উন্নয়ন-পদ্মা সেতু :উইন উইন নাকি লস লস? by সাদিক আহমদ
বিশ্বব্যাংক ফের পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে। তাদের এ সংক্রান্ত ঘোষণায় দেশবাসী অনেকটাই আশ্ব্বস্ত। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ সংক্রান্ত চুক্তি হয়। সেতুর সম্ভাব্য এলাকায় পদ্মার বুকে ভাষাশহীদ বরকত ফেরিতে চুক্তি সইয়ের সময় সবাই আশায় বুক বাঁধেন_ সড়ক ও রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে আর প্রমত্ত নদীর বাধা থাকবে না।
তারপর কত অঘটন! শেষ পর্যন্ত তো ২০১২ সালের জুনের শেষে বিশ্বব্যাংক অনিয়ম-দুর্নীতির আশঙ্কার অভিযোগ তুলে অর্থায়নে অপারগতা প্রকাশ করে বসল। দুই পক্ষের তর্ক চলে। কে ভুল আর কে সঠিক_ তা নিয়ে চলে গণমাধ্যমে বিশ্লেষণ। কিন্তু আমরা যে হারালাম মূল্যবান ১৬ মাস! এক পর্যায়ে সরকার বিশ্বব্যাংকের সব শর্ত মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। তারা অগ্রসর হয় ধাপে ধাপে। এভাবেও চলে গেল প্রায় চার মাস। সেপ্টেম্বরে ঘোষণা আসে_ বিশ্বব্যাংক শর্তসাপেক্ষে মত বদল করেছে। এ প্রক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার জন্য অব্যাহতভাবে চেষ্টা করে গেছেন।
বিশ্বব্যাংক যেসব শর্ত দিয়েছে, তার মধ্যে ছিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া। দু'জন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও একই শর্ত ছিল এবং সরকার তা মেনে নিয়েছে। আরেকটি শর্ত হচ্ছে প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত। সেতুতে অর্থের প্রধান চারটি জোগানদাতা হচ্ছে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপানের জাইকা এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক। এরা যে যে খাতে অর্থের জোগান দেবে, সেসব খাতে কন্ট্রাক্ট প্রদানসহ যাবতীয় কাজের মূল ভার থাকবে তাদের ওপর। বাংলাদেশ সরকারের অংশগ্রহণ অবশ্যই থাকবে, তবে মূল ভূমিকায় যে দাতারা চলে আসবে_ সেটা এক রূপ নিশ্চিত। এ ধরনের পদক্ষেপকে সরকারের স্বাগত জানানো উচিত। এভাবে সেতুটি নির্মাণ সম্পন্ন হলে পাইপলাইনে উন্নয়ন সহযোগীদের অঙ্গীকার করা যে প্রায় সাড়ে ১২শ' কোটি ডলার পড়ে আছে, তা ব্যবহারেরও একটি পথের দিশা মিলতে পারে।
ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা সামগ্রিকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা কখনও কেউ একবাক্যে মেনে নেয় না। প্রত্যেকেরই বলার কিছু থাকে। অনেক সময় নিছক সন্দেহবশত অভিযোগও ওঠে। গণমাধ্যমকেও কখনও কখনও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। তবে বিশ্বব্যাংকের যে বিশেষ টিম ঢাকায় দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে কাজের জন্য আসছে, তাদের কাজকে আমরা একটি সাহসী ও ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবেই দেখতে চাই। যারা এ প্যানেলে রয়েছেন, তাদের আন্তরিকতা ও পেশাগত উচ্চমান বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এরা কেউ বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব স্টাফ নন। তাদের ওপরে কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান প্রভাব খাটাবে_ এমন আশঙ্কাও কার্যত অনুপস্থিত। এদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে বিশ্বব্যাংক কিন্তু কঠিন ঝুঁকি নিয়েছে। তারা কাজ করবেন স্বাধীনভাবে এবং কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের অবকাশ নেই। তারা কি কাজের গতি আরও মন্থর করে দেবেন? সেতু নির্মাণ কি সুদূরপরাহত হয়ে থাকবে? সরকার কি তাদের পূর্ণ সহযোগিতা দেবে? এসব প্রশ্ন এখন সব মহলের। আমি বরং মনে করি, বাংলাদেশ সরকারের জন্য এটা এক দারুণ সুযোগ। তারা এত দিন দুর্নীতির যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। বিশ্বব্যাংকের অনুসন্ধান দল যদি তাদের অনুকূলে প্রমাণ পায় এবং সেটা সবাইকে জানিয়ে দেয়, তাহলে শুধু পদ্মা সেতুর প্রশ্নে নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও সরকারের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ উঠছে, তা মুহূর্তে ধুয়ে-মুছে যাবে। ফলে দেশ-বিদেশে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং ক্ষমতার বাকি সময়ে বড় বড় আর্থ-সামাজিক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারবে। রাজনীতির সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত, তাদের কেউ কেউ হয়তো এমন অভিমতও দেবেন_ যদি বিশ্বব্যাংক থেকে সরকার 'ক্লিন সনদ' পায়, তাহলে আগামী নির্বাচনে সেটাই হবে বড় ট্রাম্প কার্ড। বিশ্বব্যাংকও এ অবস্থায় বলতে পারবে যে, তারা যে সংশয় প্রকাশ করেছিল, সেটা দূর হয়েছে। তাই শুধু পদ্মা সেতুতে নয়, অন্য বড় প্রকল্পেও তারা ঋণ জোগাতে আর দ্বিধা করবে না। বিশ্বব্যাংকের বাইরেও যেসব উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা রয়েছে, তাদের ওপরেও এর বিপুল প্রভাব পড়বে। বিশ্বব্যাংকের ঝুঁকিটাও এখানে। তারা যদি দুর্নীতি-অনিয়ম প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করতে বিলম্ব এবং একই সঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, যদি অভিযোগের আংশিক বা পুরোটাই সত্য প্রমাণিত হয়; সেটা সরকারের জন্য যথেষ্ট বিব্রতকর হবে_ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তদন্তের ভিত্তিতে তারা ঋণ প্রদানের জন্য যেসব শর্ত আরোপ করবে, সেটা সহজভাবে মেনে নিয়ে তাদের সুপারিশ-পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করাই কাঙ্ক্ষিত হবে। কোনো একটি পর্যায়ে ভুল হয়ে থাকলে সেটা সংশোধনের সুযোগ অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। এটাকেই আমি বলতে চাই উইন উইন পরিস্থিতি। অন্যদিকে, সরকার যদি তদন্ত কাজে যথাযথ সহযোগিতা প্রদানে ব্যর্থ হয়, তাহলে পদ্মা সেতু তো হবেই না, দেশ-বিদেশে সবাই বিশ্বাস করবে_ অভিযোগ যথার্থ এবং এর পরিণতি হবে বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের জন্য অভাবনীয়। এর জের চলবে অনেক বছর। সরকারের জন্য বিশ্বব্যাংকের সব শর্ত মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু একবার যখন মেনে নিয়েছে, তাকে পুরো পথ চলতে হবে। পিছিয়ে গেলে সেতুও হারালাম, বদনামের কলঙ্কতিলক আরও ভালোভাবে কপালে লেপ্টে যাবে। এমন পরিস্থিতিকেই আমি বলতে চাইছি 'লস লস'।
পদ্মা সেতুর মতোই আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে হলমার্ক ও ডেসটিনি। এ দুটি ইস্যু নিয়ে এখন আলোচনা চলছে সর্বত্র। সরকার শুরুতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। উভয় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিরা এখন কারাগারে। অন্যায় করলে রেহাই মিলবে না_ এ শিক্ষা নিশ্চয়ই অনেকে গ্রহণ করবেন। একই সঙ্গে এ দুটি বিষয়কে আমি বলব, ওয়েকআপ কল বা সতর্কবার্তা। হলমার্ক গ্রুপকে সোনালী ব্যাংকের ঋণ প্রদানের ইস্যুটি এখন কেলেঙ্কারি হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে_ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ কোথায় ছিল? এত দেরিতে কেন বিষয়টি ধরা পড়ল? হোটেল রূপসী বাংলার (সাবেক শেরাটন) শাখাটিতে লেনদেন তুলনামূলক কম হতো। সেখানকার ম্যানেজার এবং আরও কয়েকজন কর্মকর্তা ঢালাওভাবে একটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে চলেছেন, অথচ হেড অফিসের টনক নড়ছে না_ এটা কি সম্ভব? এর সূত্র ধরেই প্রশ্ন আসবে_ আর কোথায় কোথায় এমন অন্যায় সংঘটিত হয়েছে কিংবা হচ্ছে। অন্যান্য সরকারি ব্যাংকও স্বভাবতই আসামির কাঠগড়ায়। এখন দুই ধরনের তদন্ত জরুরি_ সরকার ও ব্যাংক উভয় কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, অপরাধ করলে পার পাওয়া যাবে না। ব্যাংক থেকে তিন-চার হাজার কোটি টাকা চলে গেল, অথচ সরকার কেবল বলছে_ 'আইন নিজস্ব গতিতে চলবে।' এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। একই সঙ্গে অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ব্যাংকিং খাতে আরও কী কী সংস্কার চাই, সেটা দ্রুত চূড়ান্ত ও প্রয়োগ করতে হবে। এক যুগ আগে ব্যাংকিং খাতে যেসব সংস্কার হাতে নেওয়া হয়েছিল, তার সুফল মিলছে এখন। খেলাপি ঋণ কমেছে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে অনেকটাই শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। এর ফলে তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতের অজস্র ছোট-বড় উদ্যোগে সহায়তা দিতে পারছে। এখন কেবল সোনালী ব্যাংক নয়; অগ্রণী, রূপালী, জনতাসহ সব সরকারি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার প্রতি আরও মনোযোগ প্রদান করা চাই। এর দায়-দায়িত্বও চিহ্নিত করতে হবে।
এভাবে সরকারি ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ চলে যাওয়ায় তার ঝুঁকি কিন্তু সরকারকেই বহন করতে হবে। জনসাধারণ সরকারি ব্যাংকে অর্থ জমা রাখে এ ভরসায় যে, ব্যাংকের বিপদ হলেও তাদের জমা অর্থের জন্য কোনো ঝুঁকি নেই। প্রকৃতই ঝুঁকি নেমে এলে সে অর্থ পরিশোধ করতে হয় জাতীয় বাজেট থেকে, যার দায় শেষ পর্যন্ত জনগণের ওপরে বর্তায়। তাদের ওপর ট্যাক্সের বোঝা বাড়ে কিংবা প্রদত্ত ট্যাক্স উন্নয়ন কাজে না লেগে ব্যয় হয় দুর্নীতির দায় মেটাতে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে এখন মোট আমানতের দুই-তৃতীয়াংশ। ঋণ প্রদানেও তারাই কর্তৃত্ব করে। সেখানেও তদারকি বাড়াতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও ভাবতে হবে তাদের তদারকি পদ্ধতি নিয়ে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের যেসব শাখা বড় অঙ্কের ঋণ দেয়, সেগুলোই তাদের নিয়মিত তদারকিতে থাকে। এখন অন্যভাবে ভাবতে হবে, কেন এমন ঘটনা ঘটতে পারল। ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ অডিটের কোথায় দুর্বলতা সেটা চিহ্নিত করে তার সমাধানের পথনির্দেশনা দিতে হবে। সরকারকেও ভাবতে হবে তার মালিকানার সমস্যা নিয়ে। সরকারি মালিকানায় ব্যাংক রাখতে হলে এটাও মেনে নিতে হবে যে, মালিক ও নিয়ন্ত্রক এক প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। সরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের ভার অবশ্যই অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল বেসরকারি ব্যাংকের ওপর তদারকি করে। সরকারি ব্যাংকও তাদের অধীনে আনা চাই এবং এটা দ্রুত করতে হবে। তবেই যখন যেখানে অনিয়ম ঘটবে বা ঘটার আশঙ্কা দেখা দেবে, তৎক্ষণাৎ তারা পদক্ষেপ নিতে পারবে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংককেও ভাবতে হবে যে, এত বড় অনিয়ম করে চলেছে সোনালী ব্যাংক ও হলমার্ক কর্তৃপক্ষ, কিন্তু তাদের রাডারে কোনো কিছু কেন ধরা পড়ল না?
ডেসটিনি গ্রুপও বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম করে অনেক দিন জবাবদিহির বাইরে ছিল। আমার প্রস্তাব হচ্ছে, এসব আর্থিক অনিয়ম কেন ঘটছে এবং কীভাবে তার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব_ সেটা জানার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্কার কমিশন গঠন জরুরি। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। দেশের ভেতরে ও বাইরে অনেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তাদের নিয়েই এ কমিশন গঠন করা যায়। ভারতে ২০০৭ সালে এ ধরনের একটি কমিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্সের অধ্যাপক রঘুরাম রাজন। সম্প্রতি তিনি প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের একটি কমিশন গঠন করে তার ওপর আর্থিক খাতের জন্য অপরিহার্য সংস্কার প্রস্তাব তৈরির দায়িত্ব দিতে পারে। তারা আর্থিক খাতের সার্বিক চিত্র পর্যালোচনা করবে এবং এ কাজে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে হবে। বেসরকারি খাতও তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে_ এটাও প্রত্যাশিত। বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করতে চাইছে। এ অবস্থায় আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই এবং এজন্য প্রয়োজনে কঠোর হতেও দ্বিধা করা চলবে না।
ড. সাদিক আহমদ :ভাইস চেয়ারম্যান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট
বিশ্বব্যাংক যেসব শর্ত দিয়েছে, তার মধ্যে ছিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া। দু'জন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও একই শর্ত ছিল এবং সরকার তা মেনে নিয়েছে। আরেকটি শর্ত হচ্ছে প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত। সেতুতে অর্থের প্রধান চারটি জোগানদাতা হচ্ছে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপানের জাইকা এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক। এরা যে যে খাতে অর্থের জোগান দেবে, সেসব খাতে কন্ট্রাক্ট প্রদানসহ যাবতীয় কাজের মূল ভার থাকবে তাদের ওপর। বাংলাদেশ সরকারের অংশগ্রহণ অবশ্যই থাকবে, তবে মূল ভূমিকায় যে দাতারা চলে আসবে_ সেটা এক রূপ নিশ্চিত। এ ধরনের পদক্ষেপকে সরকারের স্বাগত জানানো উচিত। এভাবে সেতুটি নির্মাণ সম্পন্ন হলে পাইপলাইনে উন্নয়ন সহযোগীদের অঙ্গীকার করা যে প্রায় সাড়ে ১২শ' কোটি ডলার পড়ে আছে, তা ব্যবহারেরও একটি পথের দিশা মিলতে পারে।
ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা সামগ্রিকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা কখনও কেউ একবাক্যে মেনে নেয় না। প্রত্যেকেরই বলার কিছু থাকে। অনেক সময় নিছক সন্দেহবশত অভিযোগও ওঠে। গণমাধ্যমকেও কখনও কখনও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। তবে বিশ্বব্যাংকের যে বিশেষ টিম ঢাকায় দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে কাজের জন্য আসছে, তাদের কাজকে আমরা একটি সাহসী ও ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবেই দেখতে চাই। যারা এ প্যানেলে রয়েছেন, তাদের আন্তরিকতা ও পেশাগত উচ্চমান বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এরা কেউ বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব স্টাফ নন। তাদের ওপরে কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান প্রভাব খাটাবে_ এমন আশঙ্কাও কার্যত অনুপস্থিত। এদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে বিশ্বব্যাংক কিন্তু কঠিন ঝুঁকি নিয়েছে। তারা কাজ করবেন স্বাধীনভাবে এবং কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের অবকাশ নেই। তারা কি কাজের গতি আরও মন্থর করে দেবেন? সেতু নির্মাণ কি সুদূরপরাহত হয়ে থাকবে? সরকার কি তাদের পূর্ণ সহযোগিতা দেবে? এসব প্রশ্ন এখন সব মহলের। আমি বরং মনে করি, বাংলাদেশ সরকারের জন্য এটা এক দারুণ সুযোগ। তারা এত দিন দুর্নীতির যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। বিশ্বব্যাংকের অনুসন্ধান দল যদি তাদের অনুকূলে প্রমাণ পায় এবং সেটা সবাইকে জানিয়ে দেয়, তাহলে শুধু পদ্মা সেতুর প্রশ্নে নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও সরকারের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ উঠছে, তা মুহূর্তে ধুয়ে-মুছে যাবে। ফলে দেশ-বিদেশে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং ক্ষমতার বাকি সময়ে বড় বড় আর্থ-সামাজিক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারবে। রাজনীতির সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত, তাদের কেউ কেউ হয়তো এমন অভিমতও দেবেন_ যদি বিশ্বব্যাংক থেকে সরকার 'ক্লিন সনদ' পায়, তাহলে আগামী নির্বাচনে সেটাই হবে বড় ট্রাম্প কার্ড। বিশ্বব্যাংকও এ অবস্থায় বলতে পারবে যে, তারা যে সংশয় প্রকাশ করেছিল, সেটা দূর হয়েছে। তাই শুধু পদ্মা সেতুতে নয়, অন্য বড় প্রকল্পেও তারা ঋণ জোগাতে আর দ্বিধা করবে না। বিশ্বব্যাংকের বাইরেও যেসব উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা রয়েছে, তাদের ওপরেও এর বিপুল প্রভাব পড়বে। বিশ্বব্যাংকের ঝুঁকিটাও এখানে। তারা যদি দুর্নীতি-অনিয়ম প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করতে বিলম্ব এবং একই সঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, যদি অভিযোগের আংশিক বা পুরোটাই সত্য প্রমাণিত হয়; সেটা সরকারের জন্য যথেষ্ট বিব্রতকর হবে_ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তদন্তের ভিত্তিতে তারা ঋণ প্রদানের জন্য যেসব শর্ত আরোপ করবে, সেটা সহজভাবে মেনে নিয়ে তাদের সুপারিশ-পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করাই কাঙ্ক্ষিত হবে। কোনো একটি পর্যায়ে ভুল হয়ে থাকলে সেটা সংশোধনের সুযোগ অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। এটাকেই আমি বলতে চাই উইন উইন পরিস্থিতি। অন্যদিকে, সরকার যদি তদন্ত কাজে যথাযথ সহযোগিতা প্রদানে ব্যর্থ হয়, তাহলে পদ্মা সেতু তো হবেই না, দেশ-বিদেশে সবাই বিশ্বাস করবে_ অভিযোগ যথার্থ এবং এর পরিণতি হবে বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের জন্য অভাবনীয়। এর জের চলবে অনেক বছর। সরকারের জন্য বিশ্বব্যাংকের সব শর্ত মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু একবার যখন মেনে নিয়েছে, তাকে পুরো পথ চলতে হবে। পিছিয়ে গেলে সেতুও হারালাম, বদনামের কলঙ্কতিলক আরও ভালোভাবে কপালে লেপ্টে যাবে। এমন পরিস্থিতিকেই আমি বলতে চাইছি 'লস লস'।
পদ্মা সেতুর মতোই আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে হলমার্ক ও ডেসটিনি। এ দুটি ইস্যু নিয়ে এখন আলোচনা চলছে সর্বত্র। সরকার শুরুতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। উভয় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিরা এখন কারাগারে। অন্যায় করলে রেহাই মিলবে না_ এ শিক্ষা নিশ্চয়ই অনেকে গ্রহণ করবেন। একই সঙ্গে এ দুটি বিষয়কে আমি বলব, ওয়েকআপ কল বা সতর্কবার্তা। হলমার্ক গ্রুপকে সোনালী ব্যাংকের ঋণ প্রদানের ইস্যুটি এখন কেলেঙ্কারি হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে_ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ কোথায় ছিল? এত দেরিতে কেন বিষয়টি ধরা পড়ল? হোটেল রূপসী বাংলার (সাবেক শেরাটন) শাখাটিতে লেনদেন তুলনামূলক কম হতো। সেখানকার ম্যানেজার এবং আরও কয়েকজন কর্মকর্তা ঢালাওভাবে একটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে চলেছেন, অথচ হেড অফিসের টনক নড়ছে না_ এটা কি সম্ভব? এর সূত্র ধরেই প্রশ্ন আসবে_ আর কোথায় কোথায় এমন অন্যায় সংঘটিত হয়েছে কিংবা হচ্ছে। অন্যান্য সরকারি ব্যাংকও স্বভাবতই আসামির কাঠগড়ায়। এখন দুই ধরনের তদন্ত জরুরি_ সরকার ও ব্যাংক উভয় কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, অপরাধ করলে পার পাওয়া যাবে না। ব্যাংক থেকে তিন-চার হাজার কোটি টাকা চলে গেল, অথচ সরকার কেবল বলছে_ 'আইন নিজস্ব গতিতে চলবে।' এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। একই সঙ্গে অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ব্যাংকিং খাতে আরও কী কী সংস্কার চাই, সেটা দ্রুত চূড়ান্ত ও প্রয়োগ করতে হবে। এক যুগ আগে ব্যাংকিং খাতে যেসব সংস্কার হাতে নেওয়া হয়েছিল, তার সুফল মিলছে এখন। খেলাপি ঋণ কমেছে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে অনেকটাই শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। এর ফলে তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতের অজস্র ছোট-বড় উদ্যোগে সহায়তা দিতে পারছে। এখন কেবল সোনালী ব্যাংক নয়; অগ্রণী, রূপালী, জনতাসহ সব সরকারি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার প্রতি আরও মনোযোগ প্রদান করা চাই। এর দায়-দায়িত্বও চিহ্নিত করতে হবে।
এভাবে সরকারি ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ চলে যাওয়ায় তার ঝুঁকি কিন্তু সরকারকেই বহন করতে হবে। জনসাধারণ সরকারি ব্যাংকে অর্থ জমা রাখে এ ভরসায় যে, ব্যাংকের বিপদ হলেও তাদের জমা অর্থের জন্য কোনো ঝুঁকি নেই। প্রকৃতই ঝুঁকি নেমে এলে সে অর্থ পরিশোধ করতে হয় জাতীয় বাজেট থেকে, যার দায় শেষ পর্যন্ত জনগণের ওপরে বর্তায়। তাদের ওপর ট্যাক্সের বোঝা বাড়ে কিংবা প্রদত্ত ট্যাক্স উন্নয়ন কাজে না লেগে ব্যয় হয় দুর্নীতির দায় মেটাতে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে এখন মোট আমানতের দুই-তৃতীয়াংশ। ঋণ প্রদানেও তারাই কর্তৃত্ব করে। সেখানেও তদারকি বাড়াতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও ভাবতে হবে তাদের তদারকি পদ্ধতি নিয়ে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের যেসব শাখা বড় অঙ্কের ঋণ দেয়, সেগুলোই তাদের নিয়মিত তদারকিতে থাকে। এখন অন্যভাবে ভাবতে হবে, কেন এমন ঘটনা ঘটতে পারল। ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ অডিটের কোথায় দুর্বলতা সেটা চিহ্নিত করে তার সমাধানের পথনির্দেশনা দিতে হবে। সরকারকেও ভাবতে হবে তার মালিকানার সমস্যা নিয়ে। সরকারি মালিকানায় ব্যাংক রাখতে হলে এটাও মেনে নিতে হবে যে, মালিক ও নিয়ন্ত্রক এক প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। সরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের ভার অবশ্যই অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল বেসরকারি ব্যাংকের ওপর তদারকি করে। সরকারি ব্যাংকও তাদের অধীনে আনা চাই এবং এটা দ্রুত করতে হবে। তবেই যখন যেখানে অনিয়ম ঘটবে বা ঘটার আশঙ্কা দেখা দেবে, তৎক্ষণাৎ তারা পদক্ষেপ নিতে পারবে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংককেও ভাবতে হবে যে, এত বড় অনিয়ম করে চলেছে সোনালী ব্যাংক ও হলমার্ক কর্তৃপক্ষ, কিন্তু তাদের রাডারে কোনো কিছু কেন ধরা পড়ল না?
ডেসটিনি গ্রুপও বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম করে অনেক দিন জবাবদিহির বাইরে ছিল। আমার প্রস্তাব হচ্ছে, এসব আর্থিক অনিয়ম কেন ঘটছে এবং কীভাবে তার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব_ সেটা জানার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্কার কমিশন গঠন জরুরি। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। দেশের ভেতরে ও বাইরে অনেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তাদের নিয়েই এ কমিশন গঠন করা যায়। ভারতে ২০০৭ সালে এ ধরনের একটি কমিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্সের অধ্যাপক রঘুরাম রাজন। সম্প্রতি তিনি প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের একটি কমিশন গঠন করে তার ওপর আর্থিক খাতের জন্য অপরিহার্য সংস্কার প্রস্তাব তৈরির দায়িত্ব দিতে পারে। তারা আর্থিক খাতের সার্বিক চিত্র পর্যালোচনা করবে এবং এ কাজে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে হবে। বেসরকারি খাতও তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে_ এটাও প্রত্যাশিত। বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করতে চাইছে। এ অবস্থায় আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই এবং এজন্য প্রয়োজনে কঠোর হতেও দ্বিধা করা চলবে না।
ড. সাদিক আহমদ :ভাইস চেয়ারম্যান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট
No comments