সমকালীন প্রসঙ্গ-রাজনীতিতে আবার অশনিসংকেত by এমএম করীম

আমাদের রাজনীতিকরা অতীত থেকে শিক্ষা নেয় বলে মনে হয় না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। পাশেই পশ্চিমবঙ্গ। এই সেদিন সে দেশে বিধানসভার নির্বাচন হলো। দীর্ঘ ৩৪ বছরের ক্ষমতাসীন দল সিপিএমকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হলো। তারা কিন্তু কোনো কারচুপির অভিযোগ আনেনি 'নির্বাচন কমিশনের' বিরুদ্ধে


আগামীকাল ৫ জুন হরতাল ডেকেছে বিএনপি ও তার মিত্ররা। ইস্যু তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আমার বড় বোনের ছেলের বিয়ে ৫ জুন। আমার ছেলে অমিত প্রশ্ন করেছে, 'বিয়ের কী হবে বাবা? নিমন্ত্রণপত্র বিলি করা হয়েছে, বিয়ের অনুষ্ঠান কি বাতিল করতে হবে?' সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে বললাম_ 'দেখা যাক।' আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মনমানসিকতা বোঝার সাধ্য সাধারণ জনগণের নেই। জনগণের জন্য তারা রাজনীতি করেন বলে দাবি করলেও বাস্তবে তারা জনগণের বিরুদ্ধেই বেশিরভাগ সময় অবস্থান নেয় (সবাই নয়)। তাই দেখা গেছে, 'ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়' বলে যতই আস্টম্ফালন করা হোক না কেন, মনের কথা হলো সবার চেয়ে নিজে বড়। নিজের জন্য, নিজেকে ক্ষমতায় নিতে যা কিছু প্রয়োজন সবই করতে তারা দ্বিধা করেন না। জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধসহ জনজীবনের দুর্ভোগ ঘটাতে যতরকম কর্মসূচি আছে তার প্রয়োগ ঘটাতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করেন না। আমাদের রাজনীতিকরা অতীত থেকে শিক্ষা নেয় বলে মনে হয় না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। পাশেই পশ্চিমবঙ্গ। এই সেদিন সে দেশে বিধানসভার নির্বাচন হলো। দীর্ঘ ৩৪ বছরের ক্ষমতাসীন দল সিপিএমকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হলো। তারা কিন্তু কোনো কারচুপির অভিযোগ আনেনি 'নির্বাচন কমিশনের' বিরুদ্ধে। পরের দিন ঘোষণা করেনি 'পশ্চিমবঙ্গ বন্ধ'। মমতার শপথ অনুষ্ঠানে বুদ্ধদেবসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আমরা কোথায়? আমাদের রাজনীতি কার জন্য? সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে নেই রাজনৈতিক শিষ্টাচার। আমরা ছোট ছেলেমেয়ের মতো কথায় কথায় আড়ি দেই। একমত হতে পারি না জাতীয় ইস্যুতে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যাদের দরবারে হাজির হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে বিচার দেই তাদের কাছ থেকে শিখতে চাই না কিছু। এই তো সেদিন লাদেনকে হত্যা করার পর ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মিলনমেলা দেখলাম। কিন্তু আমরা ওদের ভালো কাজ শিখতে চাই না, খারাপ কাজগুলো রপ্ত করতে পটু। শুধু রাজনীতিকদের কথা কেন? যাদের আমরা সুশীল সমাজ বলি, তারাও কিন্তু দ্বিধাবিভক্ত বা ত্রিধাবিভক্ত। যদি কেউ আওয়ামী লীগভুক্ত হন, তিনি সেভাবেই যুক্তিতর্ক দেখাবেন একটি বিষয়ে। বিএনপিভক্তরা তাদের মতো করে ব্যাখ্যা দেবেন। কিন্তু জাতির জন্য যেটা সঠিক তা বলতে চান না। কষ্ট করে চাপ সৃষ্টি করতে পারেন না দু'দলের নীতিনির্ধারকদের অথবা দু'নেত্রীকে। দেশটি যেন দ্বিদলীয় ব্যবস্থার মধ্যে আবর্তিত। কালোকে কালো আর সাদাকে সাদা বলার সাহস আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আর এক হবেইবা কী করে? এখানে আদর্শের প্রশ্ন। আদর্শের সঙ্গে তো আপস করা যায় না। কিন্তু দেশ কীভাবে চলবে, নির্বাচন কার অধীনে করা শ্রেয় হবে এ বিষয়ে তো একমত হতে বাধা নেই। কিন্তু না, কিছুতেই একমত না। অবশেষে এক-এগারোর মতো অশনিসংকেতের পূর্বাভাস। তবুও মাথা নোয়াবার নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা-না রাখার বিষয় নিয়ে এখন রাজনীতির অঙ্গন উত্তপ্ত। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে। এ রায় বাস্তবায়নের দায়িত্ব হলো এখন জাতীয় সংসদের। ক্ষমতাসীন দল মনে করে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায় মেনে চলার ব্যাপারে যেহেতু বাধ্যবাধকতা আছে, সেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার কোনো সুযোগ নেই। অপরদিকে বিএনপি বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না রাখলে কঠোর আন্দোলন। তারা বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় সংসদের ওপর বাধ্যবাধকতা নয়। সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার আর সুযোগ নেই এবং সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করে এবং সব দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কমিশনার নিয়োগ দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি ই-ভোটিং পদ্ধতি, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রবর্তন, ছবিসহ ভোটার তালিকা ও ভোটার আইডি কার্ড চালু করার কথাও বলেন তিনি। এরশাদ বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দেশ, জাতি ও রাজনীতিবিদরা কলঙ্কমুক্ত হলেন। জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি আরও দু'দফা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার কথা বলেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা? কোন প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল তা আমাদের বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার নির্দলীয় নিরপেক্ষ চরিত্র কি দেখেছি? আগেই বলেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচিত কোনো সরকার নয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ ব্যবস্থাটা প্রবর্তন করা হয়েছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে। তখন বিদ্যমান ছিল একটি চরম অসহনশীল পরিবেশ। প্রধান রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ছিল অবিশ্বাসের অবস্থান। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিরপেক্ষভাবে কর্মসম্পাদনের ওপর আস্থার অভাব। সেই রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও অবিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন। কিন্তু প্রেক্ষাপট এখন ভিন্ন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বিষয়টি দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক। সংবিধানে এটা কীভাবে গৃহীত হবে তা রাজনৈতিক দলগুলোকে সংসদের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে। তবে বিবেচনায় আনতে হবে এটা কি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, না তার কাল-ক্ষণ ঠিক করে দেওয়া হবে। আমরা দেখেছি, বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সময় (তত্ত্বাবধায়ক প্রধান যখন) জেনারেল নাসিম ক্যু করতে চেয়েছিলেন। ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের সময় (তত্ত্বাবধায়ক প্রধান হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের রাতেই) ১৩ সচিবকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। আবার ২০০৮ সালের নির্বাচনকে বিএনপি অবৈধ ও কারচুপির নির্বাচন বলে। যে কথাটি আমি বলতে চাই তা হলো বিশ্বাস ও আস্থা। এ দুটির অভাব রয়েছে রাজনৈতিক দলের মধ্যে। যতদিন বিশ্বাস ও আস্থা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গ্রোথিত না হবে ততদিন এর সমাধা হবে বলে মনে হয় না। 'শিশু আর পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়' বলে একদা বিরোধী দলের নেতা বলেছিলেন আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। এখন যখন সংকট সামনে তখন উভয় দলকে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। বিরোধী দলের উচিত হবে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে তারা কী চান। বিরোধী দল প্রস্তাব নিয়ে সংসদে তা পেশ করুক। সংসদই হচ্ছে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। সন্দেহ আর অবিশ্বাসের পরিবর্তে বিশ্বাস আর সমঝোতার পথ ধরে জাতীয় ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, এটাই জনগণের কামনা। আর তা না করে শুধু রাজপথ বেছে নিয়ে জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিলে এক-এগারোর মতো ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং তা থেকে কেউই রেহাই পাবে না। রাজনৈতিক অঙ্গনে অশনিসংকেতের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, কাণ্ডারি হুশিয়ার!

অধ্যাপক ডা. এমএ করীম : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.