এয়ারফোর্সে ছোট চাকরিতে কোনো রকমে তাঁর জীবন চলে যাচ্ছিল।
তাঁর গান পঞ্চাশের শেষ ভাগে করাচি রেডিওতেই শুরু হয়েছিল। যখন থেকে তাঁর গানগুলো প্রচারিত হলো, ফিরে তাকানোর আর সময় হয়নি তাঁর। ‘জিন্দেগি তো ম্যায় সবই’ থেকে শুরু করে তাঁর সর্বশেষ গান সংগীতপাগল মানুষকে করেছে অধীর। সংগীতের সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর বলেন, ‘এ তো ঈশ্বরের কণ্ঠ!’ ভালোবাসা, মাধুর্য, দরদ ও সূক্ষ্ম কণ্ঠবিন্যাস বাসা বেঁধেছে ওই লোকটির কণ্ঠে, যাঁর নাম মেহদি। ঢাকায় কয়েকবার এলে জড়িয়ে ধরেন আমাকে। বলেন, ‘তোমাকে আমি ভুলিনি। তুমি আমার প্রথম বন্ধুদের একজন।’ ঢাকার রামপুরা টেলিভিশন স্টুডিওতে সকাল থেকে বিকেল গড়িয়ে গেছে রেকর্ডিং করতে করতে। গলা বসে গেছে। বললেন, ‘আব্বাসী, এই কণ্ঠ নিয়ে এখন কীভাবে জায়নামাজে বসব, তাই ভাবছি।’ লম্বা মাদুর পেতে দেওয়া হলো জিএমের কামরায়। কয়েকজন মিলে আদায় করলেন জোহর, আসর, মাগরিব। বললেন, ‘মাদুরে দাঁড়ালে নতুন করে কণ্ঠ ফিরে পাই।’ বললাম, এটিই আল্লাহর নেয়ামত। আমার সব ক্লান্তি মুছে দেয় একটি সালাত।
তাঁর ভালো লাগত ফেরদৌসী ও শাহনাজের কণ্ঠ। রুনার সঙ্গে অনেক গানে মেহদি কণ্ঠ দিয়েছেন। শেষবার যখন ঢাকায় প্রাইভেট জলসায় গান গাইতে এলেন কোনো এক বড়লোকের বাসায়, আসমা ও আমিও আমন্ত্রিত। আমাদের দুজনকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘আজ গান খুব ভালো হবে। কারণ, তোমরা এসেছ।’ এক সুন্দরী মহিলা হঠাৎ করে আমার সাদা শালটি পছন্দ করলেন এবং খানিকক্ষণ গলায় জড়িয়ে সেটি আবার পরিয়ে এলেন মেহদিকে। কৌতুক আমোদিত মেহদি বললেন, ‘আমার ঠান্ডা লাগছে না। যার চাদর তাকে দিয়ে আসো।’ এই আসরে যে গানগুলো গেয়েছিলেন, তা স্মৃতিপটে অক্ষয় হয়ে আছে। তবে তাঁর কণ্ঠ সেদিন ভালো ছিল না। ফলে তবলচি ও সারেঙ্গি অনুগমনকারী বারবার বকা খাচ্ছিল।
জ্যেষ্ঠ কন্যা সামিরা আব্বাসী সুন্দর গজল গায়। দু-তিন বছর আগে একটি গজলের সিডি প্রস্তুত করে উৎসর্গ করে মেহদি হাসানকে। অসুস্থ মেহদি আব্বাসীর মেয়েকে সমভাবে তাঁর ভালোবাসা জানান। তিনি বলেন, সামিরার মতো শিল্পী যেকোনো মাহফিলের গর্ব। তার কণ্ঠ সিল্কের মতো এবং এর বিস্তার সুর থেকে সুরে। সামিরা আমাকে টেলিফোন করে জানায় যে মেহদির হূদয় তার কণ্ঠের বিস্তৃত গজলের মায়ার মতোই ভালোবাসার বিস্তার করে চলেছে। গত রাতে যখন সামিরার সঙ্গে কথা হয়, সে কাঁদছিল।
১৯২৭ সালে রাজস্থানের লুনায় জন্মগ্রহণ মেহদির, ১৯৪৭ সালে পরিবার চলে আসে পাকিস্তানে। উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম চলে পিতা ওস্তাদ আজিম খান ও পরে চাচা ইসমাইল খানের কাছে। রবীন ঘোষ তাঁর কয়েকটি শ্রেষ্ঠ গানে সুর আরোপ করেন। প্লে-ব্যাকে অংশগ্রহণ করার পেছনে অবদান আছে অনেক সংগীত পরিচালকের। বাংলা গান, ‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়’ কে শোনেনি? তাঁর গাওয়া ‘তুমি যে আমার’, ‘ঢাকো যত না নয়ন দুহাতে’—এমনই অনেক গান শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরত।
রসিক ছিলেন। সুন্দরী মহিলা আসরে বসে আছেন। তাহলে গানগুলো তাঁরই জন্য। এতে কোনো ভুল নেই। অথচ সেদিকে একবারও তাকানোর অবকাশ নেই তাঁর। গজলের মজা, ওই সুন্দরীই সংগীতের রানি, সব সুর তাঁর উদ্দেশ্যে—এসবই অপ্রত্যক্ষ ভালোবাসার ফসল।
মেহদি ভালোবাসতেন ঢাকা। বলতেন, ঢাকাই হচ্ছে গজলের রাজধানী। এখানেই গজলপিপাসু মানুষ বাস করে। তারা এ গজল শিখেছে একজনের কাছে, তাঁর নাম কাজী নজরুল ইসলাম। আর নজরুলের এই গজলের পিপাসা এসেছে গালিবের কাছ থেকে।
তিনি আমার চেয়ে ১০ বছরের বড়। একদিন তাঁর কাছে গান শিখতে গেলাম। বললেন, ‘তোমার গজল শুনে আমিই মুগ্ধ। তোমার খাদের গলাটি ঈর্ষণীয়।’ বললাম, ‘তুমি গজলে যেমন পারদর্শী, তেমনি মিথ্যা রচনাতেও।’
পাকিস্তান সরকার তাঁকে উপাধি দিয়েছে ‘তমঘা-ই ইমতিয়াজ’ ও ‘হেলাল-ই ইমতিয়াজ’, নেপাল সরকার দিয়েছে, ‘গোরখা দক্ষিণা বাহু’ খেতাব, আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অসংখ্য। আমরা কিছুই দিইনি, নিয়েছি শুধু। তবে তার মূল্যও কম নয়। কারণ এতে আছে অশ্রু মেশানো।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
সাল ১৯৬০। করাচি রেডিও স্টেশন। স্টুডিওতে গাইছি একটার পর একটা। এক ভদ্রলোক এসে আমার পাশেই বসলেন। আমার পর তাঁর প্রোগ্রাম। বললেন, এত সুন্দর কণ্ঠ শুনিনি। গলা খুললেন, খুবই পাতলা গলা, মধুর আওয়াজ, সুর নিজের। প্রোগ্রামের পর তাঁকে এক পেয়ালা চা ও একটি বিস্কিট অফার করলাম, যেন বর্তে গেলেন। বললাম, ‘তোমার মতো মানবকণ্ঠ আর শুনিনি। ভালো ওস্তাদের কাছে শেখো, তোমার নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে। রেকর্ড বেরোয়নি।’ কেউ নাম জানে না, তা নয়। এয়ারফোর্সে ছোট চাকরিতে কোনো রকমে তাঁর জীবন চলে যাচ্ছিল।
তাঁর গান পঞ্চাশের শেষ ভাগে করাচি রেডিওতেই শুরু হয়েছিল। যখন থেকে তাঁর গানগুলো প্রচারিত হলো, ফিরে তাকানোর আর সময় হয়নি তাঁর। ‘জিন্দেগি তো ম্যায় সবই’ থেকে শুরু করে তাঁর সর্বশেষ গান সংগীতপাগল মানুষকে করেছে অধীর। সংগীতের সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর বলেন, ‘এ তো ঈশ্বরের কণ্ঠ!’ ভালোবাসা, মাধুর্য, দরদ ও সূক্ষ্ম কণ্ঠবিন্যাস বাসা বেঁধেছে ওই লোকটির কণ্ঠে, যাঁর নাম মেহদি। ঢাকায় কয়েকবার এলে জড়িয়ে ধরেন আমাকে। বলেন, ‘তোমাকে আমি ভুলিনি। তুমি আমার প্রথম বন্ধুদের একজন।’ ঢাকার রামপুরা টেলিভিশন স্টুডিওতে সকাল থেকে বিকেল গড়িয়ে গেছে রেকর্ডিং করতে করতে। গলা বসে গেছে। বললেন, ‘আব্বাসী, এই কণ্ঠ নিয়ে এখন কীভাবে জায়নামাজে বসব, তাই ভাবছি।’ লম্বা মাদুর পেতে দেওয়া হলো জিএমের কামরায়। কয়েকজন মিলে আদায় করলেন জোহর, আসর, মাগরিব। বললেন, ‘মাদুরে দাঁড়ালে নতুন করে কণ্ঠ ফিরে পাই।’ বললাম, এটিই আল্লাহর নেয়ামত। আমার সব ক্লান্তি মুছে দেয় একটি সালাত।
তাঁর ভালো লাগত ফেরদৌসী ও শাহনাজের কণ্ঠ। রুনার সঙ্গে অনেক গানে মেহদি কণ্ঠ দিয়েছেন। শেষবার যখন ঢাকায় প্রাইভেট জলসায় গান গাইতে এলেন কোনো এক বড়লোকের বাসায়, আসমা ও আমিও আমন্ত্রিত। আমাদের দুজনকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘আজ গান খুব ভালো হবে। কারণ, তোমরা এসেছ।’ এক সুন্দরী মহিলা হঠাৎ করে আমার সাদা শালটি পছন্দ করলেন এবং খানিকক্ষণ গলায় জড়িয়ে সেটি আবার পরিয়ে এলেন মেহদিকে। কৌতুক আমোদিত মেহদি বললেন, ‘আমার ঠান্ডা লাগছে না। যার চাদর তাকে দিয়ে আসো।’ এই আসরে যে গানগুলো গেয়েছিলেন, তা স্মৃতিপটে অক্ষয় হয়ে আছে। তবে তাঁর কণ্ঠ সেদিন ভালো ছিল না। ফলে তবলচি ও সারেঙ্গি অনুগমনকারী বারবার বকা খাচ্ছিল।
জ্যেষ্ঠ কন্যা সামিরা আব্বাসী সুন্দর গজল গায়। দু-তিন বছর আগে একটি গজলের সিডি প্রস্তুত করে উৎসর্গ করে মেহদি হাসানকে। অসুস্থ মেহদি আব্বাসীর মেয়েকে সমভাবে তাঁর ভালোবাসা জানান। তিনি বলেন, সামিরার মতো শিল্পী যেকোনো মাহফিলের গর্ব। তার কণ্ঠ সিল্কের মতো এবং এর বিস্তার সুর থেকে সুরে। সামিরা আমাকে টেলিফোন করে জানায় যে মেহদির হূদয় তার কণ্ঠের বিস্তৃত গজলের মায়ার মতোই ভালোবাসার বিস্তার করে চলেছে। গত রাতে যখন সামিরার সঙ্গে কথা হয়, সে কাঁদছিল।
১৯২৭ সালে রাজস্থানের লুনায় জন্মগ্রহণ মেহদির, ১৯৪৭ সালে পরিবার চলে আসে পাকিস্তানে। উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম চলে পিতা ওস্তাদ আজিম খান ও পরে চাচা ইসমাইল খানের কাছে। রবীন ঘোষ তাঁর কয়েকটি শ্রেষ্ঠ গানে সুর আরোপ করেন। প্লে-ব্যাকে অংশগ্রহণ করার পেছনে অবদান আছে অনেক সংগীত পরিচালকের। বাংলা গান, ‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়’ কে শোনেনি? তাঁর গাওয়া ‘তুমি যে আমার’, ‘ঢাকো যত না নয়ন দুহাতে’—এমনই অনেক গান শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরত।
রসিক ছিলেন। সুন্দরী মহিলা আসরে বসে আছেন। তাহলে গানগুলো তাঁরই জন্য। এতে কোনো ভুল নেই। অথচ সেদিকে একবারও তাকানোর অবকাশ নেই তাঁর। গজলের মজা, ওই সুন্দরীই সংগীতের রানি, সব সুর তাঁর উদ্দেশ্যে—এসবই অপ্রত্যক্ষ ভালোবাসার ফসল।
মেহদি ভালোবাসতেন ঢাকা। বলতেন, ঢাকাই হচ্ছে গজলের রাজধানী। এখানেই গজলপিপাসু মানুষ বাস করে। তারা এ গজল শিখেছে একজনের কাছে, তাঁর নাম কাজী নজরুল ইসলাম। আর নজরুলের এই গজলের পিপাসা এসেছে গালিবের কাছ থেকে।
তিনি আমার চেয়ে ১০ বছরের বড়। একদিন তাঁর কাছে গান শিখতে গেলাম। বললেন, ‘তোমার গজল শুনে আমিই মুগ্ধ। তোমার খাদের গলাটি ঈর্ষণীয়।’ বললাম, ‘তুমি গজলে যেমন পারদর্শী, তেমনি মিথ্যা রচনাতেও।’
পাকিস্তান সরকার তাঁকে উপাধি দিয়েছে ‘তমঘা-ই ইমতিয়াজ’ ও ‘হেলাল-ই ইমতিয়াজ’, নেপাল সরকার দিয়েছে, ‘গোরখা দক্ষিণা বাহু’ খেতাব, আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অসংখ্য। আমরা কিছুই দিইনি, নিয়েছি শুধু। তবে তার মূল্যও কম নয়। কারণ এতে আছে অশ্রু মেশানো।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
No comments