রশাসন-মেধাভিত্তিক নিয়োগেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা পাবে by আকবর আলি খান
যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা প্রশাসনে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করতে পারব না এবং যোগ্যতা ও দক্ষতাই হয়ে উঠবে না পদোন্নতির ভিত্তি, ততক্ষণ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না এবং বাংলাদেশের প্রশাসনেও প্রতিষ্ঠিত হবে না মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
আমাদের প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামের সময়ে সমান্তরালভাবে গড়ে উঠেছিল। গত চার দশকে প্রশাসনে গতিশীলতা এসেছে। বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছে। জেন্ডার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু মূল লক্ষ্য এখনও অর্জন
করা হয়নি
একাত্তরের ১ মার্চ থেকেই বাংলাদেশ ছিল কার্যত স্বাধীন_ এমন যে মত রয়েছে তা গ্রহণ করে নিতে আমজনতা থেকে রাজনৈতিক পণ্ডিতদের মধ্যে তেমন ভিন্নতা নেই। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এ ভূখণ্ডের জনগণ আওয়ামী লীগের পক্ষে বিপুলভাবে রায় প্রদান করে। পাকিস্তানের ক্ষমতায় এ দলটির আসীন হতে কোনো আইনগত সমস্যা ছিল না। এক ধরনের প্রস্তুতিও চলছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানের শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়, যার প্রকাশ ছিল ৩ মার্চ নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা। অথচ ঢাকায় এ অধিবেশন অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এর প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবেই লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসে। শহর-বন্দর-গ্রাম হয়ে ওঠে অগি্নগর্ভ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনের সঙ্গে যুক্তরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ আন্দোলনে শামিল হয়ে যায়। সচিবালয় থেকে জেলা, মহকুমা ও থানা প্রশাসনের সর্বত্র একই চিত্র আমরা দেখতে পাই। ব্যক্তি হিসেবে ধরলে কেউ বেশি সক্রিয় ছিলেন, কেউবা জনস্রোতের সঙ্গে মিশে ছিলেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলা যায়, একটি বিকল্প প্রশাসন কার্যত ১ মার্চই রূপ নিতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। এখানেও প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তাকে আমরা উপস্থিত দেখতে পাই। কিন্তু ইতিহাস জানায়, এর অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন কাজ শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা অসহযোগ আন্দোলনের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' ঘোষণা দেওয়ার সময়ে এ আন্দোলনের ডাক দেন। কার্যত কিন্তু ১ মার্চ থেকেই চলছিল পাকিস্তানি প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে অসহযোগিতা। সামগ্রিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন পরিচালনা হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। প্রশাসনিক ও অন্যান্য বিষয়ে নির্দেশনা প্রদানের জন্য তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে কয়েকজনকে নিয়ে একটি টিমও কাজ করছিল। তবে তোপখানা রোডের সচিবালয় এবং জেলা, মহকুমা ও থানার সর্বত্র একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, সেটা বলা যাবে না। কোথাও কোথাও সরকারি প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা যৌথভাবে প্রশাসন পরিচালনা করতে থাকেন। আবার কোথাও কোথাও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা স্বাধীনতার আন্দোলনে তেমন সক্রিয়ভাবে যুক্ত না হওয়ায় রাজনৈতিক নেতৃত্বই এগিয়ে এসে প্রশাসনের অনেক কাজ পালন করতে থাকে। আবার কোনো কোনো এলাকায় দেখা যায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা নেতৃত্বের ভূমিকায় চলে এসেছেন। শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীর কমান্ডের আস্থা অর্জনেও তারা সফল হয়েছিলেন। তবে এ সময়ে প্রশাসনের কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ গড়ে ওঠেনি। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়নের নামে গণহত্যা শুরু হয় ঢাকায় এবং বাংলাদেশের রাজধানীর চিত্র দ্রুত পাল্টে যায়। কর্তৃত্ব চলে যায় সেনাবাহিনীর হাতে, যারা অস্ত্রের জোরে সবকিছু চালাতে তৎপর হয়। ক্রমে জেলা ও মহকুমায় সামরিক অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান সংহত থাকে এবং দেশের ভেতরে স্বাধীনতার সপক্ষে যে প্রশাসন গড়ে উঠেছিল তা ভেঙে যায়। তখন অনেক কর্মকর্তা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মুজিবনগর সরকারে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েন। তাদের নিয়ে ধীরে ধীরে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠতে থাকে। মুজিবনগর সরকারে সব প্রশাসনিক দফতর কিংবা মন্ত্রণালয় একসঙ্গে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। আমাদের কাজ করতে হয়েছে অগ্রাধিকার চিহ্নিত করে। এর একটি কারণ শুরুর দিকে যথেষ্ট জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা না থাকা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে খুব বেশিসংখ্যক পদস্থ কর্মকর্তা সীমান্ত অতিক্রম করেননি। দ্বিতীয়ত, রণাঙ্গনের প্রয়োজনে যেসব ক্রিয়াকাণ্ড প্রাধান্য লাভ করছিল আমাদেরও তার প্রতি মনোযোগ প্রদান করতে হয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই মুজিবনগর সরকারের প্রশাসন পূর্ণ সরকারের রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করে। ১৭ এপ্রিল সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রার দিন থেকে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত সময়ে মুজিবনগর সরকারের একটি প্রশাসনিক কাঠামো শুধু যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তা নয়; পরিকল্পনা কমিশন গঠনের মতো পদক্ষেপ গ্রহণও সম্ভব হয়, যার সদস্যরা স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালেই পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে চলার জন্য কর্মসূচি প্রণয়নে কাজ শুরু করেন।
স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রশাসনের ক্ষেত্রে কয়েকটি বড় সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, মুজিবনগরে যারা কাজ করেছেন এবং দেশের ভেতরে থেকে যারা পাকিস্তানি শাসকদের অধীনে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। পাকিস্তানে আটকেপড়া সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ফেরত এসে প্রশাসনে যোগ দিলে এ সমস্যা আরও প্রকট হতে শুরু করে। এভাবে প্রশাসনের মধ্যে সৃষ্ট অন্তর্দ্বন্দ্বের সুস্পষ্ট সমাধান কখনোই সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, সরকারকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের। মুক্তিযুদ্ধকালে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল বিপর্যস্ত। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নতুন করে সূচনা করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত সরকার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্বের পরিধি বেড়ে যায়। পাকিস্তান আমলে কলকারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল ব্যক্তিমালিকানায়। সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ ছিল নীতিমালা ও আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখার মধ্যে সীমিত। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা সীমিত করা হয় এবং সরকারের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। জাতীয়করণ কর্মসূচির আওতায় বিপুলসংখ্যক শিল্প ও বাণিজ্যিক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এগুলো পরিচালনার দায়িত্ব বর্তায় অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ওপর। এ এক ভিন্ন ধরনের দায়িত্ব, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উদ্যোক্তারাই পালন করতেন। এটা যথাযথভাবে পালনের জন্য বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়। তদুপরি ছিল সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্য। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে রাষ্ট্রের তরফে বিশেষ উদ্যোগ প্রত্যাশা করা হতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে প্রশাসনিক সংস্কার ছিল জরুরি। কিন্তু একদিকে অর্থনীতির পুনর্গঠন ও অন্যান্য জরুরি প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ততা, অন্যদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট অস্থিরতার জন্য বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ের প্রতি যথাযথ মনোযোগ প্রদান করতে পারেননি। অন্যদিকে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিবর্তন সংঘটিত হওয়ার পর যেসব শাসক ক্ষমতায় আসেন তাদের ধ্যানধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপটে প্রশাসনের মধ্যে নতুন করে টানাপড়েন শুরু হয়। এক ধরনের মেরুকরণও আমরা লক্ষ্য করি। এ সমস্যা সমাধানের জন্য তদানীন্তন সরকার ১৯৭৭ সালে পুরনো সিভিল সার্ভিসগুলো তুলে দিয়ে নতুন ২৯টি ক্যাডার প্রতিষ্ঠা করে। এ সময়ে তাত্তি্বকভাবে বলা হয় যে, সব ক্যাডার সমান। পদোন্নতির ক্ষেত্রে সবার সমান সুযোগ থাকবে। বাস্তবে এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব হয়নি। এর প্রধান কারণ যেভাবে ক্যাডারগুলো গড়ে তোলা হয় তাতে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব ছিল না। উপরন্তু ক্যাডারদের পদোন্নতির সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিতভাবে চাকরিতে নতুন নিয়োগদান প্রয়োজন ছিল। এ দায়িত্বে অবহেলা করা হয়। এর ফলে আমরা দেখতে পাই, কোনো কোনো ক্যাডারের ক্ষেত্রে একসঙ্গে ৫০০, ৭০০ এমনকি এক হাজার কর্মকর্তাকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। তাদের পরীক্ষা গ্রহণের জন্য মাসের পর মাস চলে বিপুল আয়োজন। এত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে একসঙ্গে নিয়োগ প্রদানের কাজ মোটেই সহজ হয় না। তা ছাড়া এর প্রভাবে পদোন্নতির সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে নানা অসন্তোষও আমরা লক্ষ্য করি। আরেকটি প্রবণতাও প্রকট হয়। পদোন্নতির বাধা ডিঙানোর কাজ যেহেতু কঠিন, তাই কেউ কেউ ভিন্ন পথে চলতে চেষ্টা করেন। দেখা যায়, একটি অংশ লক্ষ্য হাসিলের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়া নিতে সচেষ্ট রয়েছেন। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিবেশে রাজনীতিবিদদের কাছে বিষয়টি বেশ সুবিধাজনক মনে হতে থাকে। সাম্প্রতিককালে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে যে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব, এর শুরু এভাবেই হয়েছে। প্রশাসনে এ ধরনের ঘটনা সরকারের উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করতে থাকে। সেবা খাতগুলোয়ও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতিসাধন কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে রাজনীতিকদের কারণেও প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে থাকে। তারা পছন্দ-অপছন্দ ব্যক্ত করতে থাকেন। আনুকূল্য বিতরণের ঘটনা ঘটে।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও জটিলতা বাড়ায়। বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের সব পদে মেধাভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হবে। এ নিয়মটি দুই ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। প্রথমত, কোটার ভিত্তিতে ৫৫ ভাগ কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে। এ বিষয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে অনেক মামলার ঘটনা আমরা উল্লেখ করতে পারি। সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত_ কোনো অবস্থাতেই কোটা ৫০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, মেধাভিত্তিক নিয়োগ হলো সাধারণ নিয়ম এবং কোটা হলো বিশেষ কারণে ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম সাধারণ নিয়মের চেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে না। তাই ভারতে কোনো পদে ৫০ শতাংশের বেশি কোটা সংরক্ষণ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে একসময় জেলার সংখ্যা ছিল ১৭, পরে বেড়ে হয় ১৯। পরবর্তীকালে জেলার সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ৬৪। প্রথমে ১৭ জেলার জন্য কোটা নির্ধারণ করা ছিল। জেলার সংখ্যা বাড়লে, কোটার ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, চাকরিতে পদের সংখ্যা যতটা জেলার সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। আমরা এটা দেখি যে, বর্তমানে বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত জেলাগুলো নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়। অন্যদিকে কম জনংখ্যার জেলাগুলো থেকে অনেক প্রার্থী মেধাবী হয়েও নিয়োগ পায় না। অনুন্নত অঞ্চলের প্রার্থীদের জন্য সৃষ্টি হচ্ছে বিশেষ সমস্যা। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা দেখা যায় সচিবালয়ে। এখানে সব ক্যাডার থেকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয় না।
তবে চাকরিতে মেধা নির্ণয় করার যে সুযোগ সেটাও খুব সীমাবদ্ধ। বর্তমানে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মূল্যায়ন করা হয়। এই মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নম্বর ১০০। এর মধ্যে কাজের পরিমাণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪ এবং কাজের মানের জন্য সর্বোচ্চ ৪ নির্ধারণ করা আছে। বাকি ৯২ শতাংশ মূলত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের প্রতি অনুগত কি-না এবং একই সঙ্গে ব্যক্তির প্রতি আনুগত্য কতটা, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ ধরনের আরও অনেক উপাদান রয়েছে, তার ফলে এমনকি কাজের পরিমাণ ও মানের বিবেচনায় একজন কর্মকর্তা বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের মূল্যায়নে ৮-এর মধ্যে এমনকি শূন্য পেলেও পদোন্নতিতে সমস্যা হয় না। উপরন্তু এসব মূল্যায়ন অনেক সময় খামখেয়ালিপূর্ণ হয়ে থাকে। কেউ পেয়ে যায় বিশেষ আনুকূল্য, কারও ভাগ্যে জোটে বঞ্চনা। দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের জন্য অনেক হতাশার কারণও নিয়মিতই ঘটে। স্বাধীনতার চার দশক অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মূল্যায়নের একটি বৈজ্ঞানিক এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনে যারা ভালোভাবে কাজ করেন তাদের জন্য কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা নেই। একইভাবে খারাপ কাজ করলেও শাস্তির ঘটনা কমই দেখা যায়।
হজরত আলি (রা.) ইসলামী প্রশাসন সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রেখে গেছেন মিসরের গভর্নরের কাছে লেখা চিঠিতে। এতে তিনি বলেন, প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে বড় কাজ হবে ভালো কাজ যারা করে তাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এবং কেউ খারাপ কাজ করলে তাকে শাস্তি প্রদান করা। ভগবৎ গীতায়ও আমরা একই ধরনের নির্দেশনা দেখতে পাই। এভাবেই জোর দেওয়া হয়েছে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের ওপর। এমনকি চলতি কথায়ও আমরা এটা বলে থাকি, যা বাংলা ভাষায় সচরাচর উল্লেখ হওয়া একটি প্রবাদ। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা প্রশাসনে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করতে পারব না এবং যোগ্যতা ও দক্ষতাই হয়ে উঠবে না পদোন্নতির ভিত্তি, ততক্ষণ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না এবং বাংলাদেশের প্রশাসনেও প্রতিষ্ঠিত হবে না মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমাদের প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামের সময়ে সমান্তরালভাবে গড়ে উঠেছিল। গত চার দশকে প্রশাসনে গতিশীলতা এসেছে। বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছে। জেন্ডার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু মূল লক্ষ্য এখনও অর্জন করা হয়নি।
ড. আকবর আলি খান : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং সাবেক কেবিনেট সচিব
করা হয়নি
একাত্তরের ১ মার্চ থেকেই বাংলাদেশ ছিল কার্যত স্বাধীন_ এমন যে মত রয়েছে তা গ্রহণ করে নিতে আমজনতা থেকে রাজনৈতিক পণ্ডিতদের মধ্যে তেমন ভিন্নতা নেই। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এ ভূখণ্ডের জনগণ আওয়ামী লীগের পক্ষে বিপুলভাবে রায় প্রদান করে। পাকিস্তানের ক্ষমতায় এ দলটির আসীন হতে কোনো আইনগত সমস্যা ছিল না। এক ধরনের প্রস্তুতিও চলছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানের শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়, যার প্রকাশ ছিল ৩ মার্চ নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা। অথচ ঢাকায় এ অধিবেশন অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এর প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবেই লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসে। শহর-বন্দর-গ্রাম হয়ে ওঠে অগি্নগর্ভ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনের সঙ্গে যুক্তরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ আন্দোলনে শামিল হয়ে যায়। সচিবালয় থেকে জেলা, মহকুমা ও থানা প্রশাসনের সর্বত্র একই চিত্র আমরা দেখতে পাই। ব্যক্তি হিসেবে ধরলে কেউ বেশি সক্রিয় ছিলেন, কেউবা জনস্রোতের সঙ্গে মিশে ছিলেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলা যায়, একটি বিকল্প প্রশাসন কার্যত ১ মার্চই রূপ নিতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। এখানেও প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তাকে আমরা উপস্থিত দেখতে পাই। কিন্তু ইতিহাস জানায়, এর অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন কাজ শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা অসহযোগ আন্দোলনের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' ঘোষণা দেওয়ার সময়ে এ আন্দোলনের ডাক দেন। কার্যত কিন্তু ১ মার্চ থেকেই চলছিল পাকিস্তানি প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে অসহযোগিতা। সামগ্রিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন পরিচালনা হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। প্রশাসনিক ও অন্যান্য বিষয়ে নির্দেশনা প্রদানের জন্য তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে কয়েকজনকে নিয়ে একটি টিমও কাজ করছিল। তবে তোপখানা রোডের সচিবালয় এবং জেলা, মহকুমা ও থানার সর্বত্র একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, সেটা বলা যাবে না। কোথাও কোথাও সরকারি প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা যৌথভাবে প্রশাসন পরিচালনা করতে থাকেন। আবার কোথাও কোথাও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা স্বাধীনতার আন্দোলনে তেমন সক্রিয়ভাবে যুক্ত না হওয়ায় রাজনৈতিক নেতৃত্বই এগিয়ে এসে প্রশাসনের অনেক কাজ পালন করতে থাকে। আবার কোনো কোনো এলাকায় দেখা যায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা নেতৃত্বের ভূমিকায় চলে এসেছেন। শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীর কমান্ডের আস্থা অর্জনেও তারা সফল হয়েছিলেন। তবে এ সময়ে প্রশাসনের কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ গড়ে ওঠেনি। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়নের নামে গণহত্যা শুরু হয় ঢাকায় এবং বাংলাদেশের রাজধানীর চিত্র দ্রুত পাল্টে যায়। কর্তৃত্ব চলে যায় সেনাবাহিনীর হাতে, যারা অস্ত্রের জোরে সবকিছু চালাতে তৎপর হয়। ক্রমে জেলা ও মহকুমায় সামরিক অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান সংহত থাকে এবং দেশের ভেতরে স্বাধীনতার সপক্ষে যে প্রশাসন গড়ে উঠেছিল তা ভেঙে যায়। তখন অনেক কর্মকর্তা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মুজিবনগর সরকারে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েন। তাদের নিয়ে ধীরে ধীরে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠতে থাকে। মুজিবনগর সরকারে সব প্রশাসনিক দফতর কিংবা মন্ত্রণালয় একসঙ্গে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। আমাদের কাজ করতে হয়েছে অগ্রাধিকার চিহ্নিত করে। এর একটি কারণ শুরুর দিকে যথেষ্ট জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা না থাকা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে খুব বেশিসংখ্যক পদস্থ কর্মকর্তা সীমান্ত অতিক্রম করেননি। দ্বিতীয়ত, রণাঙ্গনের প্রয়োজনে যেসব ক্রিয়াকাণ্ড প্রাধান্য লাভ করছিল আমাদেরও তার প্রতি মনোযোগ প্রদান করতে হয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই মুজিবনগর সরকারের প্রশাসন পূর্ণ সরকারের রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করে। ১৭ এপ্রিল সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রার দিন থেকে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত সময়ে মুজিবনগর সরকারের একটি প্রশাসনিক কাঠামো শুধু যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তা নয়; পরিকল্পনা কমিশন গঠনের মতো পদক্ষেপ গ্রহণও সম্ভব হয়, যার সদস্যরা স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালেই পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে চলার জন্য কর্মসূচি প্রণয়নে কাজ শুরু করেন।
স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রশাসনের ক্ষেত্রে কয়েকটি বড় সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, মুজিবনগরে যারা কাজ করেছেন এবং দেশের ভেতরে থেকে যারা পাকিস্তানি শাসকদের অধীনে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। পাকিস্তানে আটকেপড়া সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ফেরত এসে প্রশাসনে যোগ দিলে এ সমস্যা আরও প্রকট হতে শুরু করে। এভাবে প্রশাসনের মধ্যে সৃষ্ট অন্তর্দ্বন্দ্বের সুস্পষ্ট সমাধান কখনোই সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, সরকারকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের। মুক্তিযুদ্ধকালে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল বিপর্যস্ত। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নতুন করে সূচনা করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত সরকার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্বের পরিধি বেড়ে যায়। পাকিস্তান আমলে কলকারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল ব্যক্তিমালিকানায়। সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ ছিল নীতিমালা ও আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখার মধ্যে সীমিত। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা সীমিত করা হয় এবং সরকারের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। জাতীয়করণ কর্মসূচির আওতায় বিপুলসংখ্যক শিল্প ও বাণিজ্যিক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এগুলো পরিচালনার দায়িত্ব বর্তায় অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ওপর। এ এক ভিন্ন ধরনের দায়িত্ব, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উদ্যোক্তারাই পালন করতেন। এটা যথাযথভাবে পালনের জন্য বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়। তদুপরি ছিল সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্য। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে রাষ্ট্রের তরফে বিশেষ উদ্যোগ প্রত্যাশা করা হতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে প্রশাসনিক সংস্কার ছিল জরুরি। কিন্তু একদিকে অর্থনীতির পুনর্গঠন ও অন্যান্য জরুরি প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ততা, অন্যদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট অস্থিরতার জন্য বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ের প্রতি যথাযথ মনোযোগ প্রদান করতে পারেননি। অন্যদিকে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিবর্তন সংঘটিত হওয়ার পর যেসব শাসক ক্ষমতায় আসেন তাদের ধ্যানধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপটে প্রশাসনের মধ্যে নতুন করে টানাপড়েন শুরু হয়। এক ধরনের মেরুকরণও আমরা লক্ষ্য করি। এ সমস্যা সমাধানের জন্য তদানীন্তন সরকার ১৯৭৭ সালে পুরনো সিভিল সার্ভিসগুলো তুলে দিয়ে নতুন ২৯টি ক্যাডার প্রতিষ্ঠা করে। এ সময়ে তাত্তি্বকভাবে বলা হয় যে, সব ক্যাডার সমান। পদোন্নতির ক্ষেত্রে সবার সমান সুযোগ থাকবে। বাস্তবে এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব হয়নি। এর প্রধান কারণ যেভাবে ক্যাডারগুলো গড়ে তোলা হয় তাতে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব ছিল না। উপরন্তু ক্যাডারদের পদোন্নতির সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিতভাবে চাকরিতে নতুন নিয়োগদান প্রয়োজন ছিল। এ দায়িত্বে অবহেলা করা হয়। এর ফলে আমরা দেখতে পাই, কোনো কোনো ক্যাডারের ক্ষেত্রে একসঙ্গে ৫০০, ৭০০ এমনকি এক হাজার কর্মকর্তাকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। তাদের পরীক্ষা গ্রহণের জন্য মাসের পর মাস চলে বিপুল আয়োজন। এত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে একসঙ্গে নিয়োগ প্রদানের কাজ মোটেই সহজ হয় না। তা ছাড়া এর প্রভাবে পদোন্নতির সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে নানা অসন্তোষও আমরা লক্ষ্য করি। আরেকটি প্রবণতাও প্রকট হয়। পদোন্নতির বাধা ডিঙানোর কাজ যেহেতু কঠিন, তাই কেউ কেউ ভিন্ন পথে চলতে চেষ্টা করেন। দেখা যায়, একটি অংশ লক্ষ্য হাসিলের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়া নিতে সচেষ্ট রয়েছেন। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিবেশে রাজনীতিবিদদের কাছে বিষয়টি বেশ সুবিধাজনক মনে হতে থাকে। সাম্প্রতিককালে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে যে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব, এর শুরু এভাবেই হয়েছে। প্রশাসনে এ ধরনের ঘটনা সরকারের উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করতে থাকে। সেবা খাতগুলোয়ও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতিসাধন কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে রাজনীতিকদের কারণেও প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে থাকে। তারা পছন্দ-অপছন্দ ব্যক্ত করতে থাকেন। আনুকূল্য বিতরণের ঘটনা ঘটে।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও জটিলতা বাড়ায়। বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের সব পদে মেধাভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হবে। এ নিয়মটি দুই ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। প্রথমত, কোটার ভিত্তিতে ৫৫ ভাগ কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে। এ বিষয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে অনেক মামলার ঘটনা আমরা উল্লেখ করতে পারি। সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত_ কোনো অবস্থাতেই কোটা ৫০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, মেধাভিত্তিক নিয়োগ হলো সাধারণ নিয়ম এবং কোটা হলো বিশেষ কারণে ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম সাধারণ নিয়মের চেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে না। তাই ভারতে কোনো পদে ৫০ শতাংশের বেশি কোটা সংরক্ষণ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে একসময় জেলার সংখ্যা ছিল ১৭, পরে বেড়ে হয় ১৯। পরবর্তীকালে জেলার সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ৬৪। প্রথমে ১৭ জেলার জন্য কোটা নির্ধারণ করা ছিল। জেলার সংখ্যা বাড়লে, কোটার ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, চাকরিতে পদের সংখ্যা যতটা জেলার সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। আমরা এটা দেখি যে, বর্তমানে বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত জেলাগুলো নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়। অন্যদিকে কম জনংখ্যার জেলাগুলো থেকে অনেক প্রার্থী মেধাবী হয়েও নিয়োগ পায় না। অনুন্নত অঞ্চলের প্রার্থীদের জন্য সৃষ্টি হচ্ছে বিশেষ সমস্যা। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা দেখা যায় সচিবালয়ে। এখানে সব ক্যাডার থেকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয় না।
তবে চাকরিতে মেধা নির্ণয় করার যে সুযোগ সেটাও খুব সীমাবদ্ধ। বর্তমানে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মূল্যায়ন করা হয়। এই মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নম্বর ১০০। এর মধ্যে কাজের পরিমাণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪ এবং কাজের মানের জন্য সর্বোচ্চ ৪ নির্ধারণ করা আছে। বাকি ৯২ শতাংশ মূলত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের প্রতি অনুগত কি-না এবং একই সঙ্গে ব্যক্তির প্রতি আনুগত্য কতটা, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ ধরনের আরও অনেক উপাদান রয়েছে, তার ফলে এমনকি কাজের পরিমাণ ও মানের বিবেচনায় একজন কর্মকর্তা বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের মূল্যায়নে ৮-এর মধ্যে এমনকি শূন্য পেলেও পদোন্নতিতে সমস্যা হয় না। উপরন্তু এসব মূল্যায়ন অনেক সময় খামখেয়ালিপূর্ণ হয়ে থাকে। কেউ পেয়ে যায় বিশেষ আনুকূল্য, কারও ভাগ্যে জোটে বঞ্চনা। দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের জন্য অনেক হতাশার কারণও নিয়মিতই ঘটে। স্বাধীনতার চার দশক অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মূল্যায়নের একটি বৈজ্ঞানিক এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনে যারা ভালোভাবে কাজ করেন তাদের জন্য কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা নেই। একইভাবে খারাপ কাজ করলেও শাস্তির ঘটনা কমই দেখা যায়।
হজরত আলি (রা.) ইসলামী প্রশাসন সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রেখে গেছেন মিসরের গভর্নরের কাছে লেখা চিঠিতে। এতে তিনি বলেন, প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে বড় কাজ হবে ভালো কাজ যারা করে তাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এবং কেউ খারাপ কাজ করলে তাকে শাস্তি প্রদান করা। ভগবৎ গীতায়ও আমরা একই ধরনের নির্দেশনা দেখতে পাই। এভাবেই জোর দেওয়া হয়েছে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের ওপর। এমনকি চলতি কথায়ও আমরা এটা বলে থাকি, যা বাংলা ভাষায় সচরাচর উল্লেখ হওয়া একটি প্রবাদ। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা প্রশাসনে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করতে পারব না এবং যোগ্যতা ও দক্ষতাই হয়ে উঠবে না পদোন্নতির ভিত্তি, ততক্ষণ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না এবং বাংলাদেশের প্রশাসনেও প্রতিষ্ঠিত হবে না মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমাদের প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামের সময়ে সমান্তরালভাবে গড়ে উঠেছিল। গত চার দশকে প্রশাসনে গতিশীলতা এসেছে। বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছে। জেন্ডার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু মূল লক্ষ্য এখনও অর্জন করা হয়নি।
ড. আকবর আলি খান : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং সাবেক কেবিনেট সচিব
No comments