ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিন
৫০ থেকে ১০০ বছরমেয়াদি 'ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০' বাস্তবায়নে নেদারল্যান্ডস সরকারের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্বের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বিবেচনায় নিয়ে দেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা,
নাব্যতা রক্ষা এবং বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ সমন্বিতভাবে সম্পন্ন করার যে তাগিদ বিশেষজ্ঞ মহল বিভিন্ন সময় দিয়েছে, সরকার তা আমলে নিয়েছে দেখে আমরা আনন্দিত। এটা ঠিক, দীর্ঘমেয়াদি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে আমাদের। টেকসই ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনায় অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত, নেদারল্যান্ডস যদিও আমাদের পাশে; গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থল বঙ্গীয় ব-দ্বীপকে রাইন-মিউস-শেল্ট অববাহিকার মতো সম্ভাবনাময় এবং সুরক্ষিত করে তোলা সহজ নয়। কিন্তু সরকারের এই এক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে এই ক্ষেত্রে বড় ধরনের উল্লম্ফনের সুযোগ সৃষ্টি হলো। সমন্বিত এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আমাদের উন্নয়ন কাঠামোর বিভ্রান্তি ও অপচয় নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রীও স্বীকার করেছেন যে, সরকার ইতিপূর্বে যেসব জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা কাঙ্ক্ষিত ফলদানে ব্যর্থই হয়েছে। জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, সমন্বিত উপকূল ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, হাওর মহাপরিকল্পনা, জাতীয় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতিও জাতীয় স্বার্থেই প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু এগুলোতে সমন্বয়ের যে অভাব রয়েছে, ব-দ্বীপ পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে তা দূর হবে আশা করা যায়। পরিকল্পনামন্ত্রীর এই প্রত্যাশাও সঙ্গত যে নতুন মহাপরিকল্পনার 'হোলিস্টিক' চরিত্রের কারণে কৃষি, মৎস্য, শিল্প, বনায়ন, পানি ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন সংহত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলা করে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে এমন একটি পরিকল্পনার বিকল্পও অবশ্য ছিল না। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও চাহিদা এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতাও প্রণিধানযোগ্য। ব-দ্বীপ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য থাকে ভূমি উদ্ধার। আমাদের জন্য তার আশীর্বাদেরই নামান্তর। বড় পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ব্যাপক সতর্কতাও যে জরুরি, সেই কথা আমরা নীতিনির্ধারকদের মনে করিয়ে দিতে চাই। অনেক প্রত্যাশা ও অসীম প্রয়োজনের এই উদ্যোগ যেন ক্ষুদ্র স্বার্থের বলী না হয়। ব-দ্বীপ পরিকল্পনার অধীনে যে কমিশন গঠন করা হবে, তাতে দক্ষ, সৎ ও গ্রহণযোগ্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয় ঘটাতে হবে। দল ও গোষ্ঠীগত আনুগত্যের বদলে এই ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পাবে বলে প্রত্যাশা। অতীতে অনাকাঙ্ক্ষিত এসব উপাদান অনেক পরিকল্পনা স্থবির এমনকি ভেস্তেও দিয়েছে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এর পুনরাবৃত্তি কেউই দেখতে চাইবে না। পরিকল্পনাটির সুষ্ঠু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উজান থেকে আসা পানিপ্রবাহ যে মূল চালিকাশক্তি, নীতিনির্ধারকরা সেটা ভুলে যাননি নিশ্চয়ই। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে গাঙ্গেয় অববাহিকার পাদদেশের প্রাকৃতিক সাদৃশ্যের কথা আমরা জোরেশোরে বলছি বটে; আমাদের মতো তাদের নদীর প্রবাহ কিন্তু উজানের দেশনির্ভর নয়। আমরা জানি, বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনার সময়োচিত বাস্তবায়ন চাইলে সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে গতিও জরুরি। সে ক্ষেত্রে সরকার অভিন্ন সব নদীর জন্য অভিন্ন বণ্টন ফর্মুলা নিয়ে অগ্রসর হতে পারে। তাতে করে সময় যেমন বাঁচবে, কমবে জটিলতাও। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমাদের অপেক্ষার প্রহরও দীর্ঘ হবে না।
No comments