ফিরে দেখা-উত্তাল মার্চে বঙ্গবন্ধু ও আমাদের গণমাধ্যম by শেখ আবদুস সালাম
এ দেশের পত্রিকাগুলো সে সময়ে আন্দোলনের গতি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে চলমান আলোচনা সবকিছুকে পর্যবেক্ষণ করে ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কেও যথাযথভাবে হুশিয়ারি-সাবধানতা উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়েছিল
বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য আমাদের সমাজ মানসে রূপান্তরের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর অনবরত নিবিষ্ট নেতৃত্বে। ১৯৭০ সালের শেষ এবং '৭১ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের ইস্যুটিই কেবল তখন বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তানের) আপামর জনসাধারণের মুখে এবং মনে ঘুরেফিরে আলোচিত এবং আন্দোলিত হচ্ছিল। বাঙালিরা পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনার, দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তথা বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথ অন্বেষণের চিন্তা-ভাবনায় সাংবিধানিক পরিষদের সভা অনুষ্ঠান ও বাঙালির হাতে ক্ষমতার্পণের মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্য ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছিল। ঠিক সেই পরিস্থিতিতে ১ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। সঙ্গে সঙ্গে পুরো পূর্ব বাংলা এবং বাঙালি জাতি ক্ষোভে ফেটে পড়ল। এ ক্ষোভকে অত্যন্ত ধৈর্র্যের সঙ্গে সৃজনশীলভাবে একটি স্বাধীন জাতির অভ্যুদয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তা করেছিলেন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে। তার ডাকে ১ মার্চ থেকে দেশব্যাপী শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। তিনি এই দিন হোটেল পূর্বাণীতে জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘোষণার তীব্র নিন্দা করে বললেন, সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে কার্যত দেশের গণতান্ত্রিক পথে এগোনোর উপায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে_ এ পরিস্থিতিতে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আওয়ামী লীগ তাকে দান করেছে।
এ দেশের সব পত্রপত্রিকাও তখন বঙ্গবন্ধুর এ অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে সম্মান জানায়। ব্যাপক জনসমর্থনের ফলে এ আন্দোলন শুরু থেকে এমনই এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি অর্জন করে যে, একে সমর্থন না জানিয়েও উপায় ছিল না কোনো পত্রিকারই। এমনকি ঘোর পাকিস্তানপন্থি পত্রিকা মর্নিং নিউজ এবং জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক পত্রিকা সংগ্রামও তখন অন্য পত্রিকার সঙ্গে এককাতারে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। ১ মার্চ জারিকৃত ১১০ নং সামরিক বিধিতে বলা হয়_ 'পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো ছবি, খবর, অভিমত, বিবৃতি, মন্তব্য প্রভৃতি মুদ্রণ বা প্রকাশ থেকে সংবাদপত্রসমূহকে বারণ করা হচ্ছে। এই আদেশ লঙ্ঘন করা হলে সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর কারাদণ্ড।' কিন্তু সে সময়ের আন্দোলনের দুর্বার গতিতে ভেসে যায় এসব সামরিক ফরমান। ৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন এক সভায় গণআন্দোলনের সঙ্গে সাংবাদিককুলের একাত্মতা ঘোষণা করে। সে সময় এভাবে কেবল সংবাদপত্রগুলোই নয়, সাংবাদিকদেরও এ আন্দোলনে সমর্থন এবং অংশগ্রহণ ছিল সর্বাত্মক।
বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ সম্ভবত স্বাধীনতা শব্দটি প্রথম উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, 'বাংলার স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ সারাবিশ্বের সামনে প্রমাণ করবে যে, বাঙালিরা আর উৎপীড়িত হতে চায় না, তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচতে চায়, বাংলা আর কারো উপনিবেশ বা বাজার হয়ে থাকবে না।' তিনি এদিন ১ এবং ২ মার্চে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে ৩ মার্চ জাতীয় শোকদিবস এবং ৩ থেকে ৬ মার্চ ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দেশে হরতাল পালন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে গণসমাবেশের ডাক দেন। তিনি সংবাদপত্র, বেতার ও টিভি কর্মচারীদের বাঙালির পক্ষে খবর প্রচারে বাধা দিলে তাদেরও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।
৭ মার্চের আগ পর্যন্ত সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে যেন একদিকে আন্দোলনের সাজসাজ রব; অন্যদিকে তরুণদের মধ্যে এক ধরনের 'যুদ্ধের প্রস্তুতি' অবস্থা বিরাজ করছিল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ডাক- 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল... এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'; পরদিন দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায়, বিশেষ করে রেডিওতে তার ভাষণ প্রচার সারা বাংলাদেশে যেন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিল।
৮ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। ১০ এবং ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু দুটি দীর্ঘ বিবৃতি প্রদান করেন। সে সময়ের পত্রপত্রিকাসহ গণমাধ্যমের খবর পরিবেশনার প্রধান উপজীব্যই ছিল এসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের খুঁটিনাটি বিবরণ এবং সে সময়ের অসহযোগ আন্দোলনের অনুপুঙ্খ উপস্থাপন। সে সময়ের বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় উচ্চারণ_'বাংলাদেশের মুক্তির স্পৃহাকে স্তব্ধ করা যাবে না। আমাদের কেউ পরাভূত করতে পারবে না, কারণ প্রয়োজনে আমরা মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত। জীবনের বিনিময়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বাধীন দেশের মুক্ত মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে আর মর্যাদার সঙ্গে বাস করার নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে চাই। মুক্তির লক্ষ্যে না পেঁৗছা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম নবতর উদ্দীপনা নিয়ে অব্যাহত থাকবে। আর সে জন্য জনগণকে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।' গোটা বাঙালি জাতিকে এক স্বপ্নের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এভাবে অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই আসলে বঙ্গবন্ধুর লালিত আকাঙ্ক্ষা 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা' যেন আস্তে আস্তে সমগ্র জাতির মানস পর্দায় ভেসে ওঠে।
১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সে সময়ের পত্রিকার আধেয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ সময়ে দৈনিক সংবাদ আন্দোলনের খবর দিয়ে ব্যানার করেছে ৬ বার, সম্পাদকীয় লিখেছে ২০টি এবং ছবি ছেপেছে ৯৩টি। দৈনিক ইত্তেফাকে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৬টি, ১৯টি এবং ১১৫টি। সে সময়ে দৈনিক আজাদ ব্যানার শিরোনাম করেছে ১২টি, সম্পাদকীয় লিখেছে ১৫টি এবং ছবি ছেপেছে ১৫৫টি। সরকারি মালিকানাধীন মর্নিং নিউজ ব্যানার শিরোনাম করেছে ৩টি, সম্পাদকীয় ১৪টি এবং ছবি ছেপেছে ৯৪টি। একই সময়ে পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় ব্যানার করা হয়েছিল ৮টি, সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল ১৫টি এবং ছবি ছাপা হয়েছিল ৯৪টি। পত্রিকাগুলোতে প্রতিদিনের লিড স্টোরি থাকত আন্দোলন-সংগ্রাম সংক্রান্ত। সে সময়ের পত্রিকাগুলোর সম্পাদকীয় শিরোনাম যেমন : 'ক্ষান্ত হউন' (ইত্তেফাক, ৪ মার্চ); 'বীর জনগণের প্রতি অভিনন্দন' (সংবাদ, ৭ মার্চ); 'আর সময় নাই' (আজাদ, ১৪ মার্চ) প্রভৃতি জনআন্দোলনকে কেবল সমর্থন জানায়নি_ আন্দোলনে তাদেরকে উদ্দীপনাও জুগিয়েছিল।
লক্ষ্য করা যায়, এ আন্দোলন-সংগ্রামে পত্রিকাগুলো একটি আলাদা ফ্রন্ট হিসেবেও যেন ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময়ে ইংরেজি দৈনিক 'দি পিপল' পত্রিকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে 'অকুপেশন আর্মি' বলে অভিহিত করা হয়েছিল। এ দেশের পত্রিকাগুলো সে সময়ে আন্দোলনের গতি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে চলমান আলোচনা সবকিছুকে পর্যবেক্ষণ করে ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কেও যথাযথভাবে হুশিয়ারি-সাবধানতা উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়েছিল। মাত্র ১১ দিনের মাথায় এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল। ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলল মুক্তিযুদ্ধ। এভাবে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের মানুষ আর বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা সবই মিলেমিশে অসংখ্য ত্যাগ আর বিসর্জনের মধ্য দিয়ে নয় মাসব্যাপী প্রত্যক্ষ করল বাংলদেশ রাষ্ট্রের জন্মের প্রসব বেদনা। বিশ্ব পরিমণ্ডলে যুক্ত হলো আর একটি দেশের নাম আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
ড. শেখ আবদুস সালাম : অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এ দেশের সব পত্রপত্রিকাও তখন বঙ্গবন্ধুর এ অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে সম্মান জানায়। ব্যাপক জনসমর্থনের ফলে এ আন্দোলন শুরু থেকে এমনই এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি অর্জন করে যে, একে সমর্থন না জানিয়েও উপায় ছিল না কোনো পত্রিকারই। এমনকি ঘোর পাকিস্তানপন্থি পত্রিকা মর্নিং নিউজ এবং জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক পত্রিকা সংগ্রামও তখন অন্য পত্রিকার সঙ্গে এককাতারে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। ১ মার্চ জারিকৃত ১১০ নং সামরিক বিধিতে বলা হয়_ 'পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো ছবি, খবর, অভিমত, বিবৃতি, মন্তব্য প্রভৃতি মুদ্রণ বা প্রকাশ থেকে সংবাদপত্রসমূহকে বারণ করা হচ্ছে। এই আদেশ লঙ্ঘন করা হলে সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর কারাদণ্ড।' কিন্তু সে সময়ের আন্দোলনের দুর্বার গতিতে ভেসে যায় এসব সামরিক ফরমান। ৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন এক সভায় গণআন্দোলনের সঙ্গে সাংবাদিককুলের একাত্মতা ঘোষণা করে। সে সময় এভাবে কেবল সংবাদপত্রগুলোই নয়, সাংবাদিকদেরও এ আন্দোলনে সমর্থন এবং অংশগ্রহণ ছিল সর্বাত্মক।
বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ সম্ভবত স্বাধীনতা শব্দটি প্রথম উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, 'বাংলার স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ সারাবিশ্বের সামনে প্রমাণ করবে যে, বাঙালিরা আর উৎপীড়িত হতে চায় না, তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচতে চায়, বাংলা আর কারো উপনিবেশ বা বাজার হয়ে থাকবে না।' তিনি এদিন ১ এবং ২ মার্চে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে ৩ মার্চ জাতীয় শোকদিবস এবং ৩ থেকে ৬ মার্চ ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দেশে হরতাল পালন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে গণসমাবেশের ডাক দেন। তিনি সংবাদপত্র, বেতার ও টিভি কর্মচারীদের বাঙালির পক্ষে খবর প্রচারে বাধা দিলে তাদেরও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।
৭ মার্চের আগ পর্যন্ত সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে যেন একদিকে আন্দোলনের সাজসাজ রব; অন্যদিকে তরুণদের মধ্যে এক ধরনের 'যুদ্ধের প্রস্তুতি' অবস্থা বিরাজ করছিল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ডাক- 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল... এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'; পরদিন দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায়, বিশেষ করে রেডিওতে তার ভাষণ প্রচার সারা বাংলাদেশে যেন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিল।
৮ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। ১০ এবং ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু দুটি দীর্ঘ বিবৃতি প্রদান করেন। সে সময়ের পত্রপত্রিকাসহ গণমাধ্যমের খবর পরিবেশনার প্রধান উপজীব্যই ছিল এসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের খুঁটিনাটি বিবরণ এবং সে সময়ের অসহযোগ আন্দোলনের অনুপুঙ্খ উপস্থাপন। সে সময়ের বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় উচ্চারণ_'বাংলাদেশের মুক্তির স্পৃহাকে স্তব্ধ করা যাবে না। আমাদের কেউ পরাভূত করতে পারবে না, কারণ প্রয়োজনে আমরা মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত। জীবনের বিনিময়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বাধীন দেশের মুক্ত মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে আর মর্যাদার সঙ্গে বাস করার নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে চাই। মুক্তির লক্ষ্যে না পেঁৗছা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম নবতর উদ্দীপনা নিয়ে অব্যাহত থাকবে। আর সে জন্য জনগণকে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।' গোটা বাঙালি জাতিকে এক স্বপ্নের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এভাবে অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই আসলে বঙ্গবন্ধুর লালিত আকাঙ্ক্ষা 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা' যেন আস্তে আস্তে সমগ্র জাতির মানস পর্দায় ভেসে ওঠে।
১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সে সময়ের পত্রিকার আধেয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ সময়ে দৈনিক সংবাদ আন্দোলনের খবর দিয়ে ব্যানার করেছে ৬ বার, সম্পাদকীয় লিখেছে ২০টি এবং ছবি ছেপেছে ৯৩টি। দৈনিক ইত্তেফাকে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৬টি, ১৯টি এবং ১১৫টি। সে সময়ে দৈনিক আজাদ ব্যানার শিরোনাম করেছে ১২টি, সম্পাদকীয় লিখেছে ১৫টি এবং ছবি ছেপেছে ১৫৫টি। সরকারি মালিকানাধীন মর্নিং নিউজ ব্যানার শিরোনাম করেছে ৩টি, সম্পাদকীয় ১৪টি এবং ছবি ছেপেছে ৯৪টি। একই সময়ে পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় ব্যানার করা হয়েছিল ৮টি, সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল ১৫টি এবং ছবি ছাপা হয়েছিল ৯৪টি। পত্রিকাগুলোতে প্রতিদিনের লিড স্টোরি থাকত আন্দোলন-সংগ্রাম সংক্রান্ত। সে সময়ের পত্রিকাগুলোর সম্পাদকীয় শিরোনাম যেমন : 'ক্ষান্ত হউন' (ইত্তেফাক, ৪ মার্চ); 'বীর জনগণের প্রতি অভিনন্দন' (সংবাদ, ৭ মার্চ); 'আর সময় নাই' (আজাদ, ১৪ মার্চ) প্রভৃতি জনআন্দোলনকে কেবল সমর্থন জানায়নি_ আন্দোলনে তাদেরকে উদ্দীপনাও জুগিয়েছিল।
লক্ষ্য করা যায়, এ আন্দোলন-সংগ্রামে পত্রিকাগুলো একটি আলাদা ফ্রন্ট হিসেবেও যেন ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময়ে ইংরেজি দৈনিক 'দি পিপল' পত্রিকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে 'অকুপেশন আর্মি' বলে অভিহিত করা হয়েছিল। এ দেশের পত্রিকাগুলো সে সময়ে আন্দোলনের গতি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে চলমান আলোচনা সবকিছুকে পর্যবেক্ষণ করে ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কেও যথাযথভাবে হুশিয়ারি-সাবধানতা উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়েছিল। মাত্র ১১ দিনের মাথায় এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল। ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলল মুক্তিযুদ্ধ। এভাবে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের মানুষ আর বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা সবই মিলেমিশে অসংখ্য ত্যাগ আর বিসর্জনের মধ্য দিয়ে নয় মাসব্যাপী প্রত্যক্ষ করল বাংলদেশ রাষ্ট্রের জন্মের প্রসব বেদনা। বিশ্ব পরিমণ্ডলে যুক্ত হলো আর একটি দেশের নাম আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
ড. শেখ আবদুস সালাম : অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments