সৌন্দর্য-ঐতিহ্যের মিলন
টাঙ্গাইল শহর থেকে সাত কিলোমিটার দণি-পশ্চিমে লৌহজং নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক আতিয়া জামে মসজিদ। যার বর্তমান বয়স ৪শ' বছর। বহু বছরের পুরনো ও প্রাচীন স্থাপত্যের এক অনন্য স্মারক শিল্পকর্মে তৈরি মসজিদটি বর্তমানে বাংলার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল সৃষ্টি হয়ে টিকে রয়েছে।
তাই প্রাগৈতিহাসিক এ স্থাপত্য শিল্পমণ্ডিত মসজিদটিকে একনজর দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন।ইতিহাসখ্যাত বারো ভূঁইয়ার এক ভূঁইয়া ঈশা খাঁর পুত্র মুসা খাঁর শাসনামলে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। ঈশা খাঁ ছিলেন সোনারগাঁও অঞ্চলের শাসক। বৃহত্তর ঢাকা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ তখন সোনারগাঁও অঞ্চলের অনত্মভর্ুক্ত ছিল। শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে ঈশা খাঁ আতিয়া পরগনা সৃষ্টি করেন। সেসময় আতিয়ার শাসনভার ন্যসত্ম হয় ঈশা খাঁর পুত্র মুসা খাঁর ওপর।
প্রাচীন এ মসজিদটিকে সামনাসামনি না দেখেও প্রাথমিকভাবে এর সঙ্গে সবার পরিচয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ টাকার মাধ্যমে। বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ টাঙ্গাইল আতিয়া জামে মসজিদটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে সংরণ করেছে। প্রাচীন এ জামে মসজিদটির আয়তন বাইরের দিকে ২০ দশমিক ৯ মিটার ও ১৬ দশমিক ১৬ মিটার (৬র্৯ ও ৪র্০)। মসজিদের প্রাচীর ২ দশমিক ৭২ মিটার (দশমিক ৫ ফুট) প্রশসত্ম। মসজিদের চার কোণায় আছে ৪টি বিশাল আকারের অষ্টকোণাকৃতির সত্মম্ভ বা মিনার। স্ফিত রেখার সাহায্যে অলঙ্কৃত মিনারগুলো ছাদের অনেক ওপর উঠে গেছে। চূড়ায় রয়েছে কারম্নকার্যময় সুন্দর ছোট ছোট গম্বুজ। গম্বুজগুলোর পায়ে বিভিন্ন রকমের কারম্নকার্য লাগায় মসজিদটির সৌন্দর্য অনেকগুণ বেড়ে গেছে। মসজিটির প্রধান ক ও বারান্দা দুই ভাগে বিভক্ত। মসজিদের পূর্ব ও মাঝের দেয়ালে রয়েছে একটি করে দরজা। বারান্দাসহ উত্তর-দণি দেয়ালে আছে দু'টি করে দরজা। ভেতরের পশ্চিম দেয়ালে আছে ৩টি সুন্দর মেহরাব। প্রধান করে প্রত্যেক দেয়ালের সঙ্গে দু'টি করে পাথরের তৈরি সত্মম্ভ আছে। প্রধান কটি বর্গাকৃতির এবং ভেতরের দিকে এর প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৫৭ মিটার। প্রধান করে ওপরে আছে একটি বিশাল মনোমুগ্ধকর গম্বুজ। বারান্দার পূর্ব দেয়ালে আছে তিনটি প্রবেশপথ। মাঝখানের প্রবেশপথের উপরের অংশের নিম্নভাগে একটি শিলালিপি রয়েছে। বর্তমানে যে শিলালিপিটি লাগানো আছে এর আগেও একটি শিলালিপি এখানে ছিল বলে ইতিহাসে উলেস্নখ আছে। এই শিলালিপিটি ফার্সীতে লেখা। কোন কারণে আদি শিলালিপিটি হারিয়ে গেলে পরবর্তীকালে এ মসজিদ মেরামতের সময় বর্তমান শিলালিপিটি লাগানো হয়। বর্তমানে এ শিলালিপিতে উলেস্নখ করা হয়েছে আতিয়া মসজিদটি নির্মাণ হয় ১০১৮ হিজরিতে।
আরও জানা যায়, ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে বায়েজিদ খান পন্নীর পুত্র সাঈদ খান পন্নী মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৬০৯ সালে নির্মাণের পরবর্তী সময়ে তা একাধিকবার সংস্কার করা হয়। বার বার সংস্কার করা হলেও এ মসজিদের মূল কাঠামোর কোন পরিবর্তন করা হয়নি। টাঙ্গাইলের করটিয়ার বিখ্যাত পন্নী জমিদার বংশের আদিপুরম্নষ হলেন সাঈদ খান পন্নী। মসজিদের পশ্চিম দিকে অবস্থিত ফটকের ডানদিকে আরেকটি শিলালিপি আছে। এটি ইংরেজীতে লেখা। এ শিলালিপিটি পাঠ করে জানা যায়, ১৬০৯ সালে সাঈদ খান পন্নী এটি নির্মাণ করেন। ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরানী মসজিদটি মূল আদলে পুনর্নির্মাণ করেন এবং ১৯০৯ সালে আবু আহমেদ গজনবী খান ওয়াজেদ আলী পন্নীসহ আতিয়ার অন্য জমিদারদের সহযোগিতায় মেরামত করেন।
টাঙ্গাইল আতিয়া জামে মসজিদটি দেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক। তবে মসজিদের দেয়ালের উপর যে চিত্রফলক ছিল তার বেশির ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। মসজিদটি কতটা কারম্নকার্যময় করে নির্মাণ করা হয়েছিল তা বোঝা যায় এর নির্মাণশৈলী ও চিত্রফলক দেখে। এটি বাংলাদেশের অন্যান্য মসজিদ থেকে একটু ভিন্ন। মসজিদের প্রায় লাগোয়া পশ্চিম দিকেই রয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের অতি প্রাচীন একটি পুকুর। এটি উত্তর-দেিণ মাঝারি আকারের। মসজিদের পূর্বদিকে রয়েছে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। এর উত্তর-পূর্ব কোণে একটি বাঁধানো সমাধি রয়েছে। সমাধির তলদেশে একটি সুড়ঙ্গ আছে এবং সেখানে যাওয়ার জন্য সিঁড়িপথও রয়েছে। আতিয়া জামে মসজিদকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার স্থানজুড়ে বহু প্রাচীন কীর্তি ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন রয়েছে। মোগল আমলে এটি ছিল একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র। প্রাচীন হিন্দু-বৌদ্ধ সুলতানী আমল ও ইংরেজ আমলের প্রথমদিকেও এই স্থানের যথেষ্ট প্রাধান্য ছিল।
০ ইফতেখারম্নল অনুপম, টাঙ্গাইল
No comments