ইথারে ভেসে আসা সেই কণ্ঠ... by মোনায়েম সরকার

'আকাশবাণী কলকাতা, সংবাদ পরিক্রমা_ লিখেছেন প্রণবেশ সেন, পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়'_ একাত্তরে প্রতি রাতে এমন কণ্ঠ শোনার জন্য অপেক্ষা ছিল কোটি কোটি মানুষের। এ কণ্ঠ সাহস জোগাত, এগিয়ে চলার প্রেরণা হয়ে উঠত।


আমাদের স্বাধীনতার চলি্লশ বছর পূর্তির সময়েই তিনি চলে গেলেন অনন্তলোকে। বেতার ঘোষক থেকে সংবাদ পাঠক হয়ে উঠেছিলেন দেবদুলাল। সংবাদ পরিক্রমা'য় কণ্ঠ আগেও দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর তা যেন জাদুর কাঠির ছোঁয়া পেল। তিনি নিজেই বলেছেন, 'আমি নিজেই হয়ে উঠি বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা।' তিনি যখন মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনের সাফল্যের সংবাদ পাঠ করতেন তখন মনে হতো রণাঙ্গনে থেকেই এ সংবাদ প্রেরণ করেছেন। একটি ঘটনা তার কাছে শুনেছি এবং শুনতে শুনতেই কেঁদেছি। গতকাল শুক্রবার বিবিসির শোক সংবাদে ঘটনাটি শুনেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার ভূমিকায় পাকিস্তানি শাসকরা চরমভাবে ক্ষুব্ধ ছিল এবং এ জন্য তারা প্রতিহিংসামূলক গুপ্ত হামলা চালাতে পারে বলে তাকে সতর্কভাবে চলাফেরা করার জন্য বলে দেওয়া হয়েছিল। একদিন তিনি গড়ের মাঠ এলাকায় হাঁটছিলেন। এমন সময় লক্ষ্য করলেন এক শক্ত-সমর্থ তরুণ তার পেছন পেছন চলছে। তিনি কিছুটা ভয়ই পেলেন। এরপরও সাহস সঞ্চয় করে পেছনে ফিরে ধমকের সুরে বললেন, 'কেন এভাবে অনুসরণ করছেন?' ওই তরুণ তার পায়ে হাত দিয়ে বলে, 'আমি কাল যুদ্ধে যাচ্ছি। আপনাকে একটি প্রণাম করব বলে এতক্ষণ পিছু পিছু হাঁটছি।' শুধু রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের কাছে নয়, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় একাত্তরে কত মানুষের কাছে যে এভাবে প্রিয়জনে পরিণত হয়েছিলেন। একবার তিনি বলেন রণাঙ্গনের হাসপাতালের এক মুক্তিযোদ্ধার কথা, যিনি বুলেটবিদ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। চিকিৎসক তার কাছে এলে সেই মুক্তিযোদ্ধা পাশের বেডের আরেক মুক্তিযোদ্ধাকে দেখিয়ে বলেন, 'ডাক্তার সাহেব, আমাকে নয় ওকে দেখুন। আমি বাঁচব না, কিন্তু ও বাঁচবে এবং দেশের জন্য আবারও লড়বে। ওর চিকিৎসা আগে দরকার।' দেবদুলালের কণ্ঠে এ ঘটনা শুনে যেমন কেঁদেছি, তেমনি পেয়েছি অনুপ্রেরণা। তিনি বলেন, সেই তরুণের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। সে কি যুদ্ধে জয়ী হয়ে সহযোদ্ধাদের কাছে ফিরে যেতে পেরেছিল?
এই তো আমাদের একাত্তর! কতজন যে কতভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল! বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের জন্য বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম বিষয়ে ডিভিডি তৈরি করার জন্য তার সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি। ১৯৭৩ সালে বার্লিন যুব উৎসবে তিনি ছিলেন ভারতীয় প্রতিনিধি দলে। আর আমি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা এ সময়ে তাকে আমাদের দলেরই একজন হিসেবে গণ্য করত। একবার কলকাতার রূপা পাবলিশিং হাউসে বই কেনার সময় দেখা তার সঙ্গে। আমাকে দেখে দোকানের ম্যানজারকে বলেন, বাংলাদেশের বন্ধু। সর্বোচ্চ হারে কমিশন দিতে হবে। তার কথায় আমি অভিভূত হই। আবেগে কান্না আসে। বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানাই। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্বাধীনতার পরপর দেখা হয়েছিল। আবার যেতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু তাকে আর আমাদের মাঝে পাব না। বাংলাদেশ সরকার একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে প্রবাসের যারা সক্রিয়ভাবে সহায়তা দিয়েছেন তাদের সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। বাচিকশিল্পী হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে ওঠা কণ্ঠ আর ইথারে ভাসিয়ে দিতে পারছিলেন না। কিন্তু একাত্তরে প্রজন্ম যারা এখনও বেঁচে আছি, তারা ঠিক শুনতে পাই : সংবাদ পরিক্রমা,... পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়... বাংলাদেশের কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে ঘুরে এলাম... অসম সাহসে লড়ছে মুক্তিযোদ্ধারা... ক্যাম্পে এক কিশোরের কাছে জানতে চাইলাম, 'মুক্তিবাহিনীতে এসেছ_ মা আসতে দিল?'... তার লাজুক কণ্ঠে উত্তর, 'পালিয়ে এসেছি। যুদ্ধ শেষ হলেই ঘরে ফিরব... আমার আরও বন্ধুরা এভাবে এসেছে...। ওর কাঁধে ছিল এসএলআর... কণ্ঠে দৃঢ়তা... মুখে হাসি, বুকে বল... আমাদের চোখের সামনেই দৃপ্ত পায়ে চলে গেল রণাঙ্গনের পথে.... 'ও কি মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারবে?'
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাকে হাজার সালাম।

মোনায়েম সরকার :রাজনীতিক
 

No comments

Powered by Blogger.