রাষ্ট্রপতি কি ঝুঁকি নিলেন, না কোনো ইঙ্গিত পেলেন-রাজনীতি by বদিউর রহমান
রাষ্ট্রপতির সংলাপ সফল হলে উত্তম, রাজনৈতিক অচলাবস্থা কেটে গেলে আরও উত্তম, আগামী নির্বাচনের সমঝোতায় এগিয়ে যেতে পারলে তো সর্বোত্তম। কিন্তু যদি এ সংলাপ ব্যর্থ হয় তবে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগের ঝুঁকি কাদের ওপর কতটুকু বর্তাবে? আওয়ামী লীগ সরকার তখন হয়তো আরও হার্ডলাইনে চলে যাবে, বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কাবু করার জন্য সব প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে চাইবে আর বিএনপি তখন মিত্রদের নিয়ে আন্দোলন বেগবান করতে সচেষ্ট হবে। ফলে আবার
রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রপতির সংলাপ। ১৮ ডিসেম্বরের গুপ্ত হামলা নিয়ে বিএনপি বেকায়দায় পড়লেও এবং আওয়ামী লীগ এ অঘটন থেকে কিছুটা সুবিধা পেলেও রাজনৈতিক সংলাপের দিকেই সবার নজর বেশি। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন তথা নতুন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে শুরু হওয়া এ সংলাপ নিয়ে সাধারণভাবে হতাশা ব্যক্ত করা হলেও সংলাপ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগে কাগুজে ক্ষমতবান হলেও অন্যান্য শর্তসাপেক্ষ এবং প্রায়োগিক বাস্তবতায় দেখা যায়, বর্তমান অবস্থায় রাষ্ট্রপতি আসলে ক্ষমতাহীন। কেননা প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের জন্য সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন, তা একক দলীয়ই হোক আর জোটবদ্ধ সমর্থনেই হোক, রাষ্ট্রপতিকে একটা নির্দেশনায় বাধ্যবাধকতা দিয়ে দিয়েছে বিধায় তিনি তার পছন্দ অনুযায়ী যাকে-তাকে তো আর প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিতে পারবেন না। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি নিয়মকানুন মেনেই তা করে থাকেন। নিজের এখতিয়ার হলেও শোনা যায়, দলীয় বিবেচনায় নিযুক্ত রাষ্ট্রপতিরা প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ-অপছন্দেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করে থাকেন। আর এ জন্যই দেখা যায়, জ্যেষ্ঠ বিচারপতিও প্রধান বিচারপতি হতে নাকি পারেন না। বাংলাদেশে নিযুক্ত গত কয়েক বছরের প্রধান বিচারপতিদের নিয়োগ নিয়ে এমন সমালোচনা রয়েছে। আর বিচারপতি নিয়োগের দলীয়করণ নিয়ে তো খোদ প্রধান বিচারপতিরও আক্ষেপ থেকে থাকে। কোনো বিতর্কিত বিচারপতির শপথ পাঠ করানো নিয়েও কোনো কোনো প্রধান বিচারপতির মতের ভিন্নতা আমরা দেখে থাকি_ একজন শপথ পাঠ করালেন না তো আরেকজন কাজটা সেরে নিলেন। রাষ্ট্রপতির এমন ক্ষমতাহীন অবস্থায়ও তিনি যে বর্তমান সংলাপের আয়োজন করেছেন তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। সাধারণভাবে আলোচ্য প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি কি স্বেচ্ছায় এ ঝুঁকি নিয়েছেন, না তিনি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইঙ্গিত পেয়েছেন।
ঝুঁকি বা ইঙ্গিতের বিষয়টি আমরা একটু বিশ্লেষণ করে দেখি। ঝুঁকি না বলে একে কেউ কেউ রাষ্ট্রপতির সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশও ভাবতে চাইতে পারেন, কিন্তু সেটা যুক্তিতে টেকে না। কারণ রাষ্ট্রপতির এককভাবে এমন সদিচ্ছা পোষণের কোনো ক্ষেত্র আছে বলে তো দেখা যায় না। সাংগঠনিক ক্ষমতায় প্রধান বিচারপতি এবং প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ছাড়া অন্য সব বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কার্য সম্পাদন করবেন মর্মে সে সীমাবদ্ধতা তার জন্য প্রস্তুত করে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া সেটা উতরানোর তার ক্ষমতা নেই। অতএব সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনে কাউকে রাষ্ট্রপতির পছন্দ হলেও, এমনকি অন্য অনেক দলের তাতে সমর্থন থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি না থাকলে তিনি কি তাকে নিয়োগ দিতে পারবেন? প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে সুপারিশকৃত হয়ে না এলে রাষ্ট্রপতি কি নিজে নিজে নিয়োগ অনুমোদন করে তার প্রজ্ঞাপন জারি এবং তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন? সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে কি প্রজ্ঞাপন জারি সম্ভব হবে? হলেও কি তা আইনি ক্ষমতায় শুদ্ধ হবে? অতএব প্রচলিত সিস্টেমে রাষ্ট্রপতি চাইলেই তার ক্ষমতার প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সংলাপের বিষয়টি তাই তার সদিচ্ছার একটা ক্ষমতাহীন বহিঃপ্রকাশ হতে পারে মাত্র। তাই কোনো প্রকার ইঙ্গিত অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সবুজ সংকেত ছাড়া এমন সংলাপ হলে তা পুরোপুরিই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে হলেও এটা ঝুঁকিমুক্ত নয় এ জন্য যে, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে সংলাপ হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতির পছন্দেই কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য নয়, যদি না সে সিদ্ধান্তেও প্রধানমন্ত্রী সম্মত না হন। তাহলে ঘুরেফিরে আবার কথা একই হয় যে, রাষ্ট্রপতি ঝুঁকি নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন আসে, তিনি কেন এ ঝুঁকি নিলেন?
আমরা দেশের হাল-অবস্থা বিবেচনায় এমন ভাবতে পারি যে, দ্রুত অগ্রসরমান রাজনৈতিক জটিলতায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ হয়তো আর বেশি এগোতে চায় না। এটা স্বাভাবিক যে, আওয়ামী আমলে যদি রাজনৈতিক জটিলতায় পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হয় তবে তার ষোলআনা দায় প্রথম ঠেলায় আওয়ামী লীগ সরকারের ওপরই বর্তাবে। শুধু অভ্যন্তরীণ বিবেচনায় নয়, আন্তর্জাতিক বিবেচনায়ও এ ব্যর্থতাকে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। দুটি কারণে আওয়ামী লীগ সরকার এমন দায় নিতে চাইবে না। এক. আওয়ামী লীগ সরকারের ৫ বছরের মেয়াদ জাতীয় নির্বাচনের কোনো ব্যর্থতার জন্য প্রশ্নের সম্মুখীন হোক, সেটা সরকার তথা আওয়ামী লীগ চাইবে না। চাইবে না অন্তত এ জন্য যে, একবার দলীয় সরকার ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে গেলে জনমনে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা বেড়ে যাবে। তৃণমূল পর্যায়ে সুসংগঠিত বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তেমন ব্যর্থতা অবশ্যই চাইবে না। দুই. পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে স্বীকৃতভাবে নিজেদের অর্জন তুলে ধরতে হলে এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে হলেও জাতীয় নির্বাচনের কোনো বাধা বা প্রতিবন্ধকতা এ সরকার নিজেদের স্বার্থেই সৃষ্টি করতে চাইবে না। কারণ দলটির সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিশ্চয়ই পরবর্তী মেয়াদেও সরকারে আসা এবং শুধু সরকারে আসাই নয়, বরং সুষ্ঠুভাবে সে সরকারও ৫ বছরের জন্য টিকিয়ে রাখা। এমন উদ্দেশ্য যেহেতু রয়েছে সেহেতু জাতীয় নির্বাচন দেশে-বিদেশে স্বীকৃত এবং সমর্থনযোগ্য হতে হবে। অতএব এমন বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা চাইতেই পারেন। দলীয় সরকারের এমন ধারণা থাকা অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, নির্বাচন কমিশন গঠনে যদি কোনোভাবে নূ্যনতম রাজনৈতিক সমঝোতায় পেঁৗছানো সম্ভব হয় তাহলে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের জন্য একধাপ তারা এগিয়ে যেতে সক্ষম হলো। আর এর পরের পদক্ষেপ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টায়ও এগোনো হয়তো সহজ হতে পারে।
মুখে যেহেতু শেখ হাসিনা এবং দলীয় নেতারা দলীয় সরকারের অধীনে পঞ্চদশ সংশোধনী অনুসারে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বারবার বলে আসছেন, ভেতরে কিন্তু বিরোধী চাপ অনুভব করছেন। অতএব রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা এগিয়ে নিলে যদি কোনো সমাধানে পেঁৗছা যায় মন্দ কী। এতে সরকারের অন্তত তিনটা নগদ লাভ আছে ভাবা যায়_ এক. বিএনপির রোডমার্চের উত্তাপে এমন সংলাপ কিছুটা পানি ঢেলে দেওয়ার কাজ করবে। দুই. বিএনপি যেহেতু সংসদেও যাচ্ছে না, অন্য কোনোভাবেও কোনো আলোচনায় আসছে না, এ সংলাপের মাধ্যমে এ দলকে আলোচনায় আনার একটা সার্থকতা থাকতে পারে। তিন. আন্তর্জাতিকভাবেও একটা ভাবমূর্তি অর্জন করা যেতে পারে যে, সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব যখন বলেন, এ সংলাপ প্রধানমন্ত্রী করলেই ভালো হতো, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বিএনপিও একটা সুযোগ খুঁজছে সংলাপের জন্য। তবে শেখ হাসিনা নিজে তা করতে যাননি হয়তো এ জন্য যে, তাহলে তার সরাসরি প্রস্তাবকে বিএনপি আওয়ামী দুর্বলতা ভাবতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে যদি বিএনপি সরাসরি 'না' বলে দেয় সেটা সরকার এবং আওয়ামী লীগের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর হয়ে যাবে। অতএব রাষ্ট্রপতিই এ জন্য উত্তম মাধ্যম। রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে এবং নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে তাকে অবহেলা করলে অর্থাৎ আলোচনায় না এলে বিএনপি সমালোচিত হবে বেশি। নির্বাচন কমিশন গঠনের আলোচনায় গিয়ে যদি বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু নিয়েও আলোচনা করতে চায় সেটাও একটা বরফ গলানো অবস্থার সৃষ্টি করবে বটে। মন্দ কী, পিং পং খেলার উসিলায় চীনের সঙ্গে যদি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তবে নির্বাচন কমিশন গঠনের আলোচনায় গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুও বিবেচনায় আসতে পারে। আলোচনা হলেই তো গুমোট ভাব দূর হবে, দরজা খুলে যাবে, সুবাতাস বইতে শুরু করবে এবং শেষতক একটি সমাধানেও হয়তো আসা যাবে।
রাষ্ট্রপতির সংলাপ সফল হলে উত্তম, রাজনৈতিক অচলাবস্থা কেটে গেলে আরও উত্তম, আগামী নির্বাচনের সমঝোতায় এগিয়ে যেতে পারলে তো সর্বোত্তম। কিন্তু যদি এ সংলাপ ব্যর্থ হয় তবে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগের ঝুঁকি কাদের ওপর কতটুকু বর্তাবে? আওয়ামী লীগ সরকার তখন হয়তো আরও হার্ডলাইনে চলে যাবে, বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কাবু করার জন্য সব প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে চাইবে আর বিএনপি তখন মিত্রদের নিয়ে আন্দোলন বেগবান করতে সচেষ্ট হবে। ফলে আবার রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রপতির ইমেজ করুণ দশায় পড়তে পারে। তখন রাষ্ট্রপতির এক মাথার চেয়ে অনেক মাথার বুদ্ধি যে বাস্তবে ফলপ্রসূ নাও হতে পারে সেটাই প্রমাণ হয়ে যেতে পারে। অতএব রাষ্ট্রপতি যদি প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিতেও উদ্যোগটা নিয়ে থাকেন তারপরও ঝুঁকি কিন্তু থেকেই গেল। যে যাই বলুক, এ ঝুঁকিটা মোটেই থাকে না যদি শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া একটা সুষ্ঠু সমাধান চান। আমরা এ দুই নেত্রীর কাছে রাষ্ট্রপতির সংলাপকে ঝুঁকিমুক্ত করে ফলপ্রসূ করার আন্তরিকতা চাইব।
বদিউর রহমান :সাবেক চেয়ারম্যান
এনবিআর
ঝুঁকি বা ইঙ্গিতের বিষয়টি আমরা একটু বিশ্লেষণ করে দেখি। ঝুঁকি না বলে একে কেউ কেউ রাষ্ট্রপতির সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশও ভাবতে চাইতে পারেন, কিন্তু সেটা যুক্তিতে টেকে না। কারণ রাষ্ট্রপতির এককভাবে এমন সদিচ্ছা পোষণের কোনো ক্ষেত্র আছে বলে তো দেখা যায় না। সাংগঠনিক ক্ষমতায় প্রধান বিচারপতি এবং প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ছাড়া অন্য সব বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কার্য সম্পাদন করবেন মর্মে সে সীমাবদ্ধতা তার জন্য প্রস্তুত করে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া সেটা উতরানোর তার ক্ষমতা নেই। অতএব সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনে কাউকে রাষ্ট্রপতির পছন্দ হলেও, এমনকি অন্য অনেক দলের তাতে সমর্থন থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি না থাকলে তিনি কি তাকে নিয়োগ দিতে পারবেন? প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে সুপারিশকৃত হয়ে না এলে রাষ্ট্রপতি কি নিজে নিজে নিয়োগ অনুমোদন করে তার প্রজ্ঞাপন জারি এবং তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন? সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে কি প্রজ্ঞাপন জারি সম্ভব হবে? হলেও কি তা আইনি ক্ষমতায় শুদ্ধ হবে? অতএব প্রচলিত সিস্টেমে রাষ্ট্রপতি চাইলেই তার ক্ষমতার প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সংলাপের বিষয়টি তাই তার সদিচ্ছার একটা ক্ষমতাহীন বহিঃপ্রকাশ হতে পারে মাত্র। তাই কোনো প্রকার ইঙ্গিত অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সবুজ সংকেত ছাড়া এমন সংলাপ হলে তা পুরোপুরিই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে হলেও এটা ঝুঁকিমুক্ত নয় এ জন্য যে, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে সংলাপ হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতির পছন্দেই কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য নয়, যদি না সে সিদ্ধান্তেও প্রধানমন্ত্রী সম্মত না হন। তাহলে ঘুরেফিরে আবার কথা একই হয় যে, রাষ্ট্রপতি ঝুঁকি নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন আসে, তিনি কেন এ ঝুঁকি নিলেন?
আমরা দেশের হাল-অবস্থা বিবেচনায় এমন ভাবতে পারি যে, দ্রুত অগ্রসরমান রাজনৈতিক জটিলতায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ হয়তো আর বেশি এগোতে চায় না। এটা স্বাভাবিক যে, আওয়ামী আমলে যদি রাজনৈতিক জটিলতায় পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হয় তবে তার ষোলআনা দায় প্রথম ঠেলায় আওয়ামী লীগ সরকারের ওপরই বর্তাবে। শুধু অভ্যন্তরীণ বিবেচনায় নয়, আন্তর্জাতিক বিবেচনায়ও এ ব্যর্থতাকে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। দুটি কারণে আওয়ামী লীগ সরকার এমন দায় নিতে চাইবে না। এক. আওয়ামী লীগ সরকারের ৫ বছরের মেয়াদ জাতীয় নির্বাচনের কোনো ব্যর্থতার জন্য প্রশ্নের সম্মুখীন হোক, সেটা সরকার তথা আওয়ামী লীগ চাইবে না। চাইবে না অন্তত এ জন্য যে, একবার দলীয় সরকার ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে গেলে জনমনে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা বেড়ে যাবে। তৃণমূল পর্যায়ে সুসংগঠিত বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তেমন ব্যর্থতা অবশ্যই চাইবে না। দুই. পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে স্বীকৃতভাবে নিজেদের অর্জন তুলে ধরতে হলে এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে হলেও জাতীয় নির্বাচনের কোনো বাধা বা প্রতিবন্ধকতা এ সরকার নিজেদের স্বার্থেই সৃষ্টি করতে চাইবে না। কারণ দলটির সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিশ্চয়ই পরবর্তী মেয়াদেও সরকারে আসা এবং শুধু সরকারে আসাই নয়, বরং সুষ্ঠুভাবে সে সরকারও ৫ বছরের জন্য টিকিয়ে রাখা। এমন উদ্দেশ্য যেহেতু রয়েছে সেহেতু জাতীয় নির্বাচন দেশে-বিদেশে স্বীকৃত এবং সমর্থনযোগ্য হতে হবে। অতএব এমন বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা চাইতেই পারেন। দলীয় সরকারের এমন ধারণা থাকা অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, নির্বাচন কমিশন গঠনে যদি কোনোভাবে নূ্যনতম রাজনৈতিক সমঝোতায় পেঁৗছানো সম্ভব হয় তাহলে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের জন্য একধাপ তারা এগিয়ে যেতে সক্ষম হলো। আর এর পরের পদক্ষেপ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টায়ও এগোনো হয়তো সহজ হতে পারে।
মুখে যেহেতু শেখ হাসিনা এবং দলীয় নেতারা দলীয় সরকারের অধীনে পঞ্চদশ সংশোধনী অনুসারে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বারবার বলে আসছেন, ভেতরে কিন্তু বিরোধী চাপ অনুভব করছেন। অতএব রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা এগিয়ে নিলে যদি কোনো সমাধানে পেঁৗছা যায় মন্দ কী। এতে সরকারের অন্তত তিনটা নগদ লাভ আছে ভাবা যায়_ এক. বিএনপির রোডমার্চের উত্তাপে এমন সংলাপ কিছুটা পানি ঢেলে দেওয়ার কাজ করবে। দুই. বিএনপি যেহেতু সংসদেও যাচ্ছে না, অন্য কোনোভাবেও কোনো আলোচনায় আসছে না, এ সংলাপের মাধ্যমে এ দলকে আলোচনায় আনার একটা সার্থকতা থাকতে পারে। তিন. আন্তর্জাতিকভাবেও একটা ভাবমূর্তি অর্জন করা যেতে পারে যে, সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব যখন বলেন, এ সংলাপ প্রধানমন্ত্রী করলেই ভালো হতো, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বিএনপিও একটা সুযোগ খুঁজছে সংলাপের জন্য। তবে শেখ হাসিনা নিজে তা করতে যাননি হয়তো এ জন্য যে, তাহলে তার সরাসরি প্রস্তাবকে বিএনপি আওয়ামী দুর্বলতা ভাবতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে যদি বিএনপি সরাসরি 'না' বলে দেয় সেটা সরকার এবং আওয়ামী লীগের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর হয়ে যাবে। অতএব রাষ্ট্রপতিই এ জন্য উত্তম মাধ্যম। রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে এবং নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে তাকে অবহেলা করলে অর্থাৎ আলোচনায় না এলে বিএনপি সমালোচিত হবে বেশি। নির্বাচন কমিশন গঠনের আলোচনায় গিয়ে যদি বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু নিয়েও আলোচনা করতে চায় সেটাও একটা বরফ গলানো অবস্থার সৃষ্টি করবে বটে। মন্দ কী, পিং পং খেলার উসিলায় চীনের সঙ্গে যদি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তবে নির্বাচন কমিশন গঠনের আলোচনায় গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুও বিবেচনায় আসতে পারে। আলোচনা হলেই তো গুমোট ভাব দূর হবে, দরজা খুলে যাবে, সুবাতাস বইতে শুরু করবে এবং শেষতক একটি সমাধানেও হয়তো আসা যাবে।
রাষ্ট্রপতির সংলাপ সফল হলে উত্তম, রাজনৈতিক অচলাবস্থা কেটে গেলে আরও উত্তম, আগামী নির্বাচনের সমঝোতায় এগিয়ে যেতে পারলে তো সর্বোত্তম। কিন্তু যদি এ সংলাপ ব্যর্থ হয় তবে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগের ঝুঁকি কাদের ওপর কতটুকু বর্তাবে? আওয়ামী লীগ সরকার তখন হয়তো আরও হার্ডলাইনে চলে যাবে, বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কাবু করার জন্য সব প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে চাইবে আর বিএনপি তখন মিত্রদের নিয়ে আন্দোলন বেগবান করতে সচেষ্ট হবে। ফলে আবার রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রপতির ইমেজ করুণ দশায় পড়তে পারে। তখন রাষ্ট্রপতির এক মাথার চেয়ে অনেক মাথার বুদ্ধি যে বাস্তবে ফলপ্রসূ নাও হতে পারে সেটাই প্রমাণ হয়ে যেতে পারে। অতএব রাষ্ট্রপতি যদি প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিতেও উদ্যোগটা নিয়ে থাকেন তারপরও ঝুঁকি কিন্তু থেকেই গেল। যে যাই বলুক, এ ঝুঁকিটা মোটেই থাকে না যদি শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া একটা সুষ্ঠু সমাধান চান। আমরা এ দুই নেত্রীর কাছে রাষ্ট্রপতির সংলাপকে ঝুঁকিমুক্ত করে ফলপ্রসূ করার আন্তরিকতা চাইব।
বদিউর রহমান :সাবেক চেয়ারম্যান
এনবিআর
No comments