আবার সিন্ডিকেট by কাওসার রহমান
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইসু্য
পণ্যমূল্য। এটা এমন একটি বিষয়, যা সমাজের সবধরনের মানুষকেই নাড়া দেয়। আর
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে সীমিত আয়ের মানুষকে।
এর সঙ্গে
সাধারণ মানুষের পুষ্টি ও মেধা বিকাশের বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ
পণ্যমূল্য বেড়ে গেলে এই সীমিত আয়ের মানুষের খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়।
ফলে ওই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পুষ্টিহীনতা দেখা দেয়। এই পুষ্টিহীনতায়
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এদেশের নারী ও শিশুরা। তাই সুস্থ জাতি গঠনে
পণ্যমূল্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কঠোর আইনগত ব্যবস্থা। দীর্ঘ ১৫ বছরের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশেও প্রণীত হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯। এই আইন দিয়ে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব তা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও আইন প্রণয়নের ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
নির্বাচনে পণ্যমূল্যের প্রভাব
বর্তমান মহাজোট সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। বাজারের পাগলাঘোড়ার মতো ধাবমান পণ্যমূল্যকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা। নির্বাচন-পূর্ববর্তী বছরে মূল্যবৃদ্ধির চাপে পিষ্ট এদেশের সাধারণ মানুষ সেই অঙ্গীকারের প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল। একচেটিয়া ভোট দিয়েছে মহাজোট সরকারের প্রার্থীদের প্রতীকে। ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে বিজয় লাভ করে। নির্বাচনে মহাজোটের পৰে সর্বাত্মক রায় প্রদানের আরও একটি কারণ ছিল ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে সফলতার সঙ্গে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। ওই মেয়াদে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং ১৯৯৮ সালের বন্যার বছর ছাড়া পণ্যমূল্য ছিল মানুষের ক্রয়ৰমতার মধ্যে। মূল্যস্ফীতিও ছিল সহনীয় মাত্রায়। ফলে দেশ ছয় শতাংশের ওপর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সৰম হয়। যে কারণে সাধারণ নির্বাচনে দেশের মানুষের রায় যায় মহাজোটের পৰে। পণ্যমূল্য যে নির্বাচনের রায়কে পাল্টে দিতে পারে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ছিল ২০০৯ সালের নির্বাচন।
মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপট
বর্তমানে দেশে যে মূল্যসন্ত্রাস চলছে তার যাত্রা শুরু হয় মূলত ২০০২ সাল থেকে। ২০০১ সালে এক দশমিক চার শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে ২০০২ সালে এক লাফে গড়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় চার দশমিক ৭২ শতাংশে। পরবর্তী বছরগুলোয় এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫ ও ২০০৬ সালে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায় যথাক্রমে পাঁচ শতাংশ, সাড়ে তিন শতাংশ, ছয় শতাংশ এবং ১৫ শতাংশ। এ সময় ৰমতায় ছিল জোট সরকার। এই পাঁচ বছরের শেষ বছরে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিল। সাধারণ মানুষের কাছে পণ্যমূল্য যেন ত্রাসে পরিণত হয়েছিল। জোট আমলে পণ্যমূল্যের এই বৃদ্ধির ঘটনা বিশ্ববাজারের চেয়ে অভ্যনত্মরীণ কারণেই বেশি ঘটেছে। মূলত ওই সময়ই বাজার ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। ফলে দেশের ভোক্তার বাজার পরিণত হয় ব্যবসায়ীদের বাজারে। উৎপাদক থেকে আমদানিকারক, খুচরা বিক্রেতা থেকে পাইকার সকলেই অস্বাভাবিক মুনাফার দুষ্টচক্রে জড়িয়ে যায়। যার দুর্ভোগ পোহাতে হয় দেশের অতি সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষকে।
এর পরের দুই বছর পণ্যমূল্য বৃদ্ধির রেকর্ডের বছর। এই দুই বছরে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি দেশের ৩৮ বছরের ইতিহাসকে ছাড়িয়ে যায়। এ সময় পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ৰেত্রে অভ্যনত্মরীণ কারণের সঙ্গে বিশ্ব পরিস্থিতিও স্থানীয় বাজারকে দারম্নণভাবে প্রভাবিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকে গ্রাস করে। এর প্রভাবে আনত্মর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সকল পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। তবে ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির চেয়ে দ্বিগুণ তিনগুণ মূল্যবৃদ্ধি ঘটে অভ্যনত্মরীণ বাজারে। এই দুই বছরের প্রথম বছর ২০০৭ সালে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায় প্রায় ১৯ শতাংশ এবং দ্বিতীয় বছর ২০০৮ সালে বৃদ্ধি পায় সাড়ে ১২ শতাংশ। দুর্ভাগ্যক্রমে এই দুই বছরে দেশের রাষ্ট্রৰমতায় ছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ফলে ছিল না মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার। তথাকথিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বিপর্যসত্ম হয়ে পড়েছিল দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের চেইন অব কমান্ড। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিডিআরের মাধ্যমে হসত্মৰেপ করেও বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যই চলে যায় মানুষের ক্রয়ৰমাতর বাইরে। মানুষ তার কষ্টার্জিত সঞ্চয় ভেঙ্গে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এতে এই দুই বছরে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। অথচ বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দেশের মানুষ নীরবে সহ্য করে যায় মূল্যবৃদ্ধির যন্ত্রণা।
সিন্ডিকেটের উত্থান
দেশে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ৰেত্রে ব্যবসায়ীদের কারসাজির ঘটনা শুরম্ন হয় ২০০২ সাল থেকে। ওই সময় বাণিজ্যমন্ত্রীর দফতরে এক বৈঠকে ব্যবসায়ীরা ঘোষণা দেন, আগের পাঁচ বছর তাঁরা ব্যবসা করতে পারেননি। এখন তাঁরা ব্যবসা করবেন সরকার তাঁদের কিছু বলতে পারবে না। মূলত ওই ঘোষণার পর থেকেই বাজার বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বাড়তে থাকে বিভিন্ন পণ্যের দাম। বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসায়ীরা যোগসাজশ করে পরিকল্পিতভাবে বেশি দামে পণ্য বিক্রি শুরম্ন করে, যা সিন্ডিকেট হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। এই সিন্ডিকেটের ঘটনা বেশি ঘটে আমদানিকারকদের ৰেত্রে। এই ঘটনা প্রকাশিত হয়ে পড়লে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ক্যাব দীর্ঘদিন থেকে এই সিন্ডিকেটের কথা বলে আসছিল। পণ্যমূল্য সংক্রানত্ম সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এক গবেষণা প্রতিবেদনেও এই সিন্ডিকেটের অসত্মিত্ব আরও স্পষ্টভাবে উঠে আসে। যদিও ব্যবসায়ীরা বরাবরই অস্বীকার করে আসে ব্যবসায়ীদের মাঝে সিন্ডিকেটের কোন অসত্মিত্ব নেই। সুনির্দিষ্ট আইন না থাকার কারণে সরকারও সিন্ডিকেটের বিরম্নদ্দে কোন ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। ফলে জোরালো দাবি উঠে ভোক্তা অধিকার সংরৰণ আইন প্রণয়নের।
সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির ধারা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় সেই সিন্ডিকেট আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যে কারণে আনত্মর্জাতিক মূল্যের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দামে বাজারে আটা ডাল আদা রসুন প্রভৃতি পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এই মূল্য বৃদ্ধির পেছনে যে সিন্ডিকেট দায়ী তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে অর্থমন্ত্রীর কথায়। তিনি ব্যবসায়ীদের এক সেমিনারে অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরাসরি ব্যবসায়ীদের যোগসাজশ তথা সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন। বলেছেন, 'বর্তমান বাজার দরের কোন যৌক্তিকতা নেই। একটি একচেটিয়া চক্র বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। উন্নত দেশগুলোয়ও মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু আছে। কিন্তু বিশ্বের কোন দেশেই সকাল বিকালে কোন পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় না। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রত্যৰ প্রমাণ পাওয়া যায় বাজারে গেলেই। চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরের আট মাসে বাজারে পণ্যমূল্য বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি, যাতে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির প্রচ- চাপ সৃষ্টি হয়েছে_ যা শুধু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকেই আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে না, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য হুমকি হয়েও দাঁড়িয়েছে।
মহাজোট সরকার ৰমতায় আসার পর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা পর্দার আড়ালে চলে গিয়েছিল। তারা সরকারের ৰমতা পর্যবেৰণ করছিল। এ কারণে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে পণ্যমূল্য কমতে শুরম্ন করে। এর প্রভাবে কমতে থাকে মূল্যস্ফীতিও। কিন্তু পরিস্থিতি আবার উল্টে যায় জুন মাস থেকে। যখন তারা বুঝতে পারে সিন্ডিকেটের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মতো ৰমতা সরকারের নেই, তখনই তারা পর্দার আড়াল থেকে আবার বেরিয়ে আসে। রোজাকে সামনে রেখে পণ্যমূল্য বাড়াতে থাকে। বাজার আবার বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে বর্তমানে বেড়ে চলেছে আবার মূল্যস্ফীতিও; বিশেষ করে সমপ্রতি চালের মূল্যবৃদ্ধিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিপজ্জনক অবস্থায় চলে গেছে। খাদ্যশস্যের ভাল ফলন এবং বিপুল পরিমাণ চালের মজুদ সত্ত্বেও চালের এই মূল্যবৃদ্ধি সরকারের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের মন্ত্রীরাই বলছেন বাজারে সিন্ডিকেট আছে। আর ওই সিন্ডিকেট ভাঙ্গার দায়িত্বও সরকারের। সরকারের উচিত দোষারোপ না করে অবিলম্বে সিন্ডিকেট ভাঙ্গার ব্যবস্থা নেয়া। এজন্য অন্য কোন আইন না থাকলেও সরকারের হাতে বিশেষ ৰমতা আইন রয়েছে। বিশেষ ৰমতা আইন দিয়েই সিন্ডিকেট ভাঙ্গার অভিযান শুরম্ন করা উচিত। আর এটা করলে বহু বিতর্কিত এই বিশেষ ৰমতা আইনটির ভাল কাজে ব্যবহারের নজির সৃষ্টি হবে।
মহাজোট সরকারের এক বছর
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ৰমতার মধ্যে নিয়ে আসার অঙ্গীকারের মধ্যদিয়ে মহাজোট সরকার ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে সরকারের এক বছর অতিক্রম হয়েছে। এই এক বছরে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার পালস্নাই ভারি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের রাস টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি আগের রেকর্ডকেও হার মানিয়েছে। চাল, ডাল, তেল আদা, রসুন পিঁয়াজ, মাছ, মাংস_ সবই সাধারণ মানুষের ক্রয়ৰমতার বাইরে চলে গেছে। চড়া পণ্যমূল্যের ভোগানত্মির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। উর্ধমুখী মূল্যের ধারা সামলাতে তারা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে।
কনজুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) পণ্যমূল্য সংক্রানত্ম পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ সরকারের এক বছরে অর্থাৎ ২০০৯ সালে দেশে পণ্যমূল্য বেড়েছে সাত শতাংশ। এই বৃদ্ধি আগের বছরের সাড়ে ১২ শতাংশ বৃদ্ধির অতিরিক্ত। আর ওই বছরের জুলাই থেকে ফেব্রম্নয়ারি পর্যনত্ম সময় পণ্যমূল্য বৃদ্ধি অতীতের সকল হিসাব নিকাশকে ছাড়িয়ে গেছে। এই আট মাসে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ বেড়েছে মসলা জাতীয় পণ্যের দাম। মসলার মধ্যে রসুনের দাম বেড়েছে ১৫০ শতাংশ আর হলুদের দাম বেড়েছে ১২৭ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধির ৰেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গুড় ও চিনির দাম। বাজারে চিনির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে গুড়ের দাম। গত আট মাসে এ দু'টি পণ্যের মূল্য বেড়েছে গড়ে ৪২ শতাংশ। গত আট মাসে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় তৃতীয় যে পণ্যটি রয়েছে তা হচ্ছে চাল। ওই সময়ে বাজারে চালের দাম বেড়েছে গড়ে ২৮ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রকার চালের ১৮ থেকে ৪৭ শতাংশ পর্যনত্ম মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এছাড়া বেড়েছে চায়ের দাম ২০ শতাংশ, ডালের দাম সাড়ে ১২ শতাংশ এবং ভোজ্যতেলের দাম তিন শতাংশেরও বেশি।
চালের বাজারের অস্থিরতার নেপথ্যে?
মানুষের প্রধান খাদ্য চালের দাম এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ৰমতার বাইরে। বাজারে মোটা চালই বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ টাকা দরে। আর মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা দরে। গত এক বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ছয় শতাংশ। চালের এই মূল্যবৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছে সীমিত আয়ের মানুষ। মূল্য নিয়ন্ত্রণে খোলা বাজারে চাল বিক্রির কার্যক্রম কোন কাজে আসছে না। গত মৌসুমে বোরোতে বাম্পার ফলন হয়। রেকর্ড পরিমাণ এক কোটি ৮০ লাখ টন চাল আকারে বোরো ফসল উৎপাদিত হয়েছে। এরপর সদ্য মাড়াই করা আমন ধানের বাম্পার ফলন। কৃষিমন্ত্রীর হিসাব অনুযায়ী, বহু বছর পর আমন উৎপাদন এক কোটি ৩০ লাখ টন পেরিয়েছে। বাজারে রয়েছে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহও। তাহলে চালের দাম বাড়ছে কেন?
অনুসন্ধান থেকে দেখা যায়, চালের দাম বাড়ছে শুধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে। গত বছর বাম্পার ফলনের কারণে চাল থেকে বেশি ব্যবসা করতে পারেনি। এবার সেটা পুষিয়ে নিচ্ছে চাল ব্যবসায়ীরা। কৃত্রিম উপায়ে চালের দাম বৃদ্ধি করে তারা সরকারের চোখের সামনেই দেশের সাধারণ মানুষের পকেট কেটে চলেছে।
চালের এই মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা শুরম্ন হয়েছে গত নবেম্বর মাস থেকে। গত নবেম্বর মাসের শেষ দিকে হঠাৎ করেই চালের দাম বাড়তে শুরম্ন করে এবং জানুয়ারি মাস পর্যনত্ম অব্যাহত থাকে। এই দুই মাসে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ছয় থেকে ১০ টাকা পর্যনত্ম। চাল ব্যবসায়ীরা মূলত শীতের কুয়াশাকে অজুহাত দেখিয়ে চালের দাম বাড়াতে থাকে। কুয়াশা চলে গেলেও সেই মূল্যবৃদ্ধি এখনও আছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে খোলা বাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) শুরম্ন করেছে। ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকায় ২২ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু তার প্রভাব বাজারে নেই।
এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, বাজারে ধানের সরবরাহ কমে গেছে। ভারতে ধানের উৎপাদন কম হয়েছে। বিশ্ববাজারে বেড়েছে চালের দাম। এ খবর জানতে বাকি নেই চাল ব্যবসায়ীদের। বাজারে চালের দাম আরও বাড়বে, এ আশায় ব্যবসায়ীরা প্রচুর পরিমাণ ধান মজুদ করে রেখেছে। প্রতিটি চাল ব্যবসায়ীই স্ব স্ব সামর্থ্য অনুযায়ী ধান-চাল মজুদ করছে। নিয়মিত চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এবার যোগ দিয়েছে অনিয়মিত মজুদদাররাও। যার কাছে যত টাকা আছে তা দিয়ে ধান কিনে মজুদ করে রাখছে। এতে বাজারে ধানের সরবরাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গিয়ে বেড়েছে ধান ও চালের দাম।
ছোট চাষীদের ঘরে এখন আর কোন ধান নেই। ছোট চাষীরা বোরো আবাদের আগে খোরাকি রেখে ধান বিক্রি করে দেয়। ধান বিক্রির টাকা দিয়ে আবাদ করে বোরো ধান। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ফলে সব ধান এখন চলে গেছে বড় কৃষক ও চাল ব্যবসায়ীদের কব্জায়। বড় কৃষক নিজের উৎপাদিত ধানের পাশাপাশি বাজার থেকে মৌসুমে কম দামে ধান কিনে মজুদ করে রেখেছে। ব্যবসায়ীদের প্রকার ভেদে এক একজন মজুদদারের কাছে পাঁচ শ' টন থেকে দুই হাজার টন পর্যনত্ম ধান-চালের মজুদ রয়েছে। চালকল মালিকরা বাজার থেকে ধান কিনে চাল বানিয়ে মজুদ করে রেখেছে। আর আড়তদাররা মিলারদের কাছ থেকে চাল কিনে মজুদ করেছে।
চাল ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের গুদামে হাজার হাজার বসত্মা ধান-চাল থরে থরে সাজানো রয়েছে। এসব ধান-চাল গুদামে তালাবদ্ধ অবস্থায় রেখে দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে গুদামগুলোয় মালিকরা বসিয়েছে কড়া পাহারা। চালকলগুলোর আশপাশের লোকজন জানায়, এবার আমন উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে চাল ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে কিনে গুদামে নিয়ে মজুদ করেছে। তাদের কাছে গত বোরো মৌসুমের হাজার হাজার টন ধানও এখন পর্যনত্ম মজুদ রয়েছে। গত বোরো মৌসুমের কেনা ধানের দাম ছিল গড়ে ৪৫০ টাকা। এবার আমন মৌসুমের ধানের দাম পড়েছে মণপ্রতি ৪৯০ টাকা।
পর পর দু'টি বাম্পার ফলনের পর বর্তমানে চালের বাজারে যে অস্থিরতা চলছে তা অস্বাভাবিক। এই অস্থিরতার পেছনে কাজ করেছে চালের দাম বাড়বে এই গুজব এবং বেপরোয়া মজুদদারী। এবার নিয়মিত চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৌসুমী ব্যবসায়ীরাও। মূলত বড় কৃষক, চালকল মালিক এবং মৌসুমী ব্যবসায়ী এই তিন চক্রের কারণেই চালের বাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। বোরো ধান না ওঠা পর্যনত্ম চালের বাজারের এই অস্থিরতা কমবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা
বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা কোন অর্থনীতির কোন নিয়ম অনুসরণ করে চলছে না। এর মূল সমস্যা হচ্ছে বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নেই। এ কারণেই যখন-তখন পণ্যমূল্য বাড়ছে। মুক্তবাজারের রীতিনীতি অনুযায়ী বাজার মূল্য নির্ধারণ করে না। এদেশের বাজারের মূল্য নির্ধারিত হয় ব্যবসায়ীদের যোগসাজশের মাধ্যমে। আর এ কারণেই এখানে সকাল-বিকাল পণ্যের দাম বাড়তে দেখা যায়। এখানে আনত্মর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বাজারে দাম বেড়ে যায়। কিন্তু আনত্মর্জাতিক বাজারে মূল্য পড়ে গেলে তার কোন প্রতিফলন ঘটে না বাজারে।
মুক্তবাজার সৃষ্টিই হয়েছে ভোক্তাদের স্বার্থের জন্য। নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা থাকলে বাজারে কোন প্রতিযোগিতা থাকে না। ফলে ভোক্তারাও তার সুফল পায় না। মুক্তবাজারের অর্থই হলো প্রতিযোগিতা সৃষ্টি। যাতে প্রতিযোগিতার কারণে কম দামে ভোক্তারা ভাল পণ্য ক্রয় করতে পারে। অর্থাৎ মুক্তবাজার মানেই ভোক্তার বাজার এবং ভোক্তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে। আর বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে সঙ্গে সঙ্গে সরকার হসত্মৰেপ করবে।
আমাদের দেশে এর উল্টো চিত্র। এখানে বাজার হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এখানে ভোক্তারা অসহায়। সরকারও নীরব দর্শক। ব্যবসায়ীরা যে দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে সে দামেই পণ্য বিক্রি হচ্ছে। বাজারে সরকারের কোন হসত্মৰেপ নেই, নেই কোন কার্যকর পর্যবেৰণ। ফলে যখন-তখন বাজার বেসামাল হয়ে পড়ছে। আর তার দায় পোহাতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের।
বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা আইন
দীর্ঘ ১৫ বছর পর সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকার সংরৰণ আইন প্রণয়ন করেছে। জাতীয় সংসদের অনুমোদনের পর ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করেছে। এটি আইনে পরিণত হওয়ার পর ১১ মাস পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখন পর্যনত্ম এটি কার্যকর হয়নি। যদিও এই আইন দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এই আইনে পণ্যমূল্যের কোন কথা নেই। আছে সেবার কথা, আর আছে মূল্য তালিকা প্রদর্শন এবং মোড়কের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরামূল্য লিপিবদ্ধ করার কথা। আরও আছে ধার্যকৃত মূল্যের অধিক দামে পণ্য ও সেবা বিক্রয় করলে শাসত্মির বিধানের কথা। এগুলো করা না হলে অনুর্ধ এক বছর বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয়দ-ে দ-িত করা হবে। এখন প্রশ্ন হলো মূল্যটা কে ধার্য করবে? ব্যবসায়ীরা তো ইচ্ছেমতো সকাল-বিকাল দাম ধার্য করে পণ্য বিক্রি করছে। এর কোন শাসত্মির বিধান আইনে নেই। অর্থাৎ বাজারে যখন-তখন পণ্য মূল্য বেড়ে গেলে তা রোধের কোন ব্যবস্থা আইনে নেই। তাহলে এ আইনের মাধ্যমে সরকার কিভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে?
আসলে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য এটি একটি খোঁড়া আইন। কারণ এই আইনের সংজ্ঞায় পণ্যমূল্যের কোন কথা নেই। এত দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রণয়ন করা হলেও এই আইনটি বাজার নিয়ন্ত্রণে কোন কাজেই আসবে না। বাড়িভাড়া ও সেবার ৰেত্রেও একই অবস্থা। বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য আইন আছে, তার কার্যকারিতা নেই। পাবলিক পরিবহনের ৰেত্রে মিটারে কেউ যায় না, কোন রম্নটেই বাস ভাড়ার মূল্য তালিকা মানা হয় না। একই পরিনতি হবে এই আইনের ৰেত্রেও।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারেই আছে ভোক্তার স্বার্থে মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপৰ গড়ে তোলা হবে। অথচ এই আইন দিয়ে কোনভাবেই ভোক্তার স্বার্থ সংরৰণ হবে না। তার ওপর ১১ মাস হয়ে গেলে আইনটির এখনও কোন প্রয়োগ নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে ১৫ মার্চ থেকে আইনটি কার্যকরের। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে আইনটি প্রয়োগের জন্য যে প্রস্তুতি প্রয়োজন তা এখন পর্যনত্ম দৃশ্যমান হচ্ছে না। কারণ এখন পর্যনত্ম আইনের বিধিগুলোই অনুমোদন করা হয়নি।
সুপারিশ
১। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য অবিলম্বে ভোক্তা অধিকার সংরৰণ আইন ২০০৯ বাসত্মবায়ন করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন কিছু পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে আইনটিকে ভোক্তাবান্ধব করা। ২। বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নেই। ছোট ছোট আমদানিকারক তৈরির মাধ্যমে বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা। ৩। মূল্য নিয়ন্ত্রণে মজুদদারির মতো প্রচেষ্টা বন্ধে আইনী কাঠামো আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। ৪। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী অসাধু সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেট রোধে প্রতিযোগিতামূলক আইন ও নীতি প্রণয়ন। ওই আইন প্রণয়নের আগে বিশেষ ৰমতা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়া। ৫। নিয়মিত দেশীয় ও আনত্মর্জাতিক বাজার পর্যবেৰণ করা এবং সে অনুযায়ী বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৬। সরকারী সহযোগিতার মাধ্যমে ছোট আমদানিকারকদের পণ্য আমদানিতে উৎসাহিত করা। ৭। দেশের ভেতরে পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা। ৮। দ্রম্নত সংস্কারের মাধ্যমে টিসিবিকে কার্যকর করা। ৯। কৃষি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ। এবং
১০। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কঠোর আইনগত ব্যবস্থা। দীর্ঘ ১৫ বছরের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশেও প্রণীত হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯। এই আইন দিয়ে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব তা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও আইন প্রণয়নের ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
নির্বাচনে পণ্যমূল্যের প্রভাব
বর্তমান মহাজোট সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। বাজারের পাগলাঘোড়ার মতো ধাবমান পণ্যমূল্যকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা। নির্বাচন-পূর্ববর্তী বছরে মূল্যবৃদ্ধির চাপে পিষ্ট এদেশের সাধারণ মানুষ সেই অঙ্গীকারের প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল। একচেটিয়া ভোট দিয়েছে মহাজোট সরকারের প্রার্থীদের প্রতীকে। ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে বিজয় লাভ করে। নির্বাচনে মহাজোটের পৰে সর্বাত্মক রায় প্রদানের আরও একটি কারণ ছিল ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে সফলতার সঙ্গে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। ওই মেয়াদে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং ১৯৯৮ সালের বন্যার বছর ছাড়া পণ্যমূল্য ছিল মানুষের ক্রয়ৰমতার মধ্যে। মূল্যস্ফীতিও ছিল সহনীয় মাত্রায়। ফলে দেশ ছয় শতাংশের ওপর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সৰম হয়। যে কারণে সাধারণ নির্বাচনে দেশের মানুষের রায় যায় মহাজোটের পৰে। পণ্যমূল্য যে নির্বাচনের রায়কে পাল্টে দিতে পারে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ছিল ২০০৯ সালের নির্বাচন।
মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপট
বর্তমানে দেশে যে মূল্যসন্ত্রাস চলছে তার যাত্রা শুরু হয় মূলত ২০০২ সাল থেকে। ২০০১ সালে এক দশমিক চার শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে ২০০২ সালে এক লাফে গড়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় চার দশমিক ৭২ শতাংশে। পরবর্তী বছরগুলোয় এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫ ও ২০০৬ সালে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায় যথাক্রমে পাঁচ শতাংশ, সাড়ে তিন শতাংশ, ছয় শতাংশ এবং ১৫ শতাংশ। এ সময় ৰমতায় ছিল জোট সরকার। এই পাঁচ বছরের শেষ বছরে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিল। সাধারণ মানুষের কাছে পণ্যমূল্য যেন ত্রাসে পরিণত হয়েছিল। জোট আমলে পণ্যমূল্যের এই বৃদ্ধির ঘটনা বিশ্ববাজারের চেয়ে অভ্যনত্মরীণ কারণেই বেশি ঘটেছে। মূলত ওই সময়ই বাজার ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। ফলে দেশের ভোক্তার বাজার পরিণত হয় ব্যবসায়ীদের বাজারে। উৎপাদক থেকে আমদানিকারক, খুচরা বিক্রেতা থেকে পাইকার সকলেই অস্বাভাবিক মুনাফার দুষ্টচক্রে জড়িয়ে যায়। যার দুর্ভোগ পোহাতে হয় দেশের অতি সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষকে।
এর পরের দুই বছর পণ্যমূল্য বৃদ্ধির রেকর্ডের বছর। এই দুই বছরে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি দেশের ৩৮ বছরের ইতিহাসকে ছাড়িয়ে যায়। এ সময় পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ৰেত্রে অভ্যনত্মরীণ কারণের সঙ্গে বিশ্ব পরিস্থিতিও স্থানীয় বাজারকে দারম্নণভাবে প্রভাবিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকে গ্রাস করে। এর প্রভাবে আনত্মর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সকল পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। তবে ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির চেয়ে দ্বিগুণ তিনগুণ মূল্যবৃদ্ধি ঘটে অভ্যনত্মরীণ বাজারে। এই দুই বছরের প্রথম বছর ২০০৭ সালে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায় প্রায় ১৯ শতাংশ এবং দ্বিতীয় বছর ২০০৮ সালে বৃদ্ধি পায় সাড়ে ১২ শতাংশ। দুর্ভাগ্যক্রমে এই দুই বছরে দেশের রাষ্ট্রৰমতায় ছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ফলে ছিল না মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার। তথাকথিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বিপর্যসত্ম হয়ে পড়েছিল দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের চেইন অব কমান্ড। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিডিআরের মাধ্যমে হসত্মৰেপ করেও বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যই চলে যায় মানুষের ক্রয়ৰমাতর বাইরে। মানুষ তার কষ্টার্জিত সঞ্চয় ভেঙ্গে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এতে এই দুই বছরে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। অথচ বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দেশের মানুষ নীরবে সহ্য করে যায় মূল্যবৃদ্ধির যন্ত্রণা।
সিন্ডিকেটের উত্থান
দেশে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ৰেত্রে ব্যবসায়ীদের কারসাজির ঘটনা শুরম্ন হয় ২০০২ সাল থেকে। ওই সময় বাণিজ্যমন্ত্রীর দফতরে এক বৈঠকে ব্যবসায়ীরা ঘোষণা দেন, আগের পাঁচ বছর তাঁরা ব্যবসা করতে পারেননি। এখন তাঁরা ব্যবসা করবেন সরকার তাঁদের কিছু বলতে পারবে না। মূলত ওই ঘোষণার পর থেকেই বাজার বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বাড়তে থাকে বিভিন্ন পণ্যের দাম। বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসায়ীরা যোগসাজশ করে পরিকল্পিতভাবে বেশি দামে পণ্য বিক্রি শুরম্ন করে, যা সিন্ডিকেট হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। এই সিন্ডিকেটের ঘটনা বেশি ঘটে আমদানিকারকদের ৰেত্রে। এই ঘটনা প্রকাশিত হয়ে পড়লে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ক্যাব দীর্ঘদিন থেকে এই সিন্ডিকেটের কথা বলে আসছিল। পণ্যমূল্য সংক্রানত্ম সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এক গবেষণা প্রতিবেদনেও এই সিন্ডিকেটের অসত্মিত্ব আরও স্পষ্টভাবে উঠে আসে। যদিও ব্যবসায়ীরা বরাবরই অস্বীকার করে আসে ব্যবসায়ীদের মাঝে সিন্ডিকেটের কোন অসত্মিত্ব নেই। সুনির্দিষ্ট আইন না থাকার কারণে সরকারও সিন্ডিকেটের বিরম্নদ্দে কোন ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। ফলে জোরালো দাবি উঠে ভোক্তা অধিকার সংরৰণ আইন প্রণয়নের।
সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির ধারা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় সেই সিন্ডিকেট আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যে কারণে আনত্মর্জাতিক মূল্যের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দামে বাজারে আটা ডাল আদা রসুন প্রভৃতি পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এই মূল্য বৃদ্ধির পেছনে যে সিন্ডিকেট দায়ী তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে অর্থমন্ত্রীর কথায়। তিনি ব্যবসায়ীদের এক সেমিনারে অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরাসরি ব্যবসায়ীদের যোগসাজশ তথা সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন। বলেছেন, 'বর্তমান বাজার দরের কোন যৌক্তিকতা নেই। একটি একচেটিয়া চক্র বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। উন্নত দেশগুলোয়ও মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু আছে। কিন্তু বিশ্বের কোন দেশেই সকাল বিকালে কোন পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় না। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রত্যৰ প্রমাণ পাওয়া যায় বাজারে গেলেই। চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরের আট মাসে বাজারে পণ্যমূল্য বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি, যাতে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির প্রচ- চাপ সৃষ্টি হয়েছে_ যা শুধু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকেই আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে না, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য হুমকি হয়েও দাঁড়িয়েছে।
মহাজোট সরকার ৰমতায় আসার পর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা পর্দার আড়ালে চলে গিয়েছিল। তারা সরকারের ৰমতা পর্যবেৰণ করছিল। এ কারণে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে পণ্যমূল্য কমতে শুরম্ন করে। এর প্রভাবে কমতে থাকে মূল্যস্ফীতিও। কিন্তু পরিস্থিতি আবার উল্টে যায় জুন মাস থেকে। যখন তারা বুঝতে পারে সিন্ডিকেটের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মতো ৰমতা সরকারের নেই, তখনই তারা পর্দার আড়াল থেকে আবার বেরিয়ে আসে। রোজাকে সামনে রেখে পণ্যমূল্য বাড়াতে থাকে। বাজার আবার বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে বর্তমানে বেড়ে চলেছে আবার মূল্যস্ফীতিও; বিশেষ করে সমপ্রতি চালের মূল্যবৃদ্ধিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিপজ্জনক অবস্থায় চলে গেছে। খাদ্যশস্যের ভাল ফলন এবং বিপুল পরিমাণ চালের মজুদ সত্ত্বেও চালের এই মূল্যবৃদ্ধি সরকারের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের মন্ত্রীরাই বলছেন বাজারে সিন্ডিকেট আছে। আর ওই সিন্ডিকেট ভাঙ্গার দায়িত্বও সরকারের। সরকারের উচিত দোষারোপ না করে অবিলম্বে সিন্ডিকেট ভাঙ্গার ব্যবস্থা নেয়া। এজন্য অন্য কোন আইন না থাকলেও সরকারের হাতে বিশেষ ৰমতা আইন রয়েছে। বিশেষ ৰমতা আইন দিয়েই সিন্ডিকেট ভাঙ্গার অভিযান শুরম্ন করা উচিত। আর এটা করলে বহু বিতর্কিত এই বিশেষ ৰমতা আইনটির ভাল কাজে ব্যবহারের নজির সৃষ্টি হবে।
মহাজোট সরকারের এক বছর
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ৰমতার মধ্যে নিয়ে আসার অঙ্গীকারের মধ্যদিয়ে মহাজোট সরকার ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে সরকারের এক বছর অতিক্রম হয়েছে। এই এক বছরে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার পালস্নাই ভারি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের রাস টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি আগের রেকর্ডকেও হার মানিয়েছে। চাল, ডাল, তেল আদা, রসুন পিঁয়াজ, মাছ, মাংস_ সবই সাধারণ মানুষের ক্রয়ৰমতার বাইরে চলে গেছে। চড়া পণ্যমূল্যের ভোগানত্মির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। উর্ধমুখী মূল্যের ধারা সামলাতে তারা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে।
কনজুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) পণ্যমূল্য সংক্রানত্ম পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ সরকারের এক বছরে অর্থাৎ ২০০৯ সালে দেশে পণ্যমূল্য বেড়েছে সাত শতাংশ। এই বৃদ্ধি আগের বছরের সাড়ে ১২ শতাংশ বৃদ্ধির অতিরিক্ত। আর ওই বছরের জুলাই থেকে ফেব্রম্নয়ারি পর্যনত্ম সময় পণ্যমূল্য বৃদ্ধি অতীতের সকল হিসাব নিকাশকে ছাড়িয়ে গেছে। এই আট মাসে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ বেড়েছে মসলা জাতীয় পণ্যের দাম। মসলার মধ্যে রসুনের দাম বেড়েছে ১৫০ শতাংশ আর হলুদের দাম বেড়েছে ১২৭ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধির ৰেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গুড় ও চিনির দাম। বাজারে চিনির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে গুড়ের দাম। গত আট মাসে এ দু'টি পণ্যের মূল্য বেড়েছে গড়ে ৪২ শতাংশ। গত আট মাসে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় তৃতীয় যে পণ্যটি রয়েছে তা হচ্ছে চাল। ওই সময়ে বাজারে চালের দাম বেড়েছে গড়ে ২৮ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রকার চালের ১৮ থেকে ৪৭ শতাংশ পর্যনত্ম মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এছাড়া বেড়েছে চায়ের দাম ২০ শতাংশ, ডালের দাম সাড়ে ১২ শতাংশ এবং ভোজ্যতেলের দাম তিন শতাংশেরও বেশি।
চালের বাজারের অস্থিরতার নেপথ্যে?
মানুষের প্রধান খাদ্য চালের দাম এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ৰমতার বাইরে। বাজারে মোটা চালই বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ টাকা দরে। আর মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা দরে। গত এক বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ছয় শতাংশ। চালের এই মূল্যবৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছে সীমিত আয়ের মানুষ। মূল্য নিয়ন্ত্রণে খোলা বাজারে চাল বিক্রির কার্যক্রম কোন কাজে আসছে না। গত মৌসুমে বোরোতে বাম্পার ফলন হয়। রেকর্ড পরিমাণ এক কোটি ৮০ লাখ টন চাল আকারে বোরো ফসল উৎপাদিত হয়েছে। এরপর সদ্য মাড়াই করা আমন ধানের বাম্পার ফলন। কৃষিমন্ত্রীর হিসাব অনুযায়ী, বহু বছর পর আমন উৎপাদন এক কোটি ৩০ লাখ টন পেরিয়েছে। বাজারে রয়েছে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহও। তাহলে চালের দাম বাড়ছে কেন?
অনুসন্ধান থেকে দেখা যায়, চালের দাম বাড়ছে শুধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে। গত বছর বাম্পার ফলনের কারণে চাল থেকে বেশি ব্যবসা করতে পারেনি। এবার সেটা পুষিয়ে নিচ্ছে চাল ব্যবসায়ীরা। কৃত্রিম উপায়ে চালের দাম বৃদ্ধি করে তারা সরকারের চোখের সামনেই দেশের সাধারণ মানুষের পকেট কেটে চলেছে।
চালের এই মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা শুরম্ন হয়েছে গত নবেম্বর মাস থেকে। গত নবেম্বর মাসের শেষ দিকে হঠাৎ করেই চালের দাম বাড়তে শুরম্ন করে এবং জানুয়ারি মাস পর্যনত্ম অব্যাহত থাকে। এই দুই মাসে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ছয় থেকে ১০ টাকা পর্যনত্ম। চাল ব্যবসায়ীরা মূলত শীতের কুয়াশাকে অজুহাত দেখিয়ে চালের দাম বাড়াতে থাকে। কুয়াশা চলে গেলেও সেই মূল্যবৃদ্ধি এখনও আছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে খোলা বাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) শুরম্ন করেছে। ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকায় ২২ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু তার প্রভাব বাজারে নেই।
এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, বাজারে ধানের সরবরাহ কমে গেছে। ভারতে ধানের উৎপাদন কম হয়েছে। বিশ্ববাজারে বেড়েছে চালের দাম। এ খবর জানতে বাকি নেই চাল ব্যবসায়ীদের। বাজারে চালের দাম আরও বাড়বে, এ আশায় ব্যবসায়ীরা প্রচুর পরিমাণ ধান মজুদ করে রেখেছে। প্রতিটি চাল ব্যবসায়ীই স্ব স্ব সামর্থ্য অনুযায়ী ধান-চাল মজুদ করছে। নিয়মিত চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এবার যোগ দিয়েছে অনিয়মিত মজুদদাররাও। যার কাছে যত টাকা আছে তা দিয়ে ধান কিনে মজুদ করে রাখছে। এতে বাজারে ধানের সরবরাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গিয়ে বেড়েছে ধান ও চালের দাম।
ছোট চাষীদের ঘরে এখন আর কোন ধান নেই। ছোট চাষীরা বোরো আবাদের আগে খোরাকি রেখে ধান বিক্রি করে দেয়। ধান বিক্রির টাকা দিয়ে আবাদ করে বোরো ধান। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ফলে সব ধান এখন চলে গেছে বড় কৃষক ও চাল ব্যবসায়ীদের কব্জায়। বড় কৃষক নিজের উৎপাদিত ধানের পাশাপাশি বাজার থেকে মৌসুমে কম দামে ধান কিনে মজুদ করে রেখেছে। ব্যবসায়ীদের প্রকার ভেদে এক একজন মজুদদারের কাছে পাঁচ শ' টন থেকে দুই হাজার টন পর্যনত্ম ধান-চালের মজুদ রয়েছে। চালকল মালিকরা বাজার থেকে ধান কিনে চাল বানিয়ে মজুদ করে রেখেছে। আর আড়তদাররা মিলারদের কাছ থেকে চাল কিনে মজুদ করেছে।
চাল ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের গুদামে হাজার হাজার বসত্মা ধান-চাল থরে থরে সাজানো রয়েছে। এসব ধান-চাল গুদামে তালাবদ্ধ অবস্থায় রেখে দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে গুদামগুলোয় মালিকরা বসিয়েছে কড়া পাহারা। চালকলগুলোর আশপাশের লোকজন জানায়, এবার আমন উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে চাল ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে কিনে গুদামে নিয়ে মজুদ করেছে। তাদের কাছে গত বোরো মৌসুমের হাজার হাজার টন ধানও এখন পর্যনত্ম মজুদ রয়েছে। গত বোরো মৌসুমের কেনা ধানের দাম ছিল গড়ে ৪৫০ টাকা। এবার আমন মৌসুমের ধানের দাম পড়েছে মণপ্রতি ৪৯০ টাকা।
পর পর দু'টি বাম্পার ফলনের পর বর্তমানে চালের বাজারে যে অস্থিরতা চলছে তা অস্বাভাবিক। এই অস্থিরতার পেছনে কাজ করেছে চালের দাম বাড়বে এই গুজব এবং বেপরোয়া মজুদদারী। এবার নিয়মিত চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৌসুমী ব্যবসায়ীরাও। মূলত বড় কৃষক, চালকল মালিক এবং মৌসুমী ব্যবসায়ী এই তিন চক্রের কারণেই চালের বাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। বোরো ধান না ওঠা পর্যনত্ম চালের বাজারের এই অস্থিরতা কমবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা
বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা কোন অর্থনীতির কোন নিয়ম অনুসরণ করে চলছে না। এর মূল সমস্যা হচ্ছে বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নেই। এ কারণেই যখন-তখন পণ্যমূল্য বাড়ছে। মুক্তবাজারের রীতিনীতি অনুযায়ী বাজার মূল্য নির্ধারণ করে না। এদেশের বাজারের মূল্য নির্ধারিত হয় ব্যবসায়ীদের যোগসাজশের মাধ্যমে। আর এ কারণেই এখানে সকাল-বিকাল পণ্যের দাম বাড়তে দেখা যায়। এখানে আনত্মর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বাজারে দাম বেড়ে যায়। কিন্তু আনত্মর্জাতিক বাজারে মূল্য পড়ে গেলে তার কোন প্রতিফলন ঘটে না বাজারে।
মুক্তবাজার সৃষ্টিই হয়েছে ভোক্তাদের স্বার্থের জন্য। নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা থাকলে বাজারে কোন প্রতিযোগিতা থাকে না। ফলে ভোক্তারাও তার সুফল পায় না। মুক্তবাজারের অর্থই হলো প্রতিযোগিতা সৃষ্টি। যাতে প্রতিযোগিতার কারণে কম দামে ভোক্তারা ভাল পণ্য ক্রয় করতে পারে। অর্থাৎ মুক্তবাজার মানেই ভোক্তার বাজার এবং ভোক্তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে। আর বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে সঙ্গে সঙ্গে সরকার হসত্মৰেপ করবে।
আমাদের দেশে এর উল্টো চিত্র। এখানে বাজার হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এখানে ভোক্তারা অসহায়। সরকারও নীরব দর্শক। ব্যবসায়ীরা যে দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে সে দামেই পণ্য বিক্রি হচ্ছে। বাজারে সরকারের কোন হসত্মৰেপ নেই, নেই কোন কার্যকর পর্যবেৰণ। ফলে যখন-তখন বাজার বেসামাল হয়ে পড়ছে। আর তার দায় পোহাতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের।
বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা আইন
দীর্ঘ ১৫ বছর পর সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকার সংরৰণ আইন প্রণয়ন করেছে। জাতীয় সংসদের অনুমোদনের পর ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করেছে। এটি আইনে পরিণত হওয়ার পর ১১ মাস পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখন পর্যনত্ম এটি কার্যকর হয়নি। যদিও এই আইন দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এই আইনে পণ্যমূল্যের কোন কথা নেই। আছে সেবার কথা, আর আছে মূল্য তালিকা প্রদর্শন এবং মোড়কের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরামূল্য লিপিবদ্ধ করার কথা। আরও আছে ধার্যকৃত মূল্যের অধিক দামে পণ্য ও সেবা বিক্রয় করলে শাসত্মির বিধানের কথা। এগুলো করা না হলে অনুর্ধ এক বছর বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয়দ-ে দ-িত করা হবে। এখন প্রশ্ন হলো মূল্যটা কে ধার্য করবে? ব্যবসায়ীরা তো ইচ্ছেমতো সকাল-বিকাল দাম ধার্য করে পণ্য বিক্রি করছে। এর কোন শাসত্মির বিধান আইনে নেই। অর্থাৎ বাজারে যখন-তখন পণ্য মূল্য বেড়ে গেলে তা রোধের কোন ব্যবস্থা আইনে নেই। তাহলে এ আইনের মাধ্যমে সরকার কিভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে?
আসলে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য এটি একটি খোঁড়া আইন। কারণ এই আইনের সংজ্ঞায় পণ্যমূল্যের কোন কথা নেই। এত দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রণয়ন করা হলেও এই আইনটি বাজার নিয়ন্ত্রণে কোন কাজেই আসবে না। বাড়িভাড়া ও সেবার ৰেত্রেও একই অবস্থা। বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য আইন আছে, তার কার্যকারিতা নেই। পাবলিক পরিবহনের ৰেত্রে মিটারে কেউ যায় না, কোন রম্নটেই বাস ভাড়ার মূল্য তালিকা মানা হয় না। একই পরিনতি হবে এই আইনের ৰেত্রেও।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারেই আছে ভোক্তার স্বার্থে মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপৰ গড়ে তোলা হবে। অথচ এই আইন দিয়ে কোনভাবেই ভোক্তার স্বার্থ সংরৰণ হবে না। তার ওপর ১১ মাস হয়ে গেলে আইনটির এখনও কোন প্রয়োগ নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে ১৫ মার্চ থেকে আইনটি কার্যকরের। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে আইনটি প্রয়োগের জন্য যে প্রস্তুতি প্রয়োজন তা এখন পর্যনত্ম দৃশ্যমান হচ্ছে না। কারণ এখন পর্যনত্ম আইনের বিধিগুলোই অনুমোদন করা হয়নি।
সুপারিশ
১। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য অবিলম্বে ভোক্তা অধিকার সংরৰণ আইন ২০০৯ বাসত্মবায়ন করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন কিছু পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে আইনটিকে ভোক্তাবান্ধব করা। ২। বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নেই। ছোট ছোট আমদানিকারক তৈরির মাধ্যমে বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা। ৩। মূল্য নিয়ন্ত্রণে মজুদদারির মতো প্রচেষ্টা বন্ধে আইনী কাঠামো আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। ৪। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী অসাধু সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেট রোধে প্রতিযোগিতামূলক আইন ও নীতি প্রণয়ন। ওই আইন প্রণয়নের আগে বিশেষ ৰমতা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়া। ৫। নিয়মিত দেশীয় ও আনত্মর্জাতিক বাজার পর্যবেৰণ করা এবং সে অনুযায়ী বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৬। সরকারী সহযোগিতার মাধ্যমে ছোট আমদানিকারকদের পণ্য আমদানিতে উৎসাহিত করা। ৭। দেশের ভেতরে পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা। ৮। দ্রম্নত সংস্কারের মাধ্যমে টিসিবিকে কার্যকর করা। ৯। কৃষি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ। এবং
১০। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ।
No comments