পাকিস্তানের রাজনীতি-নতুন ভুট্টোর উদয় by রাজা রুমী
ভুট্টো পরিবারের বিয়োগান্ত জীবনের সঙ্গে মিশে যাওয়া সিন্ধুর ধূলিধূসর ছোট্ট গ্রামে বিলাওয়াল ভুট্টো তার মা বেনজির ভুট্টোর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করলেন। দক্ষিণ এশিয়া বা পাকিস্তানে বংশীয় উত্তরাধিকারের রাজনীতি নতুন নয়।
বিলাওয়াল ভুট্টো তার মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই পিপিপির চেয়ারপারসন রয়েছেন। তবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে গত কয়েক বছর বিলাওয়াল সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে থেকেছেন। এই সময় তিনি তার পড়ালেখা শেষ করেছেন এবং বিশাল দলীয় প্রশাসন-যন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি প্রদেশ ও অঞ্চলে অবস্থান করে নেওয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) দেশটির অন্যতম বৃহৎ দল হিসেবে বিবেচিত।
মঙ্গলবার বিলাওয়াল বক্তৃতাকালে সবাইকে তার নানা ও মায়ের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং বেনজিরের মৃত্যুর পর একজন ক্যারিশমেটিক নেতার সন্ধানরত তার মূলশক্তি পিপিপি কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তিনি সংযোগ স্থাপন করেন। তার পিতা আসিফ আলি জারদারি একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ। তবে তার গণআবেদন তেমন নেই বললেই চলে। আধুনিক ও উদারতাবাদী রাজনীতিবিদদের জীবনের ওপর পাকিস্তানে যে হুমকি রয়েছে একই হুমকি তার ক্ষেত্রেও রয়েছে। এটাও তার স্বাভাবিক চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
গরহি খোদা বক্সে ভুট্টো পরিবারের জমকালো সমাধি এলাকায় দাঁড়িয়ে বিলাওয়াল তার পরিবার সবসময় যেমনটা করে থাকে সেই পুরনো বাক্যবন্ধই উচ্চারণ করেছেন। গণতন্ত্র ও জনগণের ইচ্ছাকে এখনও কীভাবে সামরিক প্রশাসন এবং বিচারকদের মতো শক্তিশালী শক্তিগুলোকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা তিনি তুলে ধরেন। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট এখন অপেক্ষাকৃত স্বাধীন, অতীতে তা ছিল না। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টকে অতীতে অনেক সময় সামরিক জান্তার আজ্ঞাবহ থাকতে দেখা গেছে এবং তারা পিপিপির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। এ ব্যাপারে উদাহরণ হিসেবে জুলফিকার আলি ভুট্টোর ফাঁসির প্রসঙ্গ উপস্থাপন করা যায়। বিলাওয়াল তার বক্তৃতায় বিচারকদের উদ্দেশ করে বলেন, 'রাওয়ালপিন্ডির রাস্তায় বেনজির ভুট্টোর রক্ত কি আপনাদের নজরে আসে না? ভুট্টো পরিবারের উত্তরাধিকারী হিসেবে আমার জিজ্ঞাস্য, কেন এখনও আমার মায়ের হত্যাকারীরা শাস্তি পায়নি?'
বিলাওয়াল উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে বলেন, এই আত্মবলিদান শুধু ভুট্টোদেরই দিতে হয়েছে তা নয়। চরমপন্থি সহিংসতার শিকার শিয়া সম্প্রদায়, তার দলের নেতাকর্মীসহ অনেক সাধারণ পাকিস্তানির আত্মত্যাগের কথাও তিনি স্মরণ করেন। মালালা ইউসুফজাইর মতো আরও অনেকের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, 'আপনারা আর কত নিরপরাধ মানুষের জীবন নেবেন? একজন মালালাকে হত্যা করা হলে হাজারো মালালা তার জায়গা নেবে। এক বেনজিরের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে অসংখ্য বেনজিরের জন্ম হয়েছে।'
বিলাওয়ালের রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ অপেক্ষাকৃত তরুণ পাকিস্তানিদের সঙ্গে পিপিপির সংযোগ গড়ে তোলার জন্য একটা বিরাট সুযোগ। এই তরুণ প্রজন্মই এখন পাকিস্তানের জনসংখ্যার গরিষ্ঠ অংশ। তরুণ শক্তির মেগনেট হিসেবে এতকাল ইমরান খানকেই বিবেচনা করা হতো। তবে বিলাওয়াল যদি জনগণের সঙ্গে সত্যিকার সংযোগ গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে তিনি এই ধারাকে পাল্টে দিতে পারবেন। নবীন হিসেবে উর্দুর ওপর তার ভালো দখল রয়েছে। এই বয়সে তার মায়েরও এতটা উর্দুর ওপর দখল ছিল না।
রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একজন ২৪ বছরের নবিশকে নিয়ে আসার জন্য পিপিপি ইতিমধ্যেই সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এটা পাকিস্তান বা পিপিপির জন্য নতুন কিছু নয়। বেনজিরও ২৪ বছর বয়সেই রাজনীতিতে এসেছেন। তার বাবাকে যখন ক্ষমতাচ্যুত করে কারারুদ্ধ করা হয়, তখন তিনি রাজনীতিতে আসেন। ১৯৮৪ সালে বিদেশে নির্বাসনে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছর তাকে অবরুদ্ধ জীবন কাটাতে হয়েছে। পাঁচ বছর আগে রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর গুলিতে বেনজির নিহত হওয়ার পর থেকে বিলাওয়ালও জনারণ্যে আসেননি দীর্ঘদিন।
গরহিতে বিলাওয়ালের বক্তব্যের আগ্রহোদ্দীপক দিকটি ছিল চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে তার সুস্পস্ট অবস্থান। অথচ তার দলেরই অনেক নেতা পর্যন্ত এভাবে চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার সাহস করেন না। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য অনেকটা তার মায়ের মতো। বিলাওয়াল বলেন, কেউ যখন জঙ্গিদের নাম পর্যন্ত নিতে ভয় পান, তখন এই শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের প্রাচীরের মতো দাঁড়াতেই হবে।
বহুধাবিভক্ত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পাকিস্তানে পিপিপির মতো একটি বৃহৎ পার্টির নেতৃত্ব দেওয়া ও নির্বাচনী প্রচারণা চালানো বিলাওয়ালের জন্য সহজ কাজ হবে না। তার মায়ের মতো তাকেও সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে। ভুট্টো পরিবারের প্রতি ঐতিহাসিকভাবে সতর্ক মনোভাব পোষণ করা পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণীর সম্মান ও আস্থা অর্জন করতে হবে তাকে। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে যে বিষয়টি সেটি হচ্ছে, পাকিস্তান যখন চরমপন্থিদের দ্বারা অবরুদ্ধ তখন ভয়ার্ত জনগণের সঙ্গে তাকে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে হবে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক শ্রেণীর প্রতি চরমপন্থি হুমকিটা এখন বাস্তব। আল কায়দা আদর্শের ধারক তালেবানের কাছে সংসদীয় গণতন্ত্র হচ্ছে অনৈসলামিক এবং তারা সংবিধান ছুড়ে ফেলতে চায়। সম্প্রতি তারা তাদের বিরোধিতাকারী আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির সাহসী নেতা বশীর বিলাউরকে হত্যা করেছে।
তাই যারা পাকিস্তানে জঙ্গিবাদের ভয়ে ভীত তাদের পুনরায় আশ্বস্ত করতে হবে, সাহস জোগাতে হবে। আমরা আশা করব, বিলাওয়াল সে পথ ধরে এগিয়ে যাবেন এবং এভাবে পাকিস্তানের গোলমেলে রাজনীতিতে নিজের জায়গা করে নিতে সক্ষম হবেন।
রাজা রুমী :ফ্রাইডে টাইমসের সম্পাদক ও ইসলামাবাদে জিন্নাহ ইনস্টিটিউটের পরিচালক; ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
মঙ্গলবার বিলাওয়াল বক্তৃতাকালে সবাইকে তার নানা ও মায়ের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং বেনজিরের মৃত্যুর পর একজন ক্যারিশমেটিক নেতার সন্ধানরত তার মূলশক্তি পিপিপি কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তিনি সংযোগ স্থাপন করেন। তার পিতা আসিফ আলি জারদারি একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ। তবে তার গণআবেদন তেমন নেই বললেই চলে। আধুনিক ও উদারতাবাদী রাজনীতিবিদদের জীবনের ওপর পাকিস্তানে যে হুমকি রয়েছে একই হুমকি তার ক্ষেত্রেও রয়েছে। এটাও তার স্বাভাবিক চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
গরহি খোদা বক্সে ভুট্টো পরিবারের জমকালো সমাধি এলাকায় দাঁড়িয়ে বিলাওয়াল তার পরিবার সবসময় যেমনটা করে থাকে সেই পুরনো বাক্যবন্ধই উচ্চারণ করেছেন। গণতন্ত্র ও জনগণের ইচ্ছাকে এখনও কীভাবে সামরিক প্রশাসন এবং বিচারকদের মতো শক্তিশালী শক্তিগুলোকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা তিনি তুলে ধরেন। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট এখন অপেক্ষাকৃত স্বাধীন, অতীতে তা ছিল না। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টকে অতীতে অনেক সময় সামরিক জান্তার আজ্ঞাবহ থাকতে দেখা গেছে এবং তারা পিপিপির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। এ ব্যাপারে উদাহরণ হিসেবে জুলফিকার আলি ভুট্টোর ফাঁসির প্রসঙ্গ উপস্থাপন করা যায়। বিলাওয়াল তার বক্তৃতায় বিচারকদের উদ্দেশ করে বলেন, 'রাওয়ালপিন্ডির রাস্তায় বেনজির ভুট্টোর রক্ত কি আপনাদের নজরে আসে না? ভুট্টো পরিবারের উত্তরাধিকারী হিসেবে আমার জিজ্ঞাস্য, কেন এখনও আমার মায়ের হত্যাকারীরা শাস্তি পায়নি?'
বিলাওয়াল উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে বলেন, এই আত্মবলিদান শুধু ভুট্টোদেরই দিতে হয়েছে তা নয়। চরমপন্থি সহিংসতার শিকার শিয়া সম্প্রদায়, তার দলের নেতাকর্মীসহ অনেক সাধারণ পাকিস্তানির আত্মত্যাগের কথাও তিনি স্মরণ করেন। মালালা ইউসুফজাইর মতো আরও অনেকের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, 'আপনারা আর কত নিরপরাধ মানুষের জীবন নেবেন? একজন মালালাকে হত্যা করা হলে হাজারো মালালা তার জায়গা নেবে। এক বেনজিরের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে অসংখ্য বেনজিরের জন্ম হয়েছে।'
বিলাওয়ালের রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ অপেক্ষাকৃত তরুণ পাকিস্তানিদের সঙ্গে পিপিপির সংযোগ গড়ে তোলার জন্য একটা বিরাট সুযোগ। এই তরুণ প্রজন্মই এখন পাকিস্তানের জনসংখ্যার গরিষ্ঠ অংশ। তরুণ শক্তির মেগনেট হিসেবে এতকাল ইমরান খানকেই বিবেচনা করা হতো। তবে বিলাওয়াল যদি জনগণের সঙ্গে সত্যিকার সংযোগ গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে তিনি এই ধারাকে পাল্টে দিতে পারবেন। নবীন হিসেবে উর্দুর ওপর তার ভালো দখল রয়েছে। এই বয়সে তার মায়েরও এতটা উর্দুর ওপর দখল ছিল না।
রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একজন ২৪ বছরের নবিশকে নিয়ে আসার জন্য পিপিপি ইতিমধ্যেই সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এটা পাকিস্তান বা পিপিপির জন্য নতুন কিছু নয়। বেনজিরও ২৪ বছর বয়সেই রাজনীতিতে এসেছেন। তার বাবাকে যখন ক্ষমতাচ্যুত করে কারারুদ্ধ করা হয়, তখন তিনি রাজনীতিতে আসেন। ১৯৮৪ সালে বিদেশে নির্বাসনে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছর তাকে অবরুদ্ধ জীবন কাটাতে হয়েছে। পাঁচ বছর আগে রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর গুলিতে বেনজির নিহত হওয়ার পর থেকে বিলাওয়ালও জনারণ্যে আসেননি দীর্ঘদিন।
গরহিতে বিলাওয়ালের বক্তব্যের আগ্রহোদ্দীপক দিকটি ছিল চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে তার সুস্পস্ট অবস্থান। অথচ তার দলেরই অনেক নেতা পর্যন্ত এভাবে চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার সাহস করেন না। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য অনেকটা তার মায়ের মতো। বিলাওয়াল বলেন, কেউ যখন জঙ্গিদের নাম পর্যন্ত নিতে ভয় পান, তখন এই শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের প্রাচীরের মতো দাঁড়াতেই হবে।
বহুধাবিভক্ত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পাকিস্তানে পিপিপির মতো একটি বৃহৎ পার্টির নেতৃত্ব দেওয়া ও নির্বাচনী প্রচারণা চালানো বিলাওয়ালের জন্য সহজ কাজ হবে না। তার মায়ের মতো তাকেও সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে। ভুট্টো পরিবারের প্রতি ঐতিহাসিকভাবে সতর্ক মনোভাব পোষণ করা পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণীর সম্মান ও আস্থা অর্জন করতে হবে তাকে। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে যে বিষয়টি সেটি হচ্ছে, পাকিস্তান যখন চরমপন্থিদের দ্বারা অবরুদ্ধ তখন ভয়ার্ত জনগণের সঙ্গে তাকে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে হবে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক শ্রেণীর প্রতি চরমপন্থি হুমকিটা এখন বাস্তব। আল কায়দা আদর্শের ধারক তালেবানের কাছে সংসদীয় গণতন্ত্র হচ্ছে অনৈসলামিক এবং তারা সংবিধান ছুড়ে ফেলতে চায়। সম্প্রতি তারা তাদের বিরোধিতাকারী আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির সাহসী নেতা বশীর বিলাউরকে হত্যা করেছে।
তাই যারা পাকিস্তানে জঙ্গিবাদের ভয়ে ভীত তাদের পুনরায় আশ্বস্ত করতে হবে, সাহস জোগাতে হবে। আমরা আশা করব, বিলাওয়াল সে পথ ধরে এগিয়ে যাবেন এবং এভাবে পাকিস্তানের গোলমেলে রাজনীতিতে নিজের জায়গা করে নিতে সক্ষম হবেন।
রাজা রুমী :ফ্রাইডে টাইমসের সম্পাদক ও ইসলামাবাদে জিন্নাহ ইনস্টিটিউটের পরিচালক; ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
No comments