দুই অবিস্মরণীয় অগ্রজ by আহমদ রফিক
যেমন ঈশ্বরের পৃথিবীতে তেমনি ঈশ্বরহীন পৃথিবীতেও মাঝে মধ্যে বড় বিস্ময় আমাদের স্পর্শ করে যায়। আনন্দ ও বিস্ময়ে এর পারস্পরিকতা। বাংলাদেশি সাহিত্যের দুই দিকপাল_ কবিতায় আহসান হাবীব, কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান_ আমার সর্বাধিক প্রিয় দুই সাহিত্যস্রষ্টাকে একই দিনে সৌভাগ্য যে স্মরণ করতে পারছি। আশ্চর্য যে, দু'জনেরই জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি। তারা দু'জন আমাদের সাহিত্যের দুটি শীর্ষবিন্দু দু'হাতে ধরে আছেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের আমরা অপেক্ষাকৃত কম স্মরণ করি। তুলনায় সমকালীনদের জন্মদিন সুবাদে হয়তো একটু বেশিই আয়োজন-আড়ম্বর করি, এমনকি শিরোপা দিই। ভুলে যাই যে, বাংলাদেশি সাহিত্যের (কবিতা ও কথাসাহিত্যের) প্রাথমিক ভিতটা তারাই মজবুত করে গড়ে দিয়েছিলেন।
আমরা বাঙালি। এ দেশের জল-হাওয়া, আকাশ-মৃত্তিকা ও গাছগাছালির রূপময়তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যেন কবিতার এক রূপময় ভুবন তৈরি করে দেয়। তাই কবিকেই প্রথম স্মরণ করি। এ দেশীয় এক কবির ভাষায় সব কবি কবি নয়, কেউ কেউ কবি। সেই প্রকৃত কবিদের একজন আহসান হাবীব রাজপথে দাঁড়িয়েও মাটি ও জলস্রোতের টানে আবহমান বাংলার ছবি আঁকেন। নম্রকণ্ঠ এই কবির কলম 'সামান্যার সোহাগ খরিদ করে চিরন্তনীর অভাব মেটাতে' চাননি।
আর চাননি বলেই আহসান হাবীবের কবিতায় 'রেড রোডে' যেমন রাত্রি শেষের আকাঙ্ক্ষিত আলোর চিত্র দেখা দেয়, তেমনি শব্দচিত্রে উঠে আসে গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার জীবন্ত মিছিল। খেটে-খাওয়া মানুষের স্বপ্ন ও জীবন-সংগ্রামের ছবি। শংকরপাশা গ্রামের প্রতীকে গ্রামবাংলা, মহানগর কলকাতার সংগ্রামী রাজপথ থেকে শহর ঢাকার রাজপথের রক্তভেজা ছবি এক কথায় আহসান হাবীবের কবিতার প্রেরণা হয়ে ওঠে। নেপথ্যে মানুষ_ সংগ্রামী মানুষ, দুস্থ মানুষ।
গ্রামবাংলা আহসান হাবীবের কবিতার বড় একটা প্রেক্ষাপট। অথচ আশ্চর্য, তারুণ্যে গ্রাম থেকে পালিয়ে আসার পর আহসান হাবীব আমৃত্যু নগরবাসী। কিন্তু তার চৈতন্যে নদীমাতৃক গ্রামবাংলা সর্বদা দুন্দুভি বাজায়। একদিকে কৃষক-কুমার-কামার, অন্যদিকে শহুরে শ্রমজীবী মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা তার কবিতার আগাপাছতলা সমানভাবে আলোড়িত করে।
তাই শিল্পের জন্য শিল্পের বিপরীত আদর্শে ভর করে তিনি বলতে পারেন :'ক্ষুধার রাজ্যে কবিতা কিছু বলবার দায়িত্ব নিয়ে থাকে। ...শ্রেণীবৈষম্যের অভিশাপ, মধ্যবিত্ত জীবনের কৃত্রিমতা এবং উদ্ভ্রান্ত উদ্বাস্তু যৌবনের যন্ত্রণা আজো পর্যন্ত আমার কবিতার বিষয়বস্তু।'
দুই.
আর কথাশিল্পী শওকত ওসমান (যিনি মূলত কথাশিল্পী হয়েও স্যাটায়ার-ঋদ্ধ ছড়াকার) তিনিও সমাজসচেতন, জীবনঘনিষ্ঠ এমন একজন সাহিত্যস্রষ্টা, যিনি নিরীশ্বরবাদিতার সঙ্গে মানবিক চেতনার চরিত্রকে একই সামর্থ্যে ধারণ করেন। কিন্তু সমাজ ব্যবচ্ছেদে তার হাতে শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার স্যাটায়ার। এদিক থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যে তার তুলনা চোখে পড়ে না।
আহসান হাবীবে যা প্রচ্ছন্ন (হয়তো কবিতা বলে) শওকত ওসমানে তার তীব্র-তীক্ষষ্ট প্রকাশ। তাই তিনি সোজাসাপটা বলতে পারেন : "আমি ব্যক্তিগতভাবে 'শিল্পের জন্য শিল্প' এই গোত্রভুক্ত নই।... যেহেতু লেখক সামাজিক জীব, তার পক্ষে দায়িত্ব এড়ানো নিছক অকৃতজ্ঞতা।" এখানে শওকত ওসমানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মতাদর্শের পরিচয় মেলে। অনেকটা সহযাত্রী আহসান হাবীবের মতোই তিনি সমাজসচেতনতা ও মানবিক চেতনা দুই-ই সমান গুরুত্বে ধারণ করেন।
যে বিরলসংখ্যক সাহিত্যস্রষ্টা রোমান্টিকতার রঙিন চত্বর পেরিয়ে নির্মেদ, নির্ভার, ঋজু ঝকঝকে গদ্য ভাষাকে তার রচনার মাধ্যম করে তুলতে পারেন, তাদের মধ্যে অসামান্য শওকত ওসমান। ছোটগল্পে বা হালকা নিবন্ধে এবং তার শেষ বয়সের লেখা কলাম চতুষ্পদী বা ষট্পদী ছড়ায় উলি্লখিত গুণাবলি স্পষ্ট, তেমনি তীক্ষষ্ট উপন্যাসের বাকভঙ্গিতে বা বিষয়গত তির্যক সাহসিকতায়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাটা ঈষৎ পাল্টে নিয়ে বলা যায়, 'স্যাটায়ার' ও 'উইটে'র সমন্বিত উপস্থাপনায় ঈশ্বর বা ধর্মীয় রক্ষণশীলতা শওকত ওসমানের সৃষ্টিকর্ম থেকে নির্বাসিত। আর সম্প্রদায় চেতনার বিরুদ্ধে এই সাহসী যোদ্ধা বরাবর সোচ্চার, একই সঙ্গে প্রতিবাদী ও আপসহীন। একাধিক ছোটগল্পে বা সংক্ষিপ্ত উপন্যাসে তেমন প্রমাণ মেলে।
কিন্তু তার বড় লড়াইটা বোধহয় সমাজে প্রচলিত সামন্ত চেতনার বিরুদ্ধে, ধর্মীয় ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে। এদিক থেকে 'লাল সালু'র ওয়ালিউল্লাহর সঙ্গে তার যথেষ্ট মিল। আমাদের মেট্রোপলিটন মন যে মননধর্মিতার ক্ষেত্রে আধুনিকতার বিবেচনায় অনেক পিছিয়ে, এ সত্য শওকত ওসমানকে অনেক পীড়া দিয়েছে। লেখায় বা আলাপচারিতায় তা স্পষ্ট। কিন্তু তিনি নিজে আধুনিক নাগরিক চেতনার যথার্থ প্রতিনিধি। আজ এ দুই অগ্রজকে স্মরণ করি, যাতে আমরা তাদের আরাধ্য গন্তব্যে পেঁৗছতে পারি এ কালের শক্তিতে-সামর্থ্যে, সেই সঙ্গে সাহসিকতায়।
আহমদ রফিক : ভাষাসংগ্রামী
প্রাবন্ধিক, গবেষক
আমরা বাঙালি। এ দেশের জল-হাওয়া, আকাশ-মৃত্তিকা ও গাছগাছালির রূপময়তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যেন কবিতার এক রূপময় ভুবন তৈরি করে দেয়। তাই কবিকেই প্রথম স্মরণ করি। এ দেশীয় এক কবির ভাষায় সব কবি কবি নয়, কেউ কেউ কবি। সেই প্রকৃত কবিদের একজন আহসান হাবীব রাজপথে দাঁড়িয়েও মাটি ও জলস্রোতের টানে আবহমান বাংলার ছবি আঁকেন। নম্রকণ্ঠ এই কবির কলম 'সামান্যার সোহাগ খরিদ করে চিরন্তনীর অভাব মেটাতে' চাননি।
আর চাননি বলেই আহসান হাবীবের কবিতায় 'রেড রোডে' যেমন রাত্রি শেষের আকাঙ্ক্ষিত আলোর চিত্র দেখা দেয়, তেমনি শব্দচিত্রে উঠে আসে গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার জীবন্ত মিছিল। খেটে-খাওয়া মানুষের স্বপ্ন ও জীবন-সংগ্রামের ছবি। শংকরপাশা গ্রামের প্রতীকে গ্রামবাংলা, মহানগর কলকাতার সংগ্রামী রাজপথ থেকে শহর ঢাকার রাজপথের রক্তভেজা ছবি এক কথায় আহসান হাবীবের কবিতার প্রেরণা হয়ে ওঠে। নেপথ্যে মানুষ_ সংগ্রামী মানুষ, দুস্থ মানুষ।
গ্রামবাংলা আহসান হাবীবের কবিতার বড় একটা প্রেক্ষাপট। অথচ আশ্চর্য, তারুণ্যে গ্রাম থেকে পালিয়ে আসার পর আহসান হাবীব আমৃত্যু নগরবাসী। কিন্তু তার চৈতন্যে নদীমাতৃক গ্রামবাংলা সর্বদা দুন্দুভি বাজায়। একদিকে কৃষক-কুমার-কামার, অন্যদিকে শহুরে শ্রমজীবী মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা তার কবিতার আগাপাছতলা সমানভাবে আলোড়িত করে।
তাই শিল্পের জন্য শিল্পের বিপরীত আদর্শে ভর করে তিনি বলতে পারেন :'ক্ষুধার রাজ্যে কবিতা কিছু বলবার দায়িত্ব নিয়ে থাকে। ...শ্রেণীবৈষম্যের অভিশাপ, মধ্যবিত্ত জীবনের কৃত্রিমতা এবং উদ্ভ্রান্ত উদ্বাস্তু যৌবনের যন্ত্রণা আজো পর্যন্ত আমার কবিতার বিষয়বস্তু।'
দুই.
আর কথাশিল্পী শওকত ওসমান (যিনি মূলত কথাশিল্পী হয়েও স্যাটায়ার-ঋদ্ধ ছড়াকার) তিনিও সমাজসচেতন, জীবনঘনিষ্ঠ এমন একজন সাহিত্যস্রষ্টা, যিনি নিরীশ্বরবাদিতার সঙ্গে মানবিক চেতনার চরিত্রকে একই সামর্থ্যে ধারণ করেন। কিন্তু সমাজ ব্যবচ্ছেদে তার হাতে শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার স্যাটায়ার। এদিক থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যে তার তুলনা চোখে পড়ে না।
আহসান হাবীবে যা প্রচ্ছন্ন (হয়তো কবিতা বলে) শওকত ওসমানে তার তীব্র-তীক্ষষ্ট প্রকাশ। তাই তিনি সোজাসাপটা বলতে পারেন : "আমি ব্যক্তিগতভাবে 'শিল্পের জন্য শিল্প' এই গোত্রভুক্ত নই।... যেহেতু লেখক সামাজিক জীব, তার পক্ষে দায়িত্ব এড়ানো নিছক অকৃতজ্ঞতা।" এখানে শওকত ওসমানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মতাদর্শের পরিচয় মেলে। অনেকটা সহযাত্রী আহসান হাবীবের মতোই তিনি সমাজসচেতনতা ও মানবিক চেতনা দুই-ই সমান গুরুত্বে ধারণ করেন।
যে বিরলসংখ্যক সাহিত্যস্রষ্টা রোমান্টিকতার রঙিন চত্বর পেরিয়ে নির্মেদ, নির্ভার, ঋজু ঝকঝকে গদ্য ভাষাকে তার রচনার মাধ্যম করে তুলতে পারেন, তাদের মধ্যে অসামান্য শওকত ওসমান। ছোটগল্পে বা হালকা নিবন্ধে এবং তার শেষ বয়সের লেখা কলাম চতুষ্পদী বা ষট্পদী ছড়ায় উলি্লখিত গুণাবলি স্পষ্ট, তেমনি তীক্ষষ্ট উপন্যাসের বাকভঙ্গিতে বা বিষয়গত তির্যক সাহসিকতায়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাটা ঈষৎ পাল্টে নিয়ে বলা যায়, 'স্যাটায়ার' ও 'উইটে'র সমন্বিত উপস্থাপনায় ঈশ্বর বা ধর্মীয় রক্ষণশীলতা শওকত ওসমানের সৃষ্টিকর্ম থেকে নির্বাসিত। আর সম্প্রদায় চেতনার বিরুদ্ধে এই সাহসী যোদ্ধা বরাবর সোচ্চার, একই সঙ্গে প্রতিবাদী ও আপসহীন। একাধিক ছোটগল্পে বা সংক্ষিপ্ত উপন্যাসে তেমন প্রমাণ মেলে।
কিন্তু তার বড় লড়াইটা বোধহয় সমাজে প্রচলিত সামন্ত চেতনার বিরুদ্ধে, ধর্মীয় ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে। এদিক থেকে 'লাল সালু'র ওয়ালিউল্লাহর সঙ্গে তার যথেষ্ট মিল। আমাদের মেট্রোপলিটন মন যে মননধর্মিতার ক্ষেত্রে আধুনিকতার বিবেচনায় অনেক পিছিয়ে, এ সত্য শওকত ওসমানকে অনেক পীড়া দিয়েছে। লেখায় বা আলাপচারিতায় তা স্পষ্ট। কিন্তু তিনি নিজে আধুনিক নাগরিক চেতনার যথার্থ প্রতিনিধি। আজ এ দুই অগ্রজকে স্মরণ করি, যাতে আমরা তাদের আরাধ্য গন্তব্যে পেঁৗছতে পারি এ কালের শক্তিতে-সামর্থ্যে, সেই সঙ্গে সাহসিকতায়।
আহমদ রফিক : ভাষাসংগ্রামী
প্রাবন্ধিক, গবেষক
No comments