রাজধানীর শাহবাগে নতুন বসন্ত ॥ হোক বাঙালীর জয়- স্বদেশ রায়
বাতাসে নবীন বসন্তের গন্ধ। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে পুব আকাশের সূর্যের রশ্মিগুলো কোমল উজ্জ্বল রং
নিয়ে ঝরে পড়েছে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাউন্ডের আমগাছের
অজস্র মুকুলের ওপর।
নবীন মুকুলগুলো নবীন বসন্তের সূর্যের
আলোয় রুপোর তরবারির মতো ঝক ঝক করছে। আমের মুকুলের রং এত উজ্জ্বল এর আগে কোন
দিন দেখেনি। শুধু আমের মুকুল নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের দেয়াল অবধি এই বিশাল চত্ব¡রের চারদিকে যেন আরও কোন
নতুন সূর্য উঠেছে যার আলোয় সব কিছু আজ আরও বেশি উজ্জ্বল। যেন সেই ছোট বেলায়
পড়া গল্পের সেই সব বীর রাজপুত্র আর তার সঙ্গে বীরাঙ্গনা রাজকন্যার হাতের
তরবারির মতো ঝলসে উঠছে চোখের সামনে। এই উজ্জ্বল মুখগুলো সব এক একটি নতুন
সূর্য হয়ে বসে আছে রাজপথে। তাদের মুখের আলোয়, তাদের নিশ্বাসে যেন নতুন
গন্ধ, অনাবিল বিশুদ্ধতা। এক নতুন আলো, নতুন বাতাস।
বুধবারের সকালে এই আলো আর বাতাসের ভেতর দাঁড়িয়ে মনে হলো চব্বিশ ঘণ্টা পরে এই প্রথম নিশ্বাস নিতে পারলাম শুদ্ধ বাতাসে। ৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার সারাদেশের বাতাস বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। নিশ্বাস নেবার মতো কোন বাতাস ছিল না। কারণ, দীর্ঘ এক চল্লিশ বছরের পথ পরিক্রমার পরে একটি দিন ছিল গত মঙ্গলবার। এই পথ সহজে পাড়ি দেয়নি এ দেশের মানুষ। পৃথিবীর যে কটি জাতি সব থেকে বেশি ত্যাগ করে তার প্রগতি পথে এগিয়েছে বাঙালীর পথচলা হিসাব করলে সে থাকবে তাদের প্রথম কাতারে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত মাড়িয়ে, সাড়ে চার লাখ মা-বোনের আব্রু হারানো পথ সদা লজ্জায় পাড়ি দিয়ে, বঙ্গবন্ধুর রক্তস্নাত পথে হেঁটে, মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগী পুরুষ তাজউদ্দিনের রক্ত মাড়িয়ে, তারপর রাজপথে জয়নাল, জাফর, কমরেড তাজুল সর্বোপরি নূর হোসেন এমনি করে কত পথ এই চল্লিশ বছরে পাড়ি দিতে হয়েছে। এ ছাড়া আছে কত লাখ তরুণের যৌবন রাজপথে বিলিয়ে দেয়া। যার হিসাব কোনদিন কোন ইতিহাস রাখে না। যা অন্তত কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া বাতাসের মতোই হারিয়ে যায়। এই পথ পাড়ি দিয়ে গত মঙ্গলবার জাতি পৌঁছে ছিল একটি নতুন সূর্যোদয়ের মুহূর্তে। এক চল্লিশ বছর পরে প্রভাতের নতুন সূর্যের আলোর রশ্মির থেকেও অনেক বেশি দ্রুত গতিতে এ জাতির প্রতিটি মানুষ তার হাতের মুঠি দৃঢ় করেছিল। হ্যা, আজ আমরা পারব। যে আমার ভাইয়ের রক্ত নিয়েছে, আমার বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে, আমার পিতাকে হত্যা করেছে। আমাকে কবিতা লিখে যে কবি জাগিয়ে তুলত তাঁকে হত্যা করেছে। আমাকে প্রতিদিন যে সাংবাদিক তার নির্ভীক কলমের খোঁচায় জাগিয়ে তুলত তাকে হত্যা করেছে। সেই হত্যাকারীর শাস্তি দিয়ে, তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আমরা কলঙ্ক মুক্তির এক নতুন অধ্যায় শুরু করব। কিন্তু তার বদলে জাতি দেখতে পেল আদালতের রায়ের পরে সে আদালতে দাঁড়িয়ে বিকৃত মুখে সমস্ত জাতির মুখে কালি মাখিয়ে দিয়ে বিজয় চিহ্ন দেখাচ্ছে।
ওই মুহূর্তের পরে বাংলাদেশের বাতাসে বেঁচে থাকার জন্য কোন নিশ্বাস নেয়ার উপায় ছিলো না। মঙ্গলবার সে উপায় ছিল না। বিষাক্ত বাতাসে ভরে উঠেছিল দেশ। দেশত্যাগ আর আত্মহত্যাÑএই দুই পথ ছাড়া আর কোন পথ তখন আমাদের যাদের কোন কিছু ভেঙ্গে ফেলার শক্তি নেইÑ তাদের সামনে আর খোলা ছিল না। কিন্তু আর যাই হোক এ তো বাংলাদেশ! কবিকে হয়ত এজন্য সকলে বেশি ভালবাসে। এই জন্যই হয়ত বলে, কবি কখনও মিথ্যা বলে না। গত মঙ্গলবার আবারও তাই প্রমাণিত হলো, বাংলাদেশ মাথা নোয়াবার নয়। সকল দেশের সেরা আমার জন্মভূমি! এখানে যখন অনেক বড় বড় মাথা নুয়ে যায় তখন কোথা থেকে যেন নবীন মাথা এসে মুহূর্তে হিমালয়ের মতো সুউচ্চ মাথা নিয়ে জেগে ওঠে। এখানে যখন আমরা অন্ধ হয়ে বাতাসকে বিষাক্ত করি তখন সেই বাতাসকে তাড়িয়ে দেবার জন্য সহস্র আম্র মুকুলের মতো নতুন মুকুল জেগে ওঠে রাজপথে। তাই বিকেল হতে খবর হয়ে গেল যারা এতদিন শুধু আশা নিয়ে ঘরে বসে ছিল, যে তরুণ-তরুণী ফেসবুকে সময় কাটাত, ব্লগে লিখত, আর পরীক্ষায় ভাল রেজাল্টের জন্য পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল তারা নেমে এসেছে বাতাসের বিষ মোচনে।
মঙ্গলবার সারা রাত জেগে জেগে টিভির পর্দায় ওই তরুণদের খবর বার বার দেখি। দেখেও যেন শেষ হয় না। কেবল মনে হয়, এই তো আমার সেই বাংলাদেশ! যে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর মতো উঁচু। যে বাংলাদেশ ক্ষুদিরামের মতো বিশাল ভারতে চেপে বসা ইংরেজ রাজত্ব শেষ করতে একটি বোমা নিয়ে বেরিয়ে পড়া বাংলাদেশ। টেলিভিশনের পর্দায় রাতের আলোয় রাজপথের ওই মুখগুলোকে যেন শুধু মুখ মনে হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল হাজার হাজার ফুল ফুটেছে ওখানে। যাদের গন্ধে আমার শোবার ঘরেও কাল যে বিষাক্ত বাতাস ঢুকে ছিল, আমার বইয়ের পাতার ভাজে ভাজে কাল যে বিষাক্ত বাতাস ঢুকেছিল, আমার পড়ার রুমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতাগুলোতে যে বিষাক্ত বাতাস ঢুকেছিলÑ রাজপথে সারা রাত ধরে এই ফুলগুলো যেন সুবাস ছড়াচ্ছে সেই বিষাক্ত বাতাসকে তাড়ানোর জন্য।
মঙ্গলবার যে তরুণরা এই নতুন বসন্তের বাতাস নিয়ে রাজপথে নেমে আসে, ইতিহাস তাদের কোথায় রাখবে জানিনা, তাদের কি বলে সম্বোধন ও শ্রদ্ধা করব তাও জানা নেই। তবে এটুকু বলা যায়, যখন শ্রদ্ধা ও আস্থার ভিতগুলো হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ছিল, যখন বুকের ভিতর পাথর চেপে বসেছিল সেই সময় তারা শ্রদ্ধা ও আস্থার জায়গাটি তৈরি করে আবার।
বুধবার সকালেই অতি নীরবে গিয়ে দাঁড়াই তাদের পাশে। চোখ পড়ে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের আমগাছটির অজস্র মুকুলের ওপর। সূর্যের আলোয় প্রতিটি মুকুল ঝলসে উঠেছিল। কিন্তু আসলে কি সূর্যের আলোয়! না যাদের পাশে গিয়ে নীরবে দাঁড়িয়েছিলাম সেই তরুণ মুখগুলোর ভেতর দিয়ে ঝলসে ওঠা নতুন সূর্যের আলোয়! ওরা খোলা আকাশে সূর্যের নিচে ভীষণ প্রতিজ্ঞ এক একটি দৃঢ় মুখ নিয়ে বসে। ওদের হাত সেøাগানের সঙ্গে সঙ্গে একাত্তরের লাখো মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র হয়ে যেন গর্জে উঠছে। ওদের সেøাগানগুলো যেন বারুদের গোলা হয়ে বেরিয়ে আসছে। সেখানে সারি বেঁধে বসে আছে শত শত তরুণী। রাতের শিশির আর দিনের সূর্য কোনটাই যেন তাদের ক্লান্ত করেনি। বরং করেছে আরও দৃঢ়। প্রতিটি মুখ যেন একটি বারুদের গোলা। তারা তাদের শক্র চিহ্নিত করেছে। তারা জেনেছে, আর তাদের ঘরে বসে থাকার সময় নেই। একটওু সময় নেই। তাদের এখন একাত্তরের ওই সব ধর্ষণকারী, নরঘাতক কাদের মোল্লা, সাঈদী, গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাকা সকলের ফাঁসি আদায় করতে হবে। তাদের সামনে আর কোন বিকল্প খোলা নেই। তাদের মুখের প্রত্যয় বলে দেয়, তারা যে কোন বাধাকে ভেঙ্গে ফেলতে পারে, ভাঙ্গার ভেতর দিয়ে নতুনের জন্ম দিতে পারে। পৃথিবীতে এটা চরম সত্য, তরুণকে মাঝে মাঝে অনেক কিছু ভাঙতে হয়। না ভাঙলে নতুনের জন্ম হয় না। ভাঙ্গনের ভেতর দিয়েই নদী গভীর হয়, নদী খরস্রোতা হয়।
বাস্তবে গত নবেম্বর থেকে যখনই রাজপথে কিছু কুলাঙ্গার, পাকিস্তানীদের রেখে যাওয়া বীজে উৎপত্তি কিছু জারজের উন্মত্ততা দেখি তখন বার বার মনে হয়েছে, কবে নামবে আমাদের শহীদের রক্তে শপথ নেয়া, লাখো শহীদের রক্তধারা যাদের ধমনীতে প্রবাহিত সেই তরুণরা। বুধবার শাহবাগের এই নবীন বসন্তের পাশে এসে দাঁড়িয়ে মনে হলো, আজ নেমেছে সেই তরুণ, আজ উঠেছে নতুন সূর্য! মনে হলো, এদের এখন বরণ করার, আহ্বান করার সময় এসেছে সকলের সামনে। গান্ধী যখন ইংরেজের সঙ্গে আপোস করে, সুভাষ বোসকে গু-া দিয়ে পেটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন সে সময় রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন। তিনি তখন একটি মুহূর্ত অপেক্ষা করেননি। সেদিন তিনিই সুভাষ বোসকে দেশনায়কের পদে বরণ করে নিয়েছিলেন। আজ বাংলাদেশ যে সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে এ মুহূর্তে রাজধানীর শাহবাগে যে নতুন প্রজন্ম নতুন বসন্ত নিয়ে জেগে উঠেছে তাদের বরণ করার সময় এসেছে।
কারণ, পাকিস্তানী বীজের ধারায় উৎপাদিত কিছু কুলাঙ্গার আজ এ দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা রাষ্ট্রের ইউনিফর্মের গায়ে হাত দিয়েছে অর্থাৎ তারা আবার রাষ্ট্র ও সংবিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এদের নির্মূল করা ছাড়া বাংলাদেশের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। এরা অতি সামান্য। রাজধানীর শাহবাগ চত্ব¡রে যে বসন্ত নেমেছে, সাধারণ তরুণরা যদি এই বসন্ত এখন গোটা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারে, প্রতিটি শহরে শহরে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এ বসন্ত জাগিয়ে তুলতে হবে তাদের। ওই যারা কুলাঙ্গার; আমার শহীদের রক্তে কেনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ওদের ভিতর কোন বারুদ নেই। ওরা মৃত। ওরা ছারপোকার থেকেও ক্ষুদ্র। ওরা কয়েকটি ছারপোকা মাত্র। কিন্তু রাজধানীর শাহবাগে যে তরুণ-তরুণী নেমেছে তারা অজস্ত্র শক্তিতে শক্তিমান। তাদের সামনে আছে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়া লাখো শহীদের ইতিহাস। তাদের আছে শত্রুতে পরাজিত করার জন্য এগিয়ে যাবার সহস্র গান, কবিতা, ছবি। যা রক্তকে দেয় নতুন নেশা। যা কেবল বিজয়ের কথা শোনায়। যেখানে মৃত্যু ও জীবন কোলাকুলি করে মহাআনন্দে।
শাহবাগের তরুণদের পাশে দাঁড়িয়ে, ২৪ ঘণ্টা পর বিশুদ্ধ বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে মনে হলো বাংলাদেশ আর পরাজিত হবে না। ৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার যে পরাজয়ের কালো কালি বাঙালীর মুখে লেগেছে তা বাঙালী অচিরেই মুছে ফেলতে পারবে। গত তিন মাস ধরে পাকিস্তানী বীজেরা দেশের রাজপথে যে তা-ব দেখিয়ে অপমান করছে দেশের স্বাধীনতাকে, দেশের পতাকাকে, দেশের সংবিধানকে। তাদেরক রুখে দেয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ছারপোকাগুলো শেষ করা এখন এই তরুণদের কাছে সময়ের ব্যাপার মাত্র। এবং এ আশায় এখন বুক বাধা যায় যে, ব্যর্থতার ভেতর দিয়ে, আঘাত খেয়ে বাঙালীর নতুন প্রজন্ম গত মঙ্গলবার জেগে উঠেছে। এখন তাদের এই স্রোত পদ্মার স্রোতের মতো বেগবান করে ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশে। সারা দেশের সাধারণ তরুণ- তরুণী জেগে উঠে যেন শাহবাগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়া, দিনাজপুর, বরিশাল এমনি করে সারা দেশ প্রলয় দোলায় জেগে উঠুক। তখন ওই কুলাঙ্গাররা দুই ঘণ্টার ভেতর বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত হবে। সাধারণ এই তরুণদের দেখে এখন মনে হয়, যুব সমাজের আর বসে থাকার সময় নেই। কারণ, মায়ের আব্রুর, বোনের আব্রুর আর শহীদের রক্তের মূল্য দেবার এই শেষ সুযোগ। এবার যদি ঘাতকরা ছাড়া পায় তাহলে আর কোন সুযোগ এ জাতির জন্য কোনদিন আসবে না। তবে রাজধানীর শাহবাগের বসন্ত নিশ্চিত করে দিচ্ছে, বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
অবশ্য বিভ্রান্তি ছড়ানোর মানুষ বহু আছে। মঙ্গলবার সারারাত টেলিভিশনে দেখেছি এক শ্রেণীর লোক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার বলছে, ’৭১-এর বাস্তবতা আর বর্তমান বাস্তবতা এক নয়। এদের কথার ভেতর একাত্তরের পাকিস্তানী টেলিভিশনের ও রেডিওর সেই কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়। যারা তখন বলত পূর্ব পাকিস্তানে কিছুই ঘটছে না। বা সেই সব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বা সাংবাদিকের মতো যারা বলত কোন মুক্তিযোদ্ধা নেই পূর্ব বাংলায়। এরা যুগে যুগে থাকে। তাদের কেবল বলব, এয়ার কন্ডিশন রুম ছেড়ে শাহবাগের খোলা আকাশের নিচে গিয়ে দেখুন ’৭১-এর বাস্তবতা বাংলাদেশে আছে কিনা?
বেলা বাড়তে বাড়তে বুধবার সকালে দেখেছি, শাহবাগে কেবল জনস্রোত বাড়ছিল। এই লেখা যখন লিখছি তখন আরও বাড়বে এ স্রোত। এই স্রোত ছড়িয়ে যাক সারা দেশে। নতুন প্রজন্ম তোমাদের হাতে এখন দেশের বাতাসকে বিষমুক্ত করার, জাতিকে নিশ্বাস নেবার সুযোগ করে দেবার দায়িত্ব। যে মহাযাত্রা তোমরা শুরু করেছ, এই মহাযাত্রা শুরুর জন্য অভিনন্দন জানিয়ে তোমাদের ছোট করব না। জয়ী তোমরা হবেই। জয় হোক তোমাদের। জয় হোক বাংলাদেশের। রবীন্দ্রনাথ থেকে একটি লাইন নিয়ে বলি, দুঃখ সহার তপস্যাতে হোক বাঙালীর জয়।
swadeshroy@gmail.com
বুধবারের সকালে এই আলো আর বাতাসের ভেতর দাঁড়িয়ে মনে হলো চব্বিশ ঘণ্টা পরে এই প্রথম নিশ্বাস নিতে পারলাম শুদ্ধ বাতাসে। ৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার সারাদেশের বাতাস বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। নিশ্বাস নেবার মতো কোন বাতাস ছিল না। কারণ, দীর্ঘ এক চল্লিশ বছরের পথ পরিক্রমার পরে একটি দিন ছিল গত মঙ্গলবার। এই পথ সহজে পাড়ি দেয়নি এ দেশের মানুষ। পৃথিবীর যে কটি জাতি সব থেকে বেশি ত্যাগ করে তার প্রগতি পথে এগিয়েছে বাঙালীর পথচলা হিসাব করলে সে থাকবে তাদের প্রথম কাতারে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত মাড়িয়ে, সাড়ে চার লাখ মা-বোনের আব্রু হারানো পথ সদা লজ্জায় পাড়ি দিয়ে, বঙ্গবন্ধুর রক্তস্নাত পথে হেঁটে, মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগী পুরুষ তাজউদ্দিনের রক্ত মাড়িয়ে, তারপর রাজপথে জয়নাল, জাফর, কমরেড তাজুল সর্বোপরি নূর হোসেন এমনি করে কত পথ এই চল্লিশ বছরে পাড়ি দিতে হয়েছে। এ ছাড়া আছে কত লাখ তরুণের যৌবন রাজপথে বিলিয়ে দেয়া। যার হিসাব কোনদিন কোন ইতিহাস রাখে না। যা অন্তত কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া বাতাসের মতোই হারিয়ে যায়। এই পথ পাড়ি দিয়ে গত মঙ্গলবার জাতি পৌঁছে ছিল একটি নতুন সূর্যোদয়ের মুহূর্তে। এক চল্লিশ বছর পরে প্রভাতের নতুন সূর্যের আলোর রশ্মির থেকেও অনেক বেশি দ্রুত গতিতে এ জাতির প্রতিটি মানুষ তার হাতের মুঠি দৃঢ় করেছিল। হ্যা, আজ আমরা পারব। যে আমার ভাইয়ের রক্ত নিয়েছে, আমার বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে, আমার পিতাকে হত্যা করেছে। আমাকে কবিতা লিখে যে কবি জাগিয়ে তুলত তাঁকে হত্যা করেছে। আমাকে প্রতিদিন যে সাংবাদিক তার নির্ভীক কলমের খোঁচায় জাগিয়ে তুলত তাকে হত্যা করেছে। সেই হত্যাকারীর শাস্তি দিয়ে, তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আমরা কলঙ্ক মুক্তির এক নতুন অধ্যায় শুরু করব। কিন্তু তার বদলে জাতি দেখতে পেল আদালতের রায়ের পরে সে আদালতে দাঁড়িয়ে বিকৃত মুখে সমস্ত জাতির মুখে কালি মাখিয়ে দিয়ে বিজয় চিহ্ন দেখাচ্ছে।
ওই মুহূর্তের পরে বাংলাদেশের বাতাসে বেঁচে থাকার জন্য কোন নিশ্বাস নেয়ার উপায় ছিলো না। মঙ্গলবার সে উপায় ছিল না। বিষাক্ত বাতাসে ভরে উঠেছিল দেশ। দেশত্যাগ আর আত্মহত্যাÑএই দুই পথ ছাড়া আর কোন পথ তখন আমাদের যাদের কোন কিছু ভেঙ্গে ফেলার শক্তি নেইÑ তাদের সামনে আর খোলা ছিল না। কিন্তু আর যাই হোক এ তো বাংলাদেশ! কবিকে হয়ত এজন্য সকলে বেশি ভালবাসে। এই জন্যই হয়ত বলে, কবি কখনও মিথ্যা বলে না। গত মঙ্গলবার আবারও তাই প্রমাণিত হলো, বাংলাদেশ মাথা নোয়াবার নয়। সকল দেশের সেরা আমার জন্মভূমি! এখানে যখন অনেক বড় বড় মাথা নুয়ে যায় তখন কোথা থেকে যেন নবীন মাথা এসে মুহূর্তে হিমালয়ের মতো সুউচ্চ মাথা নিয়ে জেগে ওঠে। এখানে যখন আমরা অন্ধ হয়ে বাতাসকে বিষাক্ত করি তখন সেই বাতাসকে তাড়িয়ে দেবার জন্য সহস্র আম্র মুকুলের মতো নতুন মুকুল জেগে ওঠে রাজপথে। তাই বিকেল হতে খবর হয়ে গেল যারা এতদিন শুধু আশা নিয়ে ঘরে বসে ছিল, যে তরুণ-তরুণী ফেসবুকে সময় কাটাত, ব্লগে লিখত, আর পরীক্ষায় ভাল রেজাল্টের জন্য পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল তারা নেমে এসেছে বাতাসের বিষ মোচনে।
মঙ্গলবার সারা রাত জেগে জেগে টিভির পর্দায় ওই তরুণদের খবর বার বার দেখি। দেখেও যেন শেষ হয় না। কেবল মনে হয়, এই তো আমার সেই বাংলাদেশ! যে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর মতো উঁচু। যে বাংলাদেশ ক্ষুদিরামের মতো বিশাল ভারতে চেপে বসা ইংরেজ রাজত্ব শেষ করতে একটি বোমা নিয়ে বেরিয়ে পড়া বাংলাদেশ। টেলিভিশনের পর্দায় রাতের আলোয় রাজপথের ওই মুখগুলোকে যেন শুধু মুখ মনে হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল হাজার হাজার ফুল ফুটেছে ওখানে। যাদের গন্ধে আমার শোবার ঘরেও কাল যে বিষাক্ত বাতাস ঢুকে ছিল, আমার বইয়ের পাতার ভাজে ভাজে কাল যে বিষাক্ত বাতাস ঢুকেছিল, আমার পড়ার রুমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতাগুলোতে যে বিষাক্ত বাতাস ঢুকেছিলÑ রাজপথে সারা রাত ধরে এই ফুলগুলো যেন সুবাস ছড়াচ্ছে সেই বিষাক্ত বাতাসকে তাড়ানোর জন্য।
মঙ্গলবার যে তরুণরা এই নতুন বসন্তের বাতাস নিয়ে রাজপথে নেমে আসে, ইতিহাস তাদের কোথায় রাখবে জানিনা, তাদের কি বলে সম্বোধন ও শ্রদ্ধা করব তাও জানা নেই। তবে এটুকু বলা যায়, যখন শ্রদ্ধা ও আস্থার ভিতগুলো হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ছিল, যখন বুকের ভিতর পাথর চেপে বসেছিল সেই সময় তারা শ্রদ্ধা ও আস্থার জায়গাটি তৈরি করে আবার।
বুধবার সকালেই অতি নীরবে গিয়ে দাঁড়াই তাদের পাশে। চোখ পড়ে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের আমগাছটির অজস্র মুকুলের ওপর। সূর্যের আলোয় প্রতিটি মুকুল ঝলসে উঠেছিল। কিন্তু আসলে কি সূর্যের আলোয়! না যাদের পাশে গিয়ে নীরবে দাঁড়িয়েছিলাম সেই তরুণ মুখগুলোর ভেতর দিয়ে ঝলসে ওঠা নতুন সূর্যের আলোয়! ওরা খোলা আকাশে সূর্যের নিচে ভীষণ প্রতিজ্ঞ এক একটি দৃঢ় মুখ নিয়ে বসে। ওদের হাত সেøাগানের সঙ্গে সঙ্গে একাত্তরের লাখো মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র হয়ে যেন গর্জে উঠছে। ওদের সেøাগানগুলো যেন বারুদের গোলা হয়ে বেরিয়ে আসছে। সেখানে সারি বেঁধে বসে আছে শত শত তরুণী। রাতের শিশির আর দিনের সূর্য কোনটাই যেন তাদের ক্লান্ত করেনি। বরং করেছে আরও দৃঢ়। প্রতিটি মুখ যেন একটি বারুদের গোলা। তারা তাদের শক্র চিহ্নিত করেছে। তারা জেনেছে, আর তাদের ঘরে বসে থাকার সময় নেই। একটওু সময় নেই। তাদের এখন একাত্তরের ওই সব ধর্ষণকারী, নরঘাতক কাদের মোল্লা, সাঈদী, গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাকা সকলের ফাঁসি আদায় করতে হবে। তাদের সামনে আর কোন বিকল্প খোলা নেই। তাদের মুখের প্রত্যয় বলে দেয়, তারা যে কোন বাধাকে ভেঙ্গে ফেলতে পারে, ভাঙ্গার ভেতর দিয়ে নতুনের জন্ম দিতে পারে। পৃথিবীতে এটা চরম সত্য, তরুণকে মাঝে মাঝে অনেক কিছু ভাঙতে হয়। না ভাঙলে নতুনের জন্ম হয় না। ভাঙ্গনের ভেতর দিয়েই নদী গভীর হয়, নদী খরস্রোতা হয়।
বাস্তবে গত নবেম্বর থেকে যখনই রাজপথে কিছু কুলাঙ্গার, পাকিস্তানীদের রেখে যাওয়া বীজে উৎপত্তি কিছু জারজের উন্মত্ততা দেখি তখন বার বার মনে হয়েছে, কবে নামবে আমাদের শহীদের রক্তে শপথ নেয়া, লাখো শহীদের রক্তধারা যাদের ধমনীতে প্রবাহিত সেই তরুণরা। বুধবার শাহবাগের এই নবীন বসন্তের পাশে এসে দাঁড়িয়ে মনে হলো, আজ নেমেছে সেই তরুণ, আজ উঠেছে নতুন সূর্য! মনে হলো, এদের এখন বরণ করার, আহ্বান করার সময় এসেছে সকলের সামনে। গান্ধী যখন ইংরেজের সঙ্গে আপোস করে, সুভাষ বোসকে গু-া দিয়ে পেটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন সে সময় রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন। তিনি তখন একটি মুহূর্ত অপেক্ষা করেননি। সেদিন তিনিই সুভাষ বোসকে দেশনায়কের পদে বরণ করে নিয়েছিলেন। আজ বাংলাদেশ যে সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে এ মুহূর্তে রাজধানীর শাহবাগে যে নতুন প্রজন্ম নতুন বসন্ত নিয়ে জেগে উঠেছে তাদের বরণ করার সময় এসেছে।
কারণ, পাকিস্তানী বীজের ধারায় উৎপাদিত কিছু কুলাঙ্গার আজ এ দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা রাষ্ট্রের ইউনিফর্মের গায়ে হাত দিয়েছে অর্থাৎ তারা আবার রাষ্ট্র ও সংবিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এদের নির্মূল করা ছাড়া বাংলাদেশের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। এরা অতি সামান্য। রাজধানীর শাহবাগ চত্ব¡রে যে বসন্ত নেমেছে, সাধারণ তরুণরা যদি এই বসন্ত এখন গোটা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারে, প্রতিটি শহরে শহরে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এ বসন্ত জাগিয়ে তুলতে হবে তাদের। ওই যারা কুলাঙ্গার; আমার শহীদের রক্তে কেনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ওদের ভিতর কোন বারুদ নেই। ওরা মৃত। ওরা ছারপোকার থেকেও ক্ষুদ্র। ওরা কয়েকটি ছারপোকা মাত্র। কিন্তু রাজধানীর শাহবাগে যে তরুণ-তরুণী নেমেছে তারা অজস্ত্র শক্তিতে শক্তিমান। তাদের সামনে আছে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়া লাখো শহীদের ইতিহাস। তাদের আছে শত্রুতে পরাজিত করার জন্য এগিয়ে যাবার সহস্র গান, কবিতা, ছবি। যা রক্তকে দেয় নতুন নেশা। যা কেবল বিজয়ের কথা শোনায়। যেখানে মৃত্যু ও জীবন কোলাকুলি করে মহাআনন্দে।
শাহবাগের তরুণদের পাশে দাঁড়িয়ে, ২৪ ঘণ্টা পর বিশুদ্ধ বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে মনে হলো বাংলাদেশ আর পরাজিত হবে না। ৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার যে পরাজয়ের কালো কালি বাঙালীর মুখে লেগেছে তা বাঙালী অচিরেই মুছে ফেলতে পারবে। গত তিন মাস ধরে পাকিস্তানী বীজেরা দেশের রাজপথে যে তা-ব দেখিয়ে অপমান করছে দেশের স্বাধীনতাকে, দেশের পতাকাকে, দেশের সংবিধানকে। তাদেরক রুখে দেয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ছারপোকাগুলো শেষ করা এখন এই তরুণদের কাছে সময়ের ব্যাপার মাত্র। এবং এ আশায় এখন বুক বাধা যায় যে, ব্যর্থতার ভেতর দিয়ে, আঘাত খেয়ে বাঙালীর নতুন প্রজন্ম গত মঙ্গলবার জেগে উঠেছে। এখন তাদের এই স্রোত পদ্মার স্রোতের মতো বেগবান করে ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশে। সারা দেশের সাধারণ তরুণ- তরুণী জেগে উঠে যেন শাহবাগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়া, দিনাজপুর, বরিশাল এমনি করে সারা দেশ প্রলয় দোলায় জেগে উঠুক। তখন ওই কুলাঙ্গাররা দুই ঘণ্টার ভেতর বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত হবে। সাধারণ এই তরুণদের দেখে এখন মনে হয়, যুব সমাজের আর বসে থাকার সময় নেই। কারণ, মায়ের আব্রুর, বোনের আব্রুর আর শহীদের রক্তের মূল্য দেবার এই শেষ সুযোগ। এবার যদি ঘাতকরা ছাড়া পায় তাহলে আর কোন সুযোগ এ জাতির জন্য কোনদিন আসবে না। তবে রাজধানীর শাহবাগের বসন্ত নিশ্চিত করে দিচ্ছে, বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
অবশ্য বিভ্রান্তি ছড়ানোর মানুষ বহু আছে। মঙ্গলবার সারারাত টেলিভিশনে দেখেছি এক শ্রেণীর লোক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার বলছে, ’৭১-এর বাস্তবতা আর বর্তমান বাস্তবতা এক নয়। এদের কথার ভেতর একাত্তরের পাকিস্তানী টেলিভিশনের ও রেডিওর সেই কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়। যারা তখন বলত পূর্ব পাকিস্তানে কিছুই ঘটছে না। বা সেই সব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বা সাংবাদিকের মতো যারা বলত কোন মুক্তিযোদ্ধা নেই পূর্ব বাংলায়। এরা যুগে যুগে থাকে। তাদের কেবল বলব, এয়ার কন্ডিশন রুম ছেড়ে শাহবাগের খোলা আকাশের নিচে গিয়ে দেখুন ’৭১-এর বাস্তবতা বাংলাদেশে আছে কিনা?
বেলা বাড়তে বাড়তে বুধবার সকালে দেখেছি, শাহবাগে কেবল জনস্রোত বাড়ছিল। এই লেখা যখন লিখছি তখন আরও বাড়বে এ স্রোত। এই স্রোত ছড়িয়ে যাক সারা দেশে। নতুন প্রজন্ম তোমাদের হাতে এখন দেশের বাতাসকে বিষমুক্ত করার, জাতিকে নিশ্বাস নেবার সুযোগ করে দেবার দায়িত্ব। যে মহাযাত্রা তোমরা শুরু করেছ, এই মহাযাত্রা শুরুর জন্য অভিনন্দন জানিয়ে তোমাদের ছোট করব না। জয়ী তোমরা হবেই। জয় হোক তোমাদের। জয় হোক বাংলাদেশের। রবীন্দ্রনাথ থেকে একটি লাইন নিয়ে বলি, দুঃখ সহার তপস্যাতে হোক বাঙালীর জয়।
swadeshroy@gmail.com
No comments