স্বপ্নের বাজেটের দুঃস্বপ্নের পরিণতি! by বদিউল আলম মজুমদার

আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার একটি ‘স্বপ্নের বাজেট’ সংসদে উত্থাপন করেছেন, যা থেকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। সর্বকালের সর্ববৃহৎ এ বাজেটের জন্য কর ও অন্যান্য খাত থেকে প্রাক্কলিত আয় হলো ২ কোটি ৮ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৮৬ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা, যা আমাদের জিডিপির ৫ শতাংশের সমতুল্য। এই বিরাট পরিমাণের ঘাটতি পূরণের সম্ভাব্য উৎস হলো: ব্যাংকঋণ ৩৮ হাজার ৩৮০ কোটি, বৈদেশিক সাহায্য ৩০ হাজার ৪৫০ কোটি এবং ব্যাংক-বহির্ভূত ঋণ ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, প্রস্তাবিত বাজেটটি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী—এমনকি অর্থমন্ত্রীর মতেও এটি ‘সত্যিকারের উচ্চাভিলাষী’ এবং এর বাস্তবায়ন সম্পর্কে তাঁরা সন্দিহান। আবার অনেকে সন্দিহান কর ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রাক্কলিত আয়ের বাস্তবতা সম্পর্কে। প্রস্তাবিত বাজেটের বাস্তবায়ন সম্পর্কে সন্দিহান হওয়ার অবশ্যই যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে, কারণ অতীতেও আমাদের অর্থমন্ত্রীরা উচ্চাভিলাষ প্রদর্শন করে সাফল্য দেখাতে পারেননি। বস্তুত বাজেট কাটছাঁট করা, বিশেষত এডিপির কাটছাঁট আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এমনকি চলতি বছরের বাজেট থেকেও ইতিমধ্যে ১০ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা কাটছাঁট করার প্রস্তাব ইতিমধ্যে সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে।
বিরাট অঙ্কের প্রস্তাবিত বাজেটের পেছনে একটি বড় কারণ হলো বেসরকারি বিনিয়োগের স্থবিরতা এবং সেই স্থবিরতা পূরণের জন্য সরকারি ব্যয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি। এটি সত্য যে অনেক দিন থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা ও অন্যান্য জটিলতার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে স্থবিরতা বিরাজ করে আসছে, যদিও বেসরকারি বিনিয়োগ একটি গতিশীল অর্থনীতির প্রাণশক্তি সমতুল্য। কিন্তু সরকারি ব্যয় ও বিনিয়োগ অনেকগুলো কারণে বেসরকারি বিনিয়োগের যথাযথ বিকল্প হতে পারে না।
প্রথমত, সাধারণত অনুৎপাদন খাতেই সরকারি ব্যয় বেশি করা হয়। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগের ন্যায় সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে জাতীয় উৎপাদন ক্ষমতা সমহারে বৃদ্ধি পায় না। আমাদের আগামী অর্থবছরের জন্য এটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, কারণ প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য বিরাট পরিমাণের অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা সরাসরিভাবে আমাদের জাতীয় উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে না।
দ্বিতীয়ত, সরকারি খাতে ব্যাপক হারে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন বিরাজমান এবং এ-সম্পর্কিত বহু ভয়াবহ কাহিনি জনগণের জানা। সরকারি ব্যাংক লুটের বহু শিরোনাম সংবাদপত্রের পাতায় আমরা পড়েছি এবং এসব প্রতিষ্ঠানের বিরাট অঙ্কের মূলধন ঘাটতি প্রস্তাবিত বাজেট থেকে পূরণ করা হবে। এভাবে সরকারি খাতে ব্যয়ের মাধ্যমে অনেক মূল্যবান সম্পদের অপচয় ও অপব্যবহার হয়। এমনকি সরকারি বিনিয়োগ থেকে সৃষ্ট অবকাঠামো ও পণ্যও অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমানের হয়। তাই সরকারি বিনিয়োগ থেকে সর্বোচ্চ প্রতিদান ও ফলপ্রসূতা আশা করা যায় না।
তৃতীয়ত, মেগা বাজেট থেকে সরকারি অর্থায়নে গৃহীত অনেক প্রকল্পই দীর্ঘমেয়াদিভাবে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সহায়ক হবে না। উদাহরণস্বরূপ, প্রস্তাবিত কয়েকটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা মেটালেও ভবিষ্যতে এগুলো আমাদের পরিবেশ ও জননিরাপত্তার জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিজ্ঞানে আস্থা থাকলে বলতে হবে যে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়িত রামপাল প্রকল্প আমাদের সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে, যে ক্ষতি জাতির জন্য হবে অপূরণীয়। মহেশখালীতে প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উত্তরবঙ্গের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য এক বিরাট মরণফাঁদ তৈরি করতে পারে। যদিও এসব প্রকল্পে বিনিয়োগের অধিকাংশ বিদেশ থেকে আসার কথা, আমাদের সরকারের বিনিয়োগও এগুলোতে থাকবে।
চতুর্থত, বর্তমানে আমাদের সমাজে ফায়দাতন্ত্রের এক ভয়াবহ সংস্কৃতি বিরাজমান, যার ভিত্তি মেধা ও যোগ্যতার পরিবর্তে স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতদুষ্টতা। আমাদের দেশে সরকারি খাতে বহু প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় জনস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তি ও কোটারি স্বার্থে। অনেক বড় বড় প্রকল্পে মাঝপথে বিরাট পরিমাণের ‘কস্ট ওভাররান’ বা ব্যয় বৃদ্ধি ঘটে মূলত স্বার্থান্বেষীদের স্বার্থে। তাই আমাদের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত অনেক প্রকল্পেই স্বচ্ছতা-জবাবদিহি তথা সুশাসনের অভাব দৃশ্যমান। ফলে সরকারি খাতে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে মূল্যবান সম্পদের যথার্থ ব্যবহার ব্যবহৃত এবং অপব্যবহার নিশ্চিত হয়।
ফায়দাতন্ত্রভিত্তিক রাজনীতির দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ। দীর্ঘদিন ধরে ফায়দাবাজি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজি ইত্যাদির কারণে আমাদের দেশে বর্তমানে একশ্রেণির ব্যক্তি, বিশেষত পেশিশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি বিরাট অর্থকড়ির মালিক হয়েছেন। গত কয়েক দশকে এ নব্য ধনিকশ্রেণি—প্রয়াত প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ভাষায় ‘বাজিকর’ অর্থ ও পেশিশক্তি ব্যবহার করে ক্রমাগতভাবে স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করছেন। এর মাধ্যমে সারা দেশে এখন অনেক গডফাদার সৃষ্টি হয়েছে, যাঁদের হাতে একাধারে অর্থ, পেশিশক্তি ও রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। আর ক্ষমতাসীন দলের সৌজন্যে এসব গডফাদাররা বর্তমানে একধরনের ‘ইমপিউনিটি’ বা অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার অধিকার ভোগ করেন। এ ছাড়া এসব গডফাদারদের অনেকেই বিদেশে অর্থ পাচারে লিপ্ত। বস্তুত এঁদের কারণে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের দ্বিগুণের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিরাজমান ফায়দাতন্ত্র, যা গডফাদার সৃষ্টিতে সহায়তা করে, আমাদের এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। স্বপ্নের বাজেটে ফায়দা বিতরণের জন্য অধিক অর্থ বরাদ্দ দিয়ে বর্তমান পদ্ধতি অব্যাহত রাখা হলে—যা করতে আমরা বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে—আমাদের রাজনীতি ভবিষ্যতে পুরোপুরি গডফাদারদের করায়ত্ত হয়ে যেতে পারে। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে টাকা বানানোই এই গডফাদারদের জীবনের মূল লক্ষ্য, এঁরা কারও প্রতি অনুগত নন এবং আধুনিক রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হয়, সে ব্যাপারে তাঁদের অনেকেরই সামান্যতম ধারণাও নেই। তাই ভবিষ্যতে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র এসব ব্যক্তিদের পুরোপুরি করায়ত্ত হলে আমরা চরম বিপজ্জনক অবস্থায় নিপতিত হব।
স্বপ্নের বাজেটে অতিরিক্ত বরাদ্দের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা ফায়দাতন্ত্র আমাদের জন্য আরেক দিক থেকেও দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাজেটে বরাদ্দ অনেক বাড়লেও বরাদ্দের পরিমাণ সীমাহীন হতে পারে না। তবে ফায়দাতন্ত্রভিত্তিক রাজনীতিতে ফায়দার লোভে বহু ব্যক্তি ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আকৃষ্ট হয়, যা ফায়দার চাহিদাকে ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে দেয়। বস্তুত সংবাদপত্রের একটি সাম্প্রতিক শিরোনাম ছিল—দল কর, টাকা বানাও। এ ছাড়া ফায়দাপ্রাপ্তরা তাদের প্রাপ্তির পরিমাণ বাড়ানোর লক্ষ্যে ফায়দার চেইনের ওপর একক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাবে, এটাই স্বাভাবিক। এভাবে ক্রমাগত ফায়দার চাহিদা বৃদ্ধি এবং ফায়দা প্রাপ্তির পরিমাণ বৃদ্ধির সর্বাত্মক প্রতিযোগিতার কারণে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে সহিংসতা সৃষ্টি হতে বাধ্য, যা আমরা আতঙ্কের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লক্ষ করছি। তাই বিরাজমান ফায়দাতন্ত্রের সংস্কৃতি অব্যাহত থাকলে আকাশচুম্বী বাজেট বরাদ্দ ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব ও হানাহানি আরও উসকে দেবে, যার ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটতে পারে।
এ ছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগের স্থবিরতা পোষাতে বাজেটে সরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হলেও এই প্রস্তাব বাস্তবে বেসরকারি বিনিয়োগকে আরও নিরুৎসাহিতই করতে পারে। যখন নিজস্ব ব্যয় ও বিনিয়োগের জন্য সরকারকে বাজার থেকে ধার করতে হয়, তখন অর্থনীতিতে একধরনের প্রভাব পড়ে, যাকে অর্থনীতির ভাষায় ‘ক্রাউডিং আউট’ বলা হয়ে থাকে। সরকারের ধার করার কারণে মূলধন বাজারে বিনিয়োগযোগ্য মূলধনের চাহিদা বেড়ে গেলে এবং এর ফলে সুদের হার ঊর্ধ্বমুখী হলে অর্থনীতিতে এ ধরনের ক্রাউডিং আউট বা বেসরকারি বিনিয়োগের নিরুৎসাহকরণ ঘটে। প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাসহ সামাজিক খাতে বিনিয়োগের হার কমার কারণে আমাদের বিরাজমান ‘সক্ষমতার ঘাটতি’ আরও বাড়তে পারে, যার বিরূপ প্রভাবও দুর্ভাগ্যবশত বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর পড়তে পারে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।

No comments

Powered by Blogger.