পরিবেশ-নাইট্রোজেন: পুষ্টি ও প্রতিঘাত by জিয়া উদ্দিন আহমেদ
বায়ুমণ্ডলের বাড়তি কার্বন ডাই-অক্সাইড আজ বিশ্বের বড় সমস্যা। জীবদেহের অন্যতম পুষ্টি উপাদান নাইট্রোজেন পরিবেশে দিন দিন বাড়ছে আর সৃষ্টি হচ্ছে অনুরূপ আরও সমস্যা। আমাদের দেশ জনঘনত্বে বিশ্বে প্রথম ও জনসংখ্যায় সপ্তম, ফলে সীমিত স্থানে খুব বেশি মাত্রায় জৈবিক কর্মকাণ্ড আমাদের অনন্য জীবতাত্ত্বিক বাস্তবতা। কৃষিকর্মে জৈব সার ও রসায়নিক সার প্রয়োগের মাধ্যমে নাইট্রোজেন সরবরাহ করা হয়। আমাদের নিবিড় কৃষিকর্মের প্রয়োজনে হেক্টরপ্রতি
আবাদি জমিতে রসায়নিক সারের ব্যবহার অনেক বেশি। অতীতে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন মূলত জৈব সার প্রয়োগের মাধ্যমেই মেটানো সম্ভব হতো কিন্তু আজ তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল, ফলে রসায়নিক পদ্ধতিতে ডাই-নাইট্রোজেন অণু ভেঙে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে রসায়নিক সার। গাছপালা কার্যত সারের মাত্র অর্ধেক নাইট্রোজেন ব্যবহার করে থাকে আর বাকি অর্ধেক নানা ধরনের বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেন অণুতে রূপান্তরিত হয়ে মাটি, পানি ও বাতাসে মিশে যায়। এভাবে বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেন দিন দিন বাড়তে থাকে আর শুরু হয় পরিবেশদূষণের নতুন মাত্রা—নাইট্রোজেনদূষণ।
আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ মাত্র ৮০ লাখ হেক্টর আর রাসায়নিক সারের ব্যবহার বর্তমানে বছরে ৩০ লাখ টন। অর্থাৎ আবাদি জমিতে হেক্টরপ্রতি বছরে শূন্য দশমিক ৩৭ টন, যা এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। বাড়তি নাইট্রোজেন নানাভাবে পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে। এর ফলে জলাশয়ের ওপরিভাগে সায়ানোব্যাকটেরিয়া ও শৈবালের অতিবৃদ্ধি ঘটে আর ইউট্রোফিকেশন প্রক্রিয়ার সূচনা হয়, যা পানির নিচে অক্সিজেন সরবরাহ বিঘ্নিত করে, তার ফলে জলজ প্রাণীর ক্ষতি হয়। নাইট্রেট পানিতে সহজে দ্রবণীয়, অব্যবহূত নাইট্রেট দ্রুত ভূগর্ভস্থ পানিস্তরে জমা হয়। এই পানি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, শরীরে নাইট্রেটের মাত্রা বেশি হলে রক্তের লোহিত কণিকা অক্সিজেন বহনের ক্ষমতা হারায়, যা মারাত্মক মেটহিমোগ্লোবিনিমিয়া রোগের কারণ। নাইট্রেট মাটির অম্লতা বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া ঋণত্মক নাইট্রেট অণু মাটি থেকে ধনাত্মক ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম অণুকে তার সঙ্গে ভূগর্ভে নিয়ে যায়। গাছপালা এই প্রয়োজনীয় খনিজ পুষ্টির অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে ও সহজেই নানাবিধ রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।
ভূমণ্ডলে মাটি ও বাতাসে নাইট্রোজেন চক্র নিয়ত চলমান। ফলে বাতাসেও নানা ধরনের বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেন অণু বিদ্যমান, যা ক্রমেই বাড়ছে। অ্যামোনিয়া ও নাট্রোজেন অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে ওজোন-গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ। বাতাসে নাইট্রাস অক্সাইড জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপাদন করে, যা অম্লবৃষ্টি হিসেবে মাটিতে ফিরে আসে ও মাটির অম্লতা বৃদ্ধি করে। অ্যামোনিয়া ধনাত্মক আধান বহন করলেও মাটিতে এটি ভেঙে অম্লতা সৃষ্টি হয়। অ্যামোনিয়া ও নাইট্রেট শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত। নাইট্রাস অক্সাইড ও অ্যামোনিয়া-কণিকা বাতাসে স্মগ বা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে, যা সূর্যরশ্মি প্রকীর্ণকরণের মাধ্যমে ভূতলে এর প্রাপ্যতা বিঘ্নিত করে। এতে গাছপালার বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে বছরে ২৬ কোটি টন বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেন তৈরি হয়—১২ কোটি টন প্রাকৃতিক (জীবাণুপ্রসূত ও বজ্রপাতজনিত) কারণে, আর ১৪ কোটি টন মানুষের কর্মকাণ্ডপ্রসূত (রসায়নিক সার, জৈব সার ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে)। অনুমান করা হয়, ২০২০ সালে পৃথিবীতে বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেনের পরিমাণ হবে বছরে ৩০ কোটি টন, আর ২১০০ সালে ১০০ কোটি টন।
বাড়তি নাইট্রোজেনের ক্ষতিকর প্রভাব বর্তমানে জলভাগে বেশি দৃশ্যমান। কারণ, নাইট্রোজেন সহজেই পানির সঙ্গে গড়িয়ে জলাশয়ে জমা হয়। এ কারণে নানা দেশে সমুদ্র তীরবর্তী জলভূমি ও হ্রদ আর আমাদের দেশে হাওর, বিল, ঝিল ইত্যাদি ইউট্রফিকেশন-কবলিত। বিরাট জনগোষ্ঠীর জৈবিক কর্মকাণ্ড ও নাইট্রোজেন অতিপুষ্টিজনিত ইউট্রোফিকেশনের কারণে আমরা ইতিমধ্যেই হারিয়েছি চলন বিল, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ আরও অনেক জলাশয়। ক্রমে স্থলদেশেও গাছপালায় বাড়তি নাইট্রোজেনের প্রভাব পড়ে। তবে তা ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হতে জলভূমির চেয়ে সময় লাগে বেশি। বনাঞ্চলে গাছপালার ওপর বাড়তি নাইট্রোজেনের প্রভাব নিয়ে ইদানীং বিশ্বের নানা দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হচ্ছে। দেখা যায়, অতিমাত্রায় নাইট্রোজেন প্রয়োগের ফলে প্রথম কয়েক বছর বনে গাছপালার বৃদ্ধি স্বাভাবিকের চেয়ে ভালো হয়, তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মাটিতে নাইট্রোজেনের মাত্রা সম্পৃক্তি পর্যায়ে পৌঁছালে গাছপালা খনিজ পুষ্টিজনিত ভারসাম্যহীনতার শিকার হয় আর রোগ-জীবাণু ও ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
গাছপালা প্রধানত মাটি থেকেই দ্রবীভূত নাইট্রোজেন অহরণ করে থাকে, এটি আর্দ্র-অবক্ষেপণ। অন্য একটি পদ্ধতিও ইদানীং বিজ্ঞানীমহলে স্বীকৃত। পাতার প্রভূত পরিমাণ ওপরিতল দিয়ে গাছ সরাসরি বাতাস থেকে বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেন আহরণ করতে পারে, যাকে শুষ্ক-অবক্ষেণ বলা হয়। এভাবে আহরিত নাইট্রোজেন উদ্ভিদদেহে অঙ্গীভূত হয় এবং এর পরিমাণ নগন্য নয়। বাতাসের এই ‘নাইট্রোজেন সার’ বর্তমানে গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। তবে এর সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়েও বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন। নাইট্রোজেনের মাত্রা সম্পৃক্তি পর্যায়ে পৌঁছে গেলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি ত্বরান্বিত হবে। বর্তমানে আমরা আমাদের দেশের স্থলভাগে হয়তো নাইট্রোজেন পুষ্টির সুসময়টুকুই দেখছি, তবে এর পুষ্টিজনিত ভারসাম্যহীনতার কিছু ইঙ্গিতও আজ দৃষ্টি এড়ায় না। বাড়তি নাইট্রোজেনের প্রভাব বিভিন্ন বৃক্ষ-প্রজাতির ওপর ভিন্ন। মাটির নাইট্রোজেন সম্পৃক্তিতে অধিক সংবেদনশীল বৃক্ষপ্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। আমাদের দেশে কোনো কোনো বৃক্ষ-প্রজাতি আজ মড়কের শিকার, সুন্দরবনে সুন্দরী-মড়কের কারণ সম্বন্ধে আমরা কেবল অনুমানই করতে পারি, সঠিক বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিরূপণ আমাদের জন্য বর্তমানে দুরূহ কাজ।
আমরা বাতাসে কার্বন বা সিএফসি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু জমিতে নাইট্রোজেন সরবরাহ কমালে পরিণতি হবে ব্যাপক অনাহার ও মৃত্যু। আমাদের অতিঘন জনবসতির জৈব-কর্মকাণ্ডের কারণে পরিবেশে বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেনের মাত্রা প্রতি একক পরিমাণ স্থানে তুলনামূলকভাবে বেশি হবে। দেশের আয়তন ছোট, স্বাভাবিকভাবেই বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেনের তরলীকরণমাত্রাও কম হবে। ফলে পরিবেশে বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেনের দূষণ-ঘনত্ব বাড়বে। তাই বিষয়টি নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনার প্রয়োজন। বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেনের সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব সীমিত করতে হলে এর প্রকার, পরিমাণ ও পরিবেশে এসব অণুর প্রবাহ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা ও তথ্য আহরণ প্রয়োজন। আমাদের দেশে এসব বিষয়ে গবেষণা আজও সীমিত, কিন্তু এটা অবহেলা করা উচিত নয়।
জিয়া উদ্দিন আহমেদ: জীববিজ্ঞানী, অতিথি অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ মাত্র ৮০ লাখ হেক্টর আর রাসায়নিক সারের ব্যবহার বর্তমানে বছরে ৩০ লাখ টন। অর্থাৎ আবাদি জমিতে হেক্টরপ্রতি বছরে শূন্য দশমিক ৩৭ টন, যা এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। বাড়তি নাইট্রোজেন নানাভাবে পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে। এর ফলে জলাশয়ের ওপরিভাগে সায়ানোব্যাকটেরিয়া ও শৈবালের অতিবৃদ্ধি ঘটে আর ইউট্রোফিকেশন প্রক্রিয়ার সূচনা হয়, যা পানির নিচে অক্সিজেন সরবরাহ বিঘ্নিত করে, তার ফলে জলজ প্রাণীর ক্ষতি হয়। নাইট্রেট পানিতে সহজে দ্রবণীয়, অব্যবহূত নাইট্রেট দ্রুত ভূগর্ভস্থ পানিস্তরে জমা হয়। এই পানি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, শরীরে নাইট্রেটের মাত্রা বেশি হলে রক্তের লোহিত কণিকা অক্সিজেন বহনের ক্ষমতা হারায়, যা মারাত্মক মেটহিমোগ্লোবিনিমিয়া রোগের কারণ। নাইট্রেট মাটির অম্লতা বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া ঋণত্মক নাইট্রেট অণু মাটি থেকে ধনাত্মক ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম অণুকে তার সঙ্গে ভূগর্ভে নিয়ে যায়। গাছপালা এই প্রয়োজনীয় খনিজ পুষ্টির অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে ও সহজেই নানাবিধ রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।
ভূমণ্ডলে মাটি ও বাতাসে নাইট্রোজেন চক্র নিয়ত চলমান। ফলে বাতাসেও নানা ধরনের বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেন অণু বিদ্যমান, যা ক্রমেই বাড়ছে। অ্যামোনিয়া ও নাট্রোজেন অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে ওজোন-গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ। বাতাসে নাইট্রাস অক্সাইড জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপাদন করে, যা অম্লবৃষ্টি হিসেবে মাটিতে ফিরে আসে ও মাটির অম্লতা বৃদ্ধি করে। অ্যামোনিয়া ধনাত্মক আধান বহন করলেও মাটিতে এটি ভেঙে অম্লতা সৃষ্টি হয়। অ্যামোনিয়া ও নাইট্রেট শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত। নাইট্রাস অক্সাইড ও অ্যামোনিয়া-কণিকা বাতাসে স্মগ বা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে, যা সূর্যরশ্মি প্রকীর্ণকরণের মাধ্যমে ভূতলে এর প্রাপ্যতা বিঘ্নিত করে। এতে গাছপালার বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে বছরে ২৬ কোটি টন বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেন তৈরি হয়—১২ কোটি টন প্রাকৃতিক (জীবাণুপ্রসূত ও বজ্রপাতজনিত) কারণে, আর ১৪ কোটি টন মানুষের কর্মকাণ্ডপ্রসূত (রসায়নিক সার, জৈব সার ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে)। অনুমান করা হয়, ২০২০ সালে পৃথিবীতে বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেনের পরিমাণ হবে বছরে ৩০ কোটি টন, আর ২১০০ সালে ১০০ কোটি টন।
বাড়তি নাইট্রোজেনের ক্ষতিকর প্রভাব বর্তমানে জলভাগে বেশি দৃশ্যমান। কারণ, নাইট্রোজেন সহজেই পানির সঙ্গে গড়িয়ে জলাশয়ে জমা হয়। এ কারণে নানা দেশে সমুদ্র তীরবর্তী জলভূমি ও হ্রদ আর আমাদের দেশে হাওর, বিল, ঝিল ইত্যাদি ইউট্রফিকেশন-কবলিত। বিরাট জনগোষ্ঠীর জৈবিক কর্মকাণ্ড ও নাইট্রোজেন অতিপুষ্টিজনিত ইউট্রোফিকেশনের কারণে আমরা ইতিমধ্যেই হারিয়েছি চলন বিল, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ আরও অনেক জলাশয়। ক্রমে স্থলদেশেও গাছপালায় বাড়তি নাইট্রোজেনের প্রভাব পড়ে। তবে তা ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হতে জলভূমির চেয়ে সময় লাগে বেশি। বনাঞ্চলে গাছপালার ওপর বাড়তি নাইট্রোজেনের প্রভাব নিয়ে ইদানীং বিশ্বের নানা দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হচ্ছে। দেখা যায়, অতিমাত্রায় নাইট্রোজেন প্রয়োগের ফলে প্রথম কয়েক বছর বনে গাছপালার বৃদ্ধি স্বাভাবিকের চেয়ে ভালো হয়, তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মাটিতে নাইট্রোজেনের মাত্রা সম্পৃক্তি পর্যায়ে পৌঁছালে গাছপালা খনিজ পুষ্টিজনিত ভারসাম্যহীনতার শিকার হয় আর রোগ-জীবাণু ও ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
গাছপালা প্রধানত মাটি থেকেই দ্রবীভূত নাইট্রোজেন অহরণ করে থাকে, এটি আর্দ্র-অবক্ষেপণ। অন্য একটি পদ্ধতিও ইদানীং বিজ্ঞানীমহলে স্বীকৃত। পাতার প্রভূত পরিমাণ ওপরিতল দিয়ে গাছ সরাসরি বাতাস থেকে বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেন আহরণ করতে পারে, যাকে শুষ্ক-অবক্ষেণ বলা হয়। এভাবে আহরিত নাইট্রোজেন উদ্ভিদদেহে অঙ্গীভূত হয় এবং এর পরিমাণ নগন্য নয়। বাতাসের এই ‘নাইট্রোজেন সার’ বর্তমানে গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। তবে এর সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়েও বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন। নাইট্রোজেনের মাত্রা সম্পৃক্তি পর্যায়ে পৌঁছে গেলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি ত্বরান্বিত হবে। বর্তমানে আমরা আমাদের দেশের স্থলভাগে হয়তো নাইট্রোজেন পুষ্টির সুসময়টুকুই দেখছি, তবে এর পুষ্টিজনিত ভারসাম্যহীনতার কিছু ইঙ্গিতও আজ দৃষ্টি এড়ায় না। বাড়তি নাইট্রোজেনের প্রভাব বিভিন্ন বৃক্ষ-প্রজাতির ওপর ভিন্ন। মাটির নাইট্রোজেন সম্পৃক্তিতে অধিক সংবেদনশীল বৃক্ষপ্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। আমাদের দেশে কোনো কোনো বৃক্ষ-প্রজাতি আজ মড়কের শিকার, সুন্দরবনে সুন্দরী-মড়কের কারণ সম্বন্ধে আমরা কেবল অনুমানই করতে পারি, সঠিক বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিরূপণ আমাদের জন্য বর্তমানে দুরূহ কাজ।
আমরা বাতাসে কার্বন বা সিএফসি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু জমিতে নাইট্রোজেন সরবরাহ কমালে পরিণতি হবে ব্যাপক অনাহার ও মৃত্যু। আমাদের অতিঘন জনবসতির জৈব-কর্মকাণ্ডের কারণে পরিবেশে বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেনের মাত্রা প্রতি একক পরিমাণ স্থানে তুলনামূলকভাবে বেশি হবে। দেশের আয়তন ছোট, স্বাভাবিকভাবেই বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেনের তরলীকরণমাত্রাও কম হবে। ফলে পরিবেশে বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেনের দূষণ-ঘনত্ব বাড়বে। তাই বিষয়টি নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনার প্রয়োজন। বিক্রিয়াক্ষম নাইট্রোজেনের সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব সীমিত করতে হলে এর প্রকার, পরিমাণ ও পরিবেশে এসব অণুর প্রবাহ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা ও তথ্য আহরণ প্রয়োজন। আমাদের দেশে এসব বিষয়ে গবেষণা আজও সীমিত, কিন্তু এটা অবহেলা করা উচিত নয়।
জিয়া উদ্দিন আহমেদ: জীববিজ্ঞানী, অতিথি অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments