বেপরোয়া ৩ শতাধিক ছিনতাইকারী চাঁদাবাজ by রুদ্র মিজান
রাজধানীতে
সক্রিয় তিন শতাধিক ছিনতাইকারী। ঈদকে সামনে রেখে অভিনব কায়দায় ছিনতাইয়ে
সক্রিয় হয়ে উঠেছে তারা। সাংবাদিক, ডিবি পুলিশসহ নানা পরিচয়ে সাধারণ মানুষকে
বোকা বানিয়ে লুটে নিচ্ছে তাদের অর্থ-সম্পদ। এমনকি একশ্রেণীর নারী
ছিনতাইকারীও ব্ল্যাকমেইল করে দিনদুপুরে হাতিয়ে নিচ্ছে সর্বস্ব। সুন্দরী
তরুণীদের এই কাজে ব্যবহার করছে প্রতারক চক্র। ঈদকে সামনে রেখে অভিনব কায়দায়
রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই চক্রের সদস্যরা। প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন
স্থানে এই চক্রের কবলে পড়ে ছিনতাই ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
ঘটছে চাঁদাবাজির ঘটনাও।
ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে টাকার লেনদেন করতে হচ্ছে
সাধারণ মানুষকে। রমজান শুরুর পর পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার করা হলেও
নিয়ন্ত্রণে নেই ছিনতাই। দিনে-দুপুরে শত শত মানুষের সামনেই অস্ত্রের মুখে
সর্বস্ব ছিনিয়ে নিচ্ছে ছিনতাইকারীরা। কয়েক মাসের ব্যবধানে ছিনতাই-চাঁদাবাজি
বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। এই বছরের শুরুতে ছিনতাই-চাঁদাবাজির ঘটনা তুলনামূলক
কম ঘটলেও গত মে ও চলতি জুন মাসে তা প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সূত্রমতে,
গত জানুয়ারি মাসে ছিনতাই-চাঁদাবাজির অভিযোগে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার
থানাগুলোতে ১১, ফেব্রুয়ারিতে ১৩, মার্চে ১৮ ও এপ্রিলে ১০টি মামলা হয়। গত মে
মাসে তা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। ওই মাসে মামলা হয় ২১টি। সূত্রে আরও
জানা গেছে, চলতি মাসে এই পর্যন্ত এই অভিযোগে ৩০টির বেশি মামলা হয়েছে। তবে
ছিনতাই-চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে অর্ধশতাধিক। কিন্তু ভুক্তভোগীরা ঝামেলা এড়াতে
অনেকেই আইনের আশ্রয় নেন না। যে কারণে এর প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি।
সূত্রে জানা গেছে, ভুয়া ডিবি পুলিশ, ভুয়া সাংবাদিক, মডেল, নায়িকা পরিচয়ে
ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও ব্লেকমেইলের মাধ্যমে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে
দুষ্কৃতকারীরা। তাদের মধ্যে রয়েছে কয়েকটি নারী সিন্ডিকেট। রাজধানীর
যাত্রাবাড়ী, কাজলা, ডেমরা, সবুজবাগ, মুগদা, ওয়ারী, মতিঝিল, ফকিরাপুল,
তেজগাঁও, ভাটারা এলাকায় সক্রিয় আনোয়ারা আলো ওরফে আঙ্গুরি এবং শাহনাজ
পারভিনের চক্র। যাত্রাবাড়ীর সুতিরখালপাড় মোড়ে একটি বাড়ির দ্বিতীয় ও চতুর্থ
তলায় রয়েছে আনোয়ারার দুটি ফ্ল্যাট। ওই ফ্ল্যাটে তার চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন
পরিচয়ে থাকেন। এই চক্রে রয়েছে সাংবাদিক ও মডেল পরিচয়ে কয়েক সুন্দরী তরুণী।
তারা টার্গেটকৃত ব্যক্তির সঙ্গে ফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শখ্য গড়ার চেষ্টা
করে। একপর্যায়ে প্রলোভন দেখিয়ে ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। সেখানে অন্তরঙ্গ
মুহূর্তে চক্রের পুরুষ সদস্যরা ডিবি ও সাংবাদিক পরিচয়ে অভিযানের নামে
টার্গেটকৃত ব্যক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তরুণীর নগ্ন ছবি ও ভিডিও ধারণ করে।
পরে তার এবং তার স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় এই চক্র।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, এই চক্রের সদস্য বাবুলসহ কয়েক জন কখনও ডিবি, কখনও
সাংবাদিক পরিচয়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করে।
পরবর্তীকালে সামাজিকতার কারণে এ বিষয়ে মামলা তো দূরে থাক, মুখ খুলতেও রাজি
হন না ভুক্তভোগীরা। বুধবার সন্ধ্যার পর সুতিরখাল এলাকায় এই চক্রের সদস্যরা
লুটে নিয়েছে মমিন নামের এক ব্যক্তির সর্বস্ব। ঘটনার পর ছিনতাইকারীরা
আনোয়ারার বাসায় আশ্রয় নেয় বলে জানিয়েছেন মমিন। এই চক্রের অন্যান্য সদস্যদের
মধ্যে রয়েছে, আনোয়ারার বান্ধবী পারভিন, মুগদা এলাকার ছবি ও সবুজবাগের
পারুল।
এ রকম আরও একটি চক্রের হোতা হচ্ছে শাহনাজ পারভীন। সাংবাদিক পরিচয়ে কিছুদিন
আগে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে এই তরুণীসহ চার জন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়।
তেজগাঁও থানার উপপরিদর্শক সাইফুর রহমান জানান, সাংবাদিক পরিচয়ে পশ্চিম
নাখালপাড়ার একটি বাড়িতে যায় তারা। ওই বাসায় অবৈধ কার্যকলাপ হয় অভিযোগ করে
২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে এই চক্র। এসময় বাসা থেকে নগদ ১৫ হাজার টাকা ও
দুটি মোবাইলসেট লুটে নেয় তারা। তাৎক্ষণিকভাবে আশপাশের লোকজনা তাদের আটক
করে পুলিশে সোপর্দ করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রেস লেখা সাদা রঙের একটি
কার (ঢাকা-মেট্রো-ছ-৫১-২২২৮) ও কয়েকটি আইডি কার্ড জব্দ করা হয়। এ ঘটনায়
তেজগাঁও থানায় একটি মামলা হয়েছে। এই চক্রের হোতা শাহনাজ পারভিনের বাড়ি
ভাটারা থানার কুড়িল বিশ্বরোডের জোহারসাহারা এলাকার মোল্লাবাড়ি। তার স্বামীর
নাম জালাল। এর আগেও একই অভিযোগে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের হাতে আটক হয়েছিল
এই তরুণী। শাহনাজ নিজেকে কখনও সিকিউরিটি কোম্পানির সুপারভাইজার, কখনও মডেল,
কখনও সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে থাকে। তার কাছ থেকে আজকের গোয়েন্দা সংবাদ নামের
একটি পত্রিকার আইডি কার্ড জব্দ করেছে তেজগাঁও থানা পুলিশ।
ফিল্মি কায়দায়ও ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। বুধবার ভোরে রাজধানীর বিজয় সরণি রেল
ক্রসিং ফ্লাইওভারে চালককে গুলি করে প্রাইভেটকার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ
সময় ছিনতাইকারীদের গুলিতে আহত হন চালক আসিফ আবদুল্লাহ খান। প্রাইভেটকারের
আরোহী সাব্বির আহমেদ জানান, বন্ধু আসিফের গাড়িতে করে তারা পুরান ঢাকার একটি
হোটেলে সেহরি খেতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে উত্তরা ফেরার পথে ফ্লাইওভারের
ওপরে ট্রাকের ব্যারিকেড দেখতে পান তারা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চার-পাঁচ
দুষ্কৃতকারী ট্রাক থেকে নেমে গুলিবর্ষণ করে। একপর্যায়ে প্রাইভেটকার নিয়ে
চলে যায় ছিনতাইকারীরা। গুলিবিদ্ধ আসিফ উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর
রোডের ৩ বাড়ির তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে থাকেন। গুলশানে আইএলসি নামে একটি
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন তিনি। একই দিনে সকালে ওয়ারীর রাজধানী
মার্কেটের সামনে ছিনতাইয়ের শিকার হন এক যুবক। ওই যুবকের নাম শরিফুল। তার
কাছে থাকা টাকা ও মোবাইলফোন কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে তিন ছিনতাইকারী। শরিফুল
বাধা দিলে পিঠে ছুরিকাঘাত করে টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে যায় তারা।
পরে পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
শরিফুল ওয়ারীর নারিন্দার ৭/১ নম্বর বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকেন। তার আগে
সোমবার দুপুরে চানখারপুল এলাকায় এক স্বর্ণকারকে ছুরিকাঘাত করে ১৫ ভরি
স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে গেছে ছিনতাইকারীরা। আহত ওই কারিগরের নাম মনিন্দ্র পাল।
পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার শিব মন্দির সংলগ্ন সুভাষ পাল মার্কেটের সামনে
মনিন্দ্র পালের একটি স্বর্ণের দোকান রয়েছে। ওই দিন রাত ১২টার দিকে
তেজগাঁওয়ের উত্তর বেগুনবাড়ি এলাকায় এক টেলিকম ব্যবসায়ীকে গুলি করে প্রায়
নগদ ২লাখ ৮০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গুলিবিদ্ধ ব্যবসায়ীর
নাম সাইফুল ইসলাম কাজল (৪৫)। বেগুনবাড়ি এলাকায় পদ্মা গার্মেন্টসের সামনে
শুভ টেলিকম নামে দোকান রয়েছে সাইফুল ইসলামের। উত্তর বেগুন বাড়ির ৩৭/১ নম্বর
বাসায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করেন তিনি।
গত ১৮ই জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে সংলগ্ন এলাকা থেকে চারজনকে
আটক করে ডিবি পুলিশ। আটককৃত চারজনের কাছ থেকে রেডিও ওয়াকিটকি, খেলনা
পিস্তল, হাতকড়া ও বোমা উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা পুলিশকে
জানিয়েছে, তারা ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সর্বস্ব
লুটে নিতো। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে এ রকম আরও কয়েকটি গ্রুপ
রয়েছে। যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ছিনতাই ও চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছে।
তাদের গ্রেপ্তার করতে তৎপরতা চালাচ্ছে ডিবি পুলিশ। এই চক্রের মূল হোতাদের
মধ্যে রয়েছে অলি উল্লাহ ও শহীদুল ইসলাম গাজীসহ আটজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার
করা হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা জানিয়েছে, নগরীর বিভিন্ন স্থানে যেখানে যাত্রীবাহী
গাড়ির সংকট থাকে সেখানেই মাইক্রোবাস নিয়ে অবস্থান নেয় তারা। গাড়িতে যাত্রী
উঠানোর নাম করে দুই একজনকে তোলে। গাড়িতে থাকা অন্যরা তাদের লোক। গাড়ি তো
তোলার পর সুযোগমতো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেয় তারা।
প্রান্তপথ, গ্রিনরোড, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় এ
রকম একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছে এই চক্র।
গত শুক্রবার নিউমার্কেটে কেনাকাটা শেষে রিকশাযোগে ফেরার পথে ছিনতাইয়ের
শিকার গৃহবধূ অনিন্দিতা রায়। নীলক্ষেত হয়ে পুরান ঢাকার বাসায় ফেরার পথে এ
ঘটনা ঘটে। পলাশীর দিকে যাওয়ার সময় পেছন থেকে মোটরসাইকেলে আসা দুই
ছিনতাইকারী তার হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাই করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। এ
সময় ছিনতাইকারী বলে চিৎকার করেন তিনি। পথচারীরা এগিয়ে এলেও ধরতে পারেনি
ছিনতাইকারীদের। তার আগের দিন একই কায়দায় মালিবাগ থেকে এক ব্যক্তির একটি
ব্যাগ টেনে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। ওই ব্যাগে একটি ল্যাপটপ ছিল বলে
ছিনতাইয়ের শিকার যুবক জানিয়েছেন। এভাবে প্রতিদনিই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়
ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, রাজধানীতে ডিএমপির (ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ)
আওতাধীন আটটি ক্রাইম জোনের প্রতিটিতেই ১০-১২টি করে ছিনতাইকারী চক্র রয়েছে।
সব মিলিয়ে রাজধানীতে শতাধিক ছিনতাইকারী চক্র রয়েছে। এই চক্রের সদস্য তিন
শতাধিক। ছিনতাইকারীদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থেকে শুরু করে ধারালো অস্ত্র
রয়েছে। মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস, কখনও প্রাইভেট কারে করে তারা শহরজুড়ে ঘুরে
বেড়াচ্ছে। ছিনতাইয়ের সঙ্গে রয়েছে মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, কথিত মডেল
পার্টির উৎপাত। এ বছরের মে মাস পর্যন্ত এসব ঘটনায় ডিএমপির থানাগুলোতে মামলা
হয়েছে ৭৩টি। আশঙ্কাজনকভাবে তা বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি মাসে মামলার সংখ্যা
শতকের কোটা পেরিয়ে যাবে বলে সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন
পুলিশের উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মুনতাসিরুল ইসলাম জানান, রমজানে জনসাধারণের
বিশেষ নিরাপত্তার জন্য এক মাস আগ থেকেই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ।
যে কারণে প্রায়ই ছিনতাইকারী, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, ভুয়া ডিবি ও ভুয়া
সাংবাদিকসহ প্রতারক চক্রের সদস্যরা গ্রেপ্তার হচ্ছে। পুলিশের একটি বিভাগ এই
চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তৎপরতা চালাচ্ছে
বলে জানান তিনি।
No comments