ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি পার্বত্য বিরোধ কমিয়ে আনবে by নিখিল মানখিন
পার্বত্য এলাকায় সহিংসতা কমিয়ে আনতে হলে ভূমি সমস্যার সমাধান করতে হবে।
পার্বত্য এলাকার অধিকাংশ ঘটনা ভূমিকেন্দ্রিক। ভূমি মালিকানা নিয়ে
পাহাড়ী-সেটেলার বিরোধের তীব্রতা বেড়েই চলেছে।
ঘোষণা দিয়েও নানা জটিলতায়
পার্বত্য এলাকায় ভূমি জরিপ কার্যক্রম স্থগিত করেছে সরকার। সরাসরি ভূমি জরিপ
চালানোর সিদ্ধানত্মের ঘোর বিরোধিতায় পাহাড়ীরা। প্রথাগত মালিকানার বিষয়টি
স্বীকার করে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির পর জরিপে হাত দেয়ার দাবি জানিয়েছেন
তাঁরা। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না করে জরিপ চালিয়ে পার্বত্য ভূমি সমস্যার
সমাধান করা সম্ভব হবে না। বরং জটিলতা আরও বৃদ্ধি পাবে বলেও তাঁরা অভিযোগ
করেন। পার্বত্য ভূমি কমিশন এখনও নামমাত্র কাঠামো। নির্দিষ্ট অফিস ও লোকবল
নেই। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় দু'পাহাড়ী ও সেটেলার পরিবারের মধ্যে
একই জমির মালিকানা দাবি করার ঘটনাও ঘটছে। ভূমি মালিকানাকে কেন্দ্র করে
পার্বত্য এলাকায় ঘটছে অনেক সহিংস ঘটনা। সম্প্রতি সহিংস ঘটনায় হতাহতের ঘটনাও
ঘটেছে; যা এখনও সমাধানে পেঁৗছেনি। এসব ঘটনার সূত্রপাত যেখান থেকেই হোক না
কেন, পেছনে রয়েছে ভূমি মালিকানার দ্বন্দ্ব।বাংলাদেশের মোট ভূমির শতকরা প্রায় ১০ ভাগ এলাকা নিয়ে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। ২০০১ সালে চালিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক উন্নয়য়ন পরিকল্পনার প্রতিবেদন অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলায় ভূমির পরিমাণ ৯ লাখ ৩৯ হাজার ৪২১ দশমিক ১১ একর। এর মধ্যে রাঙ্গামাটিতে পড়েছে ৪ লাখ ৩২ হাজার ৯৮০ একর, খাগড়াছড়িতে ১ লাখ ৪৫ হাজার ২৭১ দশমিক ৫৬ একর এবং বান্দরবানে ৩ লাখ ৬১ হাজার ১৬৯ দশমিক ৫৫ একর। পার্বত্য চট্টগ্রাম মোট ভূমির শতকরা ৬৬ ভাগ এলাকা বন এবং সমগ্র বাংলাদেশে মোট বনভূমির শতকরা ৫০ ভাগের বেশি বনভূমি পার্বত্য এলাকায়। বাংলাদেশ আদম শুমারির প্রতিবেদন অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলায় ১৯৮১ সালে ৪ লাখ ৪১ হাজার ৭৭৪ জন পাহাড়ী ও ৩ লাখ ৪ হাজার ৮শ' ৭৩ জন সেটেলার, ১৯৯১ সালে ৫ লাখ ১ হাজার ১৪৪ জন পাহাড়ী ও ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৩০১ জন সেটেলার এবং ২০০১ সালে ৭ লাখ ৩৬ হাজার ৬শ' ৮২ জন পাহাড়ী ও ৬ লাখ ৬ হাজার ৩১ জন সেটেলার ছিল। অর্থাৎ ২০০১ সালে ওই তিন জেলায় পাহাড়ী ও সেটেলারদের সংখ্যা যথাক্রমে শতকরা ৫২ ও ৪৮ ভাগ। বর্তমানে পাহাড়ী ও সেটেলারদের সংখ্যা হবে সমানে সমান বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
পার্বত্য এলাকায় ভূমি সমস্যা প্রকাশ্য রূপ নেয় ১৯৭৯ সালে। ওই সালে জিয়াউর রহমান দেশের সমতল জেলাগুলো হতে পার্বত্য এলাকায় নিয়ে যায় ৪ লাখের বেশি বহিরাগত লোককে, যারা পরবর্তীতে সেটেলার নামে পরিচিতি পায়। তখন থেকে ওই এলাকার ভূমি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় একটি জলনত্ম অগি্নকু-। পরবর্তীতে শানত্মি চুক্তিতে ওই এলাকার প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুসারে ভূমি কমিশন গঠনের বিধান রাখা হয়। তারই প্রেেিত সরকার প্রথমে ১৯৯৯ সালের ৩ জুন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আনোয়ারম্নল হক চৌধুরীকে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। কিনত্মু তিনি কার্যভার গ্রহণের আগে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে মৃতু্যবরণ করেন। এরপর সরকার ২০০০ সালে আরেক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল করিমকে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। তিনি ২০০০ সালের ১২ জুন কার্যভার গ্রহণের পর খাগড়াছড়ি পার্বত্য এলাকা ঘুরে যান। তারপর তিনিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সবকিছু রয়ে যায় ঝুলনত্ম অবস্থায়। বিদায় নেয়ার আগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালের ১২ জুলাই এ সংশিস্নষ্ট আইন প্রণয়ন করে যায়। জনসংহতি সমিতিসহ সকল পাহাড়ী নেতা ওই আইনকে শানত্মি চুক্তির সঙ্গে বিরোধাত্মক বলে অভিযোগ তুলে প্রত্যাখ্যান করে আসছে। পরবর্তীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট মতায় আসার পর ২০০১ সালের ২৯ নবেম্বর অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মাহমুদুর রহমানকে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ভূমি কমিশন কার্যকর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বিচারপতি মাহমুদুর রহমান মৃতু্যবরণ করেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগের কথা বললেও দু'বছরের মেয়াদকালে নিয়োগ দিতে পারেনি। ভূমি কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান হলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী। কমিশনের দায়িত্ব নিয়েই তিনি পার্বত্য এলাকায় ভূমি জরিপের ঘোষণা দেন।
No comments