সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
গেল কয়েক দিনে ঢাকার নামিদামি কয়েকটি হাসপাতালে কয়েকজন রোগীর মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠায় সব মহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে উঠেছে। শিশুমৃত্যুর অভিযোগে ইবনে সিনার ডাক্তার, নার্স ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালত থেকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ জারি করা হয়েছে।
আমাদের সংগীত জগতের একজন গুণী শিল্পী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. মৃদুল কান্তি ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে ল্যাব এইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এ হাসপাতালগুলোর বেশ পরিচিতি রয়েছে। ঢাকার এমন নামিদামি হাসপাতালেও রোগীর অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে মাঝেমধ্যেই মিডিয়ায় খবর প্রচারিত হয়। ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রযত্র গজিয়ে ওঠা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার অবহেলা, রোগী মারা যাওয়া নিয়ে অনেক ঘটনাই হরহামেশা ঘটছে। ঢাকার বাইরে ছোট-বড় মফস্বল শহর, উপশহর, উপজেলাসহ সর্বত্র যেসব ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে, সেগুলোর খবর ঢাকার মিডিয়ায় খুব কমই স্থান পাচ্ছে। অল্প কিছু দিন আগে ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও উত্তরায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নাকের অপারেশন করিয়ে প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী হতে বসেছিলাম। সময়মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেকে স্থানান্তর করিয়ে বাঁচা গেল। দেশে অতি আধুনিক থেকে নিম্নমানের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দারুণ ছড়াছড়ি!
সরকারি হাসপাতালগুলোর বেশির ভাগই রোগীর চাপে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাওয়া, দেওয়া-নেওয়া_কোনোটিই ওইগুলোতে সম্ভব হচ্ছে না। যাঁদের প্রচুর অর্থ আছে তাঁরা ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংককসহ পৃথিবীর উন্নত দেশে চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমাচ্ছেন। যাঁদের তত টাকা নেই তাঁদের যেতে হয় দেশের সরকারি এবং বেসরকারি এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। নামিদামি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে গুনতে হয় প্রচুর অর্থ, যা দেওয়ার সামর্থ্য অনেকেরই নেই। মাঝারি মানের বেসরকারি হাসপাতালে গেলেও নানা চার্জ মিলিয়ে যে পরিমাণ অর্থ দিতে হয়, তা-ও অনেকেরই গলাকাটার পর্যায়েই পড়ে। তার পরও ওই সব হাসপাতালে না আছে সার্বক্ষণিক এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, না আছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স ও মানসম্মত যন্ত্রপাতি; পরিবেশও ততটা পরিচ্ছন্ন নয়। তার পরও ঢাকা শহরের অবস্থা তুলনামূলক ভালো বলা চলে। কেননা, এখানে বেশ কিছুসংখ্যক মেডিক্যাল কলেজ এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে_যেখানে কিছুসংখ্যক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছেন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এ সংখ্যাটি মোটেও পর্যাপ্ত নয়। সে কারণে একজন ডাক্তার একটু খ্যাতি অর্জন করলে তাঁর কাছে রোগীর ভিড় এতটাই বেড়ে যায় যে তার পক্ষে ভালো চিকিৎসা দেওয়া মোটামুটি অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাঁকে অনেকটাই বিরামহীনভাবে রোগী দেখতে হয়। অন্যদিকে ঢাকার বাইরের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। ঢাকা শহরেই অনেক ভুয়া ডাক্তারের চিকিৎসাদানের খবর পত্রপত্রিকায় প্রায়ই ছাপা হচ্ছে। মফস্বল শহরগুলোতে যাঁরা চিকিৎসা দিচ্ছেন কতজন সত্যিকার ডাক্তার, কতজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, তা বলাবাহুল্য। গ্রামেগঞ্জে হাতুড়ে ডাক্তাররা এখনো চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। এসএসসি, এইচএসসি পাস করে ওষুধের দোকানে কিছু দিন কাজ করে অনেকেই গ্রামেগঞ্জে 'ডাক্তার' বনে যান। তাঁরা চিকিৎসার নামে ওষুধ বিক্রি করে অর্থোপার্জন করছেন, গ্রামের গরিব মানুষ তাতেই বেঁচে উঠলে আল্লাহর রহমত, মরে গেলে 'হায়াত নেই;' 'আল্লাহ নিয়ে গেছেন'_এমন সান্ত্বনাতেই বসবাস করছে। তা হলে যাব কোথায়? অথচ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও বাসস্থানের মতো চিকিৎসাও আমাদের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃত। কিন্তু সেই অধিকার লাভের সুযোগ বা নিশ্চয়তা কোথাও নেই।
সুরম্য ও প্রাসাদের মধ্যে গড়ে ওঠা নামিদামি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বেশির ভাগ মানুষের নেই, হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার বা চিকিৎসাও ততটা নেই যতটা ঢাকঢোল বাজানো হচ্ছে। এর নিচের অবস্থা ক্রমেই শূন্যে মিলিয়ে গেছে। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশটিতে আমাদের অর্থনৈতিক অর্জন একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। দেশে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের বিকাশ ঘটেছে চোখে পড়ার মতো। নিম্নবিত্তরাও এখন আর দু-তিন দশক আগের পর্যায়ে নেই, তাদেরও আয়-উন্নতি কমবেশি ঘটছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের জীবনের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, বাসস্থান, খাদ্য ও চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা যেভাবে বিস্তৃত হওয়া জরুরি ছিল, তা কিন্তু বাংলাদেশে হয়নি, হচ্ছেও না। যেটুকু হচ্ছে তা নিয়মনীতি অনুযায়ী হচ্ছে না। সব কিছু চলছে কৃত্রিমভাবে চরম মুনাফা ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। জ্ঞানগত দক্ষতা বৃদ্ধি, পরিষেবার মান রক্ষা, নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলাকে অলঙ্ঘনীয় করে তোলার কোনো নৈতিকতাই এসব ক্রমবর্ধমান প্রতিষ্ঠানে মানা হচ্ছে না। অথচ চিকিৎসা একটি মহৎ এবং মানবিক পেশা। এর সঙ্গে অর্থ, দলীয় স্বার্থ, রাজনীতি ও বাণিজ্যকে একাকার করা হলে, প্রাধান্য দেওয়া হলে সত্যিকার চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে ওঠার সম্ভাবনাই হারিয়ে যেতে বাধ্য। বাংলাদেশে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা বিকাশের ক্ষেত্রে এসব গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব অন্যতম কারণ। এখানে বেসরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পেছনে আলু, পটল, চাল-ডাল ব্যবসার মানুষও জড়িত হয়ে গেছে, আবার রাজনৈতিক সংগঠনও হয়ে গেছে। কারো কারো উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধু ব্যবসা করা, কারো কারো উদ্দেশ্য ব্যবসা এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এর কোনোটিই চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, সমর্থনযোগ্যও নয়। চিকিৎসাশাস্ত্র একটি অতি উচ্চতর জটিল গবেষণা এবং মানবসেবার ক্ষেত্র। এখানে চিকিৎসাশাস্ত্রের মৌলিক জ্ঞানার্জন ও বিতরণের কোনো বিকল্প কিছু থাকতে পারে না।
প্রতিনিয়ত চিকিৎসাবিজ্ঞানে যেসব আবিষ্কার ঘটে চলছে সেগুলোকে আয়ত্তে আনা মোটেও সহজ কাজ নয়। মানুষকে নিত্যনতুন আবির্ভূত এবং পুরনো সব ধরনের রোগ থেকে আরোগ্য লাভের চিকিৎসা দেওয়া, ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আনা খুব সহজ কাজ নয়। দেশে চিকিৎসাশাস্ত্রকে সেই পর্যায়ে পঠনপাঠন, শল্য দক্ষতায় গড়ে তোলা, ছাত্রছাত্রী ও চিকিৎসক মহলকে গড়ে তোলা এবং যুক্ত রাখা ব্যতীত দেশে কোনোকালেই আধুনিক মানসম্মত চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে উঠবে না। কিছু সাইনবোর্ড টাঙিয়ে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও প্যাথলজিক্যাল সেন্টার নাম ধারণ করলেই চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে উঠবে না। বাংলাদেশে চিকিৎসার নামে এ পর্যন্ত যা কিছু দৃশ্যমান হচ্ছে, তার বড় অংশই নামসর্বস্ব, প্রকৃত চিকিৎসাবিজ্ঞানের চর্চা, গবেষণা ও প্রয়োগের উপস্থিতি কতটা আছে তা সংশ্লিষ্টরাই ভালো বলতে পারবেন। আমরা বাইরে থেকে যা দেখছি তাতে মনে হয় চিকিৎসা লাভের সুযোগ-সুবিধা দেশে প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। অথচ চিকিৎসার নামে যত্রতত্র হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি চলছে। কিন্তু এর ভেতরে চিকিৎসার অবস্থান ক্রমেই দুর্বল হতে হতে হারিয়ে যেতে বসেছে। সে কারণেই দেশে চিকিৎসার নামে চালু থাকা সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের ওপরই মানুষের নির্ভরতা, আস্থা ও আরোগ্য লাভের নিশ্চয়তা দ্রুতই হ্রাস পেতে বসেছে। এতে দেশের জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আধুনিক বিশ্বে যখন বিভিন্ন দেশ নিজেদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে তুলছে, আমরা তখন যেভাবে এর প্রসার ঘটাচ্ছি, তা দিয়ে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা বাস্তবে কমে আসছে। এখানেই আশঙ্কার মাত্রা বাড়ার কারণ।
তা হলে উপায় কী? এ প্রশ্নের উত্তর দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও চিকিৎসক মহলকেই দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। দেশে এখনো পর্যন্ত যুগোপযোগী কোনো স্বাস্থ্যনীতি নেই, মেডিক্যাল শিক্ষাকে অভিন্ন মানে উন্নীত করার উদ্যোগও নেই, অধিকন্তু সরকারি মেডিক্যালের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে যেসব মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেগুলোতেও 'বাণিজ্য করার' নীতি যেভাবে অনুসৃত হচ্ছে, মেডিক্যাল শিক্ষার প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ব্যতিক্রম হিসেবেই কোনো কোনোটিকে মেনে নিতে হচ্ছে। এমনটি হওয়ার কথা নয়। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে উল্টোটি। ফলে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে নির্ভর করতে হচ্ছে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের ওপর। রোগীরাও দেখছেন ডাক্তার সরকারি হাসপাতালের কি না। সে কারণে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা এক বিকেলেই একাধিক বেসরকারি ক্লিনিকে সময় দিয়ে বসেন। সরকারি হাসপাতালগুলোকে যে সময় দেওয়া প্রয়োজন, তা অনেকেই দিচ্ছেন না, দিতে পারছেন না। ফলে সরকারি হাসপাতালের রোগীরাও বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত সেবা পাওয়া থেকে। মফস্বল শহর ও উপজেলার সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির অভিযোগ নতুন করে নয়। অথচ এমনটি চলছে বেশ প্রকাশ্যেই।
বেসরকারি হাসপাতালগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ডাক্তার, নার্স, ল্যাব নিয়ে যেভাবে দাঁড়ানো প্রয়োজন ছিল সেভাবে খুব একটা হচ্ছে না। হাতে গোনা দু-চারটি কিছুটা চেষ্টা করলেও অধিকাংশই চলছে অস্থায়ী ডাক্তার, অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। ফলে অসুখ-বিসুখ নিয়ে দেশের মানুষ নানা ভোগান্তি ও বিড়ম্বনায় দিন কাটাচ্ছে। দিন দিন ভোগান্তি বাড়ছে, অর্থ খরচ বাড়ছে, চিকিৎসার অবহেলা, অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে অস্বাভাবিক মৃত্যুও বাড়ছে। একুশ শতকে এমনটি ভাবা যেমন যায় না, মেনেও নেওয়া যায় না। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর কিভাবে নিজেদের চিকিৎসাব্যবস্থাকে দেশি-বিদেশিদের জন্য উপযুক্ত, যোগ্য এবং উন্মুক্ত করে দিয়েছে তা ভাবতেই অবাক হতে হয়। ফলে নিজেদের জনগণের স্বাস্থ্য সেবাদানের পাশাপাশি অন্য দেশের মানুষের চিকিৎসাদানেও তারা ভূমিকা রাখছে, দেশের জন্য বিপুল বৈদেশিক মুদ্রাও তারা অর্জন করছে। আমরা বিদেশে কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি। ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশ নিজ দেশে বসেই বিদেশি মুদ্রা অর্জন করছে। এখানেই পার্থক্যটি বোঝার রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে ভালো, মানসম্মত আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষা লাভের সুযোগ বৃদ্ধি করা, সেটি সরকারি-বেসরকারি উভয় শাখায়ই থাকতে হবে। একই সঙ্গে চিকিৎসাসেবার নীতিমালা অনুযায়ীই সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ল্যাবকে চলতে হবে। সরকারি হাসপাতালগুলো যেন একেবারেই পঙ্গু হয়ে না পড়ে, অন্যদিকে বেসরকারিগুলো যেন শপিং মলে পরিণত না হয়, উভয় ধারার হাসপাতালই যেন মানুষের চিকিৎসার নিশ্চয়তা বিধান করে চলে, সেই সংস্কৃতিতেই কর্তৃপক্ষকে আসার কথা ভাবতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments