চরাচর-জৈব বা বায়োপ্লাস্টিক by আফতাব চৌধুরী
আমরা বর্তমানে এমন একটি যুগে বাস করছি, যাকে নিঃসন্দেহে প্লাস্টিক যুগ বলা যেতে পারে। বাড়িতে সব দিকে চোখ রাখলেই দেখা যায় প্লাস্টিকের ব্যবহার। শুধু ছোটদের খেলনা বা মোড়ক হিসেবেই নয়, জামাকাপড় থেকে রান্নাঘর, কম্পিউটার, গাড়ি, নিত্যব্যবহার্য অপরিহার্য বস্তু থেকে উড়োজাহাজের বিভিন্ন অংশ, বিজ্ঞানের বিভিন্ন কাজে সব ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের অবাধ প্রবেশ।
১৮৮৬ সালে একজন ব্রিটিশ রসায়নবিদ তুলো, নাইট্রিক এসিড, সালফিউরিক এসিড, ক্যাস্টর অয়েল, কর্পূর প্রভৃতি থেকে প্রথমে প্লাস্টিক তৈরি করেন, যা পরে পরিবর্তিত হয় সেলুলয়েডে। বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করেন, তেল-কয়লা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক হাইড্রোকার্বন পরিবর্তন করা যেতে পারে এক সম্পূর্ণ অন্য বস্তুতে, যেগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে। এর ফলস্বরূপ আবিষ্কৃত হয় নানা ধরনের প্লাস্টিক, যেমন_ক্যাসিন, বেকেলাইট, পলিথিলিন, সেলোফেন, পিভিসি, পিভিডিসি প্রভৃতি। প্রসঙ্গত, পিভিসির সৃষ্টি কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে। প্লাস্টিক শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল হলো পেট্রোলিয়ামজাত বিভিন্ন হাইড্রোকার্বন, যেমন_মিথেন, ইথিলিন, অ্যাসিটিলিন প্রভৃতি। তাই প্লাস্টিক শিল্প সম্পূর্ণ খনিজ তেলনির্ভর। বর্তমানে সারা বিশ্বে বার্ষিক প্লাস্টিক উৎপন্ন হয় চার লাখ টন, যা প্রমাণ করে ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিকের চাহিদা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিদিন সারা বিশ্বে প্লাস্টিক শিল্পে ব্যবহৃত হয় ৯ বিলিয়ন ব্যারেল পেট্রলিয়াম। যেহেতু পৃথিবীতে পেট্রলিয়ামের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির সঞ্চয় সীমিত, তাই প্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে প্রয়োজন কোনো বিকল্প কাঁচামালের। এ ছাড়া প্লাস্টিকের দূষণক্ষমতা প্রতিনিয়ত আমাদের পরিবেশ দূষণ করে চলেছে। পরিত্যক্ত অবস্থায় জঞ্জাল হিসেবে পরিবেশের ক্ষতি করে, দহনে বিষাক্ত পদার্থের নিঃসরণের আশঙ্কা থাকে, গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ হয় বা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের মতো ভয়ংকর ঘটনা ত্বরান্বিত করে। এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে কোনো বিকল্প কাঁচামালের ব্যবহারে, যা হবে কৃষি অথবা উদ্ভিদজাত। যেহেতু উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অঙ্াইড গ্রহণ করে বৃদ্ধি পায়, সেহেতু উদ্ভিদজাত বায়োপ্লাস্টিকের দহনে উৎপন্ন কার্বন ডাই-অঙ্াইড বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অঙ্াইডের ভারসাম্যের পরিবর্তন করে না। সুতরাং বিজ্ঞানীরা আশ্রয় নিলেন বায়োপ্লাস্টিক অথবা জৈব প্লাস্টিকের। জৈব প্লাস্টিক হলো নতুন প্রজন্মের প্লাস্টিক, যা প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হতে পারে ভুট্টা, আলু, ট্যাপিওকা, আখ, সয়াপ্রোটিন, ল্যাকটিক এসিড প্রভৃতি। পেট্রলিয়ামের পরিবর্তে কাঁচামাল হিসেবে এগুলো ব্যবহৃত হওয়ার সুবিধা হলো এদের সহজলভ্যতা এবং এরা হলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদার্থের উৎস। বায়োপ্লাস্টিক পরিত্যক্ত অবস্থায় ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গি প্রভৃতি আণুবীক্ষণিক জীবের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সহজেই কার্বন ডাই-অঙ্াইড, পানি ও জৈব পদার্থে পরিণত হয়। এভাবে প্রাপ্ত জৈব পদার্থ সার হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে। পরিবেশ-সহায়ক হওয়ায় পরবর্তী প্রজন্মের প্লাস্টিক হিসেবে বায়োপ্লাস্টিকের প্রচলন ক্রমেই গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। ভারতেও উদ্ভিদ বা উদ্ভিদজাত বস্তু, যেমন_বাঁশ, তন্তু, দানাশস্যের তুষ, আঠা প্রভৃতি বিশেষ প্রযুক্তির সহায়তায় এমন জৈব প্লাস্টিকে পরিবর্তিত করার প্রচেষ্টা হচ্ছে, যা হবে সুলভ ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তাযুক্ত। এই বায়োপ্লাস্টিকের সার্থকতা নির্ভর করে অর্থ সাশ্রয়কারী উৎপাদনপ্রযুক্তিতে এবং বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদার ওপর।
আফতাব চৌধুরী
আফতাব চৌধুরী
No comments