শীঘ্র মুক্তি নেই- গ্যাস সঙ্কট
রশিদ মামুন সারাদেশে গ্যাস সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হলেও শীঘ্রই এর হাত থেকে মুক্তি মিলছে না। শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস রেশনিং-এর মাধ্যমে আপতত সঙ্কট উত্তোরণের চেষ্টা করা হলেও তা কতটা ফলপ্রসূ হবে এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
তীব্র গ্যাস সঙ্কটের কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠানের চাকা থমকে যাওয়ার পাশাপাশি গৃহিণীর চুলা জ্বলছে না। এতে অর্থনীতির গতি মন্থরতার সঙ্গে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। প্রতিবছর দেশে নতুন করে ১০ শতাংশ চাহিদা বৃদ্ধির ফলে ভবিষ্যতে সঙ্কট আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পেট্রোবাংলা সূত্র মতে, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ১৯০ থেকে ১৯৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু চাহিদা রয়েছে প্রায় ২৩০ কোটি ঘনফুটের। ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি ঘনফুট। শীত মৌসুমে গৃহস্থালিতে গ্যাসের চাহিদা ৫ কোটি ঘনফুট বেড়ে যাওয়ায় সঙ্কট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুরনো কূপগুলোতে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন কূপ খননের কোন বিকল্প নেই। তাদের মতে সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের পাশাপাশি স্থলভাগে ১২টি গ্যাসসমৃদ্ধ বস্নক রয়েছে সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য জরম্নরীভিত্তিতে পদৰেপ নেয়া প্রয়োজন। তবে বিষয়টি সময় সাপেৰ হওয়ায় আপাতত পুরনো কূপগুলোতে উৎপাদন বৃদ্ধি করেই সঙ্কট নিরসন সম্ভব বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এ ৰেত্রে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আনত্মরিকতার ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
উদ্যোগ নিলেই আপাতত সঙ্কট উত্তোরণ সম্ভব সূত্রমতে, দেশে কর্মরত বিদেশী কোম্পানিগুলো পরিচালিত প্রতিটি কূপ থেকে দৈনিক ৫ থেকে ১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করলেও পেট্রোবাংলার অধীন কোম্পানিগুলো দৈনিক গড়ে উৎপাদন করে ৩ থেক ৫ কোটি ঘনফুট। উদ্যোগ নিলে তিতাস এবং হবিগঞ্জের কূপগুলো থেকে দৈনিক ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। সূত্র জানায়, সর্বোচ্চ ২ মাসের মধ্যে ৩ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ের প্রকল্প বাসত্মবায়ন করলেই উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়ে উঠবে।
বর্তমানে ১০টি কূপে নানা কারণে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে, যেগুলোতে স্বল্প বিনিয়োগ করে নিশ্চিতভাবে গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। এ কূপগুলোতে পুনরায় উৎপাদন চালু করার মাধ্যমে প্রতিটি কূপে গড়ে দৈনিক দেড় কোটি ঘনফুট করে অনত্মত ১৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন সম্ভব। বিদ্যমান সঙ্কট নিরসনে পেট্রোবাংলার বিরম্নদ্ধে 'ধীরে চল' নীতি অবলম্বনের অভিযোগ রয়েছে।
ভবিষ্যতের জন্য এখনই উদ্যোগ গ্রহণ জরম্নরী দেশে ক্রমবর্ধমান হারে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে ভবিষ্যত বছরগুলোতে গ্যাসের জন্য হাহাকার আরও বৃদ্ধি পাবে। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে পেট্রোবাংলা প্রেরিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে দেশে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে ২৫৪ কোটি ঘনফুটে দাঁড়াবে, ২০১২ সালে ২৭৪ দশমিক ৬ কোটি ঘনফুট, ২০১৩ সালে ২৯৪ দশমিক ৬ কোটি ঘনফুট, ২০১৪ সালে ৩০৭ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা সৃষ্টি হবে। অথচ পেট্রেবাংলার হিসাব মতে, ২০০৩-০৪ থেকে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এসে গ্যাসের উৎপাদন বছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, বর্ধিত চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে সরকারী পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাসত্মবায়নে আনত্মরিকতার ঘাটতির কারণে এ ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান শুরম্ন হলেও গ্যাস পেতে কমপৰে ৫ থেকে ৬ বছর সময় লেগে যাবে। এছাড়া স্থলভাগে নতুন কূপ খনন করে গ্যাস উত্তোলন করার প্রক্রিয়া শুরম্ন হলেও ২ থেকে ৩ বছর সময় লেগে যাবে। যেসব বস্নক এরমধ্যেই বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়া হয়েছে তারাও চুক্তি অনুযায়ী গ্যাস উত্তোলন করেনি। দেশের দৰিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সঞ্চালন লাইন না থাকার কারণে ওই এলাকায় গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হচ্ছে না।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর বলেছেন, চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে বড় ব্যবধান থাকায় গ্যাস সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে পেট্রোবাংলা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
গ্যাসের অভাবে শিল্পে রম্নগ্নতা ছড়িয়ে পড়তে পরে পেট্রোবাংলার হিসাব মতে, উৎপাদিত গ্যাসের মধ্যে গ্রিডভুক্ত বিদু্যত খাতে ৬৫ কোটি ঘনফুট, সার খাতে ২৫ কোটি ঘনফুট, নন-গ্রিডভুক্ত বিদু্যত কেন্দ্রগুলোতে ৩ দশমিক ৫ কোটি ঘনফুট, বাকি ১০১ দশমিক ৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস নন-বাল্কভুক্ত শিল্প, ক্যাপটিভ পাওয়ার, চা বাগান, বাণিজ্যিক, সিএনজি এবং গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত হয়। সারাদেশের তীব্র গ্যাস সঙ্কটে অর্থনৈতিক ৰতির মুখে পড়েছে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। সংশিস্নষ্টরা বলছেন, শিল্প কারখানায় গ্যাসের প্রেসার ৫০ পিএসআই থাকার কথা থাকলেও এ প্রেসারে কোথাও গ্যাস পাওয়া যায় না। গ্যাসের চাপ না থাকায় তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি ৰতিগ্রসত্ম হচ্ছে। সম্প্রতি চলমান গ্যাস সঙ্কট থেকে মুক্তির জন্য তিতাস গ্যাস কোম্পানির আওতাভুক্ত এলাকাগুলোকে ৭টি জোনে ভাগ করে গ্যাস রেশনিং-এর সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়েছে, যাতে দৈনিক তিন কোটি ঘনফুট গ্যাসের সাশ্রয় হবে। চাহিদার তুলনায় এই সাশ্রয়ের পরিমাণ সামান্য হওয়ায় রেশনিং কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তৈরি পোশাক মালিকদের তিন সংগঠন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, দেশের বৃহত্তম এ রফতানি খাত গ্যাস সঙ্কটের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভারের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই কার্যত বন্ধ রয়েছে। তীব্র গ্যাস সঙ্কটের পরেও সরকার নতুন যে বিদু্যত কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পপনা করছে তাতে ৭০০ মেগাওয়াট শুধু গ্যাসভিত্তিক বিদু্যত কেন্দ্র নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে নতুন কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলনের আগে এ ধরনের বিদু্যত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পিডিপি সূত্র জানায়, দেশে গ্যাস সঙ্কটের কারণে বর্তমানে ৭০০ মেগাওয়াট বিদু্যত কম উৎপাদন হচ্ছে। বোরোর সেচ মৌসুমে বাড়তি ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদু্যতের চাহিদা সৃষ্টি হবে। তখন গ্যাসনির্ভর বিদু্যত কেন্দ্রগুলো চালানো না গেলে দেশে বিদু্যত ঘাটতি পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করবে। কৃষি এবং শিল্পে যার বিরূপ প্রভাব পড়বে।
বিজেএমইএ সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী জনকণ্ঠকে বলেন, গ্যাস এবং বিদু্যত সঙ্কটের কারণে দেশের বিনিয়োগ কম হবে, এতে কাঙ্ৰিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, গ্যাস সঙ্কটের কারণে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প ৰতিগ্রসত্ম হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে এ পরিস্থিতির কারণে শতাধিক গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার শিল্পের জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করতে পারলে দেশে বিনিয়োগকারীরা বিপাকে পড়বে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
গ্যাসের অভাবে সিএনজি স্টেশন বন্ধের উপক্রম গ্যাসের চাপ না থাকায় পরিবেশবান্ধব সিএনজি এখন বন্ধের উপক্রম হয়েছে। অধিকাংশ সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনে সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যনত্ম গ্যাসের চাপ থাকে না। কোন কোন সিএনজি স্টেশনে মোটেই গ্যাস পাওয়া যায় না। এসব যায়গায় মধ্যরাতে গ্যাস পাওয়া গেলেও পর্যাপ্ত চাপ থাকে না। রূপানত্মরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লি. (আরপিজিসিএল) এ পর্যনত্ম ৯২৯টি সিএনজি স্টেশনের অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমানে এর ৪২৫টি স্টেশন চালু আছে। এর মধ্যে বৃহত্তর ঢাকায় রয়েছে ২০০টি সিএনজি স্টেশন। সিএনজি স্টেশনকে ঘিরে ১৪০টি রূপানত্মর কারখানা গড়ে উঠছে। সব মিলিয়ে এ খাতে ২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। অথচ গ্যাস সঙ্কটের কারণে দিনের পর দিন সিএনজি স্টেশনগুলো লোকসান দিচ্ছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানের মতো এখানেও গ্যাস রেশনিং করা হবে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা। আজ মঙ্গলবার পেট্রোবাংলার সঙ্গে সিএনজি ব্যবসায়ী নেতাদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিএনজি ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন নয়ন বলেন, সিএনজি স্টেশনে কোনভাবেই গ্যাস রেশনিং সম্ভব নয়। সরকার রেশনিং চাপিয়ে দিলে পরিবহন খাতে চরম নৈরাজ্য তৈরি হবে, যা সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। বর্তমান গ্যাস সঙ্কটের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গ্যাস সঙ্কটের কারণে শিল্পটি হুমকির মুখে পড়বে। সিএনজি ব্যবসায় যে ধস নেমেছে তাতে সরকার বিশেষ নজর না দিলে এই শিল্পটি ভয়াবহ সঙ্কটে পড়বে।
গ্যাস নেই রান্নাঘরে শুধু শিল্প প্রতিষ্ঠান আর সিএনজি স্টেশনে নয়, রান্নাঘরেও গ্যাসের সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। শীতের শুরম্ন থেকেই ঢাকা ও এর আশপাশের প্রায় প্রতিটি এলাকায় চলছে গ্যাসের জন্য হাহাকার। দিনে দিনে এ সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় এখন গ্যাসের চুলা জ্বলছে না। রাতে টিমটিম করে যে চুলা জ্বলে, তাতে রান্নাসহ প্রাত্যহিক কাজ সারা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কোন এলাকায় জ্বলনত্ম চুলা পেতে অপো করতে হচ্ছে গভীর রাত, এমনকি ভোর পর্যনত্ম। ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ঘটেছে ছন্দপতন। অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন কেরোসিনের চুলা ব্যবহারে। তবে কেরোসিনের উচ্চমূল্যের কারণে কেউ কেউ মাটির চুলাও ব্যবহার করছেন। রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, বাড্ডা, বনশ্রী, মিরপুর, তেজগাঁও, মালিবাগ, খিলগাঁও, বাসাবো, মুগদাপাড়া এলাকায় রান্নার জন্য গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। রাজধানীর বাসাবো এলাকার এক গৃহিণী রেহেনুমা পারভীন ৰোভ প্রকাশ করে বলেন, দিনে-রাতে কোন সময় ঠিক মতো চুলা জ্বলে না। রাতে বাচ্চারা রান্নার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে। তবে পেট্রোবাংলা বলছে, রেশনিং শুরম্ন হলে রাজধানীতে গৃহস্থালির গ্যাস সঙ্কট কিছুটা কমে আসবে।
No comments