চিরকুট- সংখ্যাগরিষ্ঠের দেমাগ by শাহাদুজ্জামান
সেই গানটির কথা স্মরণ করি। পশ্চিমবঙ্গের গায়ক শ্যামল মিত্রের গাওয়া, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা গানটি তুমুল জনপ্রিয় ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি।’ স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহ্বান ছিল সেই গানে।
গানটিতে যে একটা খটকা আছে, মুক্তিযুদ্ধের সেই আবেগের দিনে সেটা তেমন কারও নজর কাড়েনি। খটকা এই যে, এই ভূখণ্ডের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানমাত্রই সবাই বাঙালি নয়। এই বাংলায় আছে আরও ক্ষুদ্র নানা জাতিগোষ্ঠী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সেই কালপর্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবল তোড়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রশ্নটি তেমন বড় হয়ে দেখা দেয়নি। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী, বিভিন্ন জাতি পরিচয়ের মানুষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বৃহত্তর ছাতার নিচে দাঁড়িয়েই মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
কিন্তু সংকটটা শুরু হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই। এই যে বিজয়, এ বিজয় কার? এই যে নতুন মুক্ত দেশ, এ দেশটি কার? নিষ্পত্তি হয়—এ বিজয় বাঙালির, এ দেশ বাঙালির। নতুন রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নেয়, এ দেশের মানুষের জাতীয়তা হবে বাঙালি। এই সিদ্ধান্তে আহত হয় দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। কথা সত্য, বাংলা ভাষাভিত্তিক আন্দোলনের ধারাবাহিক যে সংগ্রাম, তার ফলেই জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের, কিন্তু সেই সংগ্রামে দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা যে সহযোদ্ধা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, তা কি আখেরে তাঁদের জাতি পরিচয়কে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে বৃহত্তর বাঙালি পরিচয়ে নিজেদের বিলীন করে দিতে? পার্বত্য এলাকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা ক্ষীণ কণ্ঠে দাবি তুলেছিলেন নতুন সংবিধানে তাঁদের জাতিসত্তার স্বতন্ত্র স্বীকৃতির। সেই কণ্ঠস্বর তলিয়ে গেছে বৃহত্তর বাঙালি ভাবাবেগের জোয়ারে। কিন্তু এতে পাহাড়ি জনপদের মানুষের মনে যে বঞ্চনার বীজ রোপিত হয়েছে, সেটি ক্রমেই ব্যাপক ও বিপুল আকার নিয়েছে। পাহাড়ি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এই সংকট স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ একটি রাজনৈতিক ও সামরিক সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে, যার জট খুলছে না এখনো।
কিন্তু ঘটনা এই যে, তারপর যত দিন গেছে, রাষ্ট্রক্ষমতার যত রকম পালাবদল হয়েছে, তাতে করে বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের এই দেমাগ কমেনি একটুও। বরং বেড়েছে এবং পেয়েছে নতুনতর মাত্রা। এই দেমাগের ছায়া ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ছাপিয়ে এরপর গিয়ে পড়েছে সংখ্যালঘু ধর্মপরিচয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর। দেশটি এবার যেন শুধু বাঙালির নয়, বরং মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানের—এমন ভাবার অবকাশ তৈরি করা হয়েছে ধারাবাহিকভাবে নানা পদক্ষেপে, নানা কর্মকাণ্ডে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিচর্চা স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ক্রমেই অবাধ পরিসর পেয়েছে, প্রবলতর হয়েছে, নানা স্থানীয়-আন্তর্জাতিক মদদে সেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সহিংস রূপটি পুষ্টি পেয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে গত ৪০ বছরে অগণিতবার প্রকাশ্য ও চোরাগোপ্তা উভয় আক্রমণের শিকার হয়েছে সংখ্যালঘু ধর্ম পরিচয়ের জনগোষ্ঠী। একপর্যায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এমনকি এই মানচিত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে ধর্ম, তার ভিত্তিতেই আত্মপরিচয় সন্ধানের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাও চলেছে দীর্ঘকাল। ফলে সব মিলিয়ে এ দেশের সংখ্যালঘু ধর্মপরিচয়ের মানুষের পক্ষে নিজেদের এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের একই কাতারের নাগরিক ভাবার অবকাশ গেছে কমে। এতে করে যখনই সুযোগ তৈরি হয়েছে, এই অধস্তন নাগরিকত্বের অবস্থা থেকে রেহাই পেতে তারা দেশত্যাগ করেছে। দেশের সংখ্যালঘু মানুষ যে নীরবে দেশত্যাগ করে চলছে, তার দালিলিক প্রমাণ রয়েছে একাধিক গবেষণায়। সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যের এই ছায়া এতকাল পড়ত মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর। এখন দেখা যাচ্ছে যে ক্রমেই তা প্রসারিত হয়েছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী জনপদেও। কক্সবাজারে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর ওই বীভৎস আক্রমণের পেছনে স্থানীয় দলীয় রাজনীতির ষড়যন্ত্র, রোহিঙ্গাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সমস্যার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই, কিন্তু এই ওপরতলের যোগসূত্রের গভীরে যে প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠের দেমাগ এমন একটি নারকীয় ঘটনা ঘটানোর মনোবৃত্তি তৈরি করেছে, সাহস জুগিয়েছে এবং সম্ভবপর করে তুলেছে, সেটি লক্ষ করার বিষয়। দীর্ঘদিন কখনো মোটা দাগে, কখনো সূক্ষ্মভাবে এই সাম্প্রদায়িক দেমাগটি পুষ্টি পেয়ে আসছে এ দেশে।
কিন্তু কথা এই যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানকে আহ্বান করা হয়েছিল যুদ্ধে। যুদ্ধকালের সংগ্রামে, ত্যাগে, বঞ্চনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের একই পরিণাম বরণ করে নিতে হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। বরং বঞ্চনার মাত্রা সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে প্রায়ই ছিল বেশি। পাকিস্তানি বাহিনী অনেক ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের রেহাই দিলেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের রেহাই দেয়নি। পাকিস্তানের ভেতরে বিভেদ সৃষ্টিকারী বিবেচনায়, বিশেষ করে হিন্দুদের পরিণাম হয়েছে ভয়াবহ। যে স্বাধীন মানচিত্রে আমরা চলাচল করছি, এর নির্মাণের পেছনে আছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অগাধ আত্মত্যাগ। সেই মানচিত্রকে আমরা যদি সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, সংখ্যালঘু ধর্মীয় পরিচয়ের মানুষের জন্য একটা অনিরাপদ, ভীতিকর জনপদে পরিণত করি, তবে সেটা হবে তাদের সেই আত্মত্যাগকে প্রতারণা করা।
অথচ ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চল বহুকাল চর্চা করেছে সহনশীলতার সাম্য। ইতিহাসজুড়ে এ অঞ্চলে আর্যের সঙ্গে অনার্যের, বৌদ্ধের সঙ্গে হিন্দুর, হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের বিবাদ হয়েছে। কিন্তু সেই বিবাদ এক জাতি আরেক জাতিকে বাতিল করে দেওয়ার ভেতর শেষ হয়নি। বরং নানা প্রভেদের ভেতর ঐক্য স্থাপন করে টিকে গেছে এই সমাজ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা, নানা পথকে একই লক্ষ্যের অভিমুখীন করিয়া দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এক কে নিঃসংশয়রূপে, অন্তররূপে উপলব্ধি করা, বাহিরে যে সকল পার্থক্য প্রতীয়মান তাহাকে নষ্ট না করিয়া তাহার ভিতরকার নিগূঢ় যোগকে অধিকার করা’—এই হচ্ছে এ অঞ্চলের সমাজের মূল সুর। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের সাধনা করব, নাকি সংখ্যাগরিষ্ঠের দেমাগকে অবিরাম পুষ্টি দিয়ে যাব।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
কিন্তু সংকটটা শুরু হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই। এই যে বিজয়, এ বিজয় কার? এই যে নতুন মুক্ত দেশ, এ দেশটি কার? নিষ্পত্তি হয়—এ বিজয় বাঙালির, এ দেশ বাঙালির। নতুন রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নেয়, এ দেশের মানুষের জাতীয়তা হবে বাঙালি। এই সিদ্ধান্তে আহত হয় দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। কথা সত্য, বাংলা ভাষাভিত্তিক আন্দোলনের ধারাবাহিক যে সংগ্রাম, তার ফলেই জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের, কিন্তু সেই সংগ্রামে দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা যে সহযোদ্ধা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, তা কি আখেরে তাঁদের জাতি পরিচয়কে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে বৃহত্তর বাঙালি পরিচয়ে নিজেদের বিলীন করে দিতে? পার্বত্য এলাকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা ক্ষীণ কণ্ঠে দাবি তুলেছিলেন নতুন সংবিধানে তাঁদের জাতিসত্তার স্বতন্ত্র স্বীকৃতির। সেই কণ্ঠস্বর তলিয়ে গেছে বৃহত্তর বাঙালি ভাবাবেগের জোয়ারে। কিন্তু এতে পাহাড়ি জনপদের মানুষের মনে যে বঞ্চনার বীজ রোপিত হয়েছে, সেটি ক্রমেই ব্যাপক ও বিপুল আকার নিয়েছে। পাহাড়ি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এই সংকট স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ একটি রাজনৈতিক ও সামরিক সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে, যার জট খুলছে না এখনো।
কিন্তু ঘটনা এই যে, তারপর যত দিন গেছে, রাষ্ট্রক্ষমতার যত রকম পালাবদল হয়েছে, তাতে করে বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের এই দেমাগ কমেনি একটুও। বরং বেড়েছে এবং পেয়েছে নতুনতর মাত্রা। এই দেমাগের ছায়া ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ছাপিয়ে এরপর গিয়ে পড়েছে সংখ্যালঘু ধর্মপরিচয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর। দেশটি এবার যেন শুধু বাঙালির নয়, বরং মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানের—এমন ভাবার অবকাশ তৈরি করা হয়েছে ধারাবাহিকভাবে নানা পদক্ষেপে, নানা কর্মকাণ্ডে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিচর্চা স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ক্রমেই অবাধ পরিসর পেয়েছে, প্রবলতর হয়েছে, নানা স্থানীয়-আন্তর্জাতিক মদদে সেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সহিংস রূপটি পুষ্টি পেয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে গত ৪০ বছরে অগণিতবার প্রকাশ্য ও চোরাগোপ্তা উভয় আক্রমণের শিকার হয়েছে সংখ্যালঘু ধর্ম পরিচয়ের জনগোষ্ঠী। একপর্যায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এমনকি এই মানচিত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে ধর্ম, তার ভিত্তিতেই আত্মপরিচয় সন্ধানের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাও চলেছে দীর্ঘকাল। ফলে সব মিলিয়ে এ দেশের সংখ্যালঘু ধর্মপরিচয়ের মানুষের পক্ষে নিজেদের এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের একই কাতারের নাগরিক ভাবার অবকাশ গেছে কমে। এতে করে যখনই সুযোগ তৈরি হয়েছে, এই অধস্তন নাগরিকত্বের অবস্থা থেকে রেহাই পেতে তারা দেশত্যাগ করেছে। দেশের সংখ্যালঘু মানুষ যে নীরবে দেশত্যাগ করে চলছে, তার দালিলিক প্রমাণ রয়েছে একাধিক গবেষণায়। সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যের এই ছায়া এতকাল পড়ত মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর। এখন দেখা যাচ্ছে যে ক্রমেই তা প্রসারিত হয়েছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী জনপদেও। কক্সবাজারে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর ওই বীভৎস আক্রমণের পেছনে স্থানীয় দলীয় রাজনীতির ষড়যন্ত্র, রোহিঙ্গাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সমস্যার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই, কিন্তু এই ওপরতলের যোগসূত্রের গভীরে যে প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠের দেমাগ এমন একটি নারকীয় ঘটনা ঘটানোর মনোবৃত্তি তৈরি করেছে, সাহস জুগিয়েছে এবং সম্ভবপর করে তুলেছে, সেটি লক্ষ করার বিষয়। দীর্ঘদিন কখনো মোটা দাগে, কখনো সূক্ষ্মভাবে এই সাম্প্রদায়িক দেমাগটি পুষ্টি পেয়ে আসছে এ দেশে।
কিন্তু কথা এই যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানকে আহ্বান করা হয়েছিল যুদ্ধে। যুদ্ধকালের সংগ্রামে, ত্যাগে, বঞ্চনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের একই পরিণাম বরণ করে নিতে হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। বরং বঞ্চনার মাত্রা সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে প্রায়ই ছিল বেশি। পাকিস্তানি বাহিনী অনেক ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের রেহাই দিলেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের রেহাই দেয়নি। পাকিস্তানের ভেতরে বিভেদ সৃষ্টিকারী বিবেচনায়, বিশেষ করে হিন্দুদের পরিণাম হয়েছে ভয়াবহ। যে স্বাধীন মানচিত্রে আমরা চলাচল করছি, এর নির্মাণের পেছনে আছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অগাধ আত্মত্যাগ। সেই মানচিত্রকে আমরা যদি সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, সংখ্যালঘু ধর্মীয় পরিচয়ের মানুষের জন্য একটা অনিরাপদ, ভীতিকর জনপদে পরিণত করি, তবে সেটা হবে তাদের সেই আত্মত্যাগকে প্রতারণা করা।
অথচ ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চল বহুকাল চর্চা করেছে সহনশীলতার সাম্য। ইতিহাসজুড়ে এ অঞ্চলে আর্যের সঙ্গে অনার্যের, বৌদ্ধের সঙ্গে হিন্দুর, হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের বিবাদ হয়েছে। কিন্তু সেই বিবাদ এক জাতি আরেক জাতিকে বাতিল করে দেওয়ার ভেতর শেষ হয়নি। বরং নানা প্রভেদের ভেতর ঐক্য স্থাপন করে টিকে গেছে এই সমাজ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা, নানা পথকে একই লক্ষ্যের অভিমুখীন করিয়া দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এক কে নিঃসংশয়রূপে, অন্তররূপে উপলব্ধি করা, বাহিরে যে সকল পার্থক্য প্রতীয়মান তাহাকে নষ্ট না করিয়া তাহার ভিতরকার নিগূঢ় যোগকে অধিকার করা’—এই হচ্ছে এ অঞ্চলের সমাজের মূল সুর। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের সাধনা করব, নাকি সংখ্যাগরিষ্ঠের দেমাগকে অবিরাম পুষ্টি দিয়ে যাব।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
No comments