ডিএনডি বাঁধের ভেতর জলাবদ্ধতা- শতাধিক অবৈধ স্থাপনা, পানিবন্দী মানুষ by অরূপ দত্ত

কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ডিএনডি বাঁধের ভেতরে বিশাল
এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। এলাকার খালগুলো
দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করায় পানি বের হতে
পারছে না। অনেক ঘরবাড়ি ডুবে গেছে পানিতে। ছবিটি
গতকাল মাতুয়াইল এলাকা থেকে তোলা l হাসান রাজা
কাপড়ের দোকান থেকে খাবার হোটেল—কী নেই! শনির আখড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় আড়াই শ গজ দূরে খাল ভরাট করে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক অবৈধ দোকানপাট। এই স্থানটি ঢাকা-ডেমরা-নারায়ণগঞ্জ (ডিএনডি) বাঁধের ভেতরে গোদনাইল থেকে মৃধাবাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত ১১ কিলোমিটার খালের অংশ এটি।
শুধু শনির আখড়ার এই স্থান নয়, পূর্ব দোলাইরপাড়ের দুই পাড়, রায়েরবাগ, সাইনবোর্ড এলাকায় খাল ও নিচু ভূমি দখল ও ভরাট করে গড়ে উঠেছে অন্তত ১০০ দোকানপাট। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা কুতুবখালী থেকে শনির আখড়া পর্যন্ত বাঁধ এলাকা ঘুরে এসব অবৈধ স্থাপনা দেখা যায়। অপরিকল্পিত সরু কালভার্ট, জলাভূমিতে মাছের অবৈধ ঘের, ভাসমান ময়লার স্তূপ। বৃষ্টির পর পানি নামতে না পারায় বাঁধের ভেতরের নিচু ভূমি তলিয়ে গেছে।
প্রায় দেড় বছর আগে শনির আখড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছের খাল এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি কার্যালয় গড়ে ওঠে। দেখাদেখি গড়ে ওঠে আরও কিছু অবৈধ স্থাপনা। প্রথম আলোয় এর ছবিও ছাপা হয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সহায়তায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন তখন এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই আবার অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠে। বর্তমানে কাপড়ের দোকান, খাবার হোটেল, হাঁড়িপাতিল, প্লাস্টিক সামগ্রী, জুতা, মুঠোফোন সার্ভিসের দোকানসহ হরেক রকম সামগ্রীর টিন ও বাঁশের দোকানঘর রয়েছে। বেশির ভাগেরই সাইনবোর্ড নেই। এখানকার একটি কাপড়ের দোকানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিক্রয়কর্মী বলেন, জায়গাটি দোকানমালিকের। ভাতের হোটেলের একজন কর্মচারী আলতাফ বলেন, তাঁর মালিকের কাছে জায়গার দলিলও রয়েছে। তবে দোকানের মালিকদের পাওয়া যায়নি।
শনির আখড়ার বাসিন্দা আবদুর রহিম, কদরতউল্লাহ, মনসুর আলীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার স্থানীয় অন্তত আটজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে খাল ছিল চওড়ায় ৪০ থেকে ৬০ ফুট। দখলে-দূষণে এখন ১৫ থেকে ২০ ফুট। খালের জায়গা দখল করে যারা ব্যবসা করছে, তারা এলাকার প্রভাবশালী। বাঁধের শুরুর অংশ কুতুবখালীর একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা সাইফুল হক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘২০ বছর আগেও এখানে চওড়া খাল দেখেছি। এখন দখলদারেরা খালের জায়গাকে নিজেদের জায়গা বলে দাবি করলেও কেউ কিছু করতে পারছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড সাময়িক উচ্ছেদের পর আর খবরই রাখে না।’
জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঢাকা কেন্দ্রীয় অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার পর আবার দখল হয়ে যায়। দখল ও আবর্জনার দূষণে খাল ও নিচু জমি ভরাট হয়ে পড়ায় জলাবদ্ধতার কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না স্থানীয় লোকজন।’
ডিএনডি বাঁধ এলাকায় খাল দখল ​করে দুই পাশে গড়ে উঠেছে
এমন শতাধিক অবৈধ স্থাপনা l ছবি: প্রথম আলো
প্রধান প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘বসবাসকারীদের অনেকেই খালের মধ্যে ময়লা-আবর্জনা ফেলে। যার পরিণতিতে বৃষ্টি হলেই লোকালয় তলিয়ে যায়। উচ্ছেদ করে সাময়িকভাবে দখল বন্ধ করা যায়। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা সচেতন না হলে পাউবোর একার পক্ষে এগুলো রোধ সম্ভব নয়।’
বাঁধের ভেতরের রায়েরবাগের বাসিন্দা বশির আহমেদ বলেন, বৃষ্টি হলে আগে খালের পানি নেমে যেত। এখন খালের বিভিন্ন অংশ দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি আটকে থাকে। খাল ছাড়াও বাঁধের ভেতরে রায়েরবাগ ও আশপাশের এলাকায় জলাভূমিতে মাছের ঘের দেখা যায়। এগুলোর জন্য লোকালয় থেকে পানি বেরোতে পারছে না। বাঁধের ভেতরে প্রায় ১৭ লাখ মানুষ বাস করে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। এদের অনেকেই এখন পানিবন্দী। বর্ষা শুরুর পর বর্তমানে শ্যামপুর, তিতাস খালসহ কয়েকটি খালের ভাসমান বর্জ্য ছড়িয়ে পড়েছে এই জলাবদ্ধ লোকালয়ে। খাল এলাকায় অন্তত পাঁচটি কালভার্ট দেখা যায়, যেগুলো খালের চেয়ে অনেক সরু। ভেতরে আবর্জনা জমে পানি যেতে পারে না।
বাসিন্দাদের ভোগান্তি: উল্লিখিত এলাকাগুলো ছাড়াও ডিএনডি বাঁধ এলাকার মাতুয়াইল, আমতলী, সারুলিয়া, ডগাইর, দেইলা, গোবিন্দপুর, রসুলপুর, দৌলতপুর, মুন্সিবাগ, আদর্শনগর, কান্দাপাড়া, সাহেবপাড়া, সানারপাড়, বাগমারা, মৌচাক, কুতুবআইল, নয়ামাটি, চানমারি, শহীদনগরসহ বাঁধের ভেতরে এই এলাকাগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। বর্ষা শুরুর পর, বিশেষ করে ১১ জুন রাজধানীতে ভারী বৃষ্টিপাতের পর থেকে এই জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নেয়। সেই থেকে অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে আছে বাসিন্দারা।
শিমরাইল এলাকায় একটি পাম্পস্টেশনের ওপর এখন পুরো বাঁধ এলাকা নির্ভরশীল। সেখানে ৫১২ কিউসেক পানি নিষ্কাশন ক্ষমতার চারটি এবং ১১২ কিউসেক ক্ষমতার ২২টি পাম্প থাকলেও সবগুলো কাজ করছে না।
পূর্ব দোলাইরপাড়ের বাড়ির মালিক বদরুল আলম বলেন, তাঁদের বাড়িটিকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে সামনে দুই ফুট উঁচু করে মাটির বাঁধ দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
মৃধাবাড়ির নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দা আবদুল লতিফ বলেন, বদ্ধ ময়লা পানি মাড়িয়ে যাতায়াত করার কারণে তাঁর পরিবারের সদস্যদের চর্মরোগ হয়েছে। ডগাইর এলাকার মো. মোহসীন, দেইলার ফজলুল করিম, মাতুয়াইলের রশিদুল হক বলেন, নিম্নাঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির খুব অভাব। ঘরে ঘরে পেটের পীড়া দেখা দিয়েছে। বিশুদ্ধ পানির জন্য বাড়ির বউ-ঝিরা কুতুবখালী, দনিয়া এসব এলাকার পাম্পে লাইন দিচ্ছেন।
নিচু এলাকায় বসবাসকারী নিম্নবিত্তদের ঘরের ভেতরে চৌকি বা মাচা পর্যন্ত পানি। চৌকির ওপর চুলা জ্বালিয়ে অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রান্নার কাজ হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.