অর্থনীতি-আর্থিক বাজারের পতন যখন অনিবার্য by আসজাদুল কিবরিয়া
অর্থনীতি যখন বিকশিত হয়, তখন নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও সংকট দেখা দেয়। সেই প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করা ও সংকট উত্তরণের মধ্য দিয়ে বিকাশটা জোরদার হয়ে থাকে। তার মানে এই নয় যে অর্থনীতিতে একটা না একটা সংকট কাঙ্ক্ষিত হবে। সংকট কখনোই কাঙ্ক্ষিত নয়, তবে সংকট কখনো না কখনো অনিবার্য হয়ে ওঠে। সে জন্যই সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া বা রাখা গুরুত্বপূর্ণ। আর তা সম্ভব হয় যদি অন্য দেশের অভিজ্ঞতা ও সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের
ভিত্তিতে সঠিক কিছু পূর্বাভাস বা পূর্বানুমান করা যায়। তবে বাস্তবতা এও বলে যে সংকট পূর্বানুমান করার পরও তা এড়ানোর বা মোকাবিলার হাতিয়ারগুলো কার্যকর নাও হতে পারে, যদি নীতি-নির্ধারকেরা সত্যিই তা এড়াতে না চান। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা বা প্রভাব একটা বড় ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গত তিন বছরের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনায় এই সত্যিটারই স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা গেছে। বিশেষ করে যদি আর্থিক বাজারের দিকে তাকানো যায়।
এটা ঠিক যে বাংলাদেশের আর্থিক বাজার এখনো সুপরিসরে বিস্তৃত ও বিকশিত হতে পারেনি। আর্থিক বাজারের আওতায় আছে মুদ্রাবাজার, ঋণবাজার ও পুঁজিবাজার। এর মধ্যে প্রথম ও তৃতীয়টির সক্রিয় উপস্থিতি বাংলাদেশে আছে, দ্বিতীয়টির তেমন একটা নেই, যদিও ঋণবাজারের বিভিন্ন উপাদান অনেক দিন ধরেই সক্রিয়। আবার পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রেও তেমন বৈচিত্র্য বা বহুমাত্রিকতা নেই। অবশ্য এগুলো একদিনে গড়ে ওঠে না। অর্থনীতি বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুদূরপ্রসারী নীতি-পরিকল্পনার সহায়তায় এসব গড়ে ওঠে ও আর্থিক বাজার বিকশিত হয়, বিস্তৃত হয়। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে আর্থিক বাজারের অন্যতম চালিকা যে ফাটকাবাজি (স্পেকুলেশন) সেটাও বেড়ে যায়। যেহেতু এটা আর্থিক বাজারের অন্যতম চালিকা, সেহেতু এটাকে কোনোভাবেই বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। একইভাবে আর্থিক বাজার যখন বিকশিত হয়, তখন বাজারভিত্তিক কারবার ও লেনদেন মিলে বাজারকে স্ফীতও করে তোলে। বিষয়টা পুঁজিবাজার দিয়ে বোঝা যতটা সহজ, সামগ্রিক আর্থিক বাজার দিয়ে ততটা সহজ নয়।
আবার বিশ্বজুড়েই আর্থিক বাজার ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করছে। বিশেষ করে উন্নত ও অগ্রসর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। নানা ধরনের পণ্য ও সেবা, নানা ধরনের লেনদেন পদ্ধতি, নানা ধরনের কারবার আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নানাবিধ প্রয়োগ মিলে গোটা আর্থিক বাজারকে আজ এত বড় একটা বিষয়ে রূপান্তর করেছে যে এটাকে বোঝা বেশ শ্রমসাধ্য কাজ। সে কারণেই অর্থায়নশাস্ত্রে (ফিন্যান্স) পড়ালেখা করাটাও আগের চেয়ে কঠিন ও জটিল হয়ে গেছে।
এ রকম একটা বাস্তবতায় আর্থিক বাজারের লেনদেনে বা কারবার একই সঙ্গে বিরাট মুনাফার প্রলোভন ও বড় ধরনের লোকসানের ঝুঁকি দুই-ই সমভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। আর তাই যারা এই বাজারে যুক্ত হয়েছে, সংশ্লিষ্ট হয়েছে, তারা লাভ-লোকসানের বিষয়টি সম্যকভাবে অবহিত বলেই ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় যখন আমরা বিবেচনা করি, তখন মনে হয় যে এই কঠিন অথচ নিরেট সত্যটির মেনে নিয়ে আর্থিক বাজারে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে এখানে বড় ধরনের দ্বিধা আছে। সোজা ভাষায় বললে, এক চোখ দিয়ে লাভের দিকটিই দেখতে বেশি পছন্দ। অপর চোখ খুললে যদি লোকসানের অপ্রিয় দিকটি দেখতে হয়, তাই সেদিকে তাকাতে আপত্তিটা প্রবল। গত তিন বছরে শেয়ারবাজার ঘিরে বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তাতে এ রকম দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেছে।
বস্তুত, শেয়ারবাজার এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বিষফোড়া হয়ে উঠেছে। এ থেকে বিষ অন্যান্য জায়গায় বিশেষত আর্থিক খাতে সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। আর এই বিষফোড়া হয়ে ওঠার পেছনে বাংলাদেশের অর্থনীতির নীতি-নির্ধারক ও পরিচালকদের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। এটা বুঝতে বিরাট গবেষণার প্রয়োজন নেই। একটু গভীরভাবে খেয়াল করলেই দেখা যায়, পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করে পুঁজি সংগ্রহের চেয়ে ১০ টাকাকে এক লাফে ১০০ টাকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ মানুষকে এখানে টেনে আনা হয়েছে। যুক্তিবুদ্ধিহীনভাবে দেওয়া হয়েছে একের পর এক ছাড়। আর তাই হু হু করে বাজার অল্প সময়ের মধ্যেই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। তবে বেলুন ফোলানোরও একটা সীমা আছে। তা না হলে একপর্যায়ে তা ফেটে যেতে বাধ্য। এখানেও সেটাই হয়েছে। একটা পর্যায়ে ফেটে গেছে ফাটকার বেলুন। এরপর তৈরি হয়েছে আরেক সংকট। ফাটা বেলুন জোড়াতালি দিয়ে আবারও ফোলানোর ব্যর্থ চেষ্টা।
অর্থাৎ অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের প্রকৃত কাজটা কী, সেটাই এখানে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন প্রতিদিন শেয়ার বেচাকেনা করা আর প্রতিদিন লাভের মুখ দেখানোই শেয়ারবাজারের কাজ। যেসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে সেগুলোর অবস্থা কী, তা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। নির্বিচারে ঋণ করে এনে এখানে টাকা খাটানো হচ্ছে। ভাবখানা এমন যে যেখানে যত টাকা আছে সব এনে শেয়ারবাজারে দিতে হবে, বাজারকে সব সময় ঊর্ধ্বমুখী রাখতে হবে। আর তাই তো বিনা প্রশ্নে কালো টাকা বিনিয়োগ করার সুবিধা বহাল রাখার দাবিতে কেউ কেউ রাস্তায় পর্যন্ত নেমে পড়ে। অথচ নৈতিক-অর্থনৈতিক কোনো বিবেচনাতেই এ ধরনের যুক্তিহীন ছাড় দীর্ঘ মেয়াদে সুফল বয়ে আনে না। আবার একরকম বিনা শ্রমে লাখ লাখ টাকা মূলধনী মুনাফা করলেও কোনো কর না দিয়ে দিব্যি আছে এখানকার ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা। আর পরিশ্রমের উপার্জনের ওপর কর কর্তন করে নিতে এতটুকু দ্বিধা নেই সরকারের। করের ক্ষেত্রে এই অন্যায্যতা ও বৈষম্য রাজস্বের শৃঙ্খলাকেও নাজুক করে দিয়েছে।
বলা যেতে পারে, এভাবেই আর্থিক বাজার সুুষ্ঠুভাবে বিকশিত হওয়ার পথটি এখন রুদ্ধ হয়ে গেছে। এর বদলে বরং আর্থিক বাজারের বিকৃতি ঘটানোর পথ খোলার চেষ্টা হচ্ছে। আর তা হচ্ছে শেয়ারবাজারকে বিকৃত করার মাধ্যমে। এটাই আমাদের নীতি-নির্ধারকদের ব্যর্থতা। বিদায়ী ২০১১ সালে বাংলাদেশে শেয়ারবাজারকে নিয়ে যা ঘটেছে, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এ রকমটাই মনে হয়। আর্থিক বাজারের মৌল চরিত্রকে অবজ্ঞা করে আর যাই হোক কোনোভাবেই পুঁজিবাজার বিকশিত হয় না, হতে পারে না। এই মৌল চরিত্র রূপায়িত হয় বাজারের উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে, ফাটকামূলক তাড়নার মধ্য দিয়ে। আর্থিক বাজারের সঙ্গে ফাটকাবাজি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার বা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
এ প্রসঙ্গে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে জেনেভায় আঙ্কটাডের (জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা) সামষ্টিক অর্থনীতিবিষয়ক প্রধান ডেটলেফ জে কোট্টের সঙ্গে আলাপচারিতাটি প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হতে পারে। এশিয়া ও আফ্রিকার ১০ জন সাংবাদিকের সঙ্গে আঙ্কটাড কার্যালয়ে এক আলোচনায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, আর্থিক বাজারে ফাটকাবাজির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা বেশ কঠিন। সে জন্যই যেসব উপাদান এই ফাটকাবাজি তৈরিতে বা উসকে দিতে ভূমিকা রাখে, সেগুলো দূর করার চেষ্টা জরুরি। তিনি আরও বলেছিলেন, একটা পর্যায়ে এসে আর্থিক বাজারের পতন হতে বাধ্য। কেননা, এই পর্যায়ে বাজারের অংশগ্রহণকারী, বিনিয়োগকারী, কারবারি কেউই আর এখানকার বিভিন্ন উপাদানের প্রকৃত মূল্যের ওপর মনোযোগ দেয় না। আঙ্কটাডের ওই অর্থনীতিবিদের মতে, আর্থিক বাজার অর্থনীতির অবস্থা সবচেয়ে ভালোভাবে মূল্যায়ন করতে পারে—এমন ধারণা অর্বাচীনতা ছাড়া কিছুই নয়।
কোট্টে যে সময় এই কথাগুলো বলেছিলেন, তখন ইউরোপজুড়ে চলছে রাজস্ব কৃচ্ছ্রতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আর্থিক বাজারকে রক্ষা করতে একদিকে কোটি কোটি ইউরো ঢালছে, অন্যদিকে বাজারের আস্থা ফেরানোর নামে রাজস্ব ঘাটতি কমাতে গিয়ে সামাজিক খাতে রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমাচ্ছে। এই রাজস্ব কৃচ্ছ্রতার নীতির তীব্র সমালোচনা করে আঙ্কটাডের অর্থনীতিবিদ তখন বলেছিলেন, জোর করে রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। একইভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্ধারের জন্য শুধু অর্থ ঢাললেই হবে না, নিয়মকানুন ও নিয়ন্ত্রণবিধি কঠোর করতে হবে। তা না হলে আবার তাদের পুনরুদ্ধারের প্রয়োজন হবে।
এক বছর পর ইউরোপের দিকে তাকিয়ে এটা এখন স্পষ্ট যে রাজস্ব কৃচ্ছ্রতা সত্যিই তেমন একটা কাজে দেয়নি, আর্থিক বাজারও ঘুরে দাঁড়ায়নি। বরং আর্থিক বাজারকে আবারও পুুনরুদ্ধারের আহ্বান জানানো হচ্ছে। এ অবস্থা গোটা ইউরোপের আর্থিক খাতকেই হুমকির মুখে ফেলেছে, সেখানকার অভিন্ন মুদ্রা ইউরোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে ফেলেছে। বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারক ও আর্থিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা কি ইউরোপের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবেন? ২০১২ সালে আমরা কি তার কোনো প্রতিফলন দেখতে পাব?
আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
এটা ঠিক যে বাংলাদেশের আর্থিক বাজার এখনো সুপরিসরে বিস্তৃত ও বিকশিত হতে পারেনি। আর্থিক বাজারের আওতায় আছে মুদ্রাবাজার, ঋণবাজার ও পুঁজিবাজার। এর মধ্যে প্রথম ও তৃতীয়টির সক্রিয় উপস্থিতি বাংলাদেশে আছে, দ্বিতীয়টির তেমন একটা নেই, যদিও ঋণবাজারের বিভিন্ন উপাদান অনেক দিন ধরেই সক্রিয়। আবার পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রেও তেমন বৈচিত্র্য বা বহুমাত্রিকতা নেই। অবশ্য এগুলো একদিনে গড়ে ওঠে না। অর্থনীতি বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুদূরপ্রসারী নীতি-পরিকল্পনার সহায়তায় এসব গড়ে ওঠে ও আর্থিক বাজার বিকশিত হয়, বিস্তৃত হয়। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে আর্থিক বাজারের অন্যতম চালিকা যে ফাটকাবাজি (স্পেকুলেশন) সেটাও বেড়ে যায়। যেহেতু এটা আর্থিক বাজারের অন্যতম চালিকা, সেহেতু এটাকে কোনোভাবেই বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। একইভাবে আর্থিক বাজার যখন বিকশিত হয়, তখন বাজারভিত্তিক কারবার ও লেনদেন মিলে বাজারকে স্ফীতও করে তোলে। বিষয়টা পুঁজিবাজার দিয়ে বোঝা যতটা সহজ, সামগ্রিক আর্থিক বাজার দিয়ে ততটা সহজ নয়।
আবার বিশ্বজুড়েই আর্থিক বাজার ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করছে। বিশেষ করে উন্নত ও অগ্রসর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। নানা ধরনের পণ্য ও সেবা, নানা ধরনের লেনদেন পদ্ধতি, নানা ধরনের কারবার আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নানাবিধ প্রয়োগ মিলে গোটা আর্থিক বাজারকে আজ এত বড় একটা বিষয়ে রূপান্তর করেছে যে এটাকে বোঝা বেশ শ্রমসাধ্য কাজ। সে কারণেই অর্থায়নশাস্ত্রে (ফিন্যান্স) পড়ালেখা করাটাও আগের চেয়ে কঠিন ও জটিল হয়ে গেছে।
এ রকম একটা বাস্তবতায় আর্থিক বাজারের লেনদেনে বা কারবার একই সঙ্গে বিরাট মুনাফার প্রলোভন ও বড় ধরনের লোকসানের ঝুঁকি দুই-ই সমভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। আর তাই যারা এই বাজারে যুক্ত হয়েছে, সংশ্লিষ্ট হয়েছে, তারা লাভ-লোকসানের বিষয়টি সম্যকভাবে অবহিত বলেই ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় যখন আমরা বিবেচনা করি, তখন মনে হয় যে এই কঠিন অথচ নিরেট সত্যটির মেনে নিয়ে আর্থিক বাজারে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে এখানে বড় ধরনের দ্বিধা আছে। সোজা ভাষায় বললে, এক চোখ দিয়ে লাভের দিকটিই দেখতে বেশি পছন্দ। অপর চোখ খুললে যদি লোকসানের অপ্রিয় দিকটি দেখতে হয়, তাই সেদিকে তাকাতে আপত্তিটা প্রবল। গত তিন বছরে শেয়ারবাজার ঘিরে বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তাতে এ রকম দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেছে।
বস্তুত, শেয়ারবাজার এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বিষফোড়া হয়ে উঠেছে। এ থেকে বিষ অন্যান্য জায়গায় বিশেষত আর্থিক খাতে সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। আর এই বিষফোড়া হয়ে ওঠার পেছনে বাংলাদেশের অর্থনীতির নীতি-নির্ধারক ও পরিচালকদের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। এটা বুঝতে বিরাট গবেষণার প্রয়োজন নেই। একটু গভীরভাবে খেয়াল করলেই দেখা যায়, পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করে পুঁজি সংগ্রহের চেয়ে ১০ টাকাকে এক লাফে ১০০ টাকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ মানুষকে এখানে টেনে আনা হয়েছে। যুক্তিবুদ্ধিহীনভাবে দেওয়া হয়েছে একের পর এক ছাড়। আর তাই হু হু করে বাজার অল্প সময়ের মধ্যেই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। তবে বেলুন ফোলানোরও একটা সীমা আছে। তা না হলে একপর্যায়ে তা ফেটে যেতে বাধ্য। এখানেও সেটাই হয়েছে। একটা পর্যায়ে ফেটে গেছে ফাটকার বেলুন। এরপর তৈরি হয়েছে আরেক সংকট। ফাটা বেলুন জোড়াতালি দিয়ে আবারও ফোলানোর ব্যর্থ চেষ্টা।
অর্থাৎ অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের প্রকৃত কাজটা কী, সেটাই এখানে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন প্রতিদিন শেয়ার বেচাকেনা করা আর প্রতিদিন লাভের মুখ দেখানোই শেয়ারবাজারের কাজ। যেসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে সেগুলোর অবস্থা কী, তা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। নির্বিচারে ঋণ করে এনে এখানে টাকা খাটানো হচ্ছে। ভাবখানা এমন যে যেখানে যত টাকা আছে সব এনে শেয়ারবাজারে দিতে হবে, বাজারকে সব সময় ঊর্ধ্বমুখী রাখতে হবে। আর তাই তো বিনা প্রশ্নে কালো টাকা বিনিয়োগ করার সুবিধা বহাল রাখার দাবিতে কেউ কেউ রাস্তায় পর্যন্ত নেমে পড়ে। অথচ নৈতিক-অর্থনৈতিক কোনো বিবেচনাতেই এ ধরনের যুক্তিহীন ছাড় দীর্ঘ মেয়াদে সুফল বয়ে আনে না। আবার একরকম বিনা শ্রমে লাখ লাখ টাকা মূলধনী মুনাফা করলেও কোনো কর না দিয়ে দিব্যি আছে এখানকার ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা। আর পরিশ্রমের উপার্জনের ওপর কর কর্তন করে নিতে এতটুকু দ্বিধা নেই সরকারের। করের ক্ষেত্রে এই অন্যায্যতা ও বৈষম্য রাজস্বের শৃঙ্খলাকেও নাজুক করে দিয়েছে।
বলা যেতে পারে, এভাবেই আর্থিক বাজার সুুষ্ঠুভাবে বিকশিত হওয়ার পথটি এখন রুদ্ধ হয়ে গেছে। এর বদলে বরং আর্থিক বাজারের বিকৃতি ঘটানোর পথ খোলার চেষ্টা হচ্ছে। আর তা হচ্ছে শেয়ারবাজারকে বিকৃত করার মাধ্যমে। এটাই আমাদের নীতি-নির্ধারকদের ব্যর্থতা। বিদায়ী ২০১১ সালে বাংলাদেশে শেয়ারবাজারকে নিয়ে যা ঘটেছে, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এ রকমটাই মনে হয়। আর্থিক বাজারের মৌল চরিত্রকে অবজ্ঞা করে আর যাই হোক কোনোভাবেই পুঁজিবাজার বিকশিত হয় না, হতে পারে না। এই মৌল চরিত্র রূপায়িত হয় বাজারের উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে, ফাটকামূলক তাড়নার মধ্য দিয়ে। আর্থিক বাজারের সঙ্গে ফাটকাবাজি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার বা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
এ প্রসঙ্গে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে জেনেভায় আঙ্কটাডের (জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা) সামষ্টিক অর্থনীতিবিষয়ক প্রধান ডেটলেফ জে কোট্টের সঙ্গে আলাপচারিতাটি প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হতে পারে। এশিয়া ও আফ্রিকার ১০ জন সাংবাদিকের সঙ্গে আঙ্কটাড কার্যালয়ে এক আলোচনায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, আর্থিক বাজারে ফাটকাবাজির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা বেশ কঠিন। সে জন্যই যেসব উপাদান এই ফাটকাবাজি তৈরিতে বা উসকে দিতে ভূমিকা রাখে, সেগুলো দূর করার চেষ্টা জরুরি। তিনি আরও বলেছিলেন, একটা পর্যায়ে এসে আর্থিক বাজারের পতন হতে বাধ্য। কেননা, এই পর্যায়ে বাজারের অংশগ্রহণকারী, বিনিয়োগকারী, কারবারি কেউই আর এখানকার বিভিন্ন উপাদানের প্রকৃত মূল্যের ওপর মনোযোগ দেয় না। আঙ্কটাডের ওই অর্থনীতিবিদের মতে, আর্থিক বাজার অর্থনীতির অবস্থা সবচেয়ে ভালোভাবে মূল্যায়ন করতে পারে—এমন ধারণা অর্বাচীনতা ছাড়া কিছুই নয়।
কোট্টে যে সময় এই কথাগুলো বলেছিলেন, তখন ইউরোপজুড়ে চলছে রাজস্ব কৃচ্ছ্রতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আর্থিক বাজারকে রক্ষা করতে একদিকে কোটি কোটি ইউরো ঢালছে, অন্যদিকে বাজারের আস্থা ফেরানোর নামে রাজস্ব ঘাটতি কমাতে গিয়ে সামাজিক খাতে রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমাচ্ছে। এই রাজস্ব কৃচ্ছ্রতার নীতির তীব্র সমালোচনা করে আঙ্কটাডের অর্থনীতিবিদ তখন বলেছিলেন, জোর করে রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। একইভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্ধারের জন্য শুধু অর্থ ঢাললেই হবে না, নিয়মকানুন ও নিয়ন্ত্রণবিধি কঠোর করতে হবে। তা না হলে আবার তাদের পুনরুদ্ধারের প্রয়োজন হবে।
এক বছর পর ইউরোপের দিকে তাকিয়ে এটা এখন স্পষ্ট যে রাজস্ব কৃচ্ছ্রতা সত্যিই তেমন একটা কাজে দেয়নি, আর্থিক বাজারও ঘুরে দাঁড়ায়নি। বরং আর্থিক বাজারকে আবারও পুুনরুদ্ধারের আহ্বান জানানো হচ্ছে। এ অবস্থা গোটা ইউরোপের আর্থিক খাতকেই হুমকির মুখে ফেলেছে, সেখানকার অভিন্ন মুদ্রা ইউরোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে ফেলেছে। বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারক ও আর্থিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা কি ইউরোপের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবেন? ২০১২ সালে আমরা কি তার কোনো প্রতিফলন দেখতে পাব?
আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
No comments