‘লুৎফর মনে করে রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যায় বিজিপি’

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৪২ ব্যাটালিয়নের হাবিলদার লুৎফর রহমানকে সেদিন খুঁজছিল মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। লুৎফর মনে করেই তারা বিজিবির নায়েক আবদুর রাজ্জাককে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া এবং পরে ছেড়ে দেওয়া নৌকার মাঝি লালমোহন দাস ও বিজিবির ৪২ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর পিলখানায় বিজিবির সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও এ তথ্য জানান বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ।
বৃহস্পতিবার বিজিবির মহাপরিচালক বলেন, নৌকার মাঝির কাছ থেকে তাঁরা জেনেছেন যে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী পুলিশের দলটি নায়েক রাজ্জাককে হাবিলদার লুৎফর মনে করেছিল। তারা নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেসও করে, ওই ব্যক্তি (রাজ্জাক) হাবিলদার লুৎফর কি না। হাবিলদার লুৎফর গত এক বছরে ওই এলাকায় সর্বোচ্চসংখ্যক ইয়াবা উদ্ধার করেছেন। এ কারণে তাঁকে বিশেষ পুরস্কারও দেওয়া হয়েছে।
১৭ জুন ভোরে নাফ নদীতে বাংলাদেশের জলসীমায় একটি নৌকায় তল্লাশি চালানোর সময় মিয়ানমারের বিজিপি হঠাৎ গুলি চালালে বিজিবির সদস্য বিপ্লব কুমার গুলিবিদ্ধ হন। বিজিপির সদস্যরা এরপর নৌকার মাঝি লালমোহন, মাঝির সহকারী ১২ বছরের জীবন দাসসহ নায়েক রাজ্জাককে মিয়ানমারে ধরে নিয়ে যান। ওই দিন সন্ধ্যায় মাঝি ও তাঁর সহকারীকে (ভাগনে) ছেড়ে দেওয়া হয়। নয় দিন পর গত বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের মংডু শহরে পতাকা বৈঠকের পর রাজ্জাককে বিজিবির হাতে তুলে দেয় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। গতকাল শুক্রবার তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়।
লালমোহন গত সোমবার নিজ বাড়িতে প্রথম আলোকে বলেন, ১৭ জুন নাফ নদীর লালদিয়া পশ্চিম পাশে বাংলাদেশের জলসীমায় ভাগনে ও সহকারী জীবন দাসকে নিয়ে তিনি মাছ ধরছিলেন। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে একটি নৌকায় করে এসে বিজিবির তিন সদস্য তাঁর নৌকায় তল্লাশি শুরু করেন। এ সময় সাত-আটজন সাদা পোশাকধারীসহ একটি ট্রলার তাঁদের নৌকার দিকে আসতে থাকে। ওই ট্রলার থেকে একজন নৌকায় থাকা লোকদের পরিচয় জানতে চাইলে বিজিবির এক সদস্য উঠে দাঁড়ান। হঠাৎ ওই ট্রলার থেকে সাদা পোশাকধারীরা গুলি শুরু করেন। বিজিবির সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালান। একপর্যায়ে তিনি (লালমোহন) নদীতে লাফ দিয়ে নৌকার এক পাশে অবস্থান নেন, জীবনকেও নৌকা থেকে কোলে করে পানিতে নামান। কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলিবিদ্ধ বিজিবির সদস্য বিপ্লব ও তাঁর সঙ্গে থাকা আরেকজন নদীতে ঝাঁপ দেন। তখন সাদা পোশাকধারীরা ট্রলারটি তাঁদের (লালমোহনের) নৌকার গা ঘেঁষে ভেড়ায়। তখন বিজিবির সদস্য রাজ্জাকও নদীতে লাফ দেন। এর মধ্যে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের আরেকটি ট্রলার চলে আসে। পরে রাজ্জাক, তাঁকে ও জীবনকে তাদের ট্রলারে তুলে নেয় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা। তাঁর নৌকা ও বিজিবির নৌকাটি তাদের ট্রলারে বেঁধে লালদিয়া থেকে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে মিয়ানমারের রইগ্যাদং ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ট্রলারে তোলার পরপরই নায়েক রাজ্জাককে বেদম মারধর করা হয়।
লালমোহন দাশ আরও বলেন, ক্যাম্পে নিয়ে রাজ্জাককে হাতকড়া পরানো হয়। এরপর লালমোহনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ওই বিজিবি সদস্যের নাম লুৎফর কি না। তখন তিনি বলেন, ওই লোকের নাম রাজ্জাক। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে হাবিলদার লুৎফর অনেক ইয়াবার চালান আটক করেছেন।
লালমোহন বলেন, ছয় ঘণ্টার বেশি সময় তাঁরা বিজিবির সদস্য রাজ্জাকের সঙ্গে ছিলেন। প্রায় ছয় ঘণ্টা নানাভাবে রাজ্জাকের ছবি তোলেন, মারধরও করেন। একপর্যায়ে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা কক্ষের বাইরে গেলে তিনি হাফপ্যান্ট পরে তাঁর লুঙ্গি রাজ্জাককে দেন। মিয়ানমারের রক্ষীরা কক্ষে ফিরে এসে রাজ্জাককে লুঙ্গি দেওয়ার কারণে তাঁকে ও জীবনকে মারধর করে। এরপর তাঁদের পাশের কক্ষে নিয়ে রাখা হয়। ওই দিন (১৭ জুন) সন্ধ্যার পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হলে সাঁতরে লালদিয়া হয়ে বাংলাদেশে আসেন তাঁরা। এলাকায় ফিরে প্রথম দুই দিন আত্মগোপনে থাকার পর বিজিবির কর্মকর্তারা তাঁকে ডেকে নেন।
এ বিষয়ে ৪২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আবু জার আল জাহিদ জানান, নাফ নদীতে ইয়াবা চোরাচালান প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকার কারণেই পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়ে নায়েক রাজ্জাককে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়।
রাজ্জাককে ঢাকায় পাঠানো হলো: অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময় রাজ্জাকের নাকে কামড়ে দিয়েছিল মিয়ানমারের এক সীমান্তরক্ষী। সেই ক্ষতটি এখনো শুকোয়নি। চিকিৎসার জন্য গতকাল সকাল ছয়টার দিকে বিজিবির অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকার পথে রওনা হয়েছেন নায়েক রাজ্জাক। রাত নয়টার দিকে বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহসিন রেজা জানান, তখন পর্যন্ত ঢাকায় পৌঁছাননি নায়েক রাজ্জাক।

No comments

Powered by Blogger.