সংবাদ বিশ্লেষণ-সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ সদস্যরা কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে?
নতুন বা প্রতিষ্ঠিত- যেকোনো শিল্পোদ্যোক্তাকে তাঁর প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। ব্যাংকের শাখা থেকে শুরু করে আঞ্চলিক ও প্রধান কার্যালয়ে ঘুরতে ঘুরতে তাঁর জুতার তলা ক্ষয়ে যায়। ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শমতো সব কাগজপত্র জমা ও জামানতের শর্ত পূরণ করতে করতে গলদঘর্ম হতে হয়।
তারপর সেই ফাইল পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে কবে উঠবে, সেই অপেক্ষায় থাকতে হয় মাসের পর মাস। সেই ফাইল আবার এমনি এমনিই ওঠে না, এর জন্য পোড়াতে হয় অনেক কাঠখড়। পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের কাছে 'তদবির' করতে হয়। তবু বোর্ডসভার বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অধীর অপেক্ষার পর শেষমেশ হয়তো শোনা যায়, ৫০ বা ১০০ কোটি টাকার সেই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়নি।
এভাবে সোনালী ব্যাংকের কাছে ঋণ চেয়ে না পাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি বলেন, 'আমার গ্রুপটির তো কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তবু আমরা ঋণ পেলাম না। তাহলে হলমার্ক গ্রুপ কিভাবে এত টাকার ঋণ পেল?'
বোর্ডসভায় বসে প্রকৃত শিল্পোদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার চেয়ে না দেওয়ার পথ খুঁজতেই যখন পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা ব্যস্ত থাকেন, সেখানে হলমার্ক গ্রুপের মতো ভুঁইফোড় একটি কম্পানির লোকেরা সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা অফিসে বসেই কাজ সেরে ফেলেন। কিভাবে ইনল্যান্ড বিল কেনাবেচা করতে হয়, কিভাবে ভুয়া ঋণপত্র দেখিয়ে ব্যাংকের ভল্ট থেকে নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা আনতে হয়, সেসব জটিল পথঘাট সহজ করে দেখিয়ে দেন ওই শাখার কর্মকর্তারাই। এমনকি তাঁদের সামনে বসেই কারখানার কর্মীকে মালিক সাজিয়ে তৈরি করা হয় নতুন কম্পানি, খোলা হয় নতুন অ্যাকাউন্ট, বানানো হয় আমদানি-রপ্তানির ভুয়া কাগজপত্র। নানা অ্যাকাউন্ট ঘুরে এক দিনেই হলমার্কের এমডি বা চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যায় ৪০০ কোটি বা এরও বেশি টাকা। সি গ্রেডের একটি ব্যাংক শাখা, বছরে যার ৫০০ কোটির টাকার বেশি ঋণ দেওয়ার ক্ষমতাই নেই, সেই রূপসী বাংলা হোটেল (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে হলমার্ক গ্রুপ একাই নগদে আত্মসাৎ করে দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি। সোনালী ব্যাংকের স্বীকৃতিপত্র নিয়ে আরো প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ২৬টি ব্যাংকের শাখা থেকে, যা শোধ করতে হবে সোনালী ব্যাংককেই।
সোনালী ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট করা কত সহজ, তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদ। এ গ্রুপের চেয়ারম্যান তানভীরের স্ত্রী জেসমিন ইসলাম ও মহাব্যবস্থাপক তাঁর ভায়রা তুষার আহমেদ। ব্যাংকের জটিল নিয়মকানুনের চোরাগলি খুঁজে খুঁজে বিশাল অঙ্কের এ টাকা লোপাট করা কেবল তাঁদের নিজেদের বুদ্ধিতে সম্ভব হয়নি। শাখা থেকে শুরু করে সোনালী ব্যাংকের আঞ্চলিক ও প্রধান কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা কিভাবে এ জালিয়াতিতে ক্রমাগত সাহায্য করেছিলেন, এর বিবরণ রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে, এমনকি ব্যাংকটির নিজস্ব নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও। প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দায়ের করা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার এজাহারেও রয়েছে সেই জালিয়াতির বিস্তারিত বিবরণ।
দুদকের দায়ের করা ১১টি মামলায় ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন হলমার্কের তানভীর ও তুষার। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি ও শাখা ব্যবস্থাপকসহ ২০ কর্মকর্তাও রয়েছেন বিবাদীর তালিকায়। যেকোনো সময় তাঁদেরও গ্রেপ্তার করা হতে পারে। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা, যাঁদের মেয়াদকালেই ঘটে গেছে দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই কেলেঙ্কারি; তাও আবার রাষ্ট্র খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকটিতে, যেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হয়ে সরকারের ট্রেজারির দায়িত্বও পালন করে।
দুদকে এসে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা উল্টো সাফাই গেয়ে গেছেন। দায় চাপিয়ে গেছেন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর। এর আগে থেকেই সদস্যদের কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে দাবি করেছেন, হলমার্কের এ কেলেঙ্কারির বিষয়টি বোর্ডকে জানানো হয়নি। প্রায় এক হাজার ২০০ শাখার কোথায় কী হচ্ছে, তাঁদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, যদি বোর্ড সভায় উপস্থাপিত না হয়।
আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলেছেন, আইবিপির লেনদেন ঋণ হিসাবে দেখা হয় না। শাখা পর্যায়েই সেগুলোর নিষ্পত্তি হয়। পোশাক খাতের যাবতীয় আমদানি-রপ্তানির কাজ এভাবেই চলে আসছে এতকাল। যেহেতু এগুলো ঋণ প্রস্তাব আকারে উপস্থাপন করা হয় না, সেহেতু বোর্ড তা নাও জেনে থাকতে পারে। তাই বলে দায় এড়াতে পারে না বোর্ড। কারণ আমানতকারীদের স্বার্থ এবং মালিক হিসেবে সরকারের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব বোর্ডের। কেলেঙ্কারির ঘটনা তারা জানত না বলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
অথচ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ব্যাপারে দুদক এখন পর্যন্ত আর কিছু করেনি। দুদক ডাকার পরও পর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী বাহারুল ইসলাম সাড়া দেননি। তিনিসহ সদস্যদের অনেকের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। সরকার তাঁকেই আবার চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। দেশজুড়ে এসব নিয়ে নানা সন্দেহ, গুঞ্জন, আলোচনা রয়েছে। ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার আগে ও পরে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পদের হিসাব নেওয়ার দাবিও উঠেছে আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে। দুদক এর মধ্যে এক সদস্যের সম্পদের হিসাব নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে।
কথা উঠেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়েও। বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সার্বিক তত্ত্ব্বাবধান করলেও সরকারি ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ মূলত অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে। তবু তদারকের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করে বাংলাদেশ ব্যাংকই প্রথম সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করার পরামর্শ দেয়। অর্থমন্ত্রী সেই পরামর্শ গ্রহণ তো করেনইনি, উল্টো বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ার নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অভিযোগ করেছেন, ব্যাংক খাতে দ্বৈতশাসন চলার কারণে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নিয়োগ ও কর্মকর্তাদের নিয়োগ-বদলির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপর খবরদারি ধরে রাখতে চায় অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে কোনো পেশাগত যোগ্যতা ছাড়াও কেবল দলীয় আনুগত্যের জোরে যে কাউকে ব্যাংকের পরিচালক বানানো যায়।
আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, সার্চ কমিটি গঠন করে সৎ, যোগ্য পেশাজীবীদের মধ্য থেকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নির্বাচন করা হোক। তাঁদের মতে, রাজনৈতিক আনুগত্য থাকা অপরাধ নয়, তবে ব্যাংক পরিচালনায় তাঁদের দক্ষতা থাকতে হবে। কিন্তু সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এক মাস পার হয়ে গেলেও এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পর্ষদের সদস্যরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য দায়িত্বে থাকেন। তাঁদের মেয়াদকালে ঘটে যাওয়া কোনো অনিয়ম বা কেলেঙ্কারির দায় তাঁদেরই নিতে হবে। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেই তাঁদের দায় শেষ হয়ে যায় না। অবসরে যাওয়ার পরও জবাবদিহি করতে হয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। দুদকের মামলায় যে ২০ কর্মকর্তা অভিযুক্ত, তাঁদের সবাই দোষী নাও হতে পারেন। কারা নির্দোষ তা দেখার জন্য তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। পরিচালনা পর্ষদের সবাই নন, কারো কারো বিষয়ে জনমনে সন্দেহ রয়েছে। সেই সন্দেহের নিরসন হওয়া দরকার বলে মনে করেন অনেকে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনায় তাঁদের কারো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না তা নিয়ে তদন্ত হওয়া জরুরি। কারণ ব্যাংকের পরিচালক পদবি ক্ষমতা দেখানোর কোনো সনদ নয়, এটি আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষার একটি বড় দায়িত্ব, যা পালনে পেশাদারি ও যোগ্যতা থাকতে হবে। আর ব্যর্থ হলে জবাবদিহি করার জন্য তৈরি থাকতে হবে, তা মেয়াদ চলাকালেই হোক, আর মেয়াদ শেষেই হোক। সোনালী ব্যাংকে ৫৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকার আমানত রয়েছে। এর মধ্যে কোটিপতি ব্যবসায়ীর টাকা যেমন আছে, তেমনি ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খোলা এক কোটি ৩০ লাখ কৃষকের সঞ্চয়ও রয়েছে। এ আমানত রক্ষার দায়িত্ব নিয়েই তাঁরা পরিচালক হয়েছিলেন। তাই যেকোনো অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আসতেই হবে।
এভাবে সোনালী ব্যাংকের কাছে ঋণ চেয়ে না পাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি বলেন, 'আমার গ্রুপটির তো কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তবু আমরা ঋণ পেলাম না। তাহলে হলমার্ক গ্রুপ কিভাবে এত টাকার ঋণ পেল?'
বোর্ডসভায় বসে প্রকৃত শিল্পোদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার চেয়ে না দেওয়ার পথ খুঁজতেই যখন পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা ব্যস্ত থাকেন, সেখানে হলমার্ক গ্রুপের মতো ভুঁইফোড় একটি কম্পানির লোকেরা সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা অফিসে বসেই কাজ সেরে ফেলেন। কিভাবে ইনল্যান্ড বিল কেনাবেচা করতে হয়, কিভাবে ভুয়া ঋণপত্র দেখিয়ে ব্যাংকের ভল্ট থেকে নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা আনতে হয়, সেসব জটিল পথঘাট সহজ করে দেখিয়ে দেন ওই শাখার কর্মকর্তারাই। এমনকি তাঁদের সামনে বসেই কারখানার কর্মীকে মালিক সাজিয়ে তৈরি করা হয় নতুন কম্পানি, খোলা হয় নতুন অ্যাকাউন্ট, বানানো হয় আমদানি-রপ্তানির ভুয়া কাগজপত্র। নানা অ্যাকাউন্ট ঘুরে এক দিনেই হলমার্কের এমডি বা চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যায় ৪০০ কোটি বা এরও বেশি টাকা। সি গ্রেডের একটি ব্যাংক শাখা, বছরে যার ৫০০ কোটির টাকার বেশি ঋণ দেওয়ার ক্ষমতাই নেই, সেই রূপসী বাংলা হোটেল (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে হলমার্ক গ্রুপ একাই নগদে আত্মসাৎ করে দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি। সোনালী ব্যাংকের স্বীকৃতিপত্র নিয়ে আরো প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ২৬টি ব্যাংকের শাখা থেকে, যা শোধ করতে হবে সোনালী ব্যাংককেই।
সোনালী ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট করা কত সহজ, তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদ। এ গ্রুপের চেয়ারম্যান তানভীরের স্ত্রী জেসমিন ইসলাম ও মহাব্যবস্থাপক তাঁর ভায়রা তুষার আহমেদ। ব্যাংকের জটিল নিয়মকানুনের চোরাগলি খুঁজে খুঁজে বিশাল অঙ্কের এ টাকা লোপাট করা কেবল তাঁদের নিজেদের বুদ্ধিতে সম্ভব হয়নি। শাখা থেকে শুরু করে সোনালী ব্যাংকের আঞ্চলিক ও প্রধান কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা কিভাবে এ জালিয়াতিতে ক্রমাগত সাহায্য করেছিলেন, এর বিবরণ রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে, এমনকি ব্যাংকটির নিজস্ব নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও। প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দায়ের করা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার এজাহারেও রয়েছে সেই জালিয়াতির বিস্তারিত বিবরণ।
দুদকের দায়ের করা ১১টি মামলায় ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন হলমার্কের তানভীর ও তুষার। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি ও শাখা ব্যবস্থাপকসহ ২০ কর্মকর্তাও রয়েছেন বিবাদীর তালিকায়। যেকোনো সময় তাঁদেরও গ্রেপ্তার করা হতে পারে। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা, যাঁদের মেয়াদকালেই ঘটে গেছে দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই কেলেঙ্কারি; তাও আবার রাষ্ট্র খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকটিতে, যেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হয়ে সরকারের ট্রেজারির দায়িত্বও পালন করে।
দুদকে এসে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা উল্টো সাফাই গেয়ে গেছেন। দায় চাপিয়ে গেছেন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর। এর আগে থেকেই সদস্যদের কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে দাবি করেছেন, হলমার্কের এ কেলেঙ্কারির বিষয়টি বোর্ডকে জানানো হয়নি। প্রায় এক হাজার ২০০ শাখার কোথায় কী হচ্ছে, তাঁদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, যদি বোর্ড সভায় উপস্থাপিত না হয়।
আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলেছেন, আইবিপির লেনদেন ঋণ হিসাবে দেখা হয় না। শাখা পর্যায়েই সেগুলোর নিষ্পত্তি হয়। পোশাক খাতের যাবতীয় আমদানি-রপ্তানির কাজ এভাবেই চলে আসছে এতকাল। যেহেতু এগুলো ঋণ প্রস্তাব আকারে উপস্থাপন করা হয় না, সেহেতু বোর্ড তা নাও জেনে থাকতে পারে। তাই বলে দায় এড়াতে পারে না বোর্ড। কারণ আমানতকারীদের স্বার্থ এবং মালিক হিসেবে সরকারের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব বোর্ডের। কেলেঙ্কারির ঘটনা তারা জানত না বলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
অথচ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ব্যাপারে দুদক এখন পর্যন্ত আর কিছু করেনি। দুদক ডাকার পরও পর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী বাহারুল ইসলাম সাড়া দেননি। তিনিসহ সদস্যদের অনেকের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। সরকার তাঁকেই আবার চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। দেশজুড়ে এসব নিয়ে নানা সন্দেহ, গুঞ্জন, আলোচনা রয়েছে। ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার আগে ও পরে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পদের হিসাব নেওয়ার দাবিও উঠেছে আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে। দুদক এর মধ্যে এক সদস্যের সম্পদের হিসাব নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে।
কথা উঠেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়েও। বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সার্বিক তত্ত্ব্বাবধান করলেও সরকারি ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ মূলত অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে। তবু তদারকের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করে বাংলাদেশ ব্যাংকই প্রথম সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করার পরামর্শ দেয়। অর্থমন্ত্রী সেই পরামর্শ গ্রহণ তো করেনইনি, উল্টো বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ার নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অভিযোগ করেছেন, ব্যাংক খাতে দ্বৈতশাসন চলার কারণে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নিয়োগ ও কর্মকর্তাদের নিয়োগ-বদলির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপর খবরদারি ধরে রাখতে চায় অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে কোনো পেশাগত যোগ্যতা ছাড়াও কেবল দলীয় আনুগত্যের জোরে যে কাউকে ব্যাংকের পরিচালক বানানো যায়।
আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, সার্চ কমিটি গঠন করে সৎ, যোগ্য পেশাজীবীদের মধ্য থেকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নির্বাচন করা হোক। তাঁদের মতে, রাজনৈতিক আনুগত্য থাকা অপরাধ নয়, তবে ব্যাংক পরিচালনায় তাঁদের দক্ষতা থাকতে হবে। কিন্তু সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এক মাস পার হয়ে গেলেও এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পর্ষদের সদস্যরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য দায়িত্বে থাকেন। তাঁদের মেয়াদকালে ঘটে যাওয়া কোনো অনিয়ম বা কেলেঙ্কারির দায় তাঁদেরই নিতে হবে। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেই তাঁদের দায় শেষ হয়ে যায় না। অবসরে যাওয়ার পরও জবাবদিহি করতে হয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। দুদকের মামলায় যে ২০ কর্মকর্তা অভিযুক্ত, তাঁদের সবাই দোষী নাও হতে পারেন। কারা নির্দোষ তা দেখার জন্য তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। পরিচালনা পর্ষদের সবাই নন, কারো কারো বিষয়ে জনমনে সন্দেহ রয়েছে। সেই সন্দেহের নিরসন হওয়া দরকার বলে মনে করেন অনেকে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনায় তাঁদের কারো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না তা নিয়ে তদন্ত হওয়া জরুরি। কারণ ব্যাংকের পরিচালক পদবি ক্ষমতা দেখানোর কোনো সনদ নয়, এটি আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষার একটি বড় দায়িত্ব, যা পালনে পেশাদারি ও যোগ্যতা থাকতে হবে। আর ব্যর্থ হলে জবাবদিহি করার জন্য তৈরি থাকতে হবে, তা মেয়াদ চলাকালেই হোক, আর মেয়াদ শেষেই হোক। সোনালী ব্যাংকে ৫৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকার আমানত রয়েছে। এর মধ্যে কোটিপতি ব্যবসায়ীর টাকা যেমন আছে, তেমনি ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খোলা এক কোটি ৩০ লাখ কৃষকের সঞ্চয়ও রয়েছে। এ আমানত রক্ষার দায়িত্ব নিয়েই তাঁরা পরিচালক হয়েছিলেন। তাই যেকোনো অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আসতেই হবে।
No comments