প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ভাষা আন্দোলন by সরদার সিরাজুল ইসলাম
অসম থেকে এসে টাঙ্গাইল থেকে প্রাদেশিক
পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেও তা খুররম খান পন্নীর আবেদন ক্রমে বাতিল ঘোষণা
এবং তাকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
একই এলাকায় পুনর্নির্বাচন হয় ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল এবং ভাসানীর মনোনীত
প্রার্থী হিসেব ১৫০, মোগলটুলী ওয়ার্কার্স ক্যাম্প সদস্য শামসুল হক মুসলিম
লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে নির্বাচিত হলেও তাকে শপথ নিতে দেয়া হয়নি। এছাড়া
৩৫টি আসনের উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠান স্থগিত রাখা হয়। সবচাইতে ন্যক্কারজনক ঘটনা
ছিল ভাসানী সোহরাওয়ার্দী সমর্থকদের নতুন সদস্য সংগ্রহের রশিদ বই প্রদানে
অসম্মতি। এই প্রতিকূলতা এবং শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক আচরণ, বিশেষ করে
প্রদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য, ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর হামলার বিরুদ্ধে শহীদ
সোহরাওয়ার্দীর (যাকে মাওলানা ভাসানী শহীদ নামে ডাকতেন) উৎসাহে ঢাকায় মওলানা
ভাসানী গঠন করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ (২৩/৬/৪৯)। শাসক মুসলিম লীগের প্রবল
বিরোধিতার মুখে ঢাকায় কে, এম, দাশ লেনস্থ কাজী হুমায়ুন বসিরের রোজ গার্ডেন
বাসভবনে গঠিত দলের ৪০ সদস্য কমিটির মধ্যে
সভাপতি : মওলানা ভাসানী
সহ-সভাপতি : আতউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহম্মদ খান
সাধারণ সম্পাদক : শামসুল হক
যুগ্ম সম্পাদক : শেখ মুজিবুর রহমান (অন্তরীণ অবস্থায়)
সহকারী সম্পাদক : খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এ, কে, এম রফিকুল হোসেন
কোষাধ্যক্ষ : ইয়ার মুহম্মদ খাঁন
১৯৫৫ সালে দলের নাম পরিবর্তন হয়ে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয়। বস্তুত ভাষা আন্দোলন থেকে ধারাবাহিক সংগ্রামসমূহকে মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরের কৃতিত্ব এই দলটির। তবে ১৯৫৭ সালে দল থেকে ভাসানী চলে গিয়ে অন্য দল (ন্যাপ) করায় এবং ১৯৬৩তে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরে শেখ মুজিব দলের শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছেন। ঐতিহাসিক ৬ দফা (১৯৬৬) দিয়ে সংগ্রামের পথ বেয়ে সাহসী এই মানুষটির বাঙালী জাতির জনক হিসেবে বরণীয় হওয়ার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ।
এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আরেক জনপ্রিয় নেতা শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ভারত বিভক্তির সময় অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক সরকারের এ্যাডভোকেট জেনারেলের চাকরি নেন। রাজনীতিতে ফেরেন ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই বিপুপ্ত কে এসপি পুনর্গঠনের মাধ্যমে। ভাসানী- সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের প্রয়োজন হয়েছিল তার জনপ্রিয়তার কারণে তাকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের।
১৯৪৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের বার্ষিক নির্বাচনী সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকার আরমানীটোলা ময়দানে এক ছাত্রজনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানী, মিয়া ইফতেখারউদ্দিন প্রমুখ বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ ভাষণে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা, চাকরি ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যা সাম্যের দাবি জানানো হয়।
১৯৪৯ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংসদের সভায় বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি জানানো হয়। পূর্ব বাংলা সরকার ১৯৪৯ সালের ভাষা কমিটি, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী সরকারী কর্মচারী, বিধান পরিষদের সদস্যদের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালান। ৩০১ জন উত্তর দাতার মধ্যে ১৮৭ জন বাংলা লিপি বজায় রাখার পক্ষে এবং ৯৬ জন আরবি লিপি ও ১৮ জন রোমান লিপি প্রবর্তনের পক্ষে মত দেন।
১৯৫০ সালের ৩০ মে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী উর্দুর মাধ্যমে শিক্ষাদান প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। ১৯৫০ সালের ১২ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজে ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়।
১৯৫০ সালের ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পূর্ব বাংলা শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি সফল করার জন্য বিবৃতি প্রদানে করেন অবজারভার সম্পাদক আব্দুস সালাম, সাংবাদিক ইউনিয়ন সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী, কাজী মোঃ ইদ্রিস, সৈনিক সম্পাদক শাহেদ আলী সৈয়দ নুরুদ্দিন, ইনসাফ সম্পাদক মহীউদ্দিন আহম্মদ, আতাউর রহমান খান, নুরুল হুদা, কমরুদ্দিন আহম্মদ, শামসুল হক, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা বেগম, আলী আহম্মদ, শামসুদ্দিন আহম্মদ, মোঃ আবুল হোসেন, আলমাস আলী, আবু তাহের প্রমুখ। ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি হলে প্রায় আড়াই শ’ ছাত্র প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সম্মেলন শুরু হয়। কিন্তু অলি আহাদের উদ্বোধনী ভাষণের পরে আবু হেনা মোহসীন ও আহসানউল্লাহর নেতৃত্বে একদল সরকারী এজন্টে হামলা চালালে তখনকার মতো সম্মেলন বন্ধ করে সন্ধ্যায় ফজলুল হক হলে পুনরায় সম্মেলনের কাজ চলে। পরদিন ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে সম্মেলন ও বিকেলে আরমানীটোলা ময়দানে জনসভার মধ্যে দিয়ে দু’দিনব্যাপী সম্মেলন শেষ হয়। এই সম্মেলনে শিক্ষা সংক্রান্ত ১৬ দফা প্রস্তাব ও গণশিক্ষা পরিষদ নামে একটি পরিষদ গঠন করা হয়। ৯ সদস্য বিশিষ্ট্য পরিষদের সেক্রেটারিয়েটের কনভেনর নির্বাচিত হন আব্দুল অদুদ।
১৯৪৮ সালের পর থেকে ছাত্ররা প্রতি বছর ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিনটি ১১ মার্চকে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদর সঙ্গে পালন করতে থাকে। তবে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। তবে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ছাত্র আন্দোলন, আলাদাভাবে ছাত্র শিক্ষক ধর্মঘট, যুবলীগের অভ্যুদয়, শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে বিছিন্ন আন্দোলন ১৯৫১ সালের ঘটনাবলীর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য। সেসময় ঢাকা ছাড়া প্রদেশে কোন মেডিকেল কলেজ ছিল না। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে ৫টি মেডিকেল স্কুল ছিল। ছাত্ররা ৫টি মেডিকেল স্কুলকে কলেজ ও এল এম এফ পাস ডাক্তারদের সংক্ষিপ্ত এমবিবিএস কোর্স প্রবর্তনের দাবিতে ২৫ জানুয়ারি ১৯৫১ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করে। উল্লেখ্য, পশ্চিম পাকিস্তানে এই সব ব্যবস্থা আগেই নেয়া হয়েছিল। সরকারী নির্যাতন, ছাত্র গ্রেফতারসহ যাবতীয় দমননীতি সত্ত্বেও ছাত্ররা ধর্মঘট চালিয়ে যেতে সক্ষম হয় যার ফলে সরকার ৭ মে দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে ৯ মে ’৫১ ছাত্ররা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে। ১৯৫১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ড. মোঃ শহীদুল্লাহ, অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ, ড. কাজী মোতাহার হোসেনসহ বহু সংখ্যক গণপরিষদ ও প্রাদেশিক সদস্য, অধ্যাপক, সাংবাদিক, পেশাজীবী পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এক স্মারকলিপিতে ১ এপ্রিল থেকে সরকারী অফিসে বাংলাভাষা চালু করার দাবি জানান। একই বছরে ১৬ মার্চ কুমিল্লায় পূর্ববাংলা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষকদের সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ব্যতীত অন্য কোন ভাষা আরোপ করা হইলে ইহার বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহ করা উচিত। বাংলা ভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রাহ করিব। নতুন ভাষা আরোপ করা পূর্ববঙ্গে গণহত্যার শামিল।
১৯৫১ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবসে ঢাকাসহ প্রদেশের সর্বত্র ছাত্র ধর্মঘট, মিছিল ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুপুরে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্রলীগের সম্পাদক খালেক নেওয়াজ। এই সভায় আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। এই কর্মপরিষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন হাবিবুর রহমান শেলী, তাজউদ্দীন আহমদ, বদিউর রহমান, মাকসুদ আহম্মদ, আনোয়ারুল হক, মোশারফ হোসেন, আব্দুল ওদুদ, নুরুল আলম, সালাউদ্দিন, রুহুল আমীন চৌধুরী, নাদিরা বেগম, জিলুর রহমান সিদ্দীকী প্রমুখ। ১৯৫১ সালের ১৭ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মপরিষদের এক সভায় ভাষার প্রশ্নটি গণপরিষদের আলোচনার জন্য গণপরিষদের কতিপয় বাঙালী সদস্যদের কাছে তার বার্তা প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই দিন নারায়ণগঞ্জ রহমতউল্লাহ ইনস্টিটিউটে অলি আহাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তব্য রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান, মোহাম্মদ তোয়াহ, শামসুল হুদা, বজলুর রহমান প্রমুখ।
১৯৫১ সালের ২৭ মার্চ ঢাকায় যুবলীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সময় ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি ছিল তাই উদ্যোক্তারা ঢাকা বার লাইব্রেরিতে সম্মেলন করতে ব্যর্থ হয়। জিনজিরা বাজার এবং বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকায় বসে সম্মেলন করে। সম্মেলন উদ্বোধন করেন অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালাম, সভাপতিত্ব করেন মাহমুদ আলী এবং বক্তব্য রাখেন অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান নুরুল হুদা। খসড়া ম্যানিফেস্টো পেশ করেন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সম্পাদক আবদুস সামাদ। প্রস্তাবাবলী পাঠ করেন কে জি মোস্তফা। ২৮ মার্চ ৩০ সদস্যের কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়। প্রগতিশীল যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত এই সংস্থার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন যথাক্রমে মাহমুদ আলী ও অলি আহাদ। সহ-সভাপতি খাজা আহম্মদ, ইয়ার মুহম্মদ খান, সামসুজ্জোহা, আব্দুল মজিদ, দৌলতন্নেসা, যুগ্ম সম্পাদক, আব্দুল মতিন, রুহুল আমিন। কোষাধ্যক্ষ তোসাদ্দক আহম্মদ চৌধুরী, দফতর সম্পাদক- আনিসুজ্জামান। সদস্যবৃন্দের মধ্যে ছিলেন নুরুল হুদা, মোহাম্মদ তোয়াহ, মতিয়র রহমান, আব্দুল হালিম, আব্দুস সামাদ, মকসুদ আহাম্মদ, কে জি মোস্তফা, কবির আহম্মদ, আব্দুল ওদুদ, আঃ গাফ্ফার চৌধুরী, প্রাণেশ সমদ্দার, তাজউদ্দীন আহমদ, আকরাম হোসেন, মোতাহার হোসেন ও রোকেয়া খাতুন। ১৯৫১ সালের ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে যুবলীগের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে নতুন কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়। এরা হলেন সভাপতি-মাহমুদ আলী। সহ-সভাপতি- মির্জা গোলাম হাফিজ, ফয়েজ আহম্মদ, মোহাম্মদ তোয়াহ, ইয়ার মহম্মদ খান ও শামসুজ্জোহা। সাধারণ সম্পাদক-অলি আহাদ। যুগ্ম সম্পাদক-মহম্মদ সুলতান ও ইমাদুল্লাহ। কোষাধ্যক্ষ মাহবুব জামাল জাহেদী। দফতর সম্পাদক- আনিসুজ্জামান। সদস্য-আব্দুল হালিম, আব্দুল মতিন, এবিএম মূসা, নুরুল হুদা, আনোয়ারুল হোসেন, আব্দুল ওদুদ, সুফী খাঁন, আলী আশরাফ, এ রহমান সিদ্দিকী, মুতাহের হোসেন, নুরুল রহমান, মতিউর রহমান, আকমল হোসেন, মকসুদ আহম্মদ, মফিজুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুস সামাদ, দেওয়ান মাহবুব আলী, আব্দুল কাদের প্রাণেশ সমাদ্দার ও কে জি মোস্তফা। এই সময়ে যুবলীগের ভূমিকা ছিল বাংলা ভাষাসহ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বঞ্চনার ব্যাপারে গণমুখী প্রগতিশীল।
পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ৮০ হাজার সদস্য বেতন বৃদ্ধি (তখন বেতন ছিল তৃতীয় শিক্ষক ১৯ টাকা, ২য় শিক্ষক ২৭ প্রথম শিক্ষক ২৯ টাকা মাত্র) সহ অন্যান্য দাবি আদায়ের জন্য ১৯৫১ সালের ১ এপ্রিল থেকে ধর্মঘট শুরু করে। এই দাবির সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ঢাকার আরমানীটোলা ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করে।(ক্রমশ.)
সভাপতি : মওলানা ভাসানী
সহ-সভাপতি : আতউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহম্মদ খান
সাধারণ সম্পাদক : শামসুল হক
যুগ্ম সম্পাদক : শেখ মুজিবুর রহমান (অন্তরীণ অবস্থায়)
সহকারী সম্পাদক : খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এ, কে, এম রফিকুল হোসেন
কোষাধ্যক্ষ : ইয়ার মুহম্মদ খাঁন
১৯৫৫ সালে দলের নাম পরিবর্তন হয়ে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয়। বস্তুত ভাষা আন্দোলন থেকে ধারাবাহিক সংগ্রামসমূহকে মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরের কৃতিত্ব এই দলটির। তবে ১৯৫৭ সালে দল থেকে ভাসানী চলে গিয়ে অন্য দল (ন্যাপ) করায় এবং ১৯৬৩তে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরে শেখ মুজিব দলের শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছেন। ঐতিহাসিক ৬ দফা (১৯৬৬) দিয়ে সংগ্রামের পথ বেয়ে সাহসী এই মানুষটির বাঙালী জাতির জনক হিসেবে বরণীয় হওয়ার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ।
এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আরেক জনপ্রিয় নেতা শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ভারত বিভক্তির সময় অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক সরকারের এ্যাডভোকেট জেনারেলের চাকরি নেন। রাজনীতিতে ফেরেন ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই বিপুপ্ত কে এসপি পুনর্গঠনের মাধ্যমে। ভাসানী- সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের প্রয়োজন হয়েছিল তার জনপ্রিয়তার কারণে তাকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের।
১৯৪৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের বার্ষিক নির্বাচনী সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকার আরমানীটোলা ময়দানে এক ছাত্রজনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানী, মিয়া ইফতেখারউদ্দিন প্রমুখ বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ ভাষণে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা, চাকরি ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যা সাম্যের দাবি জানানো হয়।
১৯৪৯ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংসদের সভায় বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি জানানো হয়। পূর্ব বাংলা সরকার ১৯৪৯ সালের ভাষা কমিটি, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী সরকারী কর্মচারী, বিধান পরিষদের সদস্যদের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালান। ৩০১ জন উত্তর দাতার মধ্যে ১৮৭ জন বাংলা লিপি বজায় রাখার পক্ষে এবং ৯৬ জন আরবি লিপি ও ১৮ জন রোমান লিপি প্রবর্তনের পক্ষে মত দেন।
১৯৫০ সালের ৩০ মে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী উর্দুর মাধ্যমে শিক্ষাদান প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। ১৯৫০ সালের ১২ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজে ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়।
১৯৫০ সালের ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পূর্ব বাংলা শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি সফল করার জন্য বিবৃতি প্রদানে করেন অবজারভার সম্পাদক আব্দুস সালাম, সাংবাদিক ইউনিয়ন সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী, কাজী মোঃ ইদ্রিস, সৈনিক সম্পাদক শাহেদ আলী সৈয়দ নুরুদ্দিন, ইনসাফ সম্পাদক মহীউদ্দিন আহম্মদ, আতাউর রহমান খান, নুরুল হুদা, কমরুদ্দিন আহম্মদ, শামসুল হক, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা বেগম, আলী আহম্মদ, শামসুদ্দিন আহম্মদ, মোঃ আবুল হোসেন, আলমাস আলী, আবু তাহের প্রমুখ। ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি হলে প্রায় আড়াই শ’ ছাত্র প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সম্মেলন শুরু হয়। কিন্তু অলি আহাদের উদ্বোধনী ভাষণের পরে আবু হেনা মোহসীন ও আহসানউল্লাহর নেতৃত্বে একদল সরকারী এজন্টে হামলা চালালে তখনকার মতো সম্মেলন বন্ধ করে সন্ধ্যায় ফজলুল হক হলে পুনরায় সম্মেলনের কাজ চলে। পরদিন ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে সম্মেলন ও বিকেলে আরমানীটোলা ময়দানে জনসভার মধ্যে দিয়ে দু’দিনব্যাপী সম্মেলন শেষ হয়। এই সম্মেলনে শিক্ষা সংক্রান্ত ১৬ দফা প্রস্তাব ও গণশিক্ষা পরিষদ নামে একটি পরিষদ গঠন করা হয়। ৯ সদস্য বিশিষ্ট্য পরিষদের সেক্রেটারিয়েটের কনভেনর নির্বাচিত হন আব্দুল অদুদ।
১৯৪৮ সালের পর থেকে ছাত্ররা প্রতি বছর ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিনটি ১১ মার্চকে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদর সঙ্গে পালন করতে থাকে। তবে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। তবে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ছাত্র আন্দোলন, আলাদাভাবে ছাত্র শিক্ষক ধর্মঘট, যুবলীগের অভ্যুদয়, শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে বিছিন্ন আন্দোলন ১৯৫১ সালের ঘটনাবলীর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য। সেসময় ঢাকা ছাড়া প্রদেশে কোন মেডিকেল কলেজ ছিল না। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে ৫টি মেডিকেল স্কুল ছিল। ছাত্ররা ৫টি মেডিকেল স্কুলকে কলেজ ও এল এম এফ পাস ডাক্তারদের সংক্ষিপ্ত এমবিবিএস কোর্স প্রবর্তনের দাবিতে ২৫ জানুয়ারি ১৯৫১ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করে। উল্লেখ্য, পশ্চিম পাকিস্তানে এই সব ব্যবস্থা আগেই নেয়া হয়েছিল। সরকারী নির্যাতন, ছাত্র গ্রেফতারসহ যাবতীয় দমননীতি সত্ত্বেও ছাত্ররা ধর্মঘট চালিয়ে যেতে সক্ষম হয় যার ফলে সরকার ৭ মে দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে ৯ মে ’৫১ ছাত্ররা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে। ১৯৫১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ড. মোঃ শহীদুল্লাহ, অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ, ড. কাজী মোতাহার হোসেনসহ বহু সংখ্যক গণপরিষদ ও প্রাদেশিক সদস্য, অধ্যাপক, সাংবাদিক, পেশাজীবী পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এক স্মারকলিপিতে ১ এপ্রিল থেকে সরকারী অফিসে বাংলাভাষা চালু করার দাবি জানান। একই বছরে ১৬ মার্চ কুমিল্লায় পূর্ববাংলা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষকদের সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ব্যতীত অন্য কোন ভাষা আরোপ করা হইলে ইহার বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহ করা উচিত। বাংলা ভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রাহ করিব। নতুন ভাষা আরোপ করা পূর্ববঙ্গে গণহত্যার শামিল।
১৯৫১ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবসে ঢাকাসহ প্রদেশের সর্বত্র ছাত্র ধর্মঘট, মিছিল ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুপুরে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্রলীগের সম্পাদক খালেক নেওয়াজ। এই সভায় আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। এই কর্মপরিষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন হাবিবুর রহমান শেলী, তাজউদ্দীন আহমদ, বদিউর রহমান, মাকসুদ আহম্মদ, আনোয়ারুল হক, মোশারফ হোসেন, আব্দুল ওদুদ, নুরুল আলম, সালাউদ্দিন, রুহুল আমীন চৌধুরী, নাদিরা বেগম, জিলুর রহমান সিদ্দীকী প্রমুখ। ১৯৫১ সালের ১৭ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মপরিষদের এক সভায় ভাষার প্রশ্নটি গণপরিষদের আলোচনার জন্য গণপরিষদের কতিপয় বাঙালী সদস্যদের কাছে তার বার্তা প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই দিন নারায়ণগঞ্জ রহমতউল্লাহ ইনস্টিটিউটে অলি আহাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তব্য রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান, মোহাম্মদ তোয়াহ, শামসুল হুদা, বজলুর রহমান প্রমুখ।
১৯৫১ সালের ২৭ মার্চ ঢাকায় যুবলীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সময় ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি ছিল তাই উদ্যোক্তারা ঢাকা বার লাইব্রেরিতে সম্মেলন করতে ব্যর্থ হয়। জিনজিরা বাজার এবং বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকায় বসে সম্মেলন করে। সম্মেলন উদ্বোধন করেন অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালাম, সভাপতিত্ব করেন মাহমুদ আলী এবং বক্তব্য রাখেন অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান নুরুল হুদা। খসড়া ম্যানিফেস্টো পেশ করেন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সম্পাদক আবদুস সামাদ। প্রস্তাবাবলী পাঠ করেন কে জি মোস্তফা। ২৮ মার্চ ৩০ সদস্যের কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়। প্রগতিশীল যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত এই সংস্থার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন যথাক্রমে মাহমুদ আলী ও অলি আহাদ। সহ-সভাপতি খাজা আহম্মদ, ইয়ার মুহম্মদ খান, সামসুজ্জোহা, আব্দুল মজিদ, দৌলতন্নেসা, যুগ্ম সম্পাদক, আব্দুল মতিন, রুহুল আমিন। কোষাধ্যক্ষ তোসাদ্দক আহম্মদ চৌধুরী, দফতর সম্পাদক- আনিসুজ্জামান। সদস্যবৃন্দের মধ্যে ছিলেন নুরুল হুদা, মোহাম্মদ তোয়াহ, মতিয়র রহমান, আব্দুল হালিম, আব্দুস সামাদ, মকসুদ আহাম্মদ, কে জি মোস্তফা, কবির আহম্মদ, আব্দুল ওদুদ, আঃ গাফ্ফার চৌধুরী, প্রাণেশ সমদ্দার, তাজউদ্দীন আহমদ, আকরাম হোসেন, মোতাহার হোসেন ও রোকেয়া খাতুন। ১৯৫১ সালের ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে যুবলীগের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে নতুন কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়। এরা হলেন সভাপতি-মাহমুদ আলী। সহ-সভাপতি- মির্জা গোলাম হাফিজ, ফয়েজ আহম্মদ, মোহাম্মদ তোয়াহ, ইয়ার মহম্মদ খান ও শামসুজ্জোহা। সাধারণ সম্পাদক-অলি আহাদ। যুগ্ম সম্পাদক-মহম্মদ সুলতান ও ইমাদুল্লাহ। কোষাধ্যক্ষ মাহবুব জামাল জাহেদী। দফতর সম্পাদক- আনিসুজ্জামান। সদস্য-আব্দুল হালিম, আব্দুল মতিন, এবিএম মূসা, নুরুল হুদা, আনোয়ারুল হোসেন, আব্দুল ওদুদ, সুফী খাঁন, আলী আশরাফ, এ রহমান সিদ্দিকী, মুতাহের হোসেন, নুরুল রহমান, মতিউর রহমান, আকমল হোসেন, মকসুদ আহম্মদ, মফিজুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুস সামাদ, দেওয়ান মাহবুব আলী, আব্দুল কাদের প্রাণেশ সমাদ্দার ও কে জি মোস্তফা। এই সময়ে যুবলীগের ভূমিকা ছিল বাংলা ভাষাসহ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বঞ্চনার ব্যাপারে গণমুখী প্রগতিশীল।
পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ৮০ হাজার সদস্য বেতন বৃদ্ধি (তখন বেতন ছিল তৃতীয় শিক্ষক ১৯ টাকা, ২য় শিক্ষক ২৭ প্রথম শিক্ষক ২৯ টাকা মাত্র) সহ অন্যান্য দাবি আদায়ের জন্য ১৯৫১ সালের ১ এপ্রিল থেকে ধর্মঘট শুরু করে। এই দাবির সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ঢাকার আরমানীটোলা ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করে।(ক্রমশ.)
No comments