চরাচর-বাঙালির বীরত্বের এক অধ্যায় by স্বপন কুমার দাস

সম্প্রতি জাতীয় জাদুঘরে কিছু দুর্লভ নিদর্শন সংগৃহীত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পাঁচটি পদক। ওই বিশ্বযুদ্ধে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ববঙ্গ) যেসব সৈন্য নিহত হন তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে এসব পদক নির্মিত হয়। পরে তাঁদের গ্রামের ঠিকানায় পাঠানো হয়েছিল।


১৯১৪ সালের ২৮ জুন বর্তমান বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রানৎস্ ফার্ডিনান্ড এক সার্বিয়াবাসীর বন্দুকের গুলিতে নিহত হন। অস্ট্রিয়া এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং ওই বছরের ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ যুদ্ধে দুই দেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। তবে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ হত্যাকাণ্ডই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একমাত্র কারণ ছিল না। উনিশ শতকে শিল্পবিপ্লবের কারণে সহজে কাঁচামাল সংগ্রহ ও তৈরি পণ্য বিক্রির জন্য বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ স্থাপনে প্রতিযোগিতা এবং আগের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সন্দেহ ইত্যাদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একপক্ষে ছিল অস্ট্রিয়া, জার্মানি, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া- যাদের বলা হতো কেন্দ্রীয় শক্তি। অন্যপক্ষে সার্বিয়া, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি ও আমেরিকা- যাদের বলা হতো মিত্রশক্তি। ভারতবর্ষ ছিল তখন ব্রিটেনের উপনিবেশ। তাই ভারতীয় সেনাদের ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধ করতে হয়। এ বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের জয় হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) বিভিন্ন ফ্রন্টে মোট ৪৭ হাজার ৭৪৬ জন ভারতীয় সৈন্য মারা যান। তাঁদের মধ্যে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৩ হাজার ভারতীয় সৈন্যকে বিভিন্ন পদক প্রদান করা হয়। পদকপ্রাপ্তদের মধ্যে পূর্ববঙ্গের বাঙালি সৈন্যরাও ছিলেন। যে পাঁচটি পদক উদ্ধার করা হয় সেই পদকপ্রাপ্তরা ছিলেন তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার অধিবাসী। তাঁদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পদকগুলো তাঁদের কাছে আত্মীয়স্বজনকে দেওয়ার জন্য আনা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা বিতরণ না হওয়ায় মহকুমা কার্যালয়ে সংরক্ষিত রাখা হয়। পদকপ্রাপ্তরা হলেন যথাক্রমে ১. শেখ হোসাইন, ২. আবদুল গণি শাইক, ৩. মসিহর রহিমন, ৪. জামির মুন্সী এবং ৫. আবদুল আসমিদ।
ব্রোঞ্জের তৈরি প্রতিটি পদকের ওজন ৩৩৩ গ্রাম, ব্যাস ১২১ মিলিমিটার। পদকের একদিক সমতল, অন্যদিকে নানা প্রতীক ও মৃতের নাম লেখা। প্রতীকের মধ্যে আছে একটি নারী মূর্তি, একটি সিংহ, দুটি ডলফিন, একটি ইগল ইত্যাদি। একটি আয়তকার ক্ষেত্রের মধ্যে প্রত্যেক সৈন্যের খোদাই করে ইংরেজিতে নাম লেখা আছে।
সেদিন ব্রিটিশ-ভারত রক্ষায় এ দেশের মানুষ যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিল- এসব পদক তারই প্রকৃষ্ট নিদর্শন। বাঙালির বীরত্বগাথা এক অতীত অধ্যায়। জাতীয় জাদুঘরের ২১ নম্বর গ্যালারিতে একটি শোকেসের মধ্যে এ পদকগুলো এখন প্রদর্শিত হচ্ছে। এ নিদর্শনগুলো জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহকে আরো সমৃৃদ্ধ করছে, তাতে সন্দেহ নেই।

No comments

Powered by Blogger.