মোটরসাইকেলের প্রথম আরোহী by শেখ রোকন

 এই লেখায় ব্যবহৃত আলোকচিত্রটি বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র 'দ্য মোটরসাইকেল ডাইরিজ' থেকে নেওয়া। মোটরসাইকেল চালক রডরিগো ডি লা সারনা যার ভূমিকায় ওই ছবিতে অভিনয় করেছেন, সেই আলবার্তো গ্রানাদো মার্চের পঞ্চম দিন কিউবার হাভানায় বয়সোচিত মৃত্যুবরণ করেছেন। স্ত্রী ও তিন পুত্র-কন্যা ছাড়াও তিনি রেখে গেছে ৮৮ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন।
কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে ওই মোটরসাইকেল যাত্রাটিই।
১৯৫১ সালের ডিসেম্বরে লাতিন আমেরিকা ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন গ্রানাদো। শেষ হয়েছিল পরের বছরের জুলাইয়ে। সঙ্গে ছিলেন আর্নেস্তো চে গুয়েভারা, এত বছর পরও বিশ্বব্যাপী তারুণ্যের প্রতীক হয়ে থাকা মার্কসবাদী বিপ্লবী। আর্জেন্টিনার বুয়েন্সআয়ারস থেকে ভেনিজুয়েলা পর্যন্ত আট মাসের ওই ভ্রমণ এখনও কিংবদন্তি। ১৯৩৯ মডেলের একটি নরটন ৫০০ সিসি মোটরসাইকেলে করে দু'জন যাত্রা শুরু করেছিলেন। গ্রানাদোর নিজের ভাষায়, বাহনটি ছিল 'প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের মতো'। এর কারিগরি ত্রুটির অন্ত ছিল না। তা সত্ত্বেও কেবল অদম্য ইচ্ছা সম্বল করে তারা বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু মোটরসাইকেলটি কিউবার সান্তিয়েগো যাওয়ার পর আর সইতে পারেনি। একেবারে ভেঙে পড়ে। সেটাকে সেখানে ফেলে রেখেই চে ও গ্রানাদো জাহাজ, বাস ও হাতে তৈরি ভেলায় উত্তরে ভ্রমণ করতে থাকেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ আমেরিকা পরিস্থিতি সচক্ষে দেখা। পরে গ্রানাদো বলেছেন, মোটরসাইকেল ভেঙে পড়া তাদের জন্য শাপে বর হয়েছিল। পরবর্তী যাত্রার বাহন ও রসদ জোগাড় করতে গিয়ে তারা প্রকৃত অর্থে মানুষের কাছাকাছি পেঁৗছে যান।
'৫২ সালের জুলাইয়ে কারাকাসে পেঁৗছার পর গ্রানাদো ক্ষান্ত দেন। সেখানে এক ল্যাবরেটরিতে চাকরি নেন। আর চে এগিয়ে চলেন আরও উত্তরে মিয়ামির দিকে। যৌথ ওই ভ্রমণের সময় চে ও গ্রানাদো নিয়মিত ডায়েরি লিখেছেন। পরে সেগুলো নিয়ে পুস্তক, চলচ্চিত্র হয়েছে; হয়েছে বিস্তর গবেষণা।
এটা ঠিক, চের যে ভাবমূর্তি ও প্রভাব, তার তুলনায় গ্রানাদো হয়তো অনেক পেছনে। কিন্তু ওই ভ্রমণ কিংবা তার আগের দিনগুলোতে গ্রানাদোই ছিলেন চের অনেকটা পথপ্রদর্শক। আর্জেন্টিনার কোরদোবা শহরে দু'জনের যখন পরিচয় হয়, গ্রানাদো তখন ওই শহরের পরিচিত মুখ_ পৈতৃকসূত্রে বামপন্থি চিন্তাধারায় দীক্ষিত, মেধাবী ছাত্র এবং শহরের রাগবি দলের ক্যাপ্টেন। তার ছয় বছরের ছোট ভাই টমাসের সঙ্গে স্কুলে পড়ত কিশোর আর্নেস্তো। সেই গ্রানাদোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল রাগবি দলে সুযোগ পাওয়ার প্রত্যাশায়। স্বপ্নময় চেকে পছন্দ হয়েছিল গ্রানাদোর। জ্যেষ্ঠ বন্ধুর মতো নিজের রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা বিনিময় করতেন তার সঙ্গে। গ্রানাদো যখন কোরদোবা ইউনিভার্সিটিতে বায়োকেমিস্ট্রি পড়ছেন, চে গুয়েভারা তখন বুয়েন্সআয়ারস মেডিকেল কলেজের ছাত্র। কিন্তু দু'জনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল।
বড় কথা, লাতিন আমেরিকা ভ্রমণের পরিকল্পনা এসেছিল গ্রানাদোর মাথা থেকেই। তিনি একাই নিজের মোটরসাইকেলটি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। ওই পরিকল্পনার কথা জানার পর চে নিজ থেকেই তার সঙ্গী হয়েছিলেন। অগ্রজ গ্রানাদো, গ্রানাদোর পরিকল্পনা, গ্রানাদোর মোটরসাইকেল, চালকের আসনেও স্বভাবতই গ্রানাদো। ওই ভ্রমণে চে ছিলেন দ্বিতীয় আরোহী, গ্রানাদোর পেছনে। কিন্তু ওই ভ্রমণ চের জীবন আমূল পাল্টে দিয়েছিল। চিকিৎসক চে বিপ্লবীতে পরিণত হয়েছিলেন। আর গ্রানাদো তার রাজনৈতিক উপলব্ধিসহ ফিরে গিয়েছিলেন নিজের প্রাণরাসায়নিক জগতে। পরে তিনিও বিখ্যাত হয়েছেন। রাজনৈতিক মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া ও বিপ্লবী সংগ্রহের কাজও করেছেন আর্জেন্টিনায়। সম্মুখযুদ্ধে মরতে মরতে বেঁচেও গিয়েছেন কয়েকবার। আজীবন পার্টির সঙ্গে ছিলেন। তবে তার মূল ক্ষেত্র, গবেষণা ও অধ্যাপনা থেকে বিচ্যুত হননি। আর কে না জানে, ফলাফল যাই হোক রাজনীতি ও বিপ্লবই তরুণদের বেশি আকর্ষণ করে। গবেষণা ও অধ্যাপনা নয়।
 

No comments

Powered by Blogger.